Author Picture

চৌধুরী রওশন ইসলামের ৫টি কবিতা

চৌধুরী রওশন ইসলাম

ইনসোমনিয়া
.
ও আমাকে বলেছিল কুকুর;
আমিও তৎক্ষণাৎ ওকে বলে দিয়েছি শুয়োর।
তারপর সারা দিন সারা রাত জেগে
ঘেউ ঘেউ আর ঘোঁৎ ঘোঁৎ আওয়াজে
পাড়ার সব লোক জাগিয়ে রাখি আমরা দু’জন।

কেবল উচ্ছিষ্ট হাড় সামনে এলে
আমার ঘেউ-ঘেউ থেমে যায়;
কচুবন সামনে এলে
ওর ঘোঁৎ-ঘোঁৎও কানে আসে না।
উচ্ছিষ্ট হাড় আর কচুর এমন মোহনীয় যাদু
মানুষের বোধের অতীত।

টের পাই দিন দিন পাড়ায় বাড়ছে কুকুর;
বাড়ছে শুয়োর সমান তালে পাল্লা দিয়ে।
একদিন সবাই কুকুর আর শুয়োর হয়ে গেলে
থেমে যাবে সব রাতজাগা ছটফট যন্ত্রণা, নির্ঘুম ক্লান্তি।

ইনসোমনিয়া মানুষেরই হয়;
কুকুর কিম্বা শুয়োরের নয়।

 

কারাগার
.
দেখ ঈশ্বর, আমি কিন্তু এখানে আসতে চাইনি।
বলা যায়, আমার অনিচ্ছেতেই তুমি
জোর করে
আমাকে পাঠিয়েছ।
বলেছিলে, এ জমীন তোমার। এ আকাশ তোমার।
এ পাহাড়, নদী, সমুদ্র— সব, সব কিছুই তোমার।

আমি চাইলেই প্রাণ ভরে আকাশ দেখতে পারি,
আমি চাইলেই বুক ভরে শ্বাস নিতে পারি,
আমি চাইলেই তোমার স্নেহে
একটা জীবন হাসতে হাসতে কাটাতে পারি।

বিনিময়ে যে পূজা চেয়েছিলে, ঈশ্বর,
তা আমি নিয়ম করে রোজ
তোমার পাতে বেড়ে দিই,
পরম যত্নে, ভক্তিরসে সিক্ত করে।

রূপকথার কোনো এক দেশের
নির্বাচনী প্রতীজ্ঞার মতোই
তুমিও ঠকালে, ঈশ্বর !
লোভের কালো ধোঁয়ায় তোমার আকাশে অন্ধকার,
বাতাসে ছড়ানো শ্বাস-বন্ধ-করা বিষ,
বেঁচে থাকার নূন্যতম শর্তে
তোমার জমীন
আমাকে কিনতে হয় !
তোমার পাহাড়, নদী, সমুদ্র, সব লুট হয়ে গেছে, ঈশ্বর।

লুটেরার দল পয়সা ছাড়া
আমাকে পাহাড় দেখতে দেয় না,
লুটেরার দল পয়সা ছাড়া
আমাকে সমুদ্র দেখতে দেয় না,
লুটেরার দল পয়সার জালে
আমার বাঁচার সব রসদ আটকে দিয়েছে।
লুটেরার দল,
তোমাকে বোবা, কালা আর অন্ধ করে দিয়েছে।

লুটেরার দল
আমাকে কাঁটাতারের খাঁচায় আটকে রেখেছে।
ঈশ্বর, কাঁটাতারের খাঁচায় বন্দী এ জীবন
আমার ভাল্লাগে না।

 

ভয়
.
ভালোবাসা নয়,
চারিদিকে জমাট বেঁধে আছে
ছোপ ছোপ নিরেট ভয়।

ভয়েরা লেগে থাকে পিছে,
চোখ মেললেই চোখের সামনে
দল বেঁধে নির্ভয়ে দুলিছে।

যতটা পারি, মিথ্যের রঙ মাখি;
সত্যের পদধ্বনি শ্রবণের আগে
কানের দরোজা দুটোও ঢাকি।

সযতনে মুখ এটে রাখি,
জিহ্বার দাম বড্ড বেশি;
খরচ না করে চুপ মেরে থাকি।

ভয় দেখে সহসা যদি
ভয় পেয়ে যাই, বাছা !
দু’চোখ এটে রাখি নিরবধি।

এখনও আসেনি দিন—
তাই অবাক হওয়ার আগে
নিরবে গুনে যাই, এক-দুই-তিন।

সবে ঈঙ্গিতে কথা কয়;
থেমে গেছে সব কলরব।
গলা ছেড়ে গান করে ভয়।

ভালোবাসা নয়,
চারিদিকে জমাট বেঁধে আছে
ছোপ ছোপ নিরেট ভয়।

 

বুদ্ধিমান
.
সত্যটা যখন পেটের ভিতরে মোচড় দিতে দিতে
আমার গলা বেয়ে উপরে উঠে আসছিল,
আমি দু’পাটি দাঁত শক্ত করে চেপে ঢোক গিলে
আবারও তাকে পেটের তলদেশে পাঠিয়ে দিয়েছি।

