ভূমিকা
বিশ শতকের সবচেয়ে প্রভাবশালী মিশরীয় লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের একজন ড. ত্বহা হুসাইন। আধুনিক আরবি সাহিত্যের অবিস্মরণীয় এই ব্যক্তিত্ব ১৮৮৯ সালে মিশরের মিনিয়া প্রদেশের মাগগাহ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। আত্মজীবনী আল-আইয়্যামের প্রথম খণ্ডে তিনি মূলত তার শৈশবের বর্ণনা করেছেন। যেখানে তের বছর বয়সে কায়রোর আল-আযহারে পড়তে যান। সেইসাথে রয়েছে মিশরের গ্রামীণ জীবন ও সেখানকার লোকদের রীতিনীতি, বিশ্বাস ও লোকাচার সমূহের আশ্চর্য মূল্যবান বর্ণনা।
আযহারে ভর্তি হয়ে সেখানে দশ বছর অতিবাহিত করেন তিনি। এই দীর্ঘ সময়ে শায়খ সায়্যিদ আলি আল-মারফাসির তত্ত্বাবধানে আরবি সাহিত্যে বিপুল জ্ঞানার্জন করেন ড. ত্বহা। এরপর অবশ্য স্বাধীন ও আধুনিক চিন্তার এই মনীষী তার যৌবনের প্রারম্ভেই আযহারের তৎকালীন রক্ষণশীল পরিবেশ ও অনুন্নত শিক্ষার সমালোচনা করে কয়েকজন শিক্ষকের বিরাগভাজন হন এবং ফলস্বরূপ চতুরতা করে তাকে আযহার থেকে বহিষ্কার করা হয়। তখন জামেয়া আযহার থেকে বেরিয়ে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ত্বহা। মূলত এখান থেকেই ইউরোপীয় শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে, আযহারীদের তৎকালীন কুসংস্কারচ্ছন্ন সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি এড়িয়ে আধুনিক সাহিত্য সমালোচনার নতুন এক ধারার সঙ্গে পরিচিত হন তিনি। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউরোপীয় শিক্ষকদের মধ্যে, প্রফেসর নালিনো, লিটম্যান এবং সান্টিল্যানো ছিলেন তার মহান শিক্ষকদের অন্যতম- যাদের কথা তিনি কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করেছেন।
১৯১৪ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পি.এইচ.ডি লাভ করেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়টির সর্বপ্রথম গ্রাজুয়েট ও ডক্টরেট অর্জনকারী তিনিই। তার গবেষণার বিষয় ছিল : ‘তাজদীদু যিকরি আ-বিল আলা’ তথা: বিখ্যাত আরব কবি, চিন্তক ও দার্শনিক আবুল-আলার ওপর অভিসন্দর্ভ। যেটা memory of abul ala muarry শিরোনামে অনূদিত। এরপর কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভের পর সরকারী বৃত্তি নিয়ে প্যারিস গমন করেন । সেখানে ১৯১৭ সালে ফরাসী ভাষায়, ‘Etude analytique et critique de la Vhilosophie Sociale d’Ibn Khaldun’ শীর্ষক অন্য একটি গবেষণা অভিসন্দর্ভ রচনা করেন। আরবিতে যেটি ‘ফালসাফাতু ইবনু খালদুন আল-ইজতেমাইয়্যা’ শিরোনামে অনূদিত হয়েছে। তার