Author Picture

আমি চেয়েছি কল্পনার ডানায় ভর করে বিজ্ঞানের আনন্দ সবার কাছে পৌঁছে দিতে

খন্দকার রেজাউল করিম

খন্দকার রেজাউল করিম শিক্ষক, গবেষক, লেখক। তাঁর শিক্ষকতা জীবনের শুরু ১৯৭৫ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭৮ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকা যান। ১৯৮৩ সালে ইউনিভার্সিটি অব অরিগন থেকে পদার্থবিদ্যায় ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপরে ৩০ বছর কাটিয়েছেন আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষনা ও শিক্ষকতার কাজে। বর্তমানে তিনি আমেরিকার ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ইমিরেটাস প্রফেসর।
ড. করিম গবেষনার কাজে জড়িত ছিলেন নাসা, মার্কিন জাতীয় বিজ্ঞান সংস্থা, মার্কিন এনার্জি সংস্থা, ন্যাটো, টোকোমাক ফিউশন টেস্ট রিয়্যাক্টর এবং আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞান প্রকল্পে। তাঁর ৮০টি গবেষনা-প্রবন্ধ রয়েছে। এর বাইরে লিখেছেন দুটি বই- ‘Quantum Nursery Rhymes’ ও ‘কোয়ান্টাম রাজ্যে ডালিম কুমার’।
২০২২ সালে সৃজন থেকে প্রকাশিত হয়েছে খন্দকার রেজাউল করিমের বিজ্ঞান-সাহিত্য বিষয়ের বই ‘কাল্পনিক বিতর্ক, বিজ্ঞান-সাহিত্য-দর্শন’। এই বইয়ের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তার সাথে আলাপ হয় সৃজন অনলাইনের। সেই আলোচনার অংশবিশেষ পাঠকদের সাথে শেয়ার করা হলো।

সৃজন: মূলত বিজ্ঞানের বই। নাম দিয়েছেন ‘কাল্পনিক বিতর্ক’। বিজ্ঞান আর বিতর্ক তো যুক্তিনির্ভর। কল্পনা এখানে কী করছে?
খন্দকার রেজাউল করিম: বিজ্ঞান শুধুই যুক্তিনির্ভর নয়। আইনস্টাইন বলেছেন, ‘যুক্তি তোমাকে নিয়ে যেতে পারে এক বিন্দু থেকে আরেক বিন্দুতে। কল্পনা তোমাকে নিয়ে যাবে সবখানে।’ বিজ্ঞানের ইতিহাসে মাঝে মাঝে এমন সময় আসে যখন যুক্তির পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায়। কল্পনার আশ্রয় না নিয়ে আর উপায় থাকে না। বিজ্ঞানের খুব বড়বড় আবিষ্কার কল্পনা থেকেই এসেছে। এই কল্পনা রূপকথার গল্পের মত। অবাক কান্ড এই যে এই কল্পনা থেকে যা পাওয়া যায় তা বাস্তব জগতের সাথে হুবহু মিলে যায়। কোনটা যে বাস্তব আর কোনটা যে কল্পনা সেই দোটানায় পড়তে হয়। শ্রোডিঙ্গারের সেই অদ্ভুত সমীকরণ কোথায় থেকে এলো? রিচার্ড ফাইনম্যান বলেছেন এই সমীকরণ এসেছে শ্রোডিঙ্গারের মন থেকে। মন কী যুক্তি মেনে চলে? এই বইটিতে যাঁরা তর্ক করেছেন তাঁদের মুখের কথাগুলো আমার কল্পনা। জীবনের অনেকটা সময় এঁদের বই পড়ে কাটিয়েছি। সেই অধিকার থেকেই আমার এই অনধিকার চর্চা। আমি চেয়েছি কল্পনার ডানায় ভর করে বিজ্ঞানের আনন্দ সবার কাছে পৌঁছে দিতে।

বিজ্ঞানের ইতিহাসে মাঝে মাঝে এমন সময় আসে যখন যুক্তির পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায়। কল্পনার আশ্রয় না নিয়ে আর উপায় থাকে না

