Author Picture

আরণ্যক শামছ এর একগুচ্ছ কবিতা

আরণ্যক শামছ

সভ্যতা দাঁড়িয়ে আছে দালানের কার্নিশে
.
অদ্ভুত মদের নেশায় বুদ হয়ে আছে স্বদেশ
আর আমি শুনি ঘাসফুল ও ফড়িং এর আর্তনাদ,
রতির শিৎকারে ভেসে যায় ছাদের উদ্যান
ম্রিয়মান চাঁদ তুমি ঝাঁপ দাও কৃষ্ণগহ্বরে।

শাহবাগের মোড়ে রাজিবের কংকাল
আর নুর হোসেন দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে,
‘আরেকটা গনতন্ত্রের বুলেট দাওনা দাদা’? দেবে?
এবার নতুন একখানা ‘গতর’ নিয়ে এসেছি গো।

সভ্যতা দাঁড়িয়ে ছিল উঁচু দালানের কার্নিশে
বিশাল স্ক্রিনে গ্লৌয়িং ক্রিমমাখা মুখে হেসে বলে,
মুর্খ জানে না মধ্যরাতে সূর্য ওঠার গল্প
মদের ঝরনাধারায় জমে ওঠা রাতের মহোৎসব।

বোকা নাকি? সোডিয়াম আলোয় চেয়ে দ্যাখো!
এখনও সময় আছে অষ্টপ্রহর,
চলে এসো খুব তাড়াতাড়ি
বুলেটে নয় রমনীয় নমনীয়তায়
কংকালে নয় কোমল কমনীয়তায়।

ত্বক ফর্সার বসন্ত উৎসবে এসো আজ
আর নয় উড়াউড়ি প্রজাপতি খেলা,
পদ্যের দিন হলো ডুবে ডুবে শেষ প্রায়
এখন ডানা ভাঙ্গা শালিকের রাতের শহরে
আজ ব্যাবিলনে ভাইরাল হবে বাংলাদেশ।

ঘোর আচ্ছন্নতা থেকে বের হয়ে দেখি
উঁচু পাঁচিল ঘেরা নিশ্চিদ্র নিরাপত্তার মাঠে,
কাপনে মোড়ানো আমার প্রিয় যত গানলামি
ফুল-পাখি-পিতামাতা-দোয়েলের শিস…
আর…
শব হয়ে শুয়ে আছে একে একে সব…!
ফেব্রুয়ারি, মার্চ, আগস্ট আর প্রিয়তমা ‘বিজয়’!

সভ্যতার সাদা কফিনে শেখ মুজিব
.
বিইয়েলজেভাবের ‘ভ্যানিটি-ফেয়ার’ থেকে
কিনে আনা এনাকুন্ডার ‘বিষমাখা লেজ’
হাজার বছর ধরে কূন্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে ছিল, ‘ঘসেটি বেগমের’ ভ্যানিটি ব্যাগে
আর রায় দূর্লভের খাজাঞ্চিখানার গোপন কুঠুরিতে।

আর ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গের ড্রইং রুমের ‘ঔপনিবেশিক-ফুল’ থেকে জন্ম নেয়া
বিষাক্ত কিছু কীট গোবরে মুখ লুকিয়ে
শীতনিদ্রায় শুয়ে থাকতে থাকতে
‘ঘাতক-শব’ হয়ে একদিন জেগে উঠে লোকালয়ে।

জরাগ্রস্ত ইতিহাসের নগ্নপাতা থেকে বিষপান করে পাঁজরের হাড়ে বেড়ে ওঠা ‘উইপোকা’
উলধ্বনি দিয়ে সভ্যতার ভাসানচরে,
খুনি খলিফাদের মগজের ঘিলু খেতে খেতে
মসনদ ও ‘নারীর-বাহুমূলের-গন্ধ’ ছড়াতে থাকলে..

ঘর আর ঘর থাকে না
দেশ আর দেশ থাকে না
মানুষ আর মানুষ থাকে না
দেশপ্রেম গ্লেসিয়ার হয়ে জমে যায়
আর্কটিক কিংবা বুকের ডিপফ্রিজে জলকুচি হয়ে।

আর রক্তস্নান করবে বলে…
কিলবিল করে জেগে উঠে মৃত নগরীর প্রেতাত্মারা আলোকিত রাজপথে,
সভ্যতার ‘সাদা কফিন’ থেকে বের হয়ে আসে
‘সাত-ইল আরব’!

