Author Picture

হাবীবাহ্ নাসরীনের একগুচ্ছ কবিতা

হাবীবাহ্ নাসরীন

তোমার নামে এক মহাকাল
.
আমার বুকে কষ্ট নামের নষ্ট একটা ঘড়ি আছে
ঘড়ির কাঁটা হঠাৎ কখন তোমার ঘরে থমকে গেছে!
তোমার নামে নামতা পড়ে, যখন-তখন তোমায় ডাকে
তোমার দিকেই উসকানি দেয় বেহায়া এই হৃদয়টাকে।

তুমি বললেই টিক টিক টিক, তুমি চাইলেই থমকে যাবে
আমার মতন বাধ্যগত এমন প্রেমিক কোথায় পাবে!
কষ্টগুলোও তোমার নামে, যা কিছু প্রেম, যা কিছু সুখ
তোমার নামেই দুঃখযাপন, আমার কিছু সুখের অসুখ।

লুকিয়েছিলাম ভোরের মায়ায়, শেষ বিকেলের লাজুক আলোয়
তোমার খোঁজে মানুষ হলাম এই পৃথিবীর মন্দ-ভালোয়
রাত্রে কি রোজ কান্না শোনো মিহিন সুরে ঝর-ঝর-ঝর?
আটকে থাকা দীর্ঘশ্বাসে তুমিই আছো বুকের ভেতর।

স্বপ্ন ভেবেই থামিয়ে দিলে, সত্যি জেনেও ছুঁইলে না তো
এক জীবনের পান্ডুলিপি তোমায় দেবো, দু’হাত পাতো!
নষ্ট ঘড়ির সবটা সময় সন্ধ্যা-দুপুর-রাত্রি-সকাল
তোমার নামেই লিখছি দ্যাখো, এক পৃথিবী এক মহাকাল।

 

করোনাকালের কবিতা
.
কী এক জীবন হলো, দিন-রাত একই মনে হয়
দরজার ওইপাশে আবছায়া মরণের ভয়
যতটা আকাশ দেখি তারও বেশি ফাঁকা লাগে বুক
মুহূর্তে অর্থহীন পৃথিবীর যাবতীয় সুখ।
রঙিন চুড়ির গোছা, ভাঁজ করা বাহারি পোশাক
আবারও উঠবে গায়ে, তার আগে মহামারি যাক
তারও আগে চলে গেলে, ফেলে রেখে ভরা সংসার
আমিহীন আগামীতে হাসবে কি পৃথিবী আবার?
এই ভরা মজলিশে উদ্বাস্তু আমি আর কে
খালি হাতে ফিরে গেলে মনে রাখে কে বলো কাকে!
এইযে মৃত্যুঘ্রাণ, মৃত্যুর ডাক অবিরাম
উত্তরে আমি এক খোলা চিঠি লিখে পাঠালাম-
উত্তাল ঢেউয়ের মতো এপারের ভেঙে বাড়িঘর
ওপারে ফিরবো এই সামান্য কিছুদিন পর।

 

এইখানে আমি একা
.
আমিও এমন বোকা,
আধেক জনম পেরিয়ে জেনেছি, ভালোবাসা একচোখা!
অন্ধ যে চোখ, সেই চোখে আমি অন্য কোথাও নেই
তবু কাঙালিনী হাত পেতে বসি তোমাদের আলোতেই।
আলো ঝলমলে দিন নিভে গেলে আমাকেই আমি ডাকি
মাঝরাতে গায় সকালের গান তোমাদের তোতাপাখি।
চেনা কথামালা, চেনা চেনা সুর তবুও অচেনা লাগে
খালি হাতে ফিরি, সবটা থাকুক তোমাদের শেষ ভাগে।
তোমাদের সুখ ঝলসে উঠুক, অন্ধ করুক চোখ
তোমাদের রোষে চাপা পড়ে যাক সময়ের সেরা শ্লোক।
অপ্রেমে ভরা এই যে নগরী তোমরাই থেকো ধারক
আমার পৃথিবী হয়তো জেগেছে হৃদয়ে অন্য কারও!
আমি কি খুঁজেছি তাকে?
অজস্র রাত নির্ঘুম, যদি নাম ধরে কেউ ডাকে!

ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায় প্রিয়দের পদরেখা,
তোমরা দেখো না অনেকের ভিড়ে এইখানে আমি একা।

 

সাবধানে তুই থাকিস আমার পাখি
.
সাবধানে তুই থাকিস আমার পাখি
হঠাৎ হঠাৎ ওড়ার ইচ্ছে হলে
তুই বড়জোর জানলা খুলে তাকাস
তোর বুকের ওই শূন্যতাটাই আকাশ।

সাবধানে তুই কণ্ঠে তুলিস সুর
হঠাৎ করেই গাইতে ইচ্ছে হলে
নিয়ম করে জানাস অভিমান
তোর না বলা দুঃখগুলোই গান।

সাবধানে তুই পালাস আমার পাখি
যাওয়ার পথে মায়ায় ভুলিস না রে
মনে রাখিস, ছায়ায় আমি আছি
যতটা চাস, তারচে কাছাকাছি।

সাবধানে তুই উড়িস আমার পাখি
হঠাৎ যদি থামতে ইচ্ছে হয়
পাঁজর আমার রেখেইছি তো খুলে-
আবার যদি আসিস ফিরে ভুলে!

 

দ্বিধা
.
না হলাম আমার আর না হলাম তোর
জীবনের শুরু থেকে আজব এক ঘোর
না আমাকে দুখি করে, না দেখায় সুখ
নিজেকেই দেখে যাই, অপরাধী মুখ।

কী আমার অপরাধ, কীসে বিস্ময়
রাতগুলো কখনো তো অনন্ত হয়!
একা বসে জেগে থাকা, একা বিভ্রম
ভুলের পরেও ফের ভুলেদের ক্রম।

না বেসেছি ভালো আমি, করিনি আঘাত
ধরিনি নিজের করে হাতে রাখা হাত
যে গিয়েছে তাকে ভেবে কাঁদিনি তো আর
তবুও তো ছুঁয়ে থাকে বেদনা আবার।

বেদনার রংগুলো মুছে ফেলি রোজ
দুঃস্মৃতি মুছে ফেলা এত কি সহজ!
প্রতিদিন পিষে দেয় আমাকে এবং
তোকেও তো ছুঁয়ে থাকে বেদনার রং।

আক্ষেপে আহলাদে কোথাও তো নেই
অভাবেরা হাত নাড়ে তবু আমাকেই
না পেলাম তোকে আর না হলাম তোর
জীবনের শেষভাগে তবু আসে ভোর!

 

ব্যথা
.
সব ব্যথা কেন তোমার একারই হবে,
আমারও তো কিছু দুঃখ থাকতে পারে
আমি ছুঁয়ে দিলে বেদনার ফুল ফোটে
দৃষ্টি ফেরালে গ্রহণ লাগতে পারে।

আমার একান্ত গভীর দুঃখবোধে
দীর্ঘশ্বাসের গোপন কানাকানি
আমি তো রয়েছি আলোকবর্ষ দূরে
দিনশেষে তবু অহেতুক অভিমানী।

আমি তো শেখাই বিরহের স্বরলিপি
দুখীদের কাছে কে আর কতটা শেখে
কেউ এসে তবু বোঝে যদি সেই ভাষা
দুইচোখে তাই ভালোবাসা আছি মেখে।

আমার বর্ণ রঙিন হবে না জানি
আমার স্বপ্ন রাত্রির ঘরে বন্দি
আমারও তো তবু ইচ্ছে হতেই পারে
বিচ্ছেদ করি মন খারাপের সন্ধি।

হঠাৎ কখনো তোমার আঙুল ছুঁতে
আমারও তো তবু ইচ্ছে জাগতে পারে
সব ব্যথা কেন তোমার একারই হবে
আমারও তো কিছু দুঃখ থাকতে পারে!

 

