
‘‘জাতে হয়তো মেথর হবে, কিংবা নেহাত ওঁচা,
যাত্রীঘরের করে ঝাড়ামোছা,
পঁচিশ টাকা দিতেই হবে তাকে!
এমন হলে দেউলে হতে কদিন বাকি থাকে।’’
বিলাসপুর ইস্টেশনে ট্রেন বদল করতে হবে, ছয় ঘন্টার বিরতি। ধরে নিচ্ছি যাত্রীটি রবীন্দ্রনাথ নিজেই, সাথের বিনু নামের মেয়েটি তাঁর অসুস্থ স্ত্রী মৃণালিনী দেবী। বিনু গল্প জুড়ে দিয়েছে যাত্রীঘরের মেথর রুক্মিনীর সাথে। সব কিছুতেই বিনুর কৌতুহল। অচ্ছুত রুক্মিনীর মেয়ের বিয়ে, পঁচিশ টাকা লাগবে, সে খরচের দায় বিনু ঘাড়ে নিতে চায়। রুক্মিনীর গল্প সত্যি না মিথ্যে তা যাচাই করে দেখবে এমন হৃদয়হীন বিনু নয়। কিন্তু বিনুর স্বামী বিচক্ষণ- তিনি আড়ালে গিয়ে রুক্মিনীকে ধমক দিয়ে তার হাতে দুই টাকা গছিয়ে দিলেন- বিনু জানতেও পারলো না। দুই মাস পরে বিনু মারা গেল। সেই না-দেওয়া পঁচিশ টাকার বোঝা কাঁধে করে বিনুর স্বামী রুক্মিনীকে খুঁজে বেড়ালেন, কিন্তু এমন সামান্য নারীর খোঁজ কে রাখে?
শুনেছি ধর্ম নাকি কুকুরের বেশে ধর্মরাজ যুধিষ্টিরের ধর্ম পরীক্ষা করেছিল। একালে ধর্ম রুক্মিনীদের পাঠায়। এরকম কতো রুক্মিনীরদের সাথে দেখা হয়, তাদের গল্প শোনার ধৈর্য আমাদের নেই। কখন আবার পঁচিশ টাকা চেয়ে বসে, সে ভয় তো আছেই! অস্পৃশ্য, দলিত, মেথর, অভাবী কুলির বউ রুক্মিনীর মাঝে ধর্মকে চিনে নিতে বিনুর একটুও ভুল হয়নি।
“বিন্দু” রুক্মিনীর চেয়েও আটকপালে। রবীন্দ্রনাথ বিন্দুর গল্প শুনিয়েছেন একটি চিঠি থেকে- স্বামীর কাছে লেখা মৃনালের চিঠি -“স্ত্রীর পত্র”। মা-বাবা নেই, আশ্রয়হীন কিশোরী- “দেখতে এমনি মন্দ যে পড়ে গিয়ে সে যদি মাথা ভাঙত তবে ঘরের মেঝেটার জন্যেই লোকে উদবিগ্ন হতো।” এ মেয়ে যাবে কোথায়? “পৃথিবীর মধ্যে সব চেয়ে অকিঞ্চিৎকর মানুষকে আশ্রয় দেওয়াই সব চেয়ে কঠিন। আশ্রয়ের দরকার তার যত বেশি আশ্রয়ের বাধাও তার তেমনি বিষম।’ পাগল স্বামী জুটলো বিন্দুর কপালে, শাশুড়ির নির্যাতন থেকে রেহাই মিললো কাপড়ে আগুন দিয়ে মরে। অনেকে রবীন্দ্রনাথের “স্ত্রীর পত্র” কে ইবসেনের “ডলস হাউস” উপন্যাসের সাথে তুলনা করেছেন। এই উপন্যাসটি প্রচলিত সমাজবিধির কালাপাহাড়, নারী-স্বাধীনতার বেদিতে মা-সন্তানের বন্ধনকেও বলি দেয়া হয়েছে। বাবার “আদরের মেয়ে,” “স্বামীর স্ত্রী”, বা “সন্তানের মা”- এই পরিচয়ের বাইরে মেয়েদের আর কোনো পরিচয় আছে কি? সেই পরিচয়ের খোঁজেই “নোরা” স্বামী-সন্তান-ঘর ছেড়ে বাইরে বেড়িয়ে পড়েন। স্বামীর ঘরে বিন্দুর অসন্মানের কারণ তার রূপের অভাব, আর মৃনালের সন্মানের কারণ তার রূপের আধিক্য। এই সন্মানে গৌরব নেই, “স্ত্রীর পত্রের” মৃনাল তাঁর স্বামীর মাখন বড়াল লেন ঠিকানায় আর ফিরবেন না।
