Author Picture

পর্নোগ্রাফিক জমানা ও বর্তমানের পর্নোগ্রাফি

রেজাউল করিম রনি

যখন একটা কাল বা জমানাকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয় তখন সেই কালের কিছু প্রধান লক্ষণকে সেই জমানার মূল চালিকা শক্তি ধরে নিয়ে সেই কালের নামকরণ করা হয়। গ্রীক সভ্যতার কাল, ইসলামী সভ্যতার কাল, শিল্প জমানা, বিজ্ঞানের কাল ইত্যাদি বিভিন্ন নামকরণ আমরা যেমন দেখি- একই ভাবে এখনকার এই বর্তমান কালকে পর্নোগ্রাফিক জমানা বলা হচ্ছে। বিখ্যাত ফরাশি দার্শনিক এলান বাদিউ’র প্রকাশিত (First published in 2013 in France as ‘Pornographie du temps present’ by Alain Badiou, এবং ইংরেজি সংষ্করণ প্রকাশিত হয়, The Pornographic Age-নামে) ছোট বইটা পড়তে গিয়ে কিছু ভাবনা জেগেছে। বাদিউর মূল ফরাশি নামটা দেখলে ইংরেজিতে এটাকে বলা যায়, ‘পর্নোগ্রাফি অফ দিস এইজ’ এটা অনুবাদকরাও উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তারা এই ছোট ২০ পাতার নোটের সাথে আরও তিনজনের ব্যাখ্যা যুক্ত করে বইটির তর্ককে বিস্তারিত করে নাম রেখেছেন, ‘The Pornographic Age’, আমরা আজকে এই বিষয় ধরে কিছু কথা বলতে চেষ্টা করবো।

একটা কাল বা জমানাকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয় তখন সেই কালের কিছু প্রধান লক্ষণকে সেই জমানার মূল চালিকা শক্তি ধরে নিয়ে সেই কালের নামকরণ করা হয়

ফ্রন্সের সোরবনে ২৬ জানুয়ারী ২০১৩ সালে এলান বাদিউ “Images of the Present Time” বা বর্তমান কালের চিত্র নামে যে লেকচারগুলো দিয়েছিলেন তারই লিখিত রুপ নিয়ে এই বই। বইটি নিয়ে চিন্তাশীল দুনিয়ায় খুব বেশি না হলেও কিছু কিছু আলোচনা হয়েছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বইটির কিছু পয়েণ্ট খুবই প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়েছে। মাত্র ১১৩ পাতার এই ছোট্ট বইটিতে মোট তিনটি লেখা স্থান পেয়েছে। মূল লেখাটি বাদিউর আর বাকি ২টা লেখা অন্য তিন জনের। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম বাদিউর লেখাটা ধরেই আগাবো। কিন্তু বইতে বাদিউর লেখাটা খুবই ছোট এবং এতোটাই জটিল আর্টিকুলেশন তিনি হাজির করেছেন যার সাথে আমি দার্শনিক পদ্ধতিগত দিক থেকেও একমত নই। মানে ওনার পদ্ধতির প্রতি আমি সবসময়ই ক্রিটিক্যাল। কিন্তু উনি যে বিষয়টি এখানে তুলে ধরেছেন তার গুরুত্ব অপরিসীম বিবেচনা করেই ছোট করে লিখতে চাই। ওনার চিন্তা পদ্ধতির ক্রিটিক করে এখানে সময় নষ্ট করতে চাই না। তাই সরাসরি বইটির বিস্তারিত আলোচনা বাদ রেখে জাস্ট কিছু প্রশ্ন ধরে কথা বলাই আজকের জন্য যথেষ্ট মনে করছি।