তোমায় ভালোবেসে
.
একই মানুষ, একই শহর, আকাশটাও এক
একই নিয়ন, একই ট্রাফিক, শান্ত জলের লেক
একই দুপুর, খা খা রোদের বিষাদভরা ক্ষণ
একই বিকেল, একই হাওয়া, কেমন করা মন
একই তো পথ, পথের সে বাঁক, বাঁকের কোণে গাছ
পথের ধুলোয় হলুদ পাতার দুঃখ বারোমাস
একই পথিক, একই ক্লান্তি, একই সে বিশ্রাম
আবেগগুলোর বেচাকেনায় বাড়েনি দরদাম
একই সন্ধ্যা, একই ফেরা, একই গৃহকোণ
আরেকটি দিন বেঁচে থাকার একই আয়োজন
একই বুকের ব্যথা এবং একই চোখের জল
চিরকালীন অপেক্ষাদের একই ফলাফল
একই সে মুখ, একই হাসি, স্মৃতির আলোড়ন
লুকিয়ে রাখা দীর্ঘশ্বাসের একই বিস্ফোরণ
একই সে রাত, একই তারা, সেই পুরনো চাঁদ
না বলা সেই গল্পগুলোর একই আর্তনাদ
একই বোবা দুঃখ এবং কষ্টেরা চিনচিন
অনেককিছুই আগের মতো আমরা শুধু ভিন্
একই আমি, একই তুমি, একই টিকে থাকা
অনেক হারিয়ে যাওয়ার ভিড়ে একটি কথা রাখা-
একইরকম আসবে প্লাবন, প্রলয় সর্বনেশে
আরেকটি দিন বাঁচবো তবু তোমায় ভালোবেসে।

 

একটা হৃদয় যাচ্ছে পুড়ে
.
একটা হৃদয় যাচ্ছে পুড়ে দেখছে না কেউ শূন্য চোখে
কাছের মানুষ জ্বালছে আগুন, বলবে কী আর অন্য লোকে!
মিলবে কি আর হারানো ধন, কুড়িয়ে পাওয়া জীবনটাতে
ফুরিয়ে যাওয়া সময়গুলো ফিরবে কি আর সন্ধ্য-রাতে!
সব কোলাহল শেষ হলে কি চুপ থাকারা একলা হবে
নীরবতার রং মেখে কি আকাশটুকু মেঘলা রবে?
বৃষ্টি এলে চোখের জলে কেউ কি যাবে সারতে স্নান
ফোঁটায় ফোঁটায় দুঃখ গিলে বাঁচতে চাওয়া খুব বেমানান?
নিজের মতো থাকতে চাওয়া একলা ঘরের আড়ালটাতে
রোজ সকালে দুখ পোহানো শূন্য মনের বারান্দাতে।
যেদিন গেছে, খুব করে কি চাইতে পারি সেদিনগুলো
সেই হারানো চড়ুইভাতি, কড়াই বাটি, চাল ও চুলো!
সেই পুরনো বন্ধু আমার, গল্পগুলোর হারিয়ে যাওয়া
চলার পথে হঠাৎ কোথাও একটি দুটি কুড়িয়ে পাওয়া।
ফুরিয়ে যাওয়া জীবনটাতে মিলবে কি আর মানুষগুলো
শেষ বিকেলের আকাশজুড়ে উড়বে কি আর ফানুসগুলো!
পুড়িয়ে ফেলা হৃদয়টাতে ফেরাবে কেউ ছন্দ আবার
ছেড়ে যাওয়ার অজস্রজন, থেকে যাবে কেউ দাঁড়াবার?

 

যদি কোনো রাতে
.
টুপ করে যদি সন্ধ্যা নামে, চুপচাপ আসে ভোর
মহাকালসম বিনিদ্র রাত পাশে থাকি আমি তোর
হঠাৎ বাতাসে অবাধ্য চুল এলোমেলো যদি ওড়ে
এককোণে একা নিভু নিভু হয়ে মোমবাতি যদি পোড়ে
জানালার কাঁচে জোসনা ও মেঘ খেলে যদি লুকোচুরি
পথভোলা কিছু জোনাকির দল করে যদি ওড়াউড়ি
কবিতার খাতা আধখোলা হয়ে আলো-ছায়া গিলে খায়
দূর কোনো গ্রামে বিজলি মেয়েরা ভয়ে ভয়ে চমকায়
তোর দুটি চোখে নামলে আকাশ আরও বেশি গম্ভীর
হঠাৎ উদাস দীর্ঘশ্বাসে আমি হবো চৌচির
বাতাসের কোলে একটি কি দুটি তারা যদি খসে পড়ে
বিরহী হুতুম মাঝরাত্তিরে কাঁদলে তারস্বরে
আমি ভয়ে ভয়ে চিবুক লুকাবো তোর ওই তামাটে দেহে
দ্বিধাভরা চোখে ফের সরে যাবো, না পাওয়ার সন্দেহে
চোখে যদি চোখ পড়ে তবুও তো অলিখিত সেই ভাষা
আমিও জানি না, তোরও অজানা, হয়তো বা ভালোবাসা!
হঠাৎ শোনাবে চেনা কোনো সুর রাতজাগা একা পাখি
কামিনির বনে থোকা থোকা ফুল গন্ধ বিলাবে নাকি!
ছুঁয়ে দেবো নাকি তোর ওই আঙুল, তিরতিরে কাঁপা নাক
ভোর হলো প্রায়, আরেকটু ক্ষণ তুই পাশে বসে থাক।