এ অভিসন্দর্ভের জন্য সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয় সে বছর তথা ১৯১৭-তেই তাকে ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেন। ১৯১৯ সালে তার এই মহামূল্যবান গবেষণাটি উর্দুতেও অনূদিত হয়। সুদীর্ঘ বৈপ্লবিক সাহিত্য জীবনে ড. ত্বহা রচনা করেছেন অসংখ্য পুস্তক। উল্লেখযোগ্য : তাজদীদু যিকরি আবিল-আলা, হাদীছ আল-আরবিয়া, ক্বাদাত আল ফিকর, ফি শাঅ’রীল জাহেলি, ফি আদাবিল জাহেলি,শাজারাতুল বুউস, লাহজাত ও আল আইয়্যাম…ইত্যাদি। বিস্তৃত সাহিত্য জীবনের মতো তার কর্মজীবনও বৈচিত্র্যময়। ১৯১৯ সালে ফ্রান্স থেকে ফিরে সেই যে কায়রো বিশ্বিবদ্যালয়ের অধ্যাপক নিযুক্ত হন- তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর, ডিরেক্টর জেনারেল অব কালচার এবং ১৯৫০ সালে শিক্ষামন্ত্রীও হন। অথচ ড.ত্বহা ছিলেন দৃষ্টিহীন। মাত্র তিন বছর বয়সে অফথালমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চোখের আলো হারান। কিন্তু আপন অন্তর্দৃষ্টির আলোকে নিতান্ত গ্রামীণ এক বালক থেকে কি করে আধুনিক মিশরের অন্যতম প্রবাদ পুরুষ হিসেবে নিজেকে অধিষ্ঠিত করলেন! বিস্ময়কর হলেও আমাদের তা মুগ্ধ করে। কেননা নিজের চিন্তা, চেতনা ও মননে যে জীবন ও জগৎ তিনি দেখেছেন তা স্বাধীন ও মুক্ত চিন্তার জগৎ। তার যাবতীয় লেখাপত্র ও রচনাবলিতে যার বিকাশ ঘটেছে পূর্ণ মাত্রায়। আধুনিক আরবি সাহিত্যে তিনি যে নতুন এক গদ্যশৈলির অবতারণা করেছেন, তা যেমনি তার সৃষ্টিকে স্বতন্ত্র করেছে, তেমনি আরবি সাহিত্যের ইতিহাসেও আনোখা। তার এই আত্মজীবনীর প্রতিটি পাতায় পাঠককে মোহাবিষ্ট করে রাখার রসদ রয়েছে। ‘আল আইয়্যাম’ শিরোনামের মূল বইয়ের বাংলায় ‘ত্বহা হুসাইন এর দিনগুলি’র অনুবাদ করেছেন কবি এবং অনুবাদক : কাউসার মাহমুদ
পর্ব-১
কবি তখন তার অভূতপূর্ব এক সুমিষ্ট স্বরে আবু যায়েদ, খলিফা ও দিয়াবের কবিতাগুলো আবৃত্তি শুরু করেন। এসময় তার শ্রোতারা পরম স্থৈর্য নিয়ে অনন্ত নীরব থাকে; যতক্ষণ না পরমানন্দ তাদের উজ্জীবিত করে তোলে এবং নিগূঢ় আকাঙ্ক্ষা চমকে দেয়। সেদিন কী বার ছিল মনে নেই ছেলেটির। মনে নেই দিন-তারিখ কোনো কিছু। দিনের কোন্ সময় ছিল- এটাও মনে করতে পারে না ভাল করে। শুধু আবছা মনে পড়ে, সেদিনের মৃদু আলোর প্রভাত অথবা সন্ধ্যার কোনো এক ক্ষণ। এই ভোর অথবা সন্ধ্যা মনে করতে পারার কারণ, এ সময় শীতল, স্নিগ্ধ, মৃদুমন্দ বাতাসের একটা পরশ তার মুখাবয়বজুড়ে অনুভব করে সে। সূর্যের তাপ তখনও যেটা বিধ্বস্ত করেনি। অথবা তখনো ছেলেটি জানত না আলো আর আঁধারের তফাত। কখনো মনে হয়, সেদিন যখন সে ঘর থেকে বেরিয়েছিল, চারপাশে অনুভূত হয়েছিল প্রশান্ত আলো। আঁধার তাকে গ্রাস করতে শুরু করেছে মাত্র। আবার কখনো মনে হয় স্নিগ্ধ আলোয় স্তব্ধ ছিল চারপাশ। যেন এইমাত্র নিদ্রা থেকে জাগছে আড়মোড়া দিয়ে। অথবা ঢলে পড়ছে নিদ্রার কোলে।
