সপ্তা দিন হলো—যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল নগরীর কাছাকাছি মাউন্ট রেনেয়ার নামক প্রচ্ছন্ন একটি আগ্নেয়গিরি সংলগ্ন উপত্যকায় বাস করছি। উদ্দেশ্য— ব্যাকপ্যাকে তাঁবু ও শুকনা খাবার ইত্যাদি নিয়ে দিন কয়েকের হাইকে পর্বতটির তুষারের শ্বেতশুভ্র উষ্ণীশ পরানো চূড়ার দিকে উঠে যাওয়া। এ যাত্রায় আমি একা নই, আমার ভ্রমণসঙ্গী স্কারলেট পেশায় পার্টটাইম ড্যান্সার। হার্ডকোর হাইকিংয়ে অভিজ্ঞ এ তরুণী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সতীর্থও। যেহেতু আমার ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপক হাইকিং এর অভিজ্ঞতা নেই, তাই আমরা সীমিত দূরত্বের ছোটখাট দুটি হাইকে ওয়ার্ম-আপ করে নিয়েছি। গতকাল একটি হাল্কা উড়োজাহাজে চেপে আকাশ থেকে পাহাড়টিকে ঘন্টা খানেকের মতো পর্যবেক্ষণও করেছি।
উপত্যকায় একজন আদিবাসি নারী টিপি বলে এক ধরনের তাঁবু পর্বতে উঠতে চাওয়া হাইকারদের কাছে ভাড়া দিচ্ছেন। তো আমি ও স্কারলেট একটি টিপিতে রাত কাটাচ্ছি, ওখানে বাস করে আস্তে-ধীরে মাউন্ট রেনেয়ারে হাইকিং এর প্রস্তুতি নিচ্ছি। তো টিপির বাইরে চা এর মগ হাতে গাছের কাটা গুড়ির উপর বসেছিলাম। সামনে— তিনটি মাঝারি সাইজের বোল্ডারে তৈরী চুলা থেকে উড়ছে ধোঁয়া, তবে অংগারগুলো মিইয়ে ধূসর হয়ে এসেছে। একটু আগে স্কারলেট ও আমি ওয়াটার হৌলে ভোরের প্রথম আলোয় স্নান সেরে এ চুলাতে কেতলি বসিয়ে তৈরী করেছি চা। রোদ এখনো চড়া হয়নি, কাকভোরে গোসলজনিত কারণে শরীর দারুণভাবে ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিলো, সুরুযের তরতাজা কিরণ তাতে এখন যেন বুলিয়ে দিচ্ছে পশমের চামর।
অতি ভোরে অবগাহনের আইডিয়াটা স্কারলেটের। ঘন্টা দুয়েক অপেক্ষা করে জোরেশোরে রোদ ওঠলে পর স্নান সারলেই চলতো। কিন্তু শেষরাতে, টিপির পেছনের আউটডোরেে— ঘাসে পড়ে থাকা ঝরা ঔক পাতার স্তূপকে এলোমেলো করে দিয়ে আমাদের অন্তরঙ্গ মিথস্ক্রিয়ার পর সুরুষ ওঠা অব্দি আমরা স্রেফে কথা বলে কাটালাম। তারপর স্কারলেটের করোটিতে পাথুরে টিলা চুঁয়ে নেমে আসা জলে সৃষ্ট ওয়াটার হৌলে সূর্যোদয়ের সময় স্নানের বাই চাপলো। সে জোরালোভাবে ইনসিস্ট করে বললো, ‘উই উইল বি হাইকিং ডেইজ আফটার ডেইজ ইন দ্য রাফ রিজ অব মাউন্ট রেনেয়ার, ওখানে তো চাইলেই হট শাওয়ার নেয়ার জন্য বাথরুম পাওয়া যাবে না।
আমাদের ওয়াটার হৌল, ঝর্ণা বা পাহাড়ি ছড়ানদীে— যেখানে যা জোটে ওখানেই স্নান করতে হবে। সুতরাং রাফ একটি ওয়াটার হৌলে গোসল করার অনুশীলনটা হয়ে যাক। সো ইউ উইল নট বি সুপার সারপ্রাইজড হোয়েন দেয়ার উইল নট বি এ্যানি ফেসিলিটিজ্ ফর টেইকিং আ বাথ।’ শেষ রাতের ব্যাপারটার পর আমার মুড বেজায় ভালো ছিল, তাই তার প্রস্তাবে চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই রাজি হই। ধলপহরের আধো-আলোয় আমরা বুনো ট্রেইল ধরে মিনিট দশেক হেঁটে গিয়ে ওয়াটার হৌলে পৌঁছি। আমাদের পদশব্দে দুটি প্রাণীে— সম্ভবত কায়োটি কিংবা শৃগাল জল ছেড়ে লাফিয়ে সরে যায় জংগলে। আমরা পাড়ের সবুজ মসে ছাওয়া পাথরে বসে মাউন্ট রেনেয়ারের তুষারাচ্ছন্ন সামিটের দিকে নিশানা করে তাকিয়ে থাকি।
