
সময়টা ১৯২৫ সন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ। নয় মাস জেল খেটে এডল্ফ হিটলার ইতিমধ্যে বেশ আলোচিত ব্যক্তিত্ব। জেলে বসেই তিনি লিখে ফেলেছেন আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘মাই ক্যাম্ফ’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিটলার তখন তৈরি হচ্ছেন। নিজেকে নিজে তিল তিল করে গড়ে তুলছেন। জার্মানির বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে জ্বালাময়ী ভাষণ দিচ্ছেন। সেই ভাষণ নাগরিকদের ওপর ভীষণ প্রভাব ফেলতো। হিটলার ভাষণ দিয়ে জনগণকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে পারতেন। জনগণ তার কথায় বিশ্বাস করতো এবং তার কথায় উজ্জীবিত হতো। তার ভাষণগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার পেছনে ছিল কঠোর পরিশ্রম। হিটলার ভাষণের প্রস্তুতি নিতেন, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অনুশীলন করতেন। তিনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণের মহড়া দিতেন যাতে নিজেকে নিজে দেখে শুধরে নিতে পারেন। ভাষণের সময় অঙ্গভঙ্গি যথার্থ ও কাঙ্ক্ষিত হচ্ছে কিনা সেবিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে তিনি পাশে রাখা শুরু করলেন জার্মান আলোকচিত্রী হেনরিখ হফম্যানকে। হফম্যান ছিলেন নাৎসি বাহিনীর দাপ্তরিক আলোকচিত্রী।
হফম্যানের কাজ ছিল- হিটলার ভাষণের মহড়া দেবেন, তিনি তার ছবি তুলবেন। সেই ছবি দেখে হিটলার ঠিক করবেন, পোজ ঠিক হয়েছে কিনা। হেনরিখ লেগে পড়লেন কাজে। এভাবে অনেক ছবিই তুললেন তিনি। কিন্তু সমস্যা হলো, হিটলার হফম্যানকে সাফ জানিয়ে দিলেন ছবিগুলো নষ্ট করে ফেলতে হবে। হফম্যানের তো আকাশ থেকে পড়ার মতো অবস্থা! হিটলার চান না এসব ছবি জনপরিসরে প্রকাশিত হোক। হিটলারের বোধ হয় আশঙ্কা ছিল, এসব ছবি দেখে মানুষ ভাববে তার ভাষণগুলো মেকি। হফম্যান বুকের ওপর পাথর রেখে বললেন, তাই হবে। হফম্যান জানতেন এসব ছবি ঐতিহাসিক ও ভীষণ দুর্লভ। তিনি ছবিগুলো নষ্ট করলেন না। হিটলারের আদেশের প্রতি শ্রদ্ধার কারণেই হোক বা নাৎসিদের ভয়েই হোক, হফম্যান হিটলারের জীবদ্দশায় ছবিগুলো প্রকাশ করেননি।

হিটলারের মৃত্যুর প্রায় এক দশক পর ১৯৫৫ সনে হফম্যান ‘হিটলার ওয়াজ মাই ফ্রেন্ড’ শিরোনামে একটি স্মৃতিচারণমূলক বই বের করেন। সেই বইয়ে তিনি হিটলারের সেই ভাষণের মহড়ার ছবিগুলো প্রকাশ করেন। ইতিহাস ও আলোকচিত্রকলার দুনিয়ায় ঝড় তোলে বইটি।
বইয়ের ছবিগুলোতে অন্য এক হিটলার ফুটে উঠেছে। হিটলারের অজানা এক অধ্যায় মেলে ধরেছিলেন হফম্যান। বইটি সম্পর্কে ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ রজার মুরহাউস লিখেছেন, ‘এখন যখন হিটলারের ভাষণগুলো শুনবেন, দেখবেন ভাষণে তিনি ক্রুদ্ধ, পাগলের মতো, কিন্তু আমরা জানি (এই ছবিগুলোর মাধ্যমে) এই ভাষণগুলো এসেছে ভীষণ বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে। হিটলার কিভাবে অনুশীলন করতেন তা গভীরভাবে বুঝতে এই ছবিগুলো সাহায্য করে। হিটলার ছিলেন একজন শোম্যান। জনগণের কাছ থেকে নির্দিষ্ট প্রতিক্রিয়া পেতে তিনি অঙ্গভঙ্গির চর্চা করতেন।’
হিটলারেরর ছবি বলতে যে ছবিগুলো আমরা দেখি তার অধিকাংশই হফম্যানের তোলা। হিটলারেরর পোরট্রেট ছাড়াও নাৎসি বাহিনীর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ছবি তিনি তুলেছেন। সেসব ছবি নানা মিথ্যা প্রচারণায়ও ব্যবহার করেছে নাৎসিরা। প্রধানত হফম্যানের ছবি দিয়েই দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়েছে হিটলারের নায়কসূলভ প্রতিকৃতি। বলা হয়ে থাকে তিনি নাকি হিটলারের বিশ লাখেরও বেশি ছবি তুলেছিলেন। এতো ছবির খবর কে রাখে! কালের গর্বে হারিয়ে যায় অনেকটা, থেকে যায় কিছু, নিঃসন্দেহে ভাষণের মহড়ার ছবিগুলো সেই ‘কিছু’র মধ্যে পড়ে। এতো কিছুর পরও হফম্যানের নাম ইতিহাসে লেখা থাকবে একজন দুর্জন ব্যক্তি হিসেবেই।