আর ‘পেট্রোডলারের অজগর’ বুলেট হয়ে
ঝাঁঝরা করে দেয়…
সবুজ ক্ষেত-বাংলার মাঠ-বুকের মানচিত্র
অবুজ শিশুর লাশ-হাজার বছরের ইতিহাস
আর আমার পিতার বুক,
দ্বিখন্ডিত সমুদ্রের স্রোতধারার ঠিক মাঝখানে
ডুব দেয় ‘বিজয়ের চাঁদ’।

বরফ যুগের হিমাগারে ঠাঁই নেয়
বাংলার টাইটানিক-ছয়দফা-৭ই মার্চ
স্বাধীনতার বিজয়গাথা-বাংলার সাদা পাঞ্জাবি…
আর আমার প্রিয় চুরুট, চশমা আর প্রিয়তমা ‘বিজয়’!

আর চেতনার কফিনের ডালা ভেঙ্গে
আরেক শীতনিদ্রা থেকে জেগে উঠে
কিছু বজ্রকন্ঠ বানী,
আকাশে বাতাসে তখন ‘জয়বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু’

আর আমি….

প্রাগৈতিহাসিক শীতনিদ্রা থেকে জেগে দেখি,
গোবর থেকে চেতনার বটমূলে আসতে
আমার লেগেছে চার হাজার বছর
আর উদ্বিগ্ন-যৌবনা পৃথিবী আজ এখন
ক্র্যাচ ধরে হাটে।

আর আমি চোখ মেলে দেখি…
মানুষের মুখে আজ মুখোশ
খানিক স্বাধীনতা অচল সিকির মতো
ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে
নতুন কোন বার্তা শুনবে বলে।

আর খানিকটা ঝুলে আছে নাছোড়বান্দার মতো প্রতিবেশীর সীমানার প্রাচীরে,
আমি তাকে লাফ দেওয়ার ঠিক আগের মূহূর্তে….
খপ করে ধরে ফেলি,
আর কয়েদি করে রেখে দেই বুক পকেটে।

সে আমার চেতনার ‘ময়না পাখি’!
আমার প্রিয় স্বাধীনতা!
আমার প্রিয় রক্তাক্ত দলিল!
আমার প্রিয়তমা বাংলাদেশ!
আর আমার পিতার জায়নামাজ!

ইচ্ছে হলেই যায়না ছোঁয়া
.
আকাশ ছুঁয়ে দেখবো বলে বাড়িয়েছিলাম হাত
হঠাৎ দেখি আকাশ গেল সরে,
ইচ্ছে হলেই যায়না ছোঁয়া আকাশ অকস্মাৎ
ইচ্ছে গুলো ইচ্ছেতে যায় মরে।

বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখবো বলে বাড়িয়েছিলাম হাত
হঠাৎ দেখি বৃষ্টি গেছে থেমে,
ইচ্ছে হলেই যায়না ছোঁয়া বৃষ্টি অকস্মাৎ
মনের কোনে বৃষ্টি যখন জমে।

তোমায় ছুঁয়ে দেখবো বলে বাড়িয়েছিলাম হাত
হঠাৎ দেখি হাতে তোমার থালা,
ইচ্ছে হলেই যায়না ছোঁয়া তোমায় অকস্মাৎ
থালায় যখন অন্য গলার মালা।

একটি ভাড়াটে ফুল ও বিশুদ্ধ পাতার কুটির
.
মেঘটা ঝুলে আছে আকাশের গায়
যেমনটি অবাধ্য ছেঁড়া ব্যাগটি
ঝুলে থাকতো আমার বেয়াড়া কাঁধে
তোমার তখন বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে
মাটিতে ঝরে পড়ার দিন।

তোমার হৃদয় চত্বরে তখন
বেওয়ারিশ রৌদ্দুরের আনাগোনা
তোমার তখন শিমুল ফোঁটার প্রাক্কাল
আর আমার তখন পাতা ঝরার দিন
আমার গন্ধ মাখা স্মৃতি তখন পলাতকা ছায়া।