মিনিট সাতেকের ভেতরে— দারুণ কোন সামাজিক অর্জনে মন-মেজাজ ভালো হয়ে যাওয়ার মতো পাহাড়ের তুষার ছাওয়া চাঁদিটি অরুণিম হয়ে ওঠে। আমাদের অপেক্ষা করতে হয় আরো কিছুক্ষণ, তারপর বনভূমি উদ্ভাসিত করে দিয়ে আলোর অজস্র কিরণরেখা ওয়াটার হৌলটিকে ঝলমলে করে দেয়। তখন পাইন তরুর সবুজাভ প্রেক্ষাপটে বরফ গলা হোয়াট রিভারসহ ধবল গিরিটিকে প্রায়-পূর্ণাঙ্গভাবে অবলোকন করার সুযোগ হয়। ভাঁপ ওঠা জলে নামতে গিয়ে আমার খেয়াল হয়, টিপি থেকে সুইমিং ট্রাংক নিয়ে আসিনি। একটু অবাক হই, স্কারলেটের এসব নিয়ে কোন হেলদোল নেই দেখে! সে দিব্যি নিরাবরণ হয়ে তার জিন্স, টিসার্ট ও অন্তর্বাস পাথরে রেখে জলে নামার উদ্যোগ নেয়। আমার দ্বিধা তার অগোচর থাকে না। সে আমার কব্জি ছুঁয়ে বলে,‘দিস ইজ কল্ড স্কিনি ডিপিং, উই আর ইন নেচার, লেটস্ বি পার্ট অব ইট, এ নির্জন ভোরে সুইমিং ট্রাংক পরে জলে নামার পোষাকি শিষ্টাচারের খুব প্রয়োজন আছে কী?’ আমি বিরুদ্ধাচারণ করে এ মুহূর্তে স্কারলেটের মুড অফ করে দিতে চাই না। তাই পরিবেশ ও পরিস্থিতির সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করে ইহ-জীন্দেগীতে সর্বপ্রথম বিবস্ত্র হয়ে জলে নামি।
চুলায় আগুন দিয়ে চা করে স্কারলেট আমাকে উষ্ণ হতে সাহায্য করেছে বটে, কিন্তু বেশিক্ষণ অগ্নিকুন্ডের কাছে দাঁড়িয়ে থাকেনি। আদিবাসি নারীর ট্রেইলারের সাথে ঠেকা দিয়ে রাখা একটি জং-ধরা বাইসাইকেল নিয়ে সে বেরিয়ে গেছে। কাছাকাছি একটি লগ কেবিনে নাকি বাস করছে ঘোড়া হাঁকানো এক কাউবয়, সে হাইকারদের ঘোড়া ও মাউন্টেনবাইক ভাড়া দেয়। স্কারলেট খোঁজ নিতে গেছে, যদি দুখানা মাউন্টেনবাইক পাওয়া যায় আজকে ফুটহিলসের বুনো টেরেইনে এক্সকারশনের জন্য।
ফুটহিলস্ ছেড়ে মাউন্ট রেনেয়ারের খাস মহলে হাইক শুরু করতে কেবলই দেরি হচ্ছে, ওয়াটার হৌলে যাওয়ার পথে এ নিয়ে আমি অনুযোগ করছিলাম। সে আমার অধৈর্য হওয়ার বিষয়টা আমলে এনে ব্যাখ্যা করে বলেছে, ‘লুক, ইউ নেভার হাইকড্ ইন সাচ আ হাই এলিভেশন, সমুদ্র পৃষ্ট থেকে অনেকটা উঁচু পরিবেশে দিন কয়েক বাস করে, শর্ট রেঞ্জের ছোট-খাট হাইক করে প্রতিবেশের সাথে শরীর খাপ খাইয়ে নিলে… ইউ নো হোয়াট? ইউ উইল ডু বেটার ইন টার্মস্ অব ডুয়িং হার্ডকোর হাইকিং।’ শুনে প্রতিক্রিয়ায় আমি মৌণ থাকি, সে তখন আরেকটি যুক্তি হাজির করে, ‘চূড়ার দিকে হাইক করার সময় পাহাড়ি টপোগ্রাফির জন্য তোমার ভিজ্যুয়েল রেঞ্জ থাকবে সীমিত। সব সময় অত্যন্ত ফোকাসডভাবে নজর দিতে হবে ট্রেইলের দিকে, মাউন্ট রেনেয়ারকে…উইথ অল ইটস্ টোটালিটি…পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে না। সুতরাং ফুটহিলসে আমরা যদি খানিক হাইক বা মাউন্টেন বাইকিং করি, ইট উইল এলাও আস টু সি দ্য গ্রেট বিগ মাউন্টেন উইথ সাম হোয়াট টোটালিটি, ইউ নো…ওয়ান ক্যান গেট আ হলিস্টিক ভিউ অনলি ফ্রম আ লিটিল ডিসটেন্স।’ আমি ইতোপূর্বে কখনো মাউন্টেনবাইকে চড়িনি, এ বিশেষ ধরনের দ্বিচক্রযান নাকি পাহাড়ি টেরেইনে অনেকগুলো গিয়ারের সহায়তায় দিব্যি পথ চলে, বিষয়টি আমাকে কৌতূহলী করে তুলেছে।
আমি স্কারলেটের ফিরে আসার অপেক্ষায় চা পান করতে করতে গত রাতের কথা ভাবি। হাল্কা প্লেনে উড়াউড়ি করে আমি টিপিতে ফিরি তীব্র মাথা ব্যাথা নিয়ে। এনালজেসিক ট্যাবলেটেও প্রশমিত হয় না মাইগ্রেনের তুমুল কষ্ট। স্কারলেট ঘাড় ও গলা বার বার ম্যাসেজ করে দেয়, তাতে ফায়দা কিছু না হলে সে উষ্ণ জলের কমপ্রেস দিয়ে ঘাড় মালিশ করতে থাকে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলামে— ঠিক বুঝতে পারিনি। জেগে ওঠি সম্ভবত মাঝরাতে। অনুভব করি, স্কারলেট পাশে নেই। টিপির ওপেনিং দিয়ে ঢুকছে জোৎস্নার উজ্জ্বল আভা। তাতে আধশোয়া হয়ে বসে থাকা নারী দেহের ছায়া ফুটে ওঠেছে টিপির সাদা দেয়ালে। আমি জানতে চাই, ‘হোয়ার আর ইউ স্কারলেট?’ লাইটার দিয়ে মোম জ্বালে সে। ব্যাকপ্যাকে হেলান দিয়ে বসে সারা শরীরে যেন জোৎস্নার রেণুকা মাখছে। আমরা টুকটাক কথা বলি। মাইগ্রেনের উপশম হয়েছে বুঝতে পেরে সে জানতে চায়, ‘ডু ইউ নো দ্য কজ অব ইয়োর হেডেইক…, শিকড়চ্যুত হয়ে তুমি ঘুরে বেড়াচ্ছো, ইজ দিস টিগারিং ইউ মাইগ্রেন?’ একটু ভেবে আমি জবাব দেই, ‘আই ডোন্ট রিয়েলি নো দ্য আনসার, হানি। এই হাইকিং ট্রিপের অনেক কিছুই আমার কাছে অনিশ্চিত মনে হচ্ছে, আই ডোন্ট সি ইন মাই মাইন্ড, হাউ দিস ইজ গোয়িং টু ওয়ার্ক… আনসার্টেনিটি আমার মাঝে তৈরী করে স্ট্রেস।’