বাদিউ মনে করেন, দার্শনিকরা সবসময় অতীতচারিতা নিয়ে মেতে থাকেন। সব সময় মনে করেন, কোন একটা প্রশ্ন মনে হয় অনুলেখ্য রয়ে গেছে। কিছু একটা মিসিং হয়ে গেছে, অতীতে কিছু একটা গলদ রয়ে গেছে। এবং সেটাকে খুঁজতে চলে চান আরও দূর অতীতে। এর ফলে বর্তমানের চিত্রটা কী? সেই দিকে যথেস্ট মনোযোগ দেয়া হয় না। তাই তিনি বর্তমানের ইমেজটা কি তা বুঝতে চেষ্টা করার দিকে বেশি মনোযোগি। এই কাজে তিনি ব্যবহার করেছেন, নাটককে। বিখ্যাত (Jean Genet-এর The Balcony) নাটকটি ধরে আলোচনা শুরু করেছেন। বর্তমান সময়টি যখন ডিসঅর্ডারে (এটার বাংলা বিশৃ্ঙ্খলা করলে পুরোটা ধরা যায় না) ভরে যায় তখন সেই বর্তমানের ইমেজ(বাংলা হিসেবে ‘চিত্র’ শব্দটাও এখানে চলছে না) কেমন তা বুঝাতে এই নাটক খুব ভালো উদাহরণ। এটা নিয়ে জ্যক লাঁকাও কথা বলেছেন। এখানে এই নাটক আলোচনা করা উদ্দেশ্য না। তাছাড়া ফরাশি দেশের বর্তমান ইমেজ বুঝতে এই নটকের সূত্র ধরে বাদিউ যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা আমার দেশের ইমেজকে বুঝতে কিছু কিছু জায়গায় প্রাসঙ্গিক হলেও পুরোপুরি কাজে দিবে না।

কিছু একটা মিসিং হয়ে গেছে, অতীতে কিছু একটা গলদ রয়ে গেছে। এবং সেটাকে খুঁজতে চলে চান আরও দূর অতীতে। এর ফলে বর্তমানের চিত্রটা কী? সেই দিকে যথেস্ট মনোযোগ দেয়া হয় না

অন্যদিকে বাদিউর যে জটিল তাত্বিক আর্টিকুলেশন তা এখানে পেশ করে পাঠক-পাঠিকাকে বিরক্ত করারও মানে হয় না। যেমন থিয়েটারের সাথে দর্শনের সম্পর্ক? রাজনৈতিক পর্নোগ্রাফি ও গণতন্ত্রের বাজারি আকাঙ্খা, গণিত ও বাস্তবের ইমেজ ইত্যাদি বেশ কয়েটি জটিল ও সাদা চোখে পরস্পর বিচ্ছিন্ন দিক নিয়ে কথা বলতে হবে। বাদিউর লেখাটা এখানে মাত্র ২০ পাতার। বাকি প্রায় একশ পাতা জুড়ে তিন জন পন্ডিতের ব্যাখ্যা। কাজেই আমিও এখানে এই একই কাজ করতে চাই না। আগ্রহীরা মূল বইটা পড়ে নিবেন নিজ দায়িত্বে। এমনিতেই এই ধরণের লেখার পাঠকভাগ্য হতাশাজনক। তাই আমরা খুব সরল করে আমাদের সময়ের ইমেজটা বুঝতে চেষ্টা করবো। যেখানে এই বইটির হেল্প লাগবে আমরা কাজে লাগবো। কিন্তু বইটি ধরে ধারাবাহিক আলোচনা তাই বাদ রাখছি। এখানে নিজেরা নিজেদের মতো করে ভাবতে চেষ্টা করবো।

এই সময়ের ইমেজ বলতে আমরা যা বুঝি তার সাথে পর্নোগ্রাফির সম্পর্ক কী? এখানে পর্নোগ্রাফি বলতে আমরা একটা ধারণার কথা বলছি। কোন একটা নীল, নিষিদ্ধ বা যৌন উত্তেজনা তৈরি করে এমন কোন নির্দিষ্ট সিন বা ছায়া-ছবির কথা বলছি না। বলছি আইডিয়া হিসেবে ‘পর্নোগ্রাফি’ যা সেই কথা। মানে পর্নোগ্রাফি কি কারণে পর্নোগ্রাফি এবং সেই নিহিত কারণের সাথে এই সময়, মানে এই বর্তমানের সম্পর্কটা কী? বাদিউ দ্যা বেলকনি নাটকটি নিয়ে আলোচনা করার পরে যে ধারণটা নিয়ে বর্তমানের সাথে এই পর্নোগ্রাফিক জনামার সূত্র তা হলো, ডেমোক্রেসি যার আদুরে বাংলা আমরা করেছি গণতন্ত্র।