আর আমি মন ভাড়া দিয়ে ছাইপাশ গিলি
হাজার দুয়ারী মন আমার
দেখে, মেঘ নাকি ঝুলে আছে জানালার গ্রীলে
ভাঙনের গান গাইতে গাইতে ঝুলে থাকি
শেষ রাতের ট্রামের হাতলে।

মন ভাড়া দিয়ে আমি হয়ে যাই ভাড়াটে ফুল
হৃদয়ে শশান নিয়ে গন্ধ ফেরি করে বেড়াই
আঁটোসাঁটো বসে থাকা চশমা পরা কবি হয়ে
সন্ধ্যা নামার আগে বাতি জ্বালিয়ে অপেক্ষা করি
অন্ধকার হয়ে তুমি আসবে বলে।

তোমার আসা হয়ে ওঠেনা আর
তুমি তখন একমুঠো গোধূলির রঙ দিয়ে
কি ভাবে রাত সাজাতে হয় শিখে গেছো
সোডিয়াম আলোতে কিংবা নাকফুলে
তোমাকে এখন বেশ মানায়।

আর আমি, তোমাকে জিতিয়ে দেবো বলে
আটপৌরে প্রেম, আটপৌরে অনুভূতি,
পছন্দের জিনিস, পুরোনো অভ্যাস,
মুঠোফোন, তোমার মনের পাড়াতে ফেলে দিয়ে
চলে যাই দ্বাবিংশ শতাব্দীতে।

অনন্তে অপেক্ষা করি
যেখানে একটি বুনো ফুল ফুটবে
একফোঁটা শিশির ঝরবে
আর আমি একমুঠো উষ্ণতা নিয়ে অপেক্ষা করবো
বিশুদ্ধ পাতার কুটিরে।

অপেক্ষা ভালোবাসি
.
বুকের পৃষ্ঠা জুড়ে ‘অপেক্ষা’
আমি অপেক্ষা ভালোবাসি,
হয়তো বেশি কিংবা অল্পে
জীবনটা ছিল খুচরো পয়সার মতো ভীষণ দরকারি,
হাজার টাকার নোটও আজকাল সিকি আধুলি খোঁজে,
আজও আমি অচল মুদ্রায় খুঁজি পরিত্যক্ত যৌবন,
আর প্রতিক্ষাকে পাশ কাটিয়ে
তোমার অপেক্ষায় বসে থাকি হাতিম গাছের নিচে
একশো কোটি বছর।

পিঁয়াজের খোসা ছাড়ানো
আর কিছু কাঁচা লংকা আর ধনেপাতা,
আটপৌরে অনাবিল দুঃখ মাখা আলুর ভর্তা,
আর গৃহপালিত সুখের পাঁচিল ঘেরা ডিম পোঁচ,
এইতো ছিল বেশ
বানেভাসা সুখের জীবন,
তোমার পলাতকা ছায়া যে দিন জানিয়ে দিলো,
বানপ্রস্থেও তুমি ঋষি হতে পারোনি,
আমি অপেক্ষা ভালোবাসতে শিখে গেলাম।

পাখি চলে গেছে সেই কবে
রেখে গেছে ছেঁড়া পালক,
জীবনের সুতোছেঁড়া এই আমি
মানুষের অরণ্যে আজও খুঁজে বেড়াই
তোমার বদলে যাওয়া অবয়ব,
সুখের পালংকে ফের হামাগুড়ি দেবো বলে
আমি তাই অপেক্ষায় আছি।

হয়তো বেশি কিংবা অল্পে
চটপটি কিংবা ফুচকায়
হাতির ঝিল কিংবা গ্রামের পড়ন্ত বিকেলে
শ্রাবণ মেঘের দিনে কিংবা কোন এক বর্ষাতি রাতে
বুকের পৃষ্ঠা ছিল আকাশের মতো
দু’চোখ ভরা লাগামহীন স্বপ্ন
দুমড়ানো মোচড়ানো বেসামাল কবিতার খাতা
আর তুমি ছিলে বলে
আজও তাই অপেক্ষা করি
আমি যে অপেক্ষা বড় বেশি ভালোবাসি।

