
সব শিল্পেরই মহৎ একটি বিষয় হলো সঞ্চরণশীলতা। শিল্পীর যে কোনো সৃষ্টিই যদি পাঠক, দর্শক কিংবা শ্রোতার ভেতর শিল্পীর বেদনা, আনন্দ, প্রেম অথবা দ্রোহকে জাগিয়ে তুলতে না পারে, তাহলে সে শিল্পের মূল আবেদনটুকুই ব্যাহত হয়। ফলে নির্দিষ্ট করে একটি উপন্যাস কিংবা সাহিত্যের কোনো দীর্ঘ রচনার ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। বলা যায়, লেখকের উপলব্ধির প্রকাশ যদি পাঠকের মর্মমূলে প্রবেশ না করে, পাঠকের হৃদয়ে নাড়া না দেয়, তবে সেই সাহিত্যকর্মের নির্যাস মূল্যহীন। তাই কোনো রচনা বিখ্যাত, জনপ্রিয় এবং লেখকের সমকালে বিপুলভাবে পঠিত ও আলোচিত না হলেও, সে রচনা যদি সত্যিই পাঠকের হৃদয়কে আন্দোলিত করে, সেই গল্প যদি নতুন এক বিস্ময়ের অবতারণা করতে পারে, তা হলে ওই রচনাটি যে সেই ভাষা ও সাহিত্যের অমূল্য সম্পদে পরিণত হয়, পাঠকমাত্রই তা উপলব্ধি করতে পারেন। তেমনই এক উপন্যাস ‘রুদেবিশ শেকাবের ব্যাতিক্রমী জীবন’। তবে হ্যাঁ! যে কোনো মহৎ ও কালোত্তীর্ণ উপন্যাসই যেহেতু নির্ণয় করে প্রকৃত পাঠক ও সময়, সে ক্ষেত্রে আগামী পঞ্চাশ কিংবা একশো বছর পর এ উপন্যাসের প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু, তার নিরিখেই না হয় এর বিচার করা যাবে। আপাতত পাঠক হিসেবে আমরা যা পারি তা হলো : এর গল্পের নূতনত্ব, ভাষার যোগাযোগের পারঙ্গমতা, এবং বর্ণনা ও চরিত্র নির্বাচণে বাংলা সাহিত্যে বহুকালের প্রচলিত পূর্বের নির্দিষ্ট রীতি পরিত্যাগ করে নতুন এক রীতির অবতারণা, ইত্যাদি সম্বন্ধে আলোচনা।
অতএব, প্রথমেই যদি আমরা এ উপন্যাসের গল্পের নতুনত্ব বিশ্লেষণ করতে যাই, তা হলে দেখি, দীর্ঘ সময় ধরে প্রকাশিত বাংলা ভাষায় অতীতের মৌলিক কোনো উপন্যাসে নিখুঁতভাবে এবং বিশেষ এই ঢঙে এমন গল্প বলা হয়নি। তা সে গল্পটি কেমন? এই প্রশ্নের জবাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি বাণী উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলা উপন্যাসকে নতুন দিগন্তে পৌঁছে দেওয়া তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘চোখের বালি।’ এ উপন্যাসের ভূমিকাতেই তিনি বলেন, ‘সাহিত্যের নবপর্যায় পদ্ধতি হচ্ছে ঘটনা পরম্পরা বিবরণ দেওয়া নয়, বিশ্লেষণ করে তাদের আঁতের কথা বের করে দেখানো।’ ঔপন্যাসিক হারুন আল রশিদ ঠিক সেই কাজটিই করেছেন এই উপন্যাসে। গল্পে নিখুঁত বিশ্লেষণে চরিত্রদের ভেতর থেকে ঠিক সেই আঁতের কথাই বের করে এনেছেন তিনি। অনন্য গদ্যশৈলীতে চরিত্রদের মুখ দিয়েই বর্ণনা করেছেন তাদের কথা। যেমন, গল্পের প্রধান চরিত্র রুদেবিশ শেকাব শত বছর বেঁচে থাকা এবং প্রেমের সুখে যাপন করা জীবনের স্বপ্ন নিয়ে তাঁর ব্যতিক্রমী জীবন শুরু করেন। সে জীবনের গল্প এমনই অদ্ভুত যে, বাস্তবের