এখানে মনে রাখতে হবে, বাদিউ আত্মস্বীকৃত প্লেটোবাদি। এর সাথে যুক্ত করেছেন কমিউনিজম। বামপন্থি কমিউনিজম থেকে একটু আলদা বাদিউর এই কমিউনিজম। সহজ করে বলা যায়, প্লোটোনিক কমিউনিজম= বাদিউ। প্লেটো গণতন্ত্রের যে সমালোচনা করেছিলেন, যে সব সমস্যার কথা বলেছেন তা প্রায় আজ হুবহু মিলে যাচ্ছে। ফলে গণতন্ত্রের পশ্চিমা মডেল এর সূত্র ধরে ক্ষমতার ফ্যাসিবাদি রুপটি এখন প্রকাশিত হয়ে গেছে। তাই শাসন পদ্ধতি নিয়ে বিপুল দার্শনিক চিন্তার প্রয়োজন আবার দেখা দিয়েছে। যাক সেই আলোচনা অন্য সময়ে করা যাবে।

গণতন্ত্র কায়েম হলেও ব্যক্তির স্বাধীনতা পাওয়া হচ্ছে না। আকাঙ্খা পূরণের কোন ওয়াদাই বাস্তবায়িত হচ্ছে না। গণতন্ত্রে খোদ গণতন্ত্র ছাড়া আর সব আছে

তো গণতন্ত্র কি ভাবে নিজের আ্যাপিল বা গ্রহণযোগ্যতা দাবি করে? দাবি করে কিসের ভিত্তিতে? এটা করে মূলত ব্যক্তি মানুষের তাঁর স্বাধীনতার স্পৃহার প্রতি যে প্রবণ টান তাকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। গণতন্ত্র এটা বুঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, আমাকে তুমি জিন্দা করো আমি তোমার সব স্বাধীনতা ও কামনা-বাসনা পূরণের ব্যাক্তিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় রক্ষাবেস্টী প্রদান করবো। মানে ব্যক্তির যে ডিজায়ার বা কামনা এটাকে সে সব চেয়ে বেশি মূল্য দেয়, ফলে মানুষও গণতন্ত্রকে বেশি মূল্য দেয়। প্রধান রক্ষাকবচ হিসেবে এই কালে গণতন্ত্রের বিকল্প আর কিছু নাই। ফলে গণতন্ত্রকে যেকোন মূল্যে প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়েই কেবল মাত্র ব্যাক্তির কামনা বা আকাঙ্খা পূরণ হতে পারে- এটাই গণতন্ত্র বলে আসছে। কিন্তু এইখানে প্যারোডি বা কমেডি হলো, খোদ গণতন্ত্রেই নাই গণতন্ত্রময়তা। মানে এখানে ট্রুথের বা সত্যের অপলাপ বা লেকিং আছে। ফলে গণতন্ত্র কায়েম হলেও ব্যক্তির স্বাধীনতা পাওয়া হচ্ছে না। আকাঙ্খা পূরণের কোন ওয়াদাই বাস্তবায়িত হচ্ছে না। গণতন্ত্রে খোদ গণতন্ত্র ছাড়া আর সব আছে।

