
দুনিয়ার মহান দার্শনিকরা প্রায় সবাই ভালোবাসা বা প্রেম নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেছেন। এ বিষয়ে কিছু না কিছু পাওয়া যায় তাদের কাজে। কেউ কেউ তো এ বিষয়ে চিন্তার জন্যই অধিক গুরুত্ব পেয়ে থাকেন চিন্তার ইতিহাসে। দার্শনিকদের মধ্যে অনেকেই যৌনতা নিয়েও কথা বলেছেন। মনোবিজ্ঞানীদের মধ্যে যারা দার্শনিক হিসেবেও প্রসিদ্ধ যেমন ফ্রয়েড, লাঁকা তাদের কাজে মন বিশ্লেষণের বাইরেও যৌনতা নিয়ে প্রচুর কথা বলেছেন। কিন্তু সেটা হলো যৌনতার ধারণাগত বা যৌনতা একটা চিন্তার বিষয় হিসেবে আলোচিত হয়েছে তাদের কাজে। কিন্তু তাদের কাজে বা লেখায় নিজের যৌনতা নিয়ে সরাসরি কথা প্রায় নাই।
আত্মজীবনীগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সব সময়ই প্রশ্ন থাকে। তার পরেও বায়োগ্রাফিতেও দার্শনিকরা বিষয়টা খুব কমই ব্যক্তিগত জায়গা থেকে ডিল করেন (বিরল ব্যতিক্রম বাদে)। তবে তাদের নিয়ে অন্যরা যেসব বই-পত্র লিখেছেন তাতে দার্শনিকদের একান্ত ব্যাক্তিগত যৌনতা, প্রেম, ভালোবাসা, প্রত্যাখানের করুণ আখ্যান ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় স্বাভাবিকভাবেই উঠে এসেছে। আবার কখনোবা ‘সিক্রেট সেক্স লাইফ অব হানড্রেট ফেমোয়াস পিপল’ টাইপের বাজার চলতি বইয়ে অনেক ব্যক্তির যৌনজীবন নিয়ে সরস বয়ান লেখা হয়েছে। কিন্তু দার্শনিকরা যৌনতা নিয়ে এতো চিন্তা করেন। এতো কথা বলেছেন কেন বাদ রেখেছেন নিজের যৌনতা নিয়ে কথা বলা? এমনকি যারা তথাকথিত ইমপিরিক্যাল বা অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক হিসেবে প্রসিদ্ধ তারাও অভিজ্ঞতার দার্শনিক দিক নিয়ে ভেবেছেন কিন্তু নিজের যৌন অভিজ্ঞতার বিষয়টা তাদের কাজেও তেমন উল্লেখ পাওয়া যায় না। বিষয়টা একটু বিস্ময়কর।
অনেকেই এর আগে বলেছেন যে, দার্শনিকদের উচিত নিজের একান্ত যৌনজীবন নিয়েও কথা বলা। নিজেদের যৌনতার বিষয়টাও সরাসরি প্রকাশ করা। কিন্তু কেন তা পর্যাপ্ত নাই এবং করেন না -এ বিষয়টি দেরিদার আগে এমনভাবে কেউ খেয়াল করেছেন বলে উল্লেখ পাই নাই।
বিষয়টা প্রথমে নজরে আসে মহান ফরাসি দার্শনিক জ্যাক দেরিদার একটা প্রশ্নের উত্তরের সূত্র ধরে। ২০০২ সালে এইমি জেরিং কফম্যান দেরিদার একটা বায়োগ্রাফিক্যাল ডকুমেন্টারি বানাতে গিয়ে দেরিদাকে প্রশ্ন করেন, যদি দার্শনিক কান্ট, হেগেল বা হাইডেগারকে নিয়ে কোন ফিল্ম হয়, সেই ফিল্মে দেরিদা কি দেখার আশা করেন? দেরিদা একটু চুপ থেকে, কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে ধীর লয়ে উত্তর দেন, ‘দেয়ার সেক্স লাইফ’। তিনি তাদের যৌনজীবন জানতে আগ্রহী। উত্তর শুনে কফম্যানের মতো অনেকেই একটু টাসকি খেয়েছেন হয়তো। আমি ভীষণভাবে অবাক হয়েছি। পরে এই বিষয়ে বিস্তারিত খুঁজতে গিয়ে অনেক ধরনের লেখা-লেখি পেয়েছি। সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছি, মার্টিন ম্যাককুইলানের লেখা-লেখি থেকে। দেরিদার উত্তরটা নিয়ে তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। যা এ লেখাতে আমি অনুসরণ করেছি। দেরিদার সাফাই শুনে মনে হলো বিষয়টা তো আসলেই কৌতূহলোদ্দীপক। তাই ছোট করে শেয়ার করার চেষ্টা করছি।
দার্শনিকরা যৌনতা নিয়ে এতো চিন্তা করেন। এতো কথা বলেছেন কেন বাদ রেখেছেন নিজের যৌনতা নিয়ে কথা বলা?