যাহোক, তবু যদি তার কাছে সন্দেহাতীত নির্দিষ্ট কোনো সময়ের নির্ধারিত স্মৃতি থাকে-তা হলো ওই বেড়ার স্মৃতি। যা তার বাড়ির সম্মুখে নির্মিত ছিল ভুট্টার ডাঁটা দিয়ে। বাড়ির প্রধান দরজা থেকে কয়েক কদম দূরে যেটা দাঁড়িয়েছিল প্রতিরক্ষা দেয়ালের মত অনড়ভাবে। এই বেড়াটির কথা তার মনে হয়- যেন এটাকে গতকালই প্রথম দেখেছে। মনে আছে, যেসব ডালপালা ও বৃক্ষশাখা দিয়ে বেড়াটি তৈরী করা হয়েছিল সেগুলো ছিল তার চেয়ে উঁচু। তাই এর বাইরে যাওয়া ছিল তার জন্য বেশ কঠিন। এমনকি সে এটাও মনে করতে পারে, বেড়ার ভেতর ডাঁটাগুলো এমনভাবে প্রক্ষিপ্ত; যেন একত্রে গাঁথা। এজন্য সেগুলোকে কোনোভাবে মোচড়ানো বা দৃঢ়মুষ্ঠিতে নিষ্পেষণও করতে পারতো না সে। তার অনুস্মরণে আছে, বাড়ির ওই বেড়াটি তার ডান দিকে অনেকদূর চলে গেছে; যার শেষ কোথায়-এ ব্যপারে সে কোনো আন্দাজ করতে পারে না। যেন এটা তার ডান দিক থেকে প্রশস্ত হয়ে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে গিয়ে ঠেকেছে। আর এই দিকে পৃথিবীর শেষ প্রান্ত নিকটেই; কারণ কাছের ওই খাল পর্যন্ত পৌঁছেছে বেড়াটি। মূলত একটু বড় হওয়ার পর এই নিগুঢ় রহস্যটি আবিষ্কার করেছিল ছেলেটি।
সুতরাং এটি তার জীবনে মহা গুরুত্বপূর্ণ এক বিষয়; অথবা আমরা বলতে পারি, এ তার কল্পনা মাত্র।
এই সবকিছুই সে মনে করতে পারে এবং আরও মনে করতে পারে, তখন একটি খরগোশের প্রতি কতোটা বিদ্বিষ্ট ছিল সে। যেটি কিনা প্রায়শই তার মতো বাড়ির বাইরে যেত। তবে যেকোনো সময় চাইলেই বেড়াটি লাফ দিয়ে ডিঙিয়ে যেতে পারতো। অথবা ডালপালা বা এর ডাঁটাসমূহ পেষণ করে এর পেছনে থাকা সবুজ সবজিসমূহ কূটকূট করে খেতে পারতো। যেসবের মধ্যে বিশেষ করে বাঁধাকপির কথা স্পষ্ট মনে পড়ে তার। মনে পড়ে, কীভাবে প্রতিদিন সূর্যাস্তের সময় ঘরের বাইরে যেত সে; যখন লোকেরা তাদের সান্ধ্যকালীন খাবার খেত। সে তখন ভুট্টার বেড়াটির সাথে হেলান দিয়ে গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত হয়ে থাকতো; যতক্ষণ না তার চারপাশে একজন কবির মহিমান্বিত কন্ঠস্বরে পুনরায় চেতনা ফিরে পেত। যেই কবির চারপাশে তার শ্রোতারা তাকে ঘিরে থাকে। কবি তার অভূতপূর্ব এক সুমিষ্ট স্বরে আবু যায়েদ, খলিফা ও দিয়াবের কবিতাগুলো আবৃত্তি করেন।
