Author Picture

তিনটি কবিতা

মঈনুস সুলতান

বালুঘড়ির শব্দে
.
ফেরা যায়— কিন্তু অবেলায় ফেরো যদি
শিশিরে জড়ানো রূপালি জুঁইচাঁপা —
দেখবে— আজো ঝরছে ফোঁটায় ফোঁটায় নিরবধি;
গোরস্থানের পাশে ধানের ক্ষেত
কখন যে কাটা হয়ে গেছে হৃদয়ের মরমী শস্য,
একটু দাঁড়াও — উড়ছে জোড়া গঙ্গাফড়িং
এমন সতেজ সবুজ কীভাবে সোনালি হলো— সেও এক রহস্য।

দেখবে— ধানখোঁটা আবাবিলের ঝাঁক পাখসাটে আঁকছে
ঝংকারের চিত্রকলা,
স্মৃতির নিসর্গ-নয়নে ফুটে চারাবাড়ি—পাঁজরে শানানো লাঙলের ফলা;
পরিতাপের প্রসঙ্গ নিয়ে ভেবো না আর— ফিরে তাকাও
অই যে ঘোড়ার নালের মতো নদীর বাঁকে—
পুঁতে আছে পুঁথি— বিগ্রহ— সুরমা-বারাক বলয়ের পরিজাত পাঁকে;
মনে আছে —
ঠিক অইখানে বারো ঠাকুরীর অমিতাভপ্রিয় রাজ্যপাঠ,
মজা দিঘিতে ভাসে কলমী দাম— অবশিষ্ঠ নেই তেমন কিছু
ক্ষয়ে গেছে কালচে চোখ-পাথরের ঘাট;
না হয় বসলে একটু
মরমের এ মতিচ্ছন্ন জানালাও একদিন হবে বন্ধ—

শুঁকে নাও শ্যাওলার সবুজ জলে জারিত শালুকের বর্ণীল গন্ধ,
আর— যদি পারো মিটিয়ে ফেলো
মননের অবতলে বালুঘড়ির শব্দে মর্মরিত হয় যে দ্বন্ধ।

 

আজ ভুলবাল হয় ব্যাপক
.
আরকের প্রস্তুত প্রণালীতে আছে নিনেভের সুষ্পষ্ট ছাপ
পানপাত্রে উপচে পড়ে ভাজা মৌরির সুগন্ধ,
জিহ্বায় ছড়ায়— ভেষজের জারিত উত্তাপ
ভাবনা-চিন্তায় লাগে বুঝি-বা বিপুল ধন্ধ;
গরমিল হয় হিসাবে— খুঁজে পাই না চেনা পথ
কবে— সুদূরের কোন শতাব্দীতে—ব্যববিলনের রাজাধিরাজ,
নিয়েছিল জেরুজালেম দখলের শপথ ,
নাগাল পাই না নক্ষত্রের পরাক্রান্ত পঞ্জিকার পরিধি আজ;
তিকরিতের বালুকায় জীবাষ্ম হয়ে পড়ে আছে পিরানহা মাছের ইস্কুল,
ব্যাপক বিভ্রান্তিতে ভুলবাল হয় তাবৎ কিছু— কেচে গন্ডুস হয় বিলকুল।

খুঁজে পাই না গন্তব্য—
তবে থামে না পথচলা,
আরকের প্রতিবিম্বে দেখি রাশিচক্রের জড়োয়ায় ঝলমলে ভবিতব্য,
রেশমের এই সড়ক ধরে এক দিন
কাঁচের নীলাভ সওদা নিয়ে গিয়েছিল কাফেলা,

পাই না খেই— হেঁটে যাই— একাকী— দাঁড়াই খানিক,
পয়গম্বর ইউনুসের প্রিয় মসজিদে
করোটির সরপোষে ঢেকে যাদুময় জগতের প্রতীক,
দেখি— দেয়াল জুড়ে ঝুলছে তিমি মাছের বয়োবৃদ্ধ বুজর্গ কংকাল
দজলা ফোরাতের অববাহিকায় খনিজ কর্দম খুঁড়ে
কারা গড়েছিল হরফের চিত্রিত মশাল?
এসে পড়ি—নেবুচাদনেজারের সমাধি সৌধের শিয়রে
দেয়াললিপিতে উদ্ভাসে মেসোপটামিয়ার বার্তাময় সৃষ্টি,
দাঁড়িয়ে প্রাঙ্গনে পার্কার কলমে মুদ্রিত পান্ডুলিপির পৃষ্টায়
অটোগ্রাফ দেন আগাথা ক্রিস্টি,
আজ ভাবনা-চিন্তায় ভুলবাল হয় ব্যাপক
আরকে দ্রবীভূত হয় বিভ্রান্তির ইন্দ্রনীল বিষ,
দেখি- কতিপয় ফিরিঙ্গি পূরাতাত্ত্বিক
আতশি কাঁচে মৎস্যের জীবাষ্মে খুঁজে নোনা আমিষ।

 