এ উত্তর দেয়ার পরে, কফম্যান দেরিদাকে জিজ্ঞেস করলেন, কেন? এর পরে দেরিদা কারণটা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করতে শুরু করলেন। দেরিদা ব্যাখ্যা করলেন যে, সেইসব মহান দার্শনিক ( প্রশ্নে উল্লেখকৃত, কান্ট, হেলেগ ও হাইডেগার) কখনও নিজের যৌনজীবনের কথা তাদের দর্শনে বলেন নাই। তারা নিজেদের একধরণের অযৌন মানব বা অসেক্সচুয়াল হিসেবে হাজির করেছেন। তারা এসব বিষয় নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক কাজ করেছেন। দেরিদা যখন হদিস পেলেন, তারা প্রেম করেছেন। যৌনক্রিয়াতেও লিপ্ত হয়েছেন। কিন্তু এই দিকগুলোর কোন উল্লেখ তাদের কাজে নাই। তাই উনার আগ্রহ হলো তাদের নিয়ে কোন ফিল্ম হলে, ব্যক্তিগত যৌনজীবন সম্পর্কে জনাতে চাওয়া।
দর্শন এমনিতে প্রেম বা ভালোবাসা নিয়ে প্রচুর কথা বলেছে। কখনও কখনও মনে করা হয় দর্শন শুরুই হয় এই প্রশ্ন দিয়ে যে, ভালোবাসা বা প্রেম কী? এবং দেরিদা মনে করেন ব্যক্তি দার্শনিকদের এর পরেও নিজের একান্ত যৌনজীবন নিয়ে খুব সামান্য হলেও বলার দরকার আছে। অন্তত তাদের দার্শনিক রচনায় সেটা কিছুটা হলেও বলা প্রয়োজন। যদিও দর্শন ডিপারসোনালইজড/ ব্যক্তিগতহীনতার আলোকে সত্তা, জ্ঞান, যুক্তি ইত্যাদি সকল বিষয় ও বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে চিন্তার তরিকার অনুসন্ধান করে।
দেরিদার অভিব্যক্তির সাথে একমত পোষণ করেও বলা যায়, ট্রেডিশনালি দর্শনে একজনের ব্যক্তিগত প্রেম ও যৌনজীবনের কাসুন্দি উপস্থাপনের কোন সুযোগ নাই। তারপরেও একটু গভীরভাবে দর্শনের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে এসব দার্শনিকদের রচনাতেও যৌনতা বিষয়ে যে চিন্তাগুলো পাওয়া যায় তার মধ্যেও তাদের ব্যক্তিগত জীবনে যৌনতার সাথে মোকাবেলার একটা সম্পর্ক ধরা পড়েছে। যদিও এটার কোন সরাসরি উল্লেখ নাই বা থাকে না। কিন্তু এটা বুঝতে পারা যায় যে, কোন এক দার্শনিকের বিশেষ রকমের যৌনতা বিষয়ক চিন্তার পেছনে সেই দার্শনিকের নিজের জীবনে যৌনতার ভূমিকা বেশ ভালোই প্রভাব রেখেছে।
তাদের দর্শনে প্রেমের যে রূপ আমরা পাই তাকে প্লেটোনিক বলে জানি। এথেন্সে ছোট ছোট সুন্দর কিশোর-যুবাদের প্রতি আসক্তি ও প্রেমের কথা দার্শনিকদের রচনায় ভালোভাবেই উল্লেখ আছে
প্লেটো ও এরিস্টোটলের লেখা-লেখিতে দেখাতে পাবেন যে, তাদের কাজ গ্রিক প্রেমের রেফারেন্স দিয়ে ভরা। সেসব রচনার চরিত্রের মধ্যে সম্পর্কগুলো যদিও আমরা প্লেটোনিক/শরীরকেন্দ্রিকতাহীন প্রেম বলে যা বুঝি- সেই রকম নয়। কিন্তু তাদের দর্শনে প্রেমের যে রূপ আমরা পাই তাকে প্লেটোনিক বলে জানি। এথেন্সে ছোট ছোট সুন্দর কিশোর-যুবাদের প্রতি আসক্তি ও প্রেমের কথা দার্শনিকদের রচনায় ভালোভাবেই উল্লেখ আছে। কিন্তু খুব কারো ব্যক্তিগত সম্পর্কের কোন ফিরিস্তি নাই। অন্যেরা হয়তো একজনের সম্পর্ক নিয়ে বলছে, তত্ত্ব করছে। কিন্তু দার্শনিকের নিজের ব্যক্তিগত কোন বয়ান নাই। আছে ফিকশনাল বা আইডিয়াল বয়ান। এই বিষয়ে দার্শনিকরা বয়ান করলে মিথ্যা বলতেন না। কোন মহান দার্শনিক মিথ্যা বলেন নাই। হয়তো অনেক বিষয় ফিকশনাল করেছেন কিন্তু মিথ্যা বলেন না। কারণ, প্রকৃত দার্শনিক সত্যের সাধনাতেই জীবন ব্যয় করেন। ফলে দেরিদার আগ্রেহের কারণ খুবই স্বাভাবিক। মহান দার্শনিকরা সরাসরি নিজের যৌনতার কথা প্রকাশ করলে বিনা দ্বিধায়, ফিকশনের ধোঁয়াশা ছাড়া তাদের যৌনতার সাথে বোঝাপড়ার খতিয়ানটা জানতে পারা যেত। এটা খুবই আগ্রহের সাথে অন্যরা বুঝতে চাইতো তাতে কোন সন্দেহ নাই।
