
.দশ.
আমাদের শিক্ষক মৃদু অনুযোগ করে বলেন, ‘আপনার কি মনে হয়, যে টাকা প্রতি মাসে আমাকে দেন তা আমার বউয়ের চেয়ে দামী? নাকি এটা মনে করেন, ওই টাকার জন্য যা অবৈধ তাকে বৈধ করব এবং আপনার উপস্থিতিতে যে স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়েছি তার সঙ্গে জীবনযাপন করব!’
সেদিন বুধবার। রোজকার মতোই আমাদের বন্ধু প্রশান্ত চিত্তে দিনাতিপাত করেছে। এর আগে সকালেই শিক্ষককে জানিয়েছে যে, তার কোরান খতম হয়ে গেছে। মূলত তারপরই সমস্ত দিন গল্পগুজব শ্রবণ ও চিত্তবিনোদনের জন্য অবসর হয়ে পড়ে সে। এরপর যদিও মকতব শেষে সরাসরি বাড়িতে না গিয়ে বন্ধুদের সাথে আসর নামাজ আদায়ে জামে মসজিদে যায়। আজকাল অবশ্য মসজিদে যেতে ভালোবাসে সে। ওখানে মিনারে চড়ে মুয়াজ্জিনের সঙ্গে আযান দিতে বেশ লাগে তার। সুতরাং সেদিনও সে মসজিদে যায় এবং মিনারে চড়ে। আযান দেয়, নামাজ পড়ে। এরপর বাড়ি ফেরার মনস্থ করে কিন্তু জুতো জোড়া হারিয়ে ফেলে। এত খোঁজে অথচ কোথাও তা পায় না। তার স্পষ্ট মনে আছে, ওগুলো সে মিনারের পাশেই রেখেছিল। কিন্তু কী অদ্ভূৎ! নামাজ শেষে গিয়ে দেখে তা চুরি হয়ে গেছে। ঘটনাটি তাকে কিছুটা ব্যথিত করলেও সেদিন সে বেশ খুশি ও আনন্দিতই ছিল। ফলে এ নিয়ে সে আর তেমন মাথা ঘামায় না এবং খালি পায়েই বাড়িতে ফিরে আসে। যদিও মসজিদ থেকে বাড়ির পথ বহুদূর। কিন্তু তা তাকে চিন্তিত করেনি নিশ্চয়; কেননা খালি পায়ে এমন বহুদিন সে হেঁটে এসেছে।
যাহোক, সে ঘরে প্রবেশ করে এবং বসার ঘর থেকেই শায়খ (বাবা) তাকে ডাকেন, ‘তোমার জুতো কই?’
‘মকতবে ভুলে রেখে এসেছি।’
কিন্তু শায়খ তার এ জবাবে কোনো ভ্রুক্ষেপ করে না। ফলে সে চুপচাপ ঘরে প্রবেশ করে এবং মা ও বোনের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে অভ্যেস অনুযায়ী এক টুকরো রুটি খায়। যেমন রোজ সে মকতব থেকে ফিরে খেত।
এরপরই শায়খ তাকে ডাকেন। সে দ্রুত তার সামনে গিয়ে হাজির হয়। যখন ঠিকঠাক ধাতস্থ হয়ে দাঁড়ায় তখন তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কী তেলাওয়াত করলে আজ?’
‘খতম করেছি এবং শেষ ছয় পারা পাঠ করেছি।’
‘ঠিকঠাক মুখস্থ করেছ তো?’
‘হ্যাঁ।’
‘আচ্ছা! তাহলে সূরা সাবা পাঠ করে শোনাও।’
কিন্ত আমাদের বন্ধুটি তো অন্যান্য সূরার মতো সূরা সাবাও ভুলে গেছে। আর আল্লাহর পক্ষ থেকেও কোনো সাহায্য আসেনি এবার।
শায়খ পুনরায় বলে, ‘তাহলে সূরা ফাতির পড়।’
এবারও কোনো গায়েবি সাহায্য নেই। শায়খ তখন শান্ত, উপহাসের স্বরে বলে, ‘ভেবেছিলে পুরো কোরান মুখস্থ করে ফেলেছ তুমি! যাহোক সূরা ইয়াসিনটা তো অন্তত মনে থাকার কথা। তা ওটাই পাঠ করে শোনাও না।’
এবার সে আল্লাহর রহমে কোনোরকম প্রথম আয়াতটি শুরু করে মাত্র। কিন্ত এরপরই যেন তার জিহবা জড়িয়ে যায়। মুখের সমস্ত লালা শুকিয়ে যায়। ভীতসন্ত্রস্ত এক কম্পন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে থাকে। আর শীতল ঘামের স্রোতধারা তার মুখ বেয়ে নেমে আসে।