এবার দেখেন পর্নোগ্রাফিতে কি হয়? পর্নোগ্রাফি মূলত যা করে তা হলো- যৌনতার আকাঙ্খাকে খুব চরম পর্যায়ে রুপায়িত করে। পর্নোগ্রাফিতে অনেক কিছু থাকে কিন্তু থাকে না বাস্তবের মতো যৌনতা। যে যৌনতার কামনা ও আকাঙ্খা থেকেই পর্নোগ্রাফির প্রতি মানুষ আকৃষ্ট হয়, ভোক্তা হয়, এটা সেই আকাঙ্খাকে কেবল বাড়াতে পারে কোন ভাবেই পূরণ করতে পারে না। কারণ, পর্নোগ্রাফি যৌনতার ন্যাচারাল বা বাস্তব যে স্বভাব তাকে ফ্যান্টাসাইজ করে ব্যাক্তিকে উত্তেজিত করতে পারে। সেই উত্তেজিত ব্যাক্তি বাস্তবে যে সেই যৌনতার চর্চা করতে গেলে কি অবস্থা হয় তার কোন বর্ণনা আশা করি দরকার নাই। তা হলে দেখা যাচ্ছে পর্নোগ্রাফির মূল যে কনটেন সেই যৌনতা ছাড়া আর সব আছে। অতি সরল করে আমি বাদিউর এই আলোচনাটা নিজেদের অবস্থাকে বুঝতে ব্যাখ্যার চেষ্টা করছি। আশা করি পন্ডিত পাঠক এই সরলীকরণ ক্ষমা করবেন। তাইলে আমরা দেখতে পাচ্ছি গণতন্ত্র আমাদের যে বাস্তবতার কথা বলে, যে আকাঙ্খার কথা বলে প্রলুব্ধ করে, বাজারের দাসে পরিণত করে, কখনও বা বিপুল জনজোয়ার (যা গণতন্ত্রের খুবই পছন্দ) উস্কে দিয়ে ফ্যাসিবাদের হাতে আমাদের কব্জা করে ফেলে- পর্নোগ্রাফিও ঠিক একই ভাবে আমাদের প্রতারিত করে। এই প্রতারণার বিশাল অর্থমূল্য বা বাজারও রয়েছে। ফলে এটা একটা বিধান বা প্রবণতা হিসেবে সহজেই জায়গা করে দিতে পেরেছে।

এই প্রতারণার বিশাল অর্থমূল্য বা বাজারও রয়েছে। ফলে এটা একটা বিধান বা প্রবণতা হিসেবে সহজেই জায়গা করে দিতে পেরেছে

দ্যা বেলকোনি নাটকে ব্রোথেলকে ভূমি বা স্থান হিসেবে দেখানো হয়েছে। সব মানুষ চাইলেই যেমন ব্রোথেলে যেতে পারে না। তার কিছু নিয়ম-নীতি আছে। এবং ব্রোথেলকে এক বিমূর্ত স্থান হিসেবে দেখে থাকে বাইরের মানুষ। স্পষ্ট ধারণা বাইরে থেকে পাওয়ার সুযোগ নাই। ডিজিটাল যুগে ব্রোথেল বা যৌনশালা বলতে বিশেষ কোন এলকা বা ঘরকে বুঝয় না। এটা সাইবার স্পেস থেকে শুরু করে একটা ছোট সেল ফোনের মধ্যেও ফাংশন করতে পারে। মানে এই কালে স্থান না ইমেজই প্রধান। ফলে সেই নাটকের সূত্র ধরে বাদিউ যে ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন এখন সেটা খাপ খাবে না। তবে এই চিন্তার সারজিনিস খুব প্রাসঙ্গিক। আমাদের প্রতিটি কাজের বা বাস্তবতার বা রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ভেতর থেকে যদি বাস্তব মানে যা রিয়েল তার ইমেজ উদ্ধার করতে চাই তা হলে দেখতে পাবো পুরো প্রক্রিয়া পর্নোগ্রাফির দখলে চলে গেছে। তাহলে এই সময়টা যে পর্নোগ্রাফিক তা আমরা বুঝবো কেমন করে? বুঝবো যখন কোন কিছুকে অতিরঞ্জিত করে তোলা হয়, কোন কিছুকে তার প্রকৃত অবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য যে আয়োজন করা হয় তার ধরণটাই হলো পর্নোগ্রাফিক ধরণ। সেই দিক থেকে এই কালকে পর্নোগ্রাফিক কাল হিসেবে মানতে আশা করি খুব সমস্যা হবে না। অর্থ শক্তি বিনিয়োগ করে কেউ ক্ষমতা দখল করে প্রথম ভাষণেই জনগণকে ধন্যবাদ দিলো, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে বলে সবাইকে সাধুবাদ দিয়ে জনগণের কল্যাণে নিজে নিবেদিত প্রাণ হয়ে কাজ করবে বলে শপথ নিয়ে কাজ শুরু করে দিলো। আইন আদালতসহ সব কাঠামো ঠিক থাকলো, থাকলো না শুধু সেইসবের প্রকৃত বা বাস্তব ভূমিকা ও চরিত্র। এটা পিওর পর্নোগ্রাফি।