মোম হাতে আমার দিকে ঝুঁকে এসে সে মন্তব্য করে, ‘লুক, হাইকিং এর অভিজ্ঞতা ঠিক নাটকের মতো না যে স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী একটার পর একটা অংক মঞ্চে অভিনিত হবে। স্ট্রেনুয়াস লং রেঞ্জ হাইকিংস্ আর ইউজ্যুয়েলি ফুল অব আনসার্টেনিটিজ্, এ অনিশ্চয়তাকে কীভাবে মোকাবেলা করতে হবে, কীভাবে অতিক্রম করতে হবেে— এটা কিন্তু আমাদের সবাইকে হাইক করে করে হাতেকলমে শিখতে হয়, আর ইউ ইন্টারেস্টেড টু লার্ন?’ আমি একটু রেগে গিয়ে জবাব দেই, ‘হেল ইয়েস, আই অ্যাম সার্টেনলি ইন্টারেস্টেড টু লার্ন, বাট ডোন্ট রিয়েলি নো হাউ টু?’ সে আরও কাছে ঘেঁষে এসে বলে, ‘আই অ্যাম ডিপলি ইন্টারেস্টেড টু হেল্প ইউ… ডু ইউ হ্যাভ কনফিডেন্স অন মি… আই মিন, ক্যান ইউ ট্রাস্ট মি?’ আমি জোর দিয়ে জবাব দিই, ‘ইয়েস’, সাথে সাথে খেয়াল করি, সে সিল্কের একটি লনজারে পরে আছে, এ রেশমী নৈশবস্ত্রে ধূসর আঁকিবুকিতে বুকের কাছে যেন পাখির বাসার মোটিফ আঁকা, তাতে অর্ধ-উন্মোচিত স্তনযুগলকে দেখাচ্ছে নীড়ে নিবিড় হয়ে বসে থাকা জোড়া কবুতরের মতো।
আমি অন্তরঙ্গ হওয়ার জন্য হাত বাড়ালে সে কাছে এসে ফিসিফিসিয়ে বলে, ‘ইউ আর ট্রাস্টিং মি, দিস ইজ আ টার্নিং পয়েন্ট ইন আওয়ার রিলেশনশীপ। লেটস্ সেলিব্রেট দিস।’ আমি কৌতূহল নিয়ে তার উদ্দেশ্য বুঝতে চেষ্টা করি। স্কারলেট হামাগুড়ি দিয়ে ব্যাকপ্যাকের পকেট থেকে বের করে নিয়ে আসে একটি কৌটা ও ছোট্ট গোলাকার হাত-আয়না। কী ঘটতে যাচ্ছে তা বুঝতে পেরে আমার মধ্যে এক্সাইটমেন্ট ছড়ায়। রাঙতার মোড়ক খুলে অতি সামান্য ঝকঝকে শুভ্র ডাস্ট আয়নার সারফেসে রাখতে রাখতে সে বলে,‘দেয়ার ইজ আ ভেরি লিটিল লেফ্ট। লং রেঞ্জ হাইকের সময় এ ধরনের হার্ডকোর জিনিস সাথে রাখা ঠিক না। লেটস্ সেলিব্রেট এন্ড ফিনিস ইট।’ আমরা উৎসাহের সাথে সেভেনাপের স্ট্রো দিয়ে শুভ্র চুর্ণ টেনে নেই নাসারন্দ্রে। খানিকক্ষণ ঝিম ধরে বসে থেকে চোখ খুলতেই দেখি, টিপির ছাদ চাঁদের আলোয় প্ল্যানেটেরিয়ামের স্ক্রিনের মতো উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে। ওখানে কোন কিছুকে কেন্দ্র না করে এলোপাথাড়ি ঘুরছে আমাদের চেনাজানা প্রতিটি গ্রহের গোলাকার বিবিধ বর্ণের প্রতীকী অবয়ব।
একটু তফাতে স্কারলেট ফের ব্যাকপ্যাকে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়েছে। সল্প ঝুলের লনজারে-টপ খানিক সরে যাওয়াতে উন্মোচিত হয়েছে সিল্কের কালো প্যান্টি। তাতে সলমা-চুমকি দিয়ে নকশা করা হার্ট শেইপ এর আকৃতিটি জোৎস্নায় মৃদু মৃদু ঝলকাচ্ছে। আমি তার শরীরের বঙ্কিমতায় সৃষ্ট রেখাচিত্রকে অবলোকন করি। সচেতন হয়ে উঠে বসে স্কারলেট ফিক করে হেসে বলে, ‘আই অ্যাম নট এন আর্ট অবজেক্ট, ডোন্ট ওয়াচ মি প্লিজ, ইফ ইউ আর ইন্টারেস্টেড, কাম এন্ড কানেক্ট উইথ মি…।’ আমি তাকে স্পর্শ করি, সে ঘন হয়ে আরো কাছে এসে বলে, ‘ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড, ইট ইজ দ্য ইমোশন দ্যাট ম্যাটারর্স…।’