এসময় শায়খ তাকে শীতল কণ্ঠে বলে, ‘যাও দাঁড়াও। আর রোজ রোজ জুতোর কথা ভুলে না যাওয়ার চেষ্টা করবে। যতদূর মনে হয়, ওগুলো ওভাবেই খুইয়েছ যেভাবে কোরানের হিফয খুইয়েছ। যাহোক, অবশ্যই শিক্ষকের সঙ্গে আমার অন্যভাবে আলাপ করতে হবে।’
এরপর আমাদের বন্ধুটি অবনত মস্তকে অতিথিকক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে। ভয়ে তখন তার হুমড়ি খেয়ে পড়ার জোগাড়। অবশেষে কোনোরকম সে ভাঁড়ারঘরে গিয়ে পৌঁছে। যেখানে ঘরের বিভিন্ন খাদ্য-দ্রব্য ইত্যাদি মজুদ রাখা হয়। তার এক কোণে রাখা ‘কিরমা।’ মোটা বৃক্ষ কান্ড; যেটাতে মা মাংস কাটেন। ওটার ওপর ছোট, বড়, ভারি, পাতলা; প্রায় সবরকম ছুড়িই সুবিন্যস্ত ছড়ানো আছে।
সবচেয়ে ধারালো ও ভারি ছুরিটি নিয়ে ঘাড়ের পেছনে পোঁচ দেয়। সেইসাথে তীক্ষ্ম এক চিৎকারের সাথে ছুরিটিও তার হাত থেকে পড়ে যায়। তখন তড়িৎ মা দৌড়ে আসেন। যিনি তার নিকটেই কোথাও ছিলেন এবং এক মুহুর্ত আগেও পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময়; তার দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ করেননি
আমাদের বন্ধুটি তখন কোণে থাকা ওই কিরমার কাছে যায়। ওটার ওপরে রাখা সবচেয়ে ধারালো ও ভারি ছুরিটি নিয়ে ঘাড়ের পেছনে পোঁচ দেয়। সেইসাথে তীক্ষ্ম এক চিৎকারের সাথে ছুরিটিও তার হাত থেকে পড়ে যায়। তখন তড়িৎ মা দৌড়ে আসেন। যিনি তার নিকটেই কোথাও ছিলেন এবং এক মুহুর্ত আগেও পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময়; তার দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ করেননি। যাহোক তিনি এসে দেখেন, সে অস্থির দাঁড়িয়ে আছে আর তার গ্রীবাদেশ এর পেছন থেকে রক্তের ধারা গড়িয়ে নামছে। ছুরিটি তখন তার পাশেই নীচে পড়ে আছে। সুতরাং যখন তিনি দ্রুত ক্ষতটির দিকে তাকিয়ে দেখেন তা তেমন গুরুতর নয়; তখন উল্টো তাকেই কিছু তিরস্কার করে ভৎসনা করেন। এরপর হাত ধরে তিনি তাকে একপ্রকার টেনে নিয়ে যান এবং রান্নাঘরের এককোণে নিক্ষেপ করে নিজের কাজে চলে যান। সেখানে আমাদের বন্ধুটি নিশ্চুপ, নির্লিপ্ত হয়ে পড়ে থাকে। না সে কোনোরূপ নড়েছিল, না কেঁদেছিল বা কিছু চিন্তা করেছিল। সে এমনই নিঃসাড় পড়েছিল; যেন এই মহাবিশ্বের মাঝে কিছুই নয় সে। তার কোনো অস্তিত্ব নেই। যখন তার ভাইবোনেরা তারই চারপাশে খেলাধুলা, হৈচৈ করছিল, অথচ তার দিকে কোনো মনোযোগই দিচ্ছিল না। না সে তাদের দিকে কোনো মনোযোগ দিয়েছিল।
ইতোমধ্যে মাগরিব আসন্ন। যথাসময়ে ঘটিতব্য সমস্ত বিষয়ের উত্তর দেওয়ার জন্য বাবা তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। সুতরাং সে ভীতসন্ত্রস্ত ও লজ্জিত হয়ে অতিথিকক্ষে প্রবেশ করে। কিন্তু সেখানে বাবা তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগে অনবরত প্রশ্নবাণে আমাদের শিক্ষকই তাকে জর্জরিত করে তোলেন যে, ‘তুমি কি আজ আমার কাছে ছয় পারা পড়নি?’
‘জ্বি’
‘গতকাল কি তুমি আমার কাছে সূরা সাবা পড়নি?’
‘জ্বি।’
‘তাহলে আজ পড়তে পারছো না কেন?’