সঙ্গে যার সামান্য কিংবা পুনঃপুন মিল। এই যে সামান্য কিংবা পুনঃপুন মিল : আদতে এ একটা বিভ্রম। উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে প্রতিটি অধ্যায়ে অধ্যায়ে পাঠক বিভ্রমের শিকার হবেন, যার ভেতরে আছে, ঈশ্বর, দেবদূত, ধর্ম, পুরোহিত, উপাসনালয়, সমাজ, সংস্কৃতি ও মিলনের এক অপূর্ব সন্ধি। ঔপন্যাসিক হারুন আল রশিদ ‘আমি সুখী হতে পারতাম’ এমনই আচমকা এক বাক্য দিয়ে সেই সন্ধির সূচনা করেছেন। যেমনটা করেছিলেন আরবি কাব্য সাহিত্যের অবিসংবাদী নেতা ইমরাউল কায়েস তাঁর ‘ক্বিফা নাবকি মিন যিকরা হাবিবীন ও মানযিলীন’ কবিতায় এই বাক্যটি দিয়ে: ‘থামো! আমি আমার প্রিয়তমা ও তার আবাসের স্মৃতিতে একটু কেঁদে নিই।’ বলা হয়, প্রাচীন আরবি কবিতার ইতিহাসে ‘ক্বিফা’ বলে এমন আচমকা সূচনা একেবারেই নতুন ছিল। যা পাঠককে মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ করে সমাপ্তি পর্যন্ত পাঠ করতে বাধ্য করে।

উপন্যাস । প্রকাশক: সৃজন । প্রথম প্রকাশ: বইমেলা-২০২৩
ঘরে বসে বইটি সংগ্রহ করতে মেসেজ করুন ‘সৃজন’-এর ফেসবুক পেইজে— fb.com/srijon2017
রকমারি ডটকম থেকে অর্ডার করতে— www.rokomari.com/book/290130
কল করুন +৮৮ ০১৯১৪ ৬৯৬৬৫৮
‘রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবন’ উপন্যাসের প্রথম বাক্যটি তেমনই এক মহিমা। ‘আমি সুখী হতে পারতাম’, এই বাক্যটিই অস্পৃশ্য একটা সংশয় ও সংবেদনশীলতা সৃষ্টি করে যে, শেষ পর্যন্ত রুদেবিশ শেকাব কি আসলেই সুখী হতে পেরেছিল, নাকি সুখের দেখা পেয়েছিল মাত্র! সে যা হোক, গল্পের এই অভূতপূর্ব প্রারম্ভের পর আমরা দেখি এর ভাষিক দূরদর্শিতার সাথে বর্ণনা ও চরিত্রের বিস্ময়াবহ প্রয়োগ। ভাষাগত বিবেচনায় এ উপন্যাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও একেবারেই আনোখা বিষয়গুলো হল, এতে ব্যবহৃত চরিত্রদের নাম, স্থান, কাল এমনকি একটি মুদ্রাও। বাংলাভাষী পাঠকদের জন্য যা সম্পূর্ণ নতুন ও চমকপ্রদ। ফলে কারো মনে হতে পারে, এটি মূলত বিদেশি কোনো উপন্যাসের স্বার্থক অনুবাদ। কেউ বলতে পারেন, স্প্যানিশ সাহিত্যে জাদুবাস্তবতার দুই পুরোধা ব্যক্তিত্ব হুয়ান রলফো ও মার্কেজের যথাক্রমে ‘পেদ্রো পারামো’ এবং ‘নিঃসঙ্গতার একশো বছর’ কিংবা এ জাতীয় অন্য কোনো চিরায়ত রচনার আবহে লিখিত বাঙলা পুস্তক। কিন্তু বাস্তবে যা একেবারেই নয়। তবে জাদুবাস্তবতার আবহ এ উপন্যাসে পরিস্ফুট কিন্তু তা সর্বৈব অনুপম এবং স্বতন্ত্র। এর সাথে উপন্যাসের পরতে পরতে রয়েছে উচ্চমার্গীয় এবং ধারালো শিল্পরস, যা পাঠককে কখনো হাসায়, কখনো চমকিত করে, কখনও বা নিশ্চল করে তোলে। যেমন, তিনি এক খ্যাপাবুড়ির কথা বলেন, যিনি কোনও এক শরৎকালে রুদেবিশ শেকাবের বাড়িতে এসে হাজির হন। তিনি