দ্রুত তার মুড পাল্টায়। উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘ইট ইজ আ বিট হট এন্ড স্টাফি ইনসাইড দ্য টিপি। চল, বাইরে গিয়ে একটু খোলা হাওয়ায় দাঁড়াই। উই উইল ফিল বেটার।’ আমরা বাইরে আসি। মেঘমালায় রঙধনুর আবছা বৃত্ত এঁকে অস্ত যাচ্ছে চাঁদ। স্কারলেট ঔক গাছের নিচে ঘন ঘাসে শুয়ে পড়ে বলে, ‘ডোন্ট বি টেন্স… চেষ্টা করো, টিপির বাইরে প্রকৃতির খোলামেলা আবহে আছে যে অঢেল ফ্রিডম, ট্রাই টু এনজয় ইট।’
একটু শীতের অনুভূতি হতেই অতঃপর আমরা ফিরে যাই টিপিতে। ভোর হতে সামান্য বাকি। স্কারলেট ঝলমলে গিফ্ট র্যাপার খুলে বের করে আনে লম্বাটে ত্রিভূজাকৃতির একটি স্ইস চকোলেট বার। তা ভেঙ্গে খেতে খেতে জানতে পারি যে— ড্যান্স পারফরমেন্সের পর সুপার সুইট আহার্যটি তার এক গুণমুগ্ধ দর্শক তাকে উপহার দিয়েছে। সে চুষে খেতে খেতে বলে, ‘দ্য সুইস চকোলেট ইজ কুল, বাট আই ডোন্ট রিয়েলি রিমেমভার দ্য নেইম অর ইভেন দ্য ফেস অব দিস ফ্যান হু গেইভ মি দিস… নো মেমোরি এ্যট অল।’ চকোলেট এর টুকরাটি আমি উপভোগ করি, আমার করোটিতে একটি নিগেটিভ ভাবনা ফিরে আসে, আমি সচেতন যে— নারী-পুরুষের সম্পর্ক চিরায়ত কিছু নয়। একদিন স্কারলেটের সঙ্গে আমার ব্রেকআপ হবে। তার ব্যাকপ্যাকে আমার দেয়া একটি ছোটখাট গিফ্ট যত্নে রাখা আছে। যখন আমরা কাছাকাছি থাকবো না, তখন আমার দেয়া সেন্টিমেন্টাল উপহারের দিকে তাকিয়ে সে কী আমার মুখখানা মনে করতে পারবে? সে আমার মুখের দিকে গাঢ়ভাবে তাকিয়ে চুলের মুঠি ধরে কাছে টেনে নিয়ে কী যেন নিরিখ করে দেখে বলে,‘ওয়াইপ আউট অল দ্য নিগেটিভ থট ফ্রম ইয়োর হেড। আমি জানি আনসার্টেনিটি তোমাকে পীড়া দিচ্ছে। লেটস্ ডু সামথিং রিয়েলি আনসার্টেন টুডে… পূর্বপরিকল্পনা ছাড়া এমন কিছু করার চেষ্টা করি, যাতে অসফল হওয়ার রিস্ক থাকবে। লেটস্ এক্সিপিরিয়েন্স দিস টুগেদার… এ অভিজ্ঞতা আখেরে আমাদের ফিজিক্যালি চ্যালেনজিং হাইকের অনিশ্চয়তাকে ম্যানেজ করতে সাহায্য করবে।’ সে মাউন্টেনবাইকে চড়ে ফুটহিলসের রাফ টেরেইনে ঘুরপাক করার প্রস্তাব দেয়। আমি চ্যালেঞ্জ গ্রহন করি।
ঝরা পাতায় ছর ছর শব্দ তুলে জং-ধরা বাইসাইকেল চড়ে ফিরে আসে স্কারলেট। না, কাউবয় এর মাউন্টেনবাইকগুলো পাওয়া যায়নি, আর্লি সানরাইজ দেখতে আগ্রহী হাইকাররা তা অলরেডি ভাড়া করে নিয়ে গেছে। ‘লেটস্ ট্রাই সামথিং ডিফরেন্ট, ধোঁয়া ছড়ানো আদ্যিকালের স্টীম ইঞ্জিনে টানা রেলগাড়িতে তোমার আগ্রহ আছে কী? এ ট্রেন ট্রিপে আছে রিভার ক্রসিং, ওখান থেকে উপত্যকাসহ মাউন্ট রেনেয়ারের প্রায় সামগ্রিক ভিউ পাওয়া যায়।’ আমি আগ্রহ দেখিয়ে বলি, ‘সাউন্ডস্ কুল টু মি।’ স্কারলেট ইশারা দিয়ে বলে ‘দেন লেটস্ গেট রেডি ইন ফাইভ টু সেভেন মিনিটস্। আমাদের এলবি বলে একটি ছোট্ট হিল টাউন থেকে ট্রেন ধরতে হবে।’ মাউন্টেনবাইক না পাওয়ার ডিসঅ্যাপোয়েন্টমেন্ট আমাদের বিশেষ একটা আফেক্ট করছে না দেখে আমি খুশি হই।
রেডি হতে স্কারলেট একটু সময় নেয়। সে হিপ হ্যাগার জিন্সের সাথে ডিজাইনার বুট পরে টিপির বাইরে আসে, চুলে বাঁধা ব্যানডেনার সাথে কালার কর্ডিনেট করে পরা মভ রঙের সিল্কি টপে তাকে লাভলি দেখায়। সড়কের দিকে হাঁটতে হাঁটতে সম্ভাব্য রেল-যাত্রা সম্পর্কে সে টুকটাক তথ্য দেয়। ক্রিসমাসের সময় উপহার হিসাবে তার মা-বাবা তাকে মাউন্ট রেনেয়ার রেল-রোডে শুধুমাত্র পর্যটক নিয়ে চলা বিশেষ রেলগাড়ির দুটি টিকিট পাঠান। তাদের প্রত্যাশা— মেয়ে যেন কোন ছেলেবন্ধুকে নিয়ে সিনিক ট্রেন রাইডটি উপভোগ করে।