এসময় শ্রোতারা পরম স্থৈর্য নিয়ে অনন্ত নীরব থাকে; যতক্ষণ না পরমানন্দ তাদের উজ্জীবিত করে তোলে এবং নিগূঢ় আকাঙ্খা চমকে দেয়। তখন তারা পুনরায় তাকে আবৃত্তি করার অনুরোধে মৃদু বাদানুবাদ ও তর্কে লিপ্ত হয়। এতে কবি একটি নির্ধারিত দীর্ঘ বা সংক্ষিপ্ত সময় পর্যন্ত নীরব হয়ে থাকেন; যতক্ষণ না তার শ্রোতারা কোলাহল থামিয়ে শান্ত হয়। এরপর পুনরায় তিনি তার সুমিষ্ট আবৃত্তি একটি বিরক্তিকর, একঘেয়ে স্বরে গাইতে থাকেন।
এও মনে আছে, যখনই রাতের বেলা বেড়াটির পাশ দিয়ে তার প্রিয় জায়গাটিতে যেত; তখন অব্যক্ত অপরিসীম তিক্ত বেদনাবোধ তার সমস্ত অস্তিত্বজুড়ে ছড়িয়ে যেত। কেননা সে খুব ভালো করেই জানতো, ঘরে আসার জন্য বোনের ডাকের সাথে তার এ আমোদ ও চিত্তবিনোদন খুব দ্রুত সঙ্কুচিত হয়ে আসবে। অবশ্য প্রথমে সে ওই ডাক প্রত্যাখ্যান করবে। কিন্তু তারপরই বোন বাইরে এসে তার জামা ধরে তাকে টেনে নিয়ে যেতে চাইলে তখনও সে তার সমস্ত শক্তি ও জোর দিয়ে প্রতিরোধ করতে চাইবে। এ পর্যায়ে তার বোন তাকে এমনভাবে নিজের দুবাহুর ভেতর তুলে নেবে, যেন সে একটি খেলনা মাত্র।
এভাবে নিঃশব্দে ঘরের ভেতর ওখানে নিয়ে যাবে, যেখানে তাকে মাটির ওপর শুইয়ে রাখা হবে। সেখানে সে তাকে প্রথমে মায়ের কোলের ওপর রাখবে। মা তখন তার দুর্বল,ক্ষীণ অক্ষিযুগল ধীরে টেনে তার দিকে মনোযোগ সহকারে দৃষ্টিপাত করবেন। এসময় চোখ দুটি এমনভাবে এক-এক করে খুলবেন; যখন দু চোখের মধ্যে স্থিত তরল জলধারাটি ভেসে উঠবে আর তার খুব কষ্ট হবে। যদিও মায়ের এমনতর কষ্টে তখন সে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করে; কিন্তু এ নিয়ে সে কোনো অভিযোগ করতো না বা কাঁদতো না। কারণ কখনোই সে তার ছোটো বোনটির মতো অমন ঘ্যানঘ্যানকারী হতে চাইত না।
যাহোক, এরপর পুনরায় তার বোন তাকে কোলে তুলে রুমের এককোণে বিছানো মাদুরের ওপর সটান শুইয়ে দিয়ে তার ওপর আরেকটি কম্বল চড়িয়ে নিজের ভেতরে তুমুল শোক করার জন্য নিরুপদ্রব ছেড়ে দেবে। তখন সে তার শ্রবণশক্তিকে আওয়াজ শ্রবণে চূড়ান্তরকম চাপ প্রয়োগ শুরু করবে এই আশায়, যেন দেয়াল ভেদ করে বাইরে খোলা আকাশের নীচে আবৃত্তিকারী ওই কবির সুমিষ্ট কন্ঠস্বরটি তার কানে আসে। এরপর অবশ্য ঘুম তাকে প্রবল আবেশে জড়িয়ে নেয় এবং জাগ্রত হওয়া পর্যন্ত আর কিছুই মনে থাকে না তার।