 

আমিই হলাম দুঃখ তোমার
.
লুকানো যায় না কিছুই
শুকানো যায় না অদেখা চোখের জল
ঘৃণিত, ব্যথিত, প্রোথিত জীবনে তবু
আচমকা ফোটে প্রণয়ের শতদল।

জানি ভুল ফুল, জানালায় তবু বিকেলের শেষ রোদ
কতটুকু হলো শোধ?
ভিটেমাটি বেচে চুকিয়ে দিয়েছি দেনা
যে ফিরে গিয়েছে, সে তো আর আসবে না।
কবরের বুকে ফুটলো কি ফুল, পাথরের বুকে ঘাস
তাই ভেবে ভেবে পাপীদের বুকে পার্থিব হা-হুতাশ
আমি তো রয়েছি সুখে,
আমার যাত্রা নিঃসীম অভিমুখে।

যত দূরে যাই চলে,
প্রতি বসন্তে ফের দেখা হবে ফুল ফোটানোর ছলে।
আমিই হলাম দুঃখ তোমার, শঙ্কায় কাঁপা বুক
আমার অশ্রু পেয়ালায় তুমি দিয়ো গো শেষ চুমুক।
আলো আর জলে, জল টলমলে, আমি কি কোথাও নেই?
ঘৃণা-অভিশাপে, পুরাতন পাপে মনে হবে আমাকেই।

লুকানো যাবে না কিছুই,
শুকানো যাবে না অদেখা চোখের জল
কত শত কথা, হাসি-গল্পের ভিড়ে
ব্যথা হয়ে আমি ফুটে রবো অবিচল।

আরো পড়তে পারেন

তরুন ইউসুফের একগুচ্ছ কবিতা

বহ্ন্যুৎসব কত কিছু পুড়ল! গাড়ি পুড়ল বাড়ি পুড়ল দম্ভের দালান পুড়ে ক্ষার জলপাই সবুজ ট্যাংক নামল পুড়ল বই গল্প রূপকথার বেলুন হাতে পুড়তে পুড়তে ফানুস হয়ে উড়ে গেল বালক মায়ের আঁচল পুড়ল পুড়ল বুকের কাছের লোক যুবকের বুক পোড়াতে পোড়াতে পুড়ে গেল বন্দুক, থানার সেপাই কারো কারো স্বপ্ন পুড়ল আমিও পোড়ার গন্ধ পাই- আমার পুড়ল….

আজাদুর রহমান-এর একগুচ্ছ কবিতা

বাবা আপনার ব্যর্থ শরীর জানত নিরাময় উড়ে গেছে আসমানে, আপনার মৃত্যু হবে। শেষবেলায় আপনি বড় নিঃস্ব, ঈশ্বরের মত নিদারুন, একমাত্র একা। সেকারনেই আপনি লুকিয়ে লুকিয়ে ভেন্টোলিন সিরাপ খেতেন, অ্যাসমা’র বড়ি গিলে সারা রাত কাঁশতেন। আপনার কফ গলানো কাঁশির শব্দে কোন কোন রাতে আমাদের কাঁচা ঘুম ছিঁড়ে যেত, আমরা বিরক্ত হতাম। তারপর, আপনার জবুথবু মুখের দিকে….

মাহমুদ দারবিশের ডায়েরি ‘নদী মরে যায় পিপাসায়’— (পর্ব: ২)

মেয়েটি আর তার চিৎকার সমুদ্রতীরের মেয়েটি, যার একটি পরিবার আছে আর সেই পরিবারটির একটি বাড়িও আছে। বাড়িটির মধ্যে দুটি জানালা আর একটি দরজা আছে। সমুদ্রে একটি যুদ্ধজাহাজ মজার ছলে তীরে হাটাহাটি করতে থাকা লোকদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে: চার, পাঁচ, সাত জন বালির উপর পড়ে যায়। একটি অস্পষ্ট ঐশ্বরিক হাতের সাহায্যে মেয়েটি কিছুক্ষণের জন্য কোন প্রকারে….

error: Content is protected !!