আমাদের হাতে সময় আছে। স্কারলেটের ধারনা— সড়কে দাঁড়ালে হিচ হাইকার হিসাবে আমাদের কেউ না কেউ লিফ্ট দিয়ে এলবিতে পৌঁছে দেবে। তবে সামান্য একটু ঝুঁকি আছে। এ ধরনের অপেন টিকিট হলেই ট্রেনে চড়া যায় না। প্যাসিঞ্জারের নাম টেলিফোনে জানিয়ে সিট রিজার্ভ করতে হয়। এদিকে কোথাও পোস্টাফিস বা পেফোন নেই যে— স্টেশনে রিং করে সে রিজারভেশন কনফার্ম করবে। স্কারলেট আমাকে অশ্বস্থ করে বলে,‘ দিস ইজ নট দ্য টুরিষ্ট সিজন, ট্রেনে খালি সিট প্রচুর থাকবে, টিকিট কন্ডাকটারকে বললে ওরা রিজারভেশন ছাড়া ট্রেনে চড়তে দিতে আপত্তি করবে না। বাট, স্টিল দেয়ার ইজ আ লিটিল রিস্ক, যদি ট্রেনে সিট খালি না থাকে?’ আমি এ নিয়ে আগেভাগে উদবিগ্ন হতে চাই না, বলি, ‘নেভার মাইন্ড, ট্রেন চড়া না গেলে আমরা না হয় একটু ঘুরে ফিরে এলবি টাউনটির কোথায় কী— তা দেখে ফিরে আসবো। আই অ্যাম ইন্টারেস্টেড টু সি অ্যান আমেরিকান টাইনি লিটিল হিল টাউন।’
রাজপথে আমরা হিচ হাইকের প্রত্যাশায় বৃদ্ধাগুলি উর্দ্ধে তুলে দাঁড়াই। পিচঢালা পথে স্পীড তুলে ছুটছে একটি-দুটি গাড়ি, কিন্তু আমাদের লিফ্ট দিতে কেউ থামে না। মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে থাকার পর বিরক্তি লাগে। স্কারলেট ফিক করে ফিচেল হেসে তার টাক-ইন করা টপ খুলে নাভি উন্মোচিত করে গিট্টি দিতে দিতে বলে,‘আই অ্যাম গোয়িং টু সিডিউস ওয়ান অব দি স্টুপিড কার-ড্রাইভারস্ এন্ড মেক হিম গিভ আস আ রাইড।’ এবার তার দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে আসে নৃত্যশিল্পীর বঙ্কিম লাস্য। একটি রঙচটা পিকাপ ট্রাক স্কিড করে থেমে আমাদের তাতে উঠতে ইশারা দেয়। শ্বেতাঙ্গ ড্রাইভারের শরীর রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে।
তার মস্তকটি নিপাট করে কামানো। তবে দাড়িওয়ালা মুখে গোঁফ জোড়া মোমের পালিশে সুঁচালো হয়ে আছে। সামনের প্যাসিঞ্জারর্স সিটে রাখা ঝুড়ি ভর্তি পাকা চেরি। স্কারলেট সবুজ পাতাসহ এক গুচ্ছ চেরিফল তুলে ধরে জানতে চায়, ‘আর দে সুইট?’ গোঁফো ড্রাইভার দেঁতো হেসে বলেন,‘ ইয়েস দে আর, আজ সকালে ফুটহিলসে আমি মাইনিং এর জন্য সুইটেবোল জায়গা খুঁজছিলাম। তখন ঝুরঝুরে হয়ে ভেঙ্গে পড়া এক লগ কেবিনের আঙিনায় ফলন্ত একটি চেরি গাছ দেখতে পাই… এন্ড ইউ নো হোয়াট, দে আর রিয়েলি গুড, সো আই হারভেসটেড কোয়াইট আ বিট। তুমি চাইলে কিছু চেরি নিতে পারো।’ স্কারলেট সাবধানে একটি চেরি চিবায়। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে গুঁফো মানুষটি তার দিকে পলিথিনের ব্যাগ বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘গো এহেড এন্ড টেক সাম।’ স্কারলেট কিছু চেরি ফল তার ব্যাকপ্যাকে পুরে। বেশ তোড়ে পিকাপ ট্রাকটি ছুটছে।
সামনের সিটে ড্রাইভারের সাথে স্কারলেটে গালগল্পও জমে ওঠে। জানতে পারি, গুঁফো মানুষটি শখের মাইনার, অর্থাৎ তার খনিজদ্রব্য খোঁড়াখুড়ি করার লাইসেন্স আছে। তিনি সচরাচর কোন পাহাড় বা পর্বতের পাদদেশে তাঁবু খাঁটিয়ে আশপাশের সুবিধাজনক জায়গায় খোঁড়াখুড়ি করে খনিজদ্রব্যি— বিশেষ করে সেমি স্পেসাশ জ্যাম স্টোন সংগ্রহের চেষ্টা করেন। কয়েক সপ্তা ধরে তিনি তাঁবু খাটিয়ে মাউন্ট সেন্ট হেলেনার পাদদেশে বাস করছেন, কিন্তু খোঁড়াখুড়িতে তার কমিয়াবি আসেনি। তাই মাউন্ট রেনেয়ারের ফুটহিলসে সুইটেবোল লকেশন খুঁজছেন। মিনিট চল্লিশেকের স্মুদ রাইডের পর তিনি আমাদের এলবি টাউনের সেন্টারে নামিয়ে দেন। ওয়েলকাম এলবি’ লেখা সাইনবোর্ডের পাশ দিয়ে হেঁটে একটু সামনে বাড়তেই দেখি— সড়কের পাশে কাঠের ফেন্সের ওপর দিকে গলা বাড়িয়ে তাকিয়ে আছে জং-ধরা লোহার পাতে তৈরী একটি জিরাফ!