সৃজন: বইটি পাঠকের কোন ধরণের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে?
করিম: তিন ধরণের পাঠকের কথা ভেবেছি: স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের ছাত্র; কৌতূহল আছে কিন্তু সমীকরণের জ্বালায় বিজ্ঞানের বই পড়েন না এমন সব লোক; এবং যাঁরা বিজ্ঞান-উদাসীন। ব্ল্যাক হোল, কোয়ান্টাম তত্ত্ব, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা, মহাবিশ্বের জন্মমৃত্যু, ইত্যাদি বিষয়ে অনেকের আগ্রহ আছে। তবু বিজ্ঞানের বই তারা পড়তে চান না। কেন? অংক কী দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে? আমি এই দেয়াল
ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেছি। সাধারণ পাঠকের অংক জানার প্রয়োজন নেই। আমি চেয়েছি বিজ্ঞানের মজার গল্পগুলোকে অংকের কারাগার থেকে মুক্ত করে দিতে। অংকের বদলে কবিতা, গান এবং গল্প ঢুকিয়েছি। যেমন আদর্শ বায়ুর সূত্রের আবিষ্কারক, চার্লস এর প্রেমের গল্প। কেপলারের মায়ের গল্প। কেপলারের মা’কে ডাইনী বলে করাগারে আটকে রাখা হয়েছিল। পিরিয়ডিক টেবিল যিনি আবিষ্কার করেছেন তাঁর মায়ের কষ্টের গল্প! এই মা ছেলেকে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে গ্রাম থেকে শহরে এসেছিলেন যাতে তাঁর ছেলে কোনো নামি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে। যিনি ক্যালোরি শব্দটি চালু করেছিলেন, সেই বিজ্ঞানীর রূপসী স্ত্রীর একাধিক প্রেমের গল্প। কবিতা এবং গানগুলো বেশিরভাগ রবীন্দ্রনাথ, জীবনান্দ, লালন ফকিরের কাছ থেকে নেয়া, কিছু ইংরেজি কবিতাও আছে।

বিজ্ঞানের খুব বড়বড় আবিষ্কার কল্পনা থেকেই এসেছে। এই কল্পনা রূপকথার গল্পের মত। অবাক কান্ড এই যে এই কল্পনা থেকে যা পাওয়া যায় তা বাস্তব জগতের সাথে হুবহু মিলে যায়

সৃজন: বিশেষ করে কোন পাঠকেরা এই বই থেকে বেশি উপকৃত হবেন বলে মনে করেন?
করিম: স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীরা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে। এই বই বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যবইয়ের ধারণাগুলো বুঝতে সাহায্য করবে, অনেক বিষয়ে জানার আগ্রহ বাড়িয়ে দিবে। ফিজিক্স এবং কেমিস্ট্রি ক্লাসের টেক্সট বইয়ে যা লেখা থাকে তা অতি সহজ ভাষায়, গল্পের ছলে বোঝানোর চেষ্টা করেছি।

সৃজন: বিজ্ঞানশিক্ষায় উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বিজ্ঞানচর্চার বর্তমান অবস্থা কেমন?
করিম: একটি দেশের বিজ্ঞানচর্চার প্রধান মানদন্ড হলো দেশটি থেকে বছরে কয়টি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ পায়। বাংলাদেশের স্থান ৬০ নম্বরে। একটা ধারণা দেয়া যেতে পারে : বিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং, এবং মেডিসিন নিয়ে প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় তিন হাজার গবেষণা প্রবন্ধ বের হয়, আমেরিকায় এই সংখ্যা চার লক্ষের উপরে। গবেষণা প্রবন্ধের মানের কথা আর এখানে টেনে আনছি না।

সৃজন: এমন বিষয়ে বই লেখার ইচ্ছেটা কেন হয়েছিল?
করিম: জীবনের সিংহভাগ মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান পড়িয়েছি, গবেষণা প্রবন্ধগুলো ইংরেজিতে লিখেছি। হঠাৎ করেই মাতৃভাষায় বিজ্ঞান নিয়ে কিছু লেখার ইচ্ছে জাগে। কয়েক বছর আগে ‘কোয়ান্টাম রাজ্যে ডালিম কুমার’ নামে একটি বই লিখে ফেলি। বাংলাদেশ সরকার এবং কিছু বেসরকারি সংস্থা বইটির কয়েক হাজার কপি বিতরণ করে। অনলাইন বইয়ের দোকান ‘রকমারি’তে জনৈক পাঠক নূর আলম মন্তব্য করেন, ‘নাসার প্রজেক্ট নিয়ে গবেষণা করেছ, অথচ বাঙালি হয়ে জন্মেও মাত্র একটি বিজ্ঞানের বই লিখেছ, শত ধিক্কার তোমায়! কে বুঝবে আমাদের জ্ঞানের তৃষ্ণা?’ এই অচেনা পাঠকের ধিক্কার আমাকে দেয় মস্ত এক ঝাঁকুনি! বিজ্ঞান নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করি। কিছু বই লেখারও চেষ্টা করছি। এই বইটি এমন একটি বই।

এই বই বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যবইয়ের ধারণাগুলো বুঝতে সাহায্য করবে, অনেক বিষয়ে জানার আগ্রহ বাড়িয়ে দিবে

সৃজন: বিজ্ঞান সাহিত্য এবং দর্শনের যে যোগসূত্রটি এ বইতে তৈরী হয়েছে, বাংলাদেশে এই তিন বিষয়ের রসায়নটা বর্তমানে কোন পর্যায়ে?
করিম: এই তিন বিষয়ের রসায়ন বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। সাহিত্য, বিজ্ঞান, এবং দর্শনের পাঠকরা যেন আলাদা জগতে বাস করে। জ্ঞানকে এরকম খন্ড খন্ড করে রাখা ঠিক না। একজন বিজ্ঞানী কেন কবিতা পড়ার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবে? একজন গল্প লেখক কেন মহাবিশ্বের জন্ম-মৃত্যুর গল্প জানবে না? এতে কার লাভ? ‘আলো আমার, আলো ওগো, আলো ভুবন-ভরা। আলো নয়ন-ধোওয়া আমার, আলো হৃদয়-হরা।।’
রবীন্দ্রনাথের গান। আলো নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করছেন কয়েক হাজার বছর ধরে। এই গবেষণা এখনো চলছে। আইনস্টাইন মরার কয়েকদিন আগে বলেছিলেন যে আলো কী তা কেউ জানে না।