প্রতিটি কাজের বা বাস্তবতার বা রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ভেতর থেকে যদি বাস্তব মানে যা রিয়েল তার ইমেজ উদ্ধার করতে চাই তা হলে দেখতে পাবো পুরো প্রক্রিয়া পর্নোগ্রাফির দখলে চলে গেছে

যে আকাঙ্খার প্রচার, প্রতিশ্রুতি দেখি বা যে ঘটনা ঘটাতে দেখি তার সাথে যাপিত বাস্তবের কোন মিল যে নাই, শুধু না, বরং বাস্তবকে হত্যা করে তৈরি করা হয় এক হাইপার বা অতিবাস্তব। ঠিক পর্নোগ্রাফিতে যেমন করা হয়। পর্নোগ্রাফিতে বাস্তবের নারী ও তার যৌনতার এক প্রসেসড বা নির্মানকৃত রুপ হাজির করা হয়। খোদ যৌনতার সব উপাদান থাকে কিন্তু থাকে না বাস্তবতার বা প্রকৃত যৌনতার সত্য। এটাই পর্নোগ্রাফির বৈশিষ্ট্য। পর্নোগ্রাফি মানে সেক্স ভিডিও না। যৌনতার এই যে হাইপার অতি অবাস্তব উপস্থাপন এটাই পর্নোগ্রাফি। এই প্রবণতা যে কোন বিষয়ে বা যে কোন উপাদানে দেখতে পাওয়া গেলে তাকে পর্নোগ্রাফিক বলা যাবে। আমাদের সময়ের ইমেজ যদি দেখি তাহলে দেখতে পারো এ সময়ের সব কিছুই সব দিক থেকেই বাস্তবতার এক হাইপার রুপায়নে নিয়োজিত। সেই দিক থেকে এই জমানাকে ভালোভাবেই পর্নোগ্রাফিক বলা যায়। আর এই জমানার প্রধান পর্নোগ্রাফি হলো গণতন্ত্র। যার ভোক্তাতে পরিণত হয়ে আমরা গণতন্ত্রহীন গণতন্ত্রের শাসনে কেবল আশা পূরণের স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছি। যৌনতার আশায় যেমন মানুষ পর্নোগ্রাফির ভোক্তা হয়ে প্রতারিত হয়, এই ফেইক গণতন্ত্রের কালেও আমরা একই অবস্থায় বিরাজ করছি। পৃথিবীর প্রতিটি ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরতন্ত্র এখন গণতন্ত্রের আশ্রয়েই ফাংশন করে।