অনেকটা কলোনিয়েল যুগের হিল স্টেশনের মতো ছোট্ট টাউনটি বেজায় নির্জন। দোকানপাটে আমরা তেমন কোন তৎপরতা দেখতে পাই না। শহরের একমাত্র গ্রোসারী দোকানের সামনে পার্ক করে রাখা কটকটে হলুদ রঙের একখানা পুরোনো মডেলের ভিনটেজ কার। আমরা ঢুকে পড়ি গ্রোসারিতে। ট্রেনে ডাইনিং কার থাকবে, তবে খাবার দামে হবে অত্যন্ত এক্সপেনসিভ। মহিলা দোকানি নিজ হাতে স্যান্ডুইচ ও তরতিয়া রুটি দিয়ে ভেজি র্যাপ তৈরী করেন। তার কাছ থেকে স্কারলেট দুটি চিজ স্যান্ডুইচ, চিপস্ ও জিনজার এইল কিনে নেয়। হেঁটে আরেকটি ব্লক পাড়ি দিতেই দেখি, রেললাইনে নিরিবিলি দাঁড়িয়ে আছে ট্রেনের সবুজ রঙা একখানা অকেজো কম্পার্টমেন্ট। স্কারলেট জানায় যে, এ কমপার্টমেন্টটি ব্যবহৃত হয় হাইকারর্স লজ হিসাবে। এটার ভেতরে আছে বেশ কতগুলো বাংকবেড। তাতে হাইকাররা সল্প মূল্যে রাত কাটাতে পারে। স্টেশনের দিকে হেঁটে আসার সময় পিটে বেজায় ভারী ব্যাকপ্যাক নিয়ে বিভ্রান্তের মতো ঘুরপাক করা কয়েক জোড়া হাইকার গোছের পর্যটকদের দেখা যায়।
রেলওয়ে স্টেশনটি এমনই জনহীন যে—প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে মনেই হয় না, এখান থেকে কোথাও কোন ট্রেন যাবে বলে। স্কারলেট একটি বেঞ্চে বসে পড়ে। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে সে দূরের একটি দীর্ঘ গাছের ডালের দিকে ইশারা দেয়। ওখানে বেশ বড়সড় একটি পাখির নীড়। তাতে বসে বসে পাখা নাড়ছে সারস জাতীয় একটি পাখি। স্কারলেট ব্যাকপ্যাক থেকে বাইনোকুলার বের করে তাতে চোখ রেখে এক্সাইটেড হয়ে ওঠে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে আমার দিকে বাইনোকুলারটি বাড়িয়ে দেয়। মা পাখিটি আকারে অত্যন্ত বড়, তার নীড়টিও সুপরিসর, তাতে চারটি ছোট ছোট শাবক ঠোঁট ফাঁক করে খাবার খুঁজছে। মা-পাখিটি বার বার ডানা ঝাপটিয়ে বোধ করি তাদের অপেক্ষা করতে বলে। দেখতে দেখতে মদ্দা পাখিটি ফিরে আসে, সে ঠোঁটে করে নিয়ে এসেছে মাঝারি সাইজের মাছ। স্কারলেট তার হাতে বাইনোকুলারটি ফিরিয়ে নিয়ে বিমুগ্ধ হয়ে শাবকদের আদার খাওয়ানো দেখতে থাকে।
কোন ধরনের তৎপরতাহীন রেলওয়ে স্টেশনে স্কারলেটের পাশে বসে থেকে থেকে আমি বিরক্ত হয়ে অনুযোগ করি। চোখ থেকে বাইনোকুলার না সরিয়ে সে আশ্বস্থ করে, ‘এখনো ট্রেনের সময় হয়নি, প্লিজ বি পেসেন্ট।’ ‘কিন্তু স্টেশনও তো খুলেনি, স্কারলেট?’ সে একটু বিরক্ত হয়ে জবাব দেয়,‘এখান থেকে শুধু পর্যটক নিয়ে একটি ট্রেন সপ্তাহে মাত্র তিনবার মাউন্ট রেনেয়ার ভ্যালির মিনরেল নামে আরেকটি ছোট্ট টাউনে যায়। স্টেশন থেকে ট্রেন অব্দি সবই ম্যানেজ করে আন-পেইড ভলান্টিয়াররা। এদের সকলেরই অন্য চাকুরি-বাকরি আছে। বাট নট টু ওয়ারি মাচ, সময় হলে ট্রেনও আসবে, ড্রাইভার ও কন্ডাকটারদেরও দেখা পাওয়া যাবে।’ আরো মিনিট সাতেক স্কারলেটের পাশে বসে থেকে অধৈর্য হয়ে আমি উঠে পড়ি। কদম কয়েক সামনে যেতেই দেখি, স্টেশন ঘরটির ছায়ায় দাঁড়িয়ে ব্যাকপ্যাক পিটে পাঁচ-সাত জন পর্যটক।