সে যখন জাগে,তখন সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ভাই-বোনেরা তার দিকে সটান শুয়ে গভীর ও উচ্চস্বরে নাক ডাকতে থাকে। সে তার মুখের ওপর থেকে একটি ভয় ও দ্বিধামিশ্রিত বোধের সাথে কম্বলটা সরায়। কারণ সত্যিই সে এভাবে মুখ ঢেকে ঘুমুতে অপছন্দ ও ঘৃণা করে। কিন্ত তবু তা ঢেকে রাখার কারণ হচ্ছে, সে খুব ভালোভাবে বিশ্বাস করে,যদি রাতের বেলা মুখ খোলা রেখে ঘুমায় এবং শরীরের একটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গও কোনোভাবে খোলা রাখে, তাহলে তা বাড়ির প্রতিটি অংশে বসবাসকারী অসংখ্য অশুভ ভূতপ্রেতের জন্য মায়া দেখানো হবে। যারা বাড়ির প্রতিটি ফাটল, কোণ ও চিড়ের ভেতর পরিপূর্ণ। তবে ভোরের উজ্জ্বল আলো ও পৃথিবীতে মানুষের আলোড়ন ও নড়াচড়া শুরু হওয়ার সাথে সাথে অতল ভূগর্ভে নামতে বাধ্য হয় এরা। কিন্তু যখনই আবার সূর্যটা তার শেষ দিগন্তে অস্ত যেতে শুরু করে, মানুষ তাদের বিশ্রাম স্থানে অবসর গ্রহণে যায়। যখন বাতিগুলো নিভে যায়, কণ্ঠস্বরগুলো নিস্তব্ধ হয়, তখন পুনরায় সে প্রেতাত্মারা ভূগর্ভ থেকে পৃথিবীর বুকে বেরিয়ে আসে এবং হৈচৈ ও ব্যতিব্যস্ততায় আকাশ-বাতাস ভরিয়ে তোলে। ফিসফিস ও তীক্ষ্ম চিৎকার করে।
ফলে প্রায়শই সে হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে যেত এবং কাক ও মুরগির ডাকাডাকির আওয়াজ শুনতো। তখন খুব আকুলভাবে এসব বিবিধ স্বরের পার্থক্য করার চেষ্টা করতো সে। কারণ কখনো কখনো তা সত্যিই মোরগের কো কো শব্দ হতো ঠিক; অন্যথা এগুলো ছিল ওসব ভূতপ্রেত; যারা মানুষকে প্রতারিত ও জ্বালাতন করার জন্য তাদের আকৃতি ধারণ করে। যাহোক, এ নিয়ে অবশ্য সে তেমন মাথা ঘামায়নি এবং তাদের ব্যাপারে খুব বিরক্তবোধও করেনি। কারণ এই শব্দগুলো বহুদূর থেকে তার কাছে পৌঁছাতো। কিন্ত মূলত যা তাকে ভয় দেখাতো; তা ছিল অন্য এমন কিছু শব্দ; খুব কষ্টে যেগুলো সে বুঝতে ও পার্থক্য করতে পারতো। সেসব শব্দগুলো বেশ আলতোভাবে রুমের প্রান্তসমূহ থেকে নির্গত হতো। তাদের কিছু চুলোয় বসানো কেতলির ভেতর ফুটন্ত পানির হিসহিস শব্দের মতোন। অন্য শব্দগুলো ছিলো জিনিসপত্র একস্থান হতে অন্যস্থানে সরানোর আওয়াজের মতো। এছাড়া অন্যরা যেন আবার কাঠচেরা ও ডালপালা ভাঙার শব্দের মতো আওয়াজ করতো।
কিন্তু তার সবচেয়ে কঠিন ভয়টি ছিল কল্পনায় থাকা তার ওই অজ্ঞাত ব্যক্তিটির ব্যাপারে, যে কিনা দরজায় দাঁড়িয়ে ভেতর থেকে কামরাটি বন্ধ করে দেয়। তারপর দরবেশদের ক্রিয়াকলাপের মত অদ্ভুত নিনাদ করতে থাকে। তার দৃঢ়বিশ্বাস, এসব ভয়ঙ্কর উপস্থিতি ও ভীতিসঞ্চারিত আওয়াজসমূহ থেকে কোনরূপ সুরক্ষা নেই তার; যদি না মাথা থেকে পা পর্যন্ত পুরো শরীরকে কম্বলের নীচে ঢেকে নেয়। ফলে ছোট কোনো ছিদ্রও বাকি রাখে না সে। কারণ কোনোভাবে যদি একটি ফুটোও ফাঁক রাখে, তাহলে তা দিয়ে দুষ্ট ভূতের আত্মা ভেতর প্রবেশ করে তার শরীর ধরে ফেলবে এবং তাকে বশ করবে।