সবুজ অংকুর ও ভবিতব্য
.
আমার করোটিতে অজস্র অংকুর ছড়াতো
বনভূমির সহজিয়া সবুজ,
পরাণের পিঞ্জিরায় শোলার কাকাতুয়া এক
বোল ফোটেনি তখনো.. ছিলো সে অবুঝ,
একটি পোষা সরোবরও ছিলো আমার
ভাসতো দিনমান রূপার আটটি হাঁস,

বাক বেখেয়ালে হয়েছে সব অকিঞ্চিতকর পরিহাস।

বাসে চেপে গিয়েছি কত গোয়ালন্দ ঘাটে
পাটাতনে বসে চেখেছি ভাজা ইলিশের মুখরোচক পদ,
উঠে গেছি বিজয় নগরে পানির ট্যাংকির চাঁদিতে
শোরগোলে পাঠ করেছি মেঘনাদ বধ।

মানিনি ভেদাভেদ রিকশা ও রেলগাড়িতে
কি-বা যায় আসে কনিয়াক কিংবা তাড়িতে,
ঝোলায় বয়েছি ঘাসের বীজ— বাবুই পাখির নীড়
অন্তরে বেজেছে দিগন্তপ্লাবী মীড়,
প্রপাতে বহতা নুড়ির চলাচল ছিলো সহজাত
ছুঁয়েছি সূর্যমুখীর অরুণিম পাপড়ি—
কখন হয়েছে সন্ধ্যা— কৃষ্ণপক্ষের গভীর রাত?

আহসান মঞ্জিলের ছাদে বসে দেখেছি নক্ষত্রের পথচলা
অঙ্কুরে ছড়ায়নি পত্রালি— বাগিচা হয়েছে আমার নিষ্ফলা,
তবে দূরে কোথাও…অন্তরের গভীর অন্তস্থলে
সৃজিত হয়েছে সবুজের সহজিয়া পরিবেশ,
বেড়ে ওঠেছে শিকড়হীন বৃক্ষ এক
তার ডালে এসে বসেছে বর্ণালী ডানার ধ্যানী ধনেশ;

বুকপকেটে পরাগ মাখা সোনার রেণু

ফড়িং এর পাখায় চাঁদ বাজিয়েছে জোছনার বেণু.. ..

নিমের মাধুরী মেখে— সদরঘাটের জেটিতে সন্ধ্যাবেলা
বলেছিলে— চাইলে বদলাতে পারো বাচনভঙ্গি
হতে পারো ভালো,
গলুই-এ লন্ঠন…জলে ছিটকে পড়েছিলো আলো।

কেটেছে অনেক বছর.. .. মোছে যায়নি কিছু অভিমান
নির্বাসনে যেতে চেয়েছি কালাপানি — সুদূর আন্দামান,
পৌঁছতে পারিনি ইস্পিত কোন ইশটিশনে —
আমার পথ মিশেছে গিয়ে ফণিমনসার বনে,
আরাধ্য আমার আজীবন অগন্থব্য —
বাকচাতুরির বোলচালে — বলা চলে —ভবিতব্য।

আরো পড়তে পারেন

আহমেদ ফরিদের একগুচ্ছ কবিতা

তোমার সাথে দেখা হওয়া জরুরী নয় সেদিন তুমি আমাকের ডেকে বললে, ”আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি ঝরছে এসো চা খেয়ে যাও ঝাল মুড়ি, পেঁয়াজ ভেজে দেবো সঙ্গে কাঁচালংকাও থাকবে। দুজনে চা খাব, মুড়ি খাব, আর গল্প করবো।’ আমি বললাম, ’না, আমি যাবো না । আমি আমার জানালায় বসে আকাশ দেখছি, বৃষ্টি দেখছি, আকাশের কান্না দেখছি, গাছেদের নুয়ে….

নিকোলাই রুবৎসভের কবিতা

নিকোলাই মিখাইলোভিচ রুবৎসভ (৩ জানুয়ারি ১৯৩৬ – ১৯ জানুয়ারি ১৯৭১) মাত্র পঁয়ত্রিশ বছরের জীবন পেয়েছেন রুশ কবি নিকোলাই রুবৎসভ। দুর্ভাগ্য তাঁকে তাড়া করেছে সারাজীবন। শৈশবে মায়ের মৃত্যু ও পিতার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য তাঁর স্থান হয় শিশু আশ্রমে। পড়াশোনা শেষ করার আগেই জীবিকার তাগিদে তাকে খনিতে, জাহাজে কাজ করতে হয়। সৈন্য বাহিনীতে যোগ দেওয়ার….

সোহরাব পাশা’র একগুচ্ছ কবিতা

নিদ্রিত ঘ্রাণের শব্দ দীর্ঘ যায় আশালতা ফিরে আসে বিষণ্ণ গোধূলি ফিরে আসে দুঃখিত সকাল, ক্ষয়ে যাওয়া এক দূরের উপনিবেশ পাখির চেয়ে মানুষের কোলাহল বেশি কোনো মৃত্যু মানুষকে অপরাধী করে না নিঃশ্বাসের রোদে আবছায়া নিদ্রিত মেঘ স্মৃতির অসুখ বাড়ে; দূরে নির্জন আধাঁরে জেগে ছিলো মানুষের কথা পুরনো সে বাড়ি সেই ছায়াপথ মায়াপথ জুড়ে কতো ভুল মানুষের….

error: Content is protected !!