টাউন সেন্টার থেকে স্টেশনে আসার পথে এদের ছন্নের মতো ঘোরাফেরা করতে দেখেছি। উৎসাহিত হয়ে আমি অন্য দিকের প্ল্যাটফর্মে আসি। স্টেশন থেকে বেশ খানিকটা দূরে প্রচুর ব্যক্তিত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি স্টিম ইঞ্জিনসহ আস্ত রেলগাড়ি দেখতে পেয়ে আমার উল্লাস চরমে পৌঁছায়। ইঞ্জিন থেকে নীল ওভারঅল পরা একজন শ্বেতাঙ্গকে নেমে আসতে দেখি। মানুষটি আমার কাছাকাছি এসে ‘হাই’ বললে আমি খুশি হয়ে জানতে চাই,‘ রেলগাড়ি ছাড়বে কখন, স্যার?’ তিনি ভুরু কুঁচকে ওভারঅলে কালিঝুলি মাখা হাত মুছতে মুছতে আমাকে নোটিশ বোর্ডের দিকে ইশারা দেন। ওখানে গিয়ে দেখিÑ টাইপ করা নোটিশে দুঃখ প্রকাশ করে ট্রেন ছাড়াতে আরো ঘন্টা খানেক দেরি হওয়ার সংবাদটি লেখা। ফিরে আসি স্কারলেটের কাছে।
সে মনযোগ দিয়ে জার্নালে এন্ট্রি লিখছে, আর থেকে থেকে কাঠপেন্সিলটি কামড়ে বাইনোকুলার দিয়ে দেখছে— নীড়ে সারস পরিবারের তৎপরতা। পাখি পর্যবেক্ষণ আমারও প্রিয় প্যাশন, কিন্তু এ মুহূর্তে শাবকদের মা-পাখির ঠোঁট থেকে মাছের টুকরা খাওয়ার বিশদ বর্ণনা জার্নালে লেখার কোন যুক্তি দেখি না। সে চোখ তুলে আমার দিকে তাকালে, আমি ট্রেন লেট হওয়ার সংবাদ জানিয়ে প্রস্তাব করি,‘ লেটস্ গো এন্ড লুক আরাউন্ড দ্য এলবি টাউন আ বিট।’ এ সাজেশনে সে উৎসাহিত না হয়ে নেতিবাচক ভঙ্গিতে বলে,‘দেয়ার ইজ নট আ হৌল লট টু সি ইন দিস টাইনি লিটিল হিল টাউন। তামার ইচ্ছা হলে একা একটু ঘোরাফেরা করো, বাট প্লিজ বি ব্যাক বিফোর দ্য ট্রেন লিভস্ধসঢ়;।’ এ মন্তব্যে আমার উষ্ণ উৎসাহে যেন ঠান্ডা পানির ছিটা পড়ে। আমি ধপাস করে বেঞ্চে তার পাশে বসে পড়ি।
জার্নাল লেখা থেকে সে ফের চোখ তুলে বলে, ‘নো, ইউ ডোন্ট হ্যাভ টু সিট নেক্সট টু মি এন্ড ওয়াচ দ্য বার্ডস্ ইফ ইউ ডোন্ট ওয়ান্ট।’ আমি আমসি মুখে রিয়েক্ট করি,‘ কী করবো এখানে স্কারলেট, হোয়াট উড ইউ সাজেস্ট মি টু ডু?’ সে অন্যমনষ্কভাবে জবাব দেয়, ‘গো এন্ড ওয়াক আরাউন্ড আ বিট এন্ড টক উইথ পিপুল… দিস উইল হেল্প ইউ টু ইনপ্রুভ ইয়োর স্যোশাল স্কিল।’ আমি উঠে পড়ে প্ল্যাটফর্মের অন্য দিকে যেতে যেতে স্কারলেটের মুড পরিবর্তন নিয়ে ভাবি। আমি সচেতন যে, তার মধ্যে স্ট্রেস তীব্র হলে সে জার্নাল লেখার অজুহাতে একা হয়। আমাদের টিকিটের রিজারভেশন কনফার্ম করা হয়নি, এ কারণে কী তার মধ্যে দানা বাঁধছে উদ্বেগ? নাকি ডিএপোয়েন্টেড হলে আমার যে রেগে যাওয়ার প্রবণতা আছে, তা তাকে ভাবিয়ে তুলছে?