‘সুরঞ্জনা, ওইখানে যেওনাকো তুমি, /বোলোনাকো কথা ওই যুবকের সাথে;’
সুরঞ্জনা কেন ওখানে যাবে না? ওই যুবকের সাথে কথা বলা বারণ কেন? মানুষের মন, প্রেম বা প্রেমহীনতা নিয়ে দার্শনিক এবং বিজ্ঞানীদের অনেক কিছু বলার আছে।
‘ফিরে এসো সুরঞ্জনা:
নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে;’
নক্ষত্র, বস্তুর রূপ, এবং আগুন নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করছেন হাজার বছর ধরে। গাছ, ফুল, মেঘ, প্রকৃতি, মানুষের মন, মানুষের প্রেম নিয়ে কবিরা সেই কবে থেকে কবিতা লিখছেন। কবিদের কবিতা লেখা যেমন শেষ হয় নি, বিজ্ঞানীদের গবেষণারও শেষ হয় নি। এই বইটিতে কয়েকজন কবি, বিজ্ঞানী, দার্শনিক একসাথে বসে আড্ডা দিয়েছেন, তর্ক করেছেন, মত বিনিময় করেছেন। বিজ্ঞান, সাহিত্য, এবং দর্শনের মাঝে একটা রসায়নের সৃষ্টি হয়েছে। আমার আশা এই রসায়ন পাঠকের মনে ছড়িয়ে পড়বে। বাংলা ভাষায় এরকম বই আর আছে কি না তা আমার জানা নেই।

সৃজন: বিজ্ঞানচর্চার সামাজিক প্রভাবটা কেমন হয়ে থাকে?
করিম: বিজ্ঞানচর্চা মানুষ এবং সমাজকে যুক্তিবাদী, সংস্কারমুক্ত, এবং অসম্প্রদায়িক করে তোলে। যে দেশে বিজ্ঞানচর্চা যত বেশি, সে দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান ততই উন্নত।

আরো পড়তে পারেন

মুখোমুখি: আন্দ্রেজ আল-আসাদি

১৯৯৭ সালে লন্ডনে জন্মগ্রহণ করা আন্দ্রেজ আল-আসাদি বর্তমান সময়ে মেসিডোনিয়ান ভাষায় লেখালেখি করা প্রধানতম তরুণ কবিদের অন্যতম। তার বহুসাংস্কৃতিক পটভূমি এবং তার ও অন্যান্য সমসাময়িক মেসিডোনিয়ান কবিদের কাজকে অনুপ্রাণিত করার প্রভাব নিয়ে কথা বলেছেন ব্রিটিশ-আমেরিকান সাহিত্যিক অনুবাদক পিটার কনস্টানটাইনের সাথে। ওয়ার্ল্ড লিটারেচার টুডে কর্তৃক প্রকাশিত সেই সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন মেজবাহ উদ্দিন আপনার জন্ম লন্ডনে, আপনার….

রুশ সংস্কৃতির প্রধান শত্রু রুশ রেজিম: মিখাইল শিশকিন

অন্য দেশে ইমপেরিয়াল অথবা সোভিয়েত রাশিয়া থেকে বর্তমানের রুশ ফেডারেশনের নির্বাসিত লেখকদের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। অনেকে যাকে সমকালীন রুশ সাহিত্যে পাস্তারনাক ও সলঝোনেতসিনের উত্তরসূরি হিসেবে মনে করেন, সেই মিখাইল শিশকিন ১৯৯৫ সাল থেকে বসবাস করছেন সুইজারল্যান্ডে। একমাত্র লেখক হিসেবে লাভ করেছেন রাশিয়ার প্রথমসারির প্রায় সব সাহিত্য পুরস্কার, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য— রুশ বুকার (২০০০), বিগ….

বাংলা সাহিত্যের লেখকদের কূপমণ্ডূকতা পাঠকদের কূপমণ্ডূক করেছে : হারুন আল রশিদ

রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবন উপন্যাসের লেখক হারুন আল রশিদ বাংলা সাহিত্যে এক ব্যতিক্রম ও সম্পূর্ণ নতুন কণ্ঠ। তার  গদ্যের শক্তি ও গভীরতা পাঠকের কাছে যেমন বিস্ময়ের ব্যাপার তেমনি তার ভাষার সহজবোধ্যতা বাংলা গদ্যের একটি নতুন ধারা তৈরি করেছে। মাত্র দুটি উপন্যাস প্রকাশ করে তিনি পাঠকদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। অন্য উপন্যাসটি হল— ‘রেণুর আবির্ভাব’। তাঁর তৃতীয়….

error: Content is protected !!