নাকি অনেকদিন ধরে এমন এক গ্রাম খুঁজছিলেন, যে গ্রামের শিশুরা তাকে উলঙ্গ করার চেষ্টা করবে না। এইটুকু পড়ে নিশ্চয়ই আপনার বোধে অজ্ঞাত এক চিন্তা নাড়া দেবে! বুড়ির ব্যাপারে নানাবিধ সংশয় আপনার মনে জাগবে! আধাআধি সিদ্ধান্তে যেতে পারলেও, যে আপনি চূড়ান্ত কোনো ফায়সালায় যেতে পারবেন না, সে আপনিই স্তম্ভিত হবেন যখন বেশ খানিকটা পরে গিয়ে জানবেন এই বুড়ি রুদেবিশ শেকাবের পিতার গোপন প্রেমিকা। বহু বছর পর যাকে রুদেবিশ শেকাব তার পিতার সাথে মিলনরত অবস্থায় আবিষ্কার করে।
সেই তথাকথিত খ্যাপাবুড়ি ছিল এক রাজকুমারী। রুদেবিশ শেকাবের বাবাকে তার বাবা সৎ মায়ের হাত থেকে বাঁচাতে পতুর্গিজ মিশনারীদের তৈরি দুশো বছরের পুরনো এক বোর্ডিং স্কুলে পাঠান। রুদেবিশ শেকাবের বাবা সেখানে এক রাজকুমারীর সাথে প্রেম করে তাঁকে ফেলে চলে আসেন। তার বহুবছর পর সেই রাজকুমারী খ্যাপাবুড়ির অভিনয় করে তাঁদের বাড়িতে ঢোকেন। এই যে আখ্যান, যা পড়তে গেলে পরাবাস্তব কিংবা দ্বন্দ্বের একটা সীমানায় নিগূঢ়ভাবে পাঠক জড়িয়ে যান-এটিই হলো এ উপন্যাসের বিষ্ময়কর বিষয়গুলোর একটি। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে এমনতর আঙ্গিক ইতোপূর্বে কোনো উপন্যাসে এমন নিখুঁতভাবে বর্ণিত হয়েছে কি-না তা খুঁজে দেখার দাবি রাখে। সেই সাথে মাঝেমাঝেই যে কিছু নির্মম উচ্চমার্গীয় রসিকতা বেশ সাবলীলভাবে এ উপন্যাসের ভাঁজে ভাঁজে অঙ্কিত, তা পাঠককে অভিভূত করলেও প্রচ্ছন্ন এক দ্বন্দ্ব ঘনীভূত করে তোলে। যেমন বলা হচ্ছে:
‘তখনকার যুগে যে স্বল্প সংখ্যক জিনিসে আমরা পৃথিবীতে শীর্ষ স্থানে ছিলাম মাথা-পিছু ঝরা ঘাম ছিল তাদের অন্যতম।’
‘আফসোস ছিল এই যে, তখনও আমার একটাও মরা মানুষ দেখা হয়নি।’
‘আমাদের মেয়েরা খানাখন্দে ভেসে থাকা শুক্রাণুর ভয়ে জলনিরোধক অন্তর্বাস পড়ে পানিতে নামত।’
‘প্রেম হল তোমার মুষ্কের ভেতরের বাসনা-রসের চাপ, এর বেশি কিছু নয়।’
‘সাহেবদের সন্তানেরা, তোমরা তোমাদের আনন্দের জন্য আমাকে উলঙ্গ করো, তবু আমার শাকসবজির ক্ষতি কোরো না।’
গল্পের ছলে এ রকম অসংখ্য শিল্পঘন কঠোর রসিকতা দিয়ে কল্পনার সঙ্গে উড়িয়ে পাঠককে অন্তে নিয়ে যেতে পারা যে কোনো স্বার্থক উপন্যাসেরই একটা পরিণত বিষয়। কাজেই আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, বিগত বিশ বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন মহৎ ও শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর ভাষাকে ব্যাবচ্ছেদ করে রচনার যাবতীয় কলাকৌশল রপ্তের যে দাবী ঔপন্যাসিক হারুন আল রশিদ করেন, তা যথার্থই বটে। সর্বোপরি উপন্যাসে আঙ্গিক ও প্রকরণের যে সার্থক প্রয়োগ তিনি ঘটিয়েছেন, বাংলাভাষী পাঠক ও লেখকদের জন্য তা এক নতুন অধ্যায়েরই সূচনা।