তাই এসব কারণে ঘুম আসা পর্যন্ত সে তার রাতগুলো প্রবল ভয় ও কাঁপুনির ভেতর কাটাতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্ত কোনোভাবেই সে খুব বেশি ঘুমাত না। সাধারণত প্রত্যহ খুব ভোর ও ভোরের প্রথম রশ্মি ফোটার সাথে সাথেই জেগে যেত। আর রাতের প্রধান একটি অংশ ওই ভূতপ্রেতের ভয়েই কাটাত; যতক্ষণ পর্যন্ত না ওই নারীদের কণ্ঠস্বর শুনতে পেত, যারা ভোরবেলা পুকুর থেকে তাদের জলপাত্রগুলো পূর্ণ করে বাড়ি ফিরে আসত এবং গান গাইতো, ‘আল্লাহ ইয়া লাইল আল্লাহ।’ মূলত এর মাধ্যমে সে জানতে পারতো ভোর উঁকি দেয়া শুরু করেছে। সেইসাথে অশুভ আত্মারাও তাদের ভূগর্ভস্থ আবাসে যাচ্ছে। এরপর সে নিজে নিজেই এক ভূতে রূপান্তরিত হয় এবং উচ্চস্বরে নিজের সঙ্গে কথা বলে আর ওই কবির গীতিকবিতা থেকে যা কিছু তার মনে আসে, তাই সুর করে গাইতে থাকে। সেইসাথে তার দিকে স্থির শুয়ে থাকা ভাইবোনদের ক্রমাগত কনুই দিয়ে ঠেলতে থাকে যতক্ষণ না তাদের জাগিয়ে তোলে। সুতরাং যখনই সে তা সম্পন্ন করে, তখন পুরো রুমজুড়ে হৈচৈ আর চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়। আর তা কেবল তখনই ক্ষান্ত হয় যখন শায়খ; মানে তাদের বাবা তার বিছানা ছেড়ে ওঠেন এবং নামাজের আগে পবিত্রতা অর্জনের জন্য এক জগ পানির নির্দেশ দেন।
এরপর হঠাৎ যেন সমস্ত কণ্ঠস্বরগুলো স্তব্ধ হয়ে যায় এবং চারপাশের সমূহ বিচলন কিছুক্ষণের জন্য পুরোপুরি নিশ্চল হয়ে রয়। যতক্ষণ পিতা তার ধর্মীয় প্রার্থনা জারি রাখেন। মোনাজাত ও কোরানের বিশেষ কোনো অংশ পাঠ করেন। এরপর চা পান করে কাজে বেরিয়ে যান। তখন ক্ষণকালের অপেক্ষা মাত্র; কারণ যেই বাবার পেছনে দরজাটা বন্ধ হয়; অমনি পুরো পরিবার হৈচৈ করে তাদের বিছানা ছেড়ে ওঠে এবং সারা বাড়ি হৈ-হুল্লোড় করে মাতিয়ে তোলে। যেন বাড়ির অন্যান্য পাখি আর পশুদের সাথে মিশে যায় তাদের কোলাহল।
~…~
* শায়খ অথবা শাইখ : আক্ষরিকভাবে এর অর্থ হলো ; বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি। বেদুঈনদের মাঝে কোনো জাতি বা গোত্রের প্রধান আর প্রগতিশীল আরবদের মাঝে ধর্মীয় মান্য ব্যক্তিদের বোঝায়; যেমন দরবেশ। অবশ্য এছাড়াও শায়খ শব্দের আরও অর্থ আছে।যেমন এর দ্বারা সাধারণ ধর্মীয় প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদেরও বোঝায় (যেহেতু ইসলামে কোনো পুরোহিত বা যাজক নেই)। এখানে অবশ্য শায়খ শব্দটি নিছকই লেখকের পিতার সম্মানার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যিনি পরিবারের প্রধান ও এমন একজন যিনি কোরান মুখস্থ করেছেন।