এখন স্বাভাবিক ভাবেই আসবে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী? এই প্রশ্নের আগে আমাদের তো বাস্তবতাকে বাস্তবতা আকারে বুঝতে হবে। এই অস্থায় বিপ্লব বা প্রতিরোধও কঠিন ও অকার্যকর হয়ে যায়। কারণ প্রতিরোধের জন্য বিপ্লবের জন্য প্রথমে প্রয়োজন বাস্তব অবস্থাকে বাস্তব রুপে চিহ্নিত করতে পারা, তার পরে সেই বাস্তবকে পাল্টে দেয়ার ধারাবাহিক ও পদ্ধতিগত সংগ্রামই তো বিপ্লবের জন্ম দেয়। কিন্তু আমাদের যে ধরণের বাস্তবতার মধ্যে বাস করতে হয়, তাতে তো বাস্তবতা নাই। রিয়ালিটি নাই। ফলে এখানে বিপ্লবেরও কোন প্রকল্প শক্ত ভিতের উপর দাঁড়াতে পারে না। এক একটা ইভেন্ট বা ঘটনা যেন পর্নোছবির এক একটা উত্তেজক সিনের মতোই, খুব আগ্রহ নিয়ে হাজির হয়, আবার দ্রুতই মিলিয়ে যায় বা শেষ হয়ে যায়। একই সামাজিক ও রাজনৈতিক এজেন্ডার বা প্রেক্ষিতের ভিন্ন ভিন্ন হাজিরা নানান ঘটনায় আমরা প্রত্যক্ষ করি । তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধেরও নানান উপলক্ষ্য হাজির হয়, কিন্তু সেই প্রতিরোধের সমাজিক ও রাজনৈতিক মতাদর্শ, এজেন্ডা ও প্রেক্ষিতও যেহেতু ফেইক তাই এই ফেইকের বিরুদ্ধে গজিয়ে ওঠা প্রতিরোধও আমাদের প্রতারিত করে। ফেইকের বিরুদ্ধে ফেইকের বিপ্লব বলতে পারেন। ফটকার বিরুদ্ধে ফটকার বিদ্রোহ চরম হতাশাকে সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। এটাও পর্নোগ্রাফিক ইমেজের সাথে মিলে যায়। ব্যাক্তি পর্নোগ্রাফি থেকে আনন্দ বা বিকার গোপনে চর্চা করে মনে করছে সে পর্নোগ্রাফিকে টেক্কা দিচ্ছে। কারণ সে আনন্দ নিচ্ছে, কিন্তু এটাকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না বা এটার এসেন্স নিচ্ছে না। কিন্তু পর্নো প্রস্তুতকারীও মনে করছে, এই ফেইক ইমেজ দিয়ে তারে আটকে রেখে টাকা কামায়ে নিচ্ছি। গবেট কোথাকার। এখানে একটা চোর-পুলিশ খেলা আছে। এরকম আরও বহু উদাহরন দেয়া যায়। কিন্তু মূল পয়েন্টটা অল্পতে বূঝতে পারলে সেটার আর দরকার নাই।

আরো পড়তে পারেন

ছাত্র-প্রতিবাদ: শক্তির এক প্রমাণপত্র

নিয়তি চিত্রনাট্য লেখে ঠিকই। তবে সেই কলমে কালিটা আপনাকেই জোগাতে হয়। নয়তো নিয়তি নিশ্চুপ বসে থাকে প্রাণহীন কলমের প্রান্ত হাতে; আর জীবন-ইতিহাসের পৃষ্ঠা সাদাই থেকে যায় আলস্যের করুণ পরিণতি হয়ে। সেই করুণ পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে যেতেই হঠাৎ আমাদের ছাত্রসমাজ বৈষম্যবিরোধী এক্সটেনশন নিয়ে হাজির হলো নিয়তিকে দিয়ে বাঙালির বিজয়গাঁথা লিখিয়ে নিতে। ‘এমন কতদিন কাঁদিনি /….

বাংলাদেশে চার্টার্ড সেক্রেটারী পেশার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

কিছুটা বিলম্ব হলেও বাংলাদেশে চার্টার্ড সেক্রেটারী পেশার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব সৃষ্টি হয়েছে। দেশের কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান সমূহে দক্ষ চার্টার্ড সেক্রেটারী তৈরিতে দেশে এই পেশার নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারীজ অব বাংলাদেশ (আইসিএসবি)’ অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে চার্টার্ড সেক্রেটারী আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে এই পেশার অগ্রযাত্রা শুরু হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন তিনটি….

একাত্তরের গণহত্যা প্রতিহত করা কি সম্ভব ছিল?

২৫ মার্চ কালরাতে বাঙালি জাতির স্বাধিকারের দাবিকে চিরতরে মুছে দিতে পাকিস্তানি নরঘাতকেরা যে নৃশংস হত্যাকান্ড চালিয়েছিল, তা বিশ্ব ইতিহাসে চিরকাল কলঙ্কময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ওই এক রাতেই শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই ৭ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। গ্রেফতার করা হয় প্রায় তিন হাজার। এর আগে ওই দিন সন্ধ্যায়, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সমঝোতা আলোচনা একতরফাভাবে….

error: Content is protected !!