এই প্রশ্নের জবাবে অবশ্য সে কিছু বলেনি।
তখন শিক্ষক বলেন, ‘নাও এখন সূরা সাবা তেলাওয়াত কর।’
কিন্তু একটি শব্দের জন্যও প্রভূ তার ঠোঁট উন্মুক্ত করেননি। এই দেখে বাবা বলেন, ‘তাহলে সূরা সাজদা পড়।’ এতেও সে কিছু বলতে পারেনি।
এখানে এসে অবশ্য শায়খ যারপরনাই উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। তবে তা বালকের সাথে নয় বরং আমাদের শিক্ষকের সাথে। ফলে তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, ‘দেখলেন তো। রোজ ও মকতবে গিয়েছে ঠিক কিন্তু কিছুই পড়েনি এবং মুখস্থ করেনি। আর না আপনি তার প্রতি দায়িত্বশীল ছিলেন, না কোনো মনোযোগ দিয়েছেন। সে শুধু ওখানে খেলাধুলাই করেছে আর অহেতুক সময় নষ্ট করেছে। এমনকি আজই সে খালি পায়ে বাড়ি ফিরেছে এবং বলতে চেয়েছে যে, জুতোর কথা ভুলে গেছে এবং মকতবে ফেলে এসেছে।… তাই বলি কী! ওর কোরান মুখস্থ করার ব্যপারে আপনার যে উদ্বেগ ও চেষ্টা; কোনোভাবেই তা ওর জুতো ছাড়া খালি পায়ে চলাফেরার ব্যপারে আপনার উদ্বেগ থেকে বিশেষ বড় কিছু নয়।’
আমাদের শিক্ষক তখন হন্তদন্ত হয়ে বলেন, ‘এই আমি তিনবার আল্লাহর নামে কসম খেয়ে বলছি, একদিনের জন্যও আমি ওর প্রতি কোনো অবহেলা করিনি। এমনকি আজ যদি ছাত্রদের আগেই মকতব থেকে না বেরুতাম, তাহলে সে কোনোভাবেই খালি পায়ে আসতে পারত না। প্রকৃতপক্ষে প্রতি সপ্তাহে একবার সে আমার কাছ পাঠ করে শোনায়। তাছাড়া প্রতিদিন ছয় পারা নির্ধারণ করে দিয়েছি। ফলে ভোরে যখনই মকতবে আসি সর্বপ্রথম তার কাছে তা শুনি।
জবাবে শায়খ বলেন, ‘এসব কিছুই বিশ্বাস করি না আমি।’
এতে আমাদের শিক্ষক পুনরায় কসম খেয়ে বলেন, ‘মিথ্যা বললে আমার বউ তালাক হয়ে যাবে। বিশ্বাস করুন! কখনওই আপনার সঙ্গে মিথ্যা বলিনি। সত্যিই প্রতি সপ্তাহে ওর কাছ থেকে কোরান শুনতাম আমি।’
শায়খ তবুও তার কথায় অনড় এবং পুনরায় দ্বিরুক্তি করে বলেন, ‘না আমি বিশ্বাস করি না।’
তখন আমাদের শিক্ষক মৃদু অনুযোগ করে বলেন, ‘আপনার কি মনে হয়, যে টাকা প্রতি মাসে আমাকে দেন তা আমার বউয়ের চেয়ে দামী? নাকি এটা মনে করেন, ওই টাকার জন্য যা অবৈধ তাকে বৈধ করব এবং আপনার উপস্থিতিতে যে স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়েছি তার সঙ্গে জীবনযাপন করব!’
‘আপনি যাই বলুন আমার কাছে ওসবের কোনো মূল্য নেই। কাল থেকে ও আর মকতবে যাবে না।’ এই বলে তিনি উঠে দাঁড়ান এবং বেরিয়ে যান। সেইসাথে আমাদের শিক্ষকও উঠেন এবং ভারাক্রান্ত হৃদয়ে প্রস্থান করেন।
আমাদের বন্ধুটি তখন ওখানে, ওভাবেই ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল। না কোরান বা অন্য কিছু নিয়ে ভাবতে পারছিল। কেবল শিক্ষকের মিথ্যা বলার ওই অসীম ক্ষমতা এবং তালাকের কথা ভাবছিল। যা তিনি এইমাত্র এভাবে তার স্ত্রীর ওপর নিক্ষেপ করলেন, যেমন একটা সিগার ফুঁকে তা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলেন।
এরপর সেদিন আর রাতের খাবার খেতে দস্তরখানে হাজির হয়নি বালক। এমনকি তিনদিনের জন্য বাবার উপস্থিতি ও খাবার ঘর; দুটোই এড়িয়ে যায় সে। অবশেষে চতুর্থ দিন বাবা নিজেই তার কাছে রান্নাঘরে আসেন। অধিকাংশ সময় যেখানে সে চুলোর কিনারে বসে থাকত পছন্দ করত। যাহোক, তিনি এসে তার সঙ্গে বেশ খোশমেজাজে হাস্যকর ও কোমলভাবে কথা বলা শুরু করলেন, যতক্ষণ না বালক তার মনমরা, ব্যথাভাব কাটিয়ে পুনরায় কথা শুরু করে এবং উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। এরপর বাবা তার হাত ধরে তাকে দস্তরখানে নিয়ে যান এবং সেদিন দুপরের আহারে তার দিকে বিশেষ মনোযোগ রাখেন। কিন্তু যখনই সে খাওয়া শেষ করে উঠতে যাবে অমনি বাবা তার দিকে নিষ্করুণ এক বাক্য নিক্ষেপ করেন। যা সে কোনোদিনই ভুলেনি। কারণ, এতে ভাইয়েরা তাকে নিয়ে উপহাসের হাসি হেসেছিল। এমনকি সময়ে সময়ে তাকে খেপানো ও বিরক্ত করার জন্য তারা তা ভালোভাবেই মনে রেখেছিল। বাক্যটি ছিল, ‘তা তুমি কোরান মুখস্থ করেছ?’