সুতপা’দের ঠিকানা থাকেনা
.
বাসের জানালার কার্নিশে হাত রেখে
নিশ্চুপ শবের চোখে তাকিয়ে থাকে ‘সুতপা’
বিপরীত দিকে নির্মম নিপীড়নে ছুটে যায় গাছপালা,সবুজ মাঠ, হলুদ শস্যক্ষেত,
স্বামীর সংসার, পিতৃভিটা, পরিত্যক্ত শৈশব,
আর স্বামীর কবরের পাশে রেখে যাওয়া,
সাড়ে তিন হাত জমিনটাও,
আর নাভি থেকে ছিঁড়ে যায় ‘নাড়ির এন্টিনা”।

সুতপা’দের কখনো কোন ঠিকানা থাকেনা
জন্ম থেকে জন্ম শুধু স্থান বদলের খেলা
জন্ম থেকে জন্ম শুধু হাতবদলের খেলা
স্থাবর কিংবা অস্থাবর সম্পত্তির মতো,
মুল ভিত সরে গেলে যেমন কিছুই থাকেনা
মাথার উপর থেকে আকাশ সরে সরে যায়
আর সুতপা’দের পায়ের নিচে থেকে…
মাটি সরে সরে যায়
ভালোবাসা সরে সরে যায়
জীবনের রঙ মরে মরে যায়
পাতা ঝরে ঝরে যায়
সুতপা’দের তাই কোন ঠিকানা থাকে না।

আরো পড়তে পারেন

গাজী গিয়াস উদ্দিনের একগুচ্ছ কবিতা

বীভৎস খেলা নগরে বাতাসে মথিত জনস্রোতের কোলাহলে শুনতে পেয়েছি সারিগান গঞ্জের হাটে আকাঙ্খার গভীরে মন্দ্রিত অভিন্ন প্রাণ নীরব দর্শক ছিলাম ব্যর্থতার করুণ গান ফেরার মহড়ায় বঞ্চিত কুঁড়েঘরে সরাইখানার- শুঁড়িখানার মাছিরাও নেশায় বুদ্বুদ প্রকম্পিত কান্নার পর একদিন হাসির তিলকরেখা বিচ্ছুরিত শৈশবের ক্ষুধার্ত চিৎকার ক্রর হাসি চেপে মৃত্যু পরোয়ানা ঝুলে ভাগ্য প্রহসনে যুদ্ধের ব্যগ্র দামামা থেমে গেলো-….

তোফায়েল তফাজ্জলের একগুচ্ছ কবিতা

উপায় অবলম্বন কাঁটা থেকে,  সুচালো কাঁকর থেকে পা রাখিও দূরে, জায়গা না পাক চলন-বাঁকা চেতনায় উড়ে এসে বসতে জুড়ে; এসবে খরগোশ কানে থাকবে রাতে, পড়ন্ত বেলায়, দ্বিপ্রহরে, পূর্বাহ্নে বা কাক ডাকা ভোরে। দুর্গন্ধ ছড়ানো  মুখ ও পায়ের তৎপরতা থেকে গ্রীষ্ম থেকে সমস্ত ঋতুতে একে একে নেবে মুখটা ফিরিয়ে তিলার্ধকালও না জিরিয়ে। কেননা, এদের চরিত্রের শাখা-প্রশাখায়….

আহমেদ ফরিদের একগুচ্ছ কবিতা

তোমার সাথে দেখা হওয়া জরুরী নয় সেদিন তুমি আমাকের ডেকে বললে, ”আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি ঝরছে এসো চা খেয়ে যাও ঝাল মুড়ি, পেঁয়াজ ভেজে দেবো সঙ্গে কাঁচালংকাও থাকবে। দুজনে চা খাব, মুড়ি খাব, আর গল্প করবো।’ আমি বললাম, ’না, আমি যাবো না । আমি আমার জানালায় বসে আকাশ দেখছি, বৃষ্টি দেখছি, আকাশের কান্না দেখছি, গাছেদের নুয়ে….

error: Content is protected !!