কেউ বাহবা দিয়ে বলেছে, ধৈর্যশীল।
কেউ ভেবেছে, ভেতরের খবর না-জানা বেকুব।
কেউ কেউ কিছু বলেও নি, কিছু ভাবেও নি।
কেউ কেউ অপেক্ষায় থাকে, সত্যটা যেন হজম হয়ে
দেহের পিছন-দরজা দিয়ে গোপনে বেরিয়ে যায়।
গলার মতোন সদর দরজা খুললেই ঘনিয়ে আসে দুর্বিপাক।

সূর্যোজ্জ্বল স্পষ্ট দ্বিপ্রহরে সভয়ে দেখেছি,
বুদ্ধিমানেরা পরম মমতায়
ধৈর্যশীল কিম্বা বেকুবের নিশ্চিন্ত জীবন বেছে নিচ্ছে
রোজ, দু’পাটি দাঁত শক্ত করে চেপে, ঢোক গিলে।

গলার মতোন সদর দরজা খুললেই চারিদিকে বিভীষিকা।

 

বাবা
.
জ্যোতিষী মুচকি হেসে বলেছিল,
‘বাবার দরবারে এসে খালি হাতে কেউ ফেরেনি।
একবার ভক্তি-ভরা গদগদ গলায় আমাকে বাবা বলে ডাক।’

যারা ডেকেছে, তাদের দু’হাত উপচে পড়েছে।
লক্ষ্মী এসে সকাল-সন্ধ্যা তাদের সদর দরজায় চুপচাপ বসে থেকেছে।
আমি চেষ্টা করেও জ্যোতিষীকে বাবা ডাকতে পারিনি;
আমার জন্মদাতা বাবার মুখ খুব স্পষ্ট হয়ে চোখের সামনে দোল খায়।

জ্যোতিষীর দরবারে মাদুলির স্তুপ;
ভক্তের কোমরে মেরুদণ্ড ঘিরে, গলায় কণ্ঠ ও শ্বাসনালী ঘিরে,
বাহুতে সবটুকু পৌরুষ ঘিরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে মাদুলির মন্ত্র।

আমি চুরি করে এক ফাঁকে একটি মাদুলির মন্ত্র খুলে দেখেছিলাম,
খুব স্পষ্ট সরল ভাষায় ভেতরে লেখা ছিল,
‘সর্বরোগ হতে মুক্তি নিহিত অভিন্ন-স্বার্থে কিম্বা মেরুদণ্ড খুলে ফেলায়।’

আমি চেষ্টা করেও জ্যোতিষীকে বাবা ডাকতে পারিনি;
মাদুলিবিহীন আমার এ মেরুদণ্ডী-দেহ সর্বরোগে পীড়িত।

আরো পড়তে পারেন

আহমেদ ফরিদের একগুচ্ছ কবিতা

তোমার সাথে দেখা হওয়া জরুরী নয় সেদিন তুমি আমাকের ডেকে বললে, ”আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি ঝরছে এসো চা খেয়ে যাও ঝাল মুড়ি, পেঁয়াজ ভেজে দেবো সঙ্গে কাঁচালংকাও থাকবে। দুজনে চা খাব, মুড়ি খাব, আর গল্প করবো।’ আমি বললাম, ’না, আমি যাবো না । আমি আমার জানালায় বসে আকাশ দেখছি, বৃষ্টি দেখছি, আকাশের কান্না দেখছি, গাছেদের নুয়ে….

নিকোলাই রুবৎসভের কবিতা

নিকোলাই মিখাইলোভিচ রুবৎসভ (৩ জানুয়ারি ১৯৩৬ – ১৯ জানুয়ারি ১৯৭১) মাত্র পঁয়ত্রিশ বছরের জীবন পেয়েছেন রুশ কবি নিকোলাই রুবৎসভ। দুর্ভাগ্য তাঁকে তাড়া করেছে সারাজীবন। শৈশবে মায়ের মৃত্যু ও পিতার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য তাঁর স্থান হয় শিশু আশ্রমে। পড়াশোনা শেষ করার আগেই জীবিকার তাগিদে তাকে খনিতে, জাহাজে কাজ করতে হয়। সৈন্য বাহিনীতে যোগ দেওয়ার….

সোহরাব পাশা’র একগুচ্ছ কবিতা

নিদ্রিত ঘ্রাণের শব্দ দীর্ঘ যায় আশালতা ফিরে আসে বিষণ্ণ গোধূলি ফিরে আসে দুঃখিত সকাল, ক্ষয়ে যাওয়া এক দূরের উপনিবেশ পাখির চেয়ে মানুষের কোলাহল বেশি কোনো মৃত্যু মানুষকে অপরাধী করে না নিঃশ্বাসের রোদে আবছায়া নিদ্রিত মেঘ স্মৃতির অসুখ বাড়ে; দূরে নির্জন আধাঁরে জেগে ছিলো মানুষের কথা পুরনো সে বাড়ি সেই ছায়াপথ মায়াপথ জুড়ে কতো ভুল মানুষের….

error: Content is protected !!