রবীন্দ্রনাথ একজন স্বপ্নদ্রষ্টা কবি। তবুও নারী-স্বাধীনতার ক্ষেত্রে তিনি তাঁর যুগের বাইরে যেতে পারেননি। চোদ্দ বছরের মেয়েকে আইবুড়ো অপবাদ দেয়ার দিন একেবারেই চলে গেছে। রবীন্দ্রনাথের “অবলার বল” দিয়ে একজন বর্বরের সাথে যুদ্ধ চলে না। পকেটে টাকা নেই, চাকুরী নেই- নোরা বরফ পড়া শীতের রাতে স্বামী-সন্তান-ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়লেন- বুদ্ধিবিবেচনাহীন কান্ড। এ থেকে মেয়েদের মুক্তি নয়- আরো সর্বনাশ ঘটে। সবার আগে চাই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা
“যোগাযোগ” উপন্যাসের “কুমু” নলিনীর মতো একটি মেয়ে, বিলেত-ফেরত নয়, তবে সে তেমনি রূপসী- কালিদাস পড়ে, বেহালা বজায়, দাবা খেলতে জানে। তার বিয়ে হলো একজন স্থুল, অমার্জিত, চরিত্রহীন, নব্য-ধনীর সাথে। রবীন্দ্রনাথ এদের “যোগাযোগ” করিয়ে দিলেন কুমুর কোলে একটি সন্তান দিয়ে। বিন্দুর মৃত্যু যদি বা সহ্য হয়, কুমুর যন্ত্রণা অসহ্য। এমন “যোগাযোগের” চেয়ে মরণ অনেক ভালো। দেনাপাওনা গল্পের নিরুপমার বিয়েতে দশ হাজার টাকার বরপণের তিন হাজার টাকা ছিলো বাঁকি। সেই অপরাধে নিরুর আর বাবার বাড়ি ফেরা হয় নি। অনেক অসন্মান আর অনাদরে শশুর বাড়িতেই তার মৃত্যু হলো।
স্বামী-সন্তান ছেড়ে বরফ-পড়া শীতের রাতে কপর্দকহীন নোরার “door-slamming exit” ভারী নাটকীয়, হয়তোবা নির্বুদ্ধিতা। মৃনালের চিঠি অনেক ঠান্ডা মাথায় লেখা। মৃনালের সন্তান নাই, তাই রবীন্দ্রনাথ মাতৃত্বের শেকল ভাঙার চরম-প্রশ্ন সহজেই এড়িয়ে গেছেন। তিনি তাঁর অতুলনীয় লেখনীর সর্বশক্তি ব্যায় করেছেন এই চিঠিতে : দয়াহীন, মনুষ্যত্বহীন, পুরুষ-শাসিত সমাজকে মার্জিত ভাষায় এর চেয়ে বেশি গালাগালি করা সম্ভব না। ওদিকে ইবসেন গল্পটি লিখেছেন নাটকের সাদামাটা ভাষায়, নোরার অন্তর্দাহ সহজেই চোখে পড়ে। ইবসেন নিজেকে ফেমিনিস্ট বলে পরিচয় দিতে আপত্তি করেছেন। “নারী-মুক্তি আন্দোলনের জন্য নয়, আমার লেখা সমগ্র মানবতার গল্প”, এই ছিল তাঁর দাবী।
১৮৭৯ সালে নোরার মতো নারী চরিত্র ছিল বেমানান। বিতর্কের ঝড় উঠেছিলো চারিদিকে। এক বিখ্যাত জার্মান অভিনেত্রী এই নাটকে অভিনয় করতে রাজী হননি। ইবসেন নাটকের শেষ দৃশ্যটি তখন নতুন করে লেখেন, যেখানে শিশুর ঘুমন্ত মুখ মাকে মায়ার জালে জড়িয়ে ফেলে। পরে তিনি অবশ্য আবার আগের ভাষ্যে ফিরে যান। নাটকের পরিবর্তিত শেষ অংশটি ছিল এরকম :
NORA: Where we could make a real marriage out of our lives together. Goodbye. (Begins to go)
HELMER: Go then! (Seizes her arm.) But first you shall see your children for the last time!
NORA: Let me go! I will not see them! I cannot!