প্ল্যাটফর্মের এদিকে আরো কিছু প্যাসিঞ্জার জড়ো হয়েছে। সিগনাল বাতির কাছে দাঁড়িয়ে হোল্ডারে আয়েশ করে সিগ্রেট ফুঁকছেন বয়স্কা এক মহিলা। এ মেমসাহেবের হ্যাট ও গাউনে গাঁথা অনেকগুলো শুকনা ক্রিসেনথিমাম। চোখাচুখি হতেই তিনি এগিয়ে এসে আমাকে গ্রীট করেন,‘হাই দেয়ার, আর ইউ ফ্রম ইন্ডিয়া?’ আমি জবাব দেই,‘নো ম্যাম, মাই হোম ইজ ইন বাংলাদেশ।’ তিনি ‘ দ্যাটস্ লাভলি, রাভিশংকর এন্ড উসটাড আলী এ্যকবর, বোথ আর ফ্রম বাংলাদেশ।’ হাত মেলাতে গিয়ে হাসিখুশি বৃদ্ধার বেজায় কুঁচকানো ত্বক ও অযত্নে ক্ষয়ে যাওয়া কালশিটে ধরা দাঁত দেখে অবাক লাগে! কিন্তু এ অনুভূতি গোপন রেখে প্রশ্ন করি,‘হাউ ডু ইউ নো রবিশংকর এন্ড ওস্তাদ আলী আকবর? ’ তিনি আমার কাঁধে মৃদুভাবে হাত ছুঁইয়ে জবাব দেন,‘ লুক আই এ্যম অ্যান ওল্ড হিপি, ওরা যখন নিউইয়র্কে জর্জ হ্যারিসনকে নিয়ে কনসার্ট বাংলাদেশ করেন, বিলিভ ইট অন নট আই ওয়াজ রাইট
দেয়ার টু প্রোটেস্ট দ্য কিলিং ইন ইষ্ট বেঙ্গল।’ আমি তাঁকে ‘থ্যাংক ইউ ফর সাপোর্টিং বাংলাদেশ মুভমেন্ট, ম্যাম’
বলে ধন্যবাদ জানাই। তিনি চোখেমুখে রহস্য ফুটিয়ে বলেন,‘ ডিড এনি ওয়ান হিয়ার টোল্ড ইউ… ম্যান, ইউ আর আ ওয়ান ভেরি হ্যান্ডসাম গাই?’ আমি লজ্জা পাই, তবে লোডশেডিং এর নিশিথে বালভে ফিনকি দিয়ে বিজলি ফেরার মতো আমার অভ্যন্তর আলোকিত হয়ে ওঠে।
আমিও তাকে কম্পলিমেন্ট দেই,‘ আই আপ্রিসিয়েট ইয়োর রিফাইন টেইস্ট অব পুটিং অল দিজ বিউটিফুল ক্রিসেথিমামস্ অন ইয়োর গাউন এন্ড হ্যাট।’ মহিলাকে যেন কথা বলার মুডে পেয়ে বসে। তিনি মুখখানা সিরিয়াস করে বলেন,‘লেট মি টেল ইউ সামথিং আবাউট ক্রিসেনথিমাম, সাদা চন্দ্রমল্লিকা হচ্ছে ডিভোটেড লাভ এর প্রতীক। আমি প্রতিরাতে গ্লাসের নিচে একটি পাপড়ি রেখে পান করি রেড ওয়াইন। দ্যাটস্ হোয়াই… এ বয়সেও আমি, লুক অ্যাট মি… স্টিল স্ট্রং এন্ড হেলথি।’ আমি ফের তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে আলাপের ইতি ঘটাতে চাই, কিন্তু তিনি ফিসফিসিয়ে বলেন,‘উড ইউ লাইক টু বাই সাম রোক্কান হ্যাশ, তোমাকে আমি খুব শস্তা দামে দিচ্ছি, প্লিজ ডোন্ট সে নো…।’ স্কারলেট ভালোবাসে মরোক্কান হ্যাশ, আমি সাত-পাঁচ ভেবে ওয়ালেট থেকে টাকা বের করি। তিনি আমার হাতখানা তাঁর মুঠোয় নিয়ে আন্তরিকভাবে চাপ দেন। এবং আমি বুঝতে পারি, রংতার অতি ছোট্ট একটি মোড়ক আমার হাতে চলে এলো।
ফিরে আসি বেঞ্চে বসা স্কারলেটের কাছে। সে জার্নালে কিছু লিখছে না, তবে কাঠপেন্সিলটি কামড়ে আছে। আমাকে দেখতে পেয়ে তার সী-গ্রীন চোখ দুটিতে চটুল আভা খেলে যায়। কিন্তু রহস্য ধরতে না পেরে আমি বলি,‘টেল মি হোয়াট ইজ ইট?’ দুষ্টুমির অভিব্যক্তিকে আরো শার্প করে সে মন্তব্য করে,‘আই ডোন্ট থিং ইউ আর আ ভেরি গুড অবজারভার।’ বিষয়টি তখন আমার চোখে পড়ে। তার করোনেট কায়দায় ব্রেইড করা চুলে ক্লিপ দিয়ে গাঁথা সবুজ পাত্রালীশুদ্ধ লালচে চেরি ফলগুলো ঝিলমিল করছে। ‘দিস ইজ ইনডিড আ ক্রয়েটিভ ফ্যাশন স্টেটমেন্ট, কুল… স্কারলেট, কুড আই টেক আ পিকচার?’ কপট ভ্রুকুটি করে সে বলে, ‘অহ হেল নো, ক্যান ইউ নট ইমপ্রিন্ট দিস ইমেজ ইন ইয়োর মাইন্ড… আই মিন ইন ইয়োর হার্ট।’ মনে হয়, এই প্রথম আমি বিমুগ্ধ হয়ে তাকে অবলোকন করছি। সে পার্স থেকে ছোট্ট একটি কৌটা বের করে চোখে কনটাক্ট লেন্স পরে তাকায়। সূক্ষ কাঁচের কারণে তার চোখের সমুদ্র-সবুজ রঙ যেন খানিক ছলকে যায়।
আমি অনুযোগ করি, ‘কনটাক্ট না পরলে হতো না, স্কারলেট?’ তার অভিব্যক্তিতে এবার আকুতি ফোটে, ফিসফিসিয়ে সে লে,‘লেন্সেস হেল্প মি টু সি ইউ বেটার।’ আমি চুপচাপ তার পাশে বসি। অপেক্ষা করতে থাকি কখন স্টীম ইঞ্জিনের ড্রাইভার আসবে আর আমরা জানালায় বসে অদ্যিকালের রেলগাড়ির ঝিক ঝিক আওয়াজের ভেতর পাড়ি দেব মাউন্ট রেনেয়ারের পাদদেশে একটি বাইসন চরা বিশাল উপত্যকা।