HELMER: (draws her over to the door, left) You shall see them. (Opens the door and says softly.) Look, there they are asleep, peaceful and carefree. Tomorrow, when they wake up and call for their mother, they will be – motherless.
NORA: (trembling) Motherless….!
HELMER: As you once were.
NORA: Motherless! (Struggles with herself, lets her travelling-bag fall and says.) Oh, this is a sin against myself, but I cannot leave them, (Half sinks down by the door).
HELMER: (joyfully, but softly) Nora!
(The curtain falls.)
রবীন্দ্রনাথ কি ফেমিনিস্ট ছিলেন? তাঁর লেখায় আছে গভীর মানবতাবোধ- তাঁর কাছে শিখেছি ন্যায়-অন্যায়, শালীনতা, নম্রতা, ভালোবাসা। পনপ্রথা, বাল্যবিবাহ, বিধবাবিবাহ, সতীদাহ নিয়ে অনেক গল্প লিখেছেন তিনি। “প্রতিবেশিনী” গল্পের বাল্যবিধবার বিয়েতে রবীন্দ্রনাথের আপত্তি নেই, কিন্তু “বেহারীর” মতো সুপাত্র হাতের কাছে থাকতেও “চোখের বালির” বিধবা বিনোদিনীর বিয়ে আর হলো না। এমন অনেক অসঙ্গতি চোখে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ “অবলার বল” কথাটি প্রচলন করেছেন- অনেকটা অসহযোগ আন্দোলনের মতো। “তুমি মৃত্যুর চেয়ে বড় নয়”- নিপীড়নকারীকে রবীন্দ্রনাথ একথা শোনাতে চেয়েছেন। এসব শুধুই সান্ত্বনার কথা, কাজের কথা নয়।
রবীন্দ্রনাথ নিজে বাইশ বছর বয়েসে দশ বছরের মৃনালিনী দেবীকে বিয়ে করেন। মেয়ে মাধুরীলতা, রেনুকা এবং মীরার বিয়ে হয় যখন ওরা যথাক্রমে পনের, দশ এবং বারো বছরের কিশোরী। বিয়েগুলি তেমন সুখের হয়নি, তা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ক্ষোভের অন্ত ছিল না। ছেলে রথীন্দ্রনাথকে ১৯০৬ সালে আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর কোনো মেয়ের এ সুযোগ হয়নি।
রবীন্দ্রনাথের গল্পে অনেক পিতা পাওয়া যাবে যারা শিক্ষা বা অন্য যে কোনো ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়ের মাঝে কোনো প্রভেদ রাখেনি। পিতা হিসেবে রবিন্দ্রনাথ সে উদারতা দেখাননি। ফেমিনিস্ট শব্দের আভিধানিক অর্থ : নারী সমানাধিকার আন্দোলনের প্রবক্তা। যারা সবার পিছে, সবার নীচে, প্রান্তিক অবস্থানে পড়ে আছে, তাদের সবার কথাই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন। কিন্তু জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর সমানাধিকার নিয়ে তিনি সোচ্চার ছিলেন না।
রবীন্দ্রনাথ মেয়েদের কল্যানী, মাতা, প্রেমিকা হিসেবেই দেখেছেন- অফিসের চাকুরে বা কারখানার শ্রমিক হিসেবে নয়। রবীন্দ্রনাথ একজন স্বপ্নদ্রষ্টা কবি। তবুও নারী-স্বাধীনতার ক্ষেত্রে তিনি তাঁর যুগের বাইরে যেতে পারেননি। চোদ্দ বছরের মেয়েকে আইবুড়ো অপবাদ দেয়ার দিন একেবারেই চলে গেছে। রবীন্দ্রনাথের “অবলার বল” দিয়ে একজন বর্বরের সাথে যুদ্ধ চলে না। পকেটে টাকা নেই, চাকুরী নেই- নোরা বরফ পড়া শীতের রাতে স্বামী-সন্তান-ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়লেন- বুদ্ধিবিবেচনাহীন কান্ড। এ থেকে মেয়েদের মুক্তি নয়- আরো সর্বনাশ ঘটে। সবার আগে চাই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। আজ বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ মেয়ে সেলাই কারখানায় কাজ করছে, গ্রামে-গঞ্জে দোকান খুলে বসেছে, গরু ছাগলের খামার করেছে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতাই এনে দিচ্ছে নারীর মর্যদা ও মুক্তি। মায়ের কাছে মোল্লারা ধীরে ধীরে হেরে যাচ্ছে। একালের “বিন্দু” রা আর অত অসহায় নয়।