প্রখ্যাত ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিক সেন্ট অগাস্টিন তার রচনায় কনফেশন বা স্বীকারোক্তিমূলক একটি ধারার সংযোজন করেন। তার যাজক জীবন শুরুর আগের পর্বে বিভিন্ন নারীর সাথে তার প্রেমের কথা বলেছেন সেসব লেখাতে। এবং তিনি প্রভুর কাছে প্রার্থনা করেছেন তাকে যেন পবিত্রতা ( সতীত্ব অর্থে) এবং স্থীতি দান করা হয়। মধ্যযুগের আরেক পণ্ডিত,দার্শনিক পিটার এবেলারড ও তার প্রেমিকা দার্শনিক Héloïse d’Argenteuil পশ্চিমা দর্শনের পরিচিত আদি জুটি। তাদের প্রেম ও বিখ্যাত পত্রগুলো এবং পিটারের প্রেমের কবিতাগুলো তাদের প্রেমের সরাসরি দলিল হয়ে আছে। এ ধারায় যার নাম বিশেষভাবে স্মরণীয় তিনি হলেন জ্যা জ্যাক রুশো। তাঁর পত্রোপন্যাস ‘জুলি’ এবং ‘নিউ হ্যালোইস’-এ তার নিজের জীবনের প্রেম ও যৌনতার কথাই বলেছেন। এ উপন্যাসগুলো দর্শন ও ফিকশনের একধরনের মিশ্রণ বয়ান হাজির করেছে। এ ছাড়া রুশোর বিখ্যাত কনফেশনে তিনি তার প্রেম ও প্রত্যাখান, যৌনতার উদাম বয়ান হাজির করেছেন। যা প্রায় বিরল। এবং তিনি যে বাড়িতে কাজ করতেন সেই মালিকিনের সাথে তার প্রেমের অকপট বয়ানও তিনি হাজির করেছেন। এবং রুশো কান্টের পরে সেই বিস্ময়কর দার্শনিক যিনি হস্তমৈথুন নিয়ে প্রচুর কথা বলেছেন। যদিও কান্ট বিবাহ নিয়ে লিখেছেন এবং মাস্টারবেশনটাইপের আত্মপ্রেমের ধারণার বিষয়ে খুব ক্রিটিক্যাল ছিলেন।
যৌনতার সাথে তাদের মোকাবেলার দার্শনিক প্রকল্প ও প্রয়াসের মধ্যে নিজেদের ব্যক্তিগত যৌনতার ঝোঁক, রুচি, কামনা, পছন্দও ঠিকই সতর্ক পাঠক ধরে ফেলতে পারবেন
এ বিষয়ে আরেক প্রসিদ্ধ উদাহরণ হলেন, শোরেন কিয়েরকেগার্ড। তার লেখা ‘দ্যা সিডিউসারস ডাইরি’ -তে তরুণী নারীর সিডিউস বা সম্মোহনীপনা ও ম্যানুপুলেশনের বয়ান হাজির করেছেন। এ বইটা পড়তে পড়তে সহজেই এটা বুঝতে পারা যায় যে, এ বয়ান মূলত তৈরি হয়েছে, Regine Olsen-এর সাথে তার নিজের সম্পর্কের আলোকে। বা সেই সম্পর্কের নিরিখেই তিনি এ বয়ান হাজির করেছেন। এ ছাড়া দিদেরোর কামনা উগ্রেককারী ‘দ্যা নান’ এবং শোপেনহাওয়ারের থিসিস, ‘অন ওমেন’ -এগুলো পড়তে গেলে এটা বিশ্বাস করা মুশকিল যে, এগুলো তাদের পারসোনাল জীবনের অভিব্যক্তি ছাড়াই লিখিত হয়েছে। পুরুষ দার্শনিক হিসেবে আঠারো শতকের নীতির আলোকে নারীদের প্রতি তাদের দৃষ্টি-ভঙ্গি ও কামনা বাসনাই ধরা পড়েছে এসব লেখাতে। খ্রিষ্টান নীতিবোধ, বিবাহ, পরিবার ও মানুষের যৌনতা নিয়ে লিখতে গিয়ে নিজেদের যৌনরুচিকে তারা খুবই ইমপারসোনাল/অব্যক্তিগতভাবে হাজির করেছেন। কিন্তু যৌনতার সাথে তাদের মোকাবেলার দার্শনিক প্রকল্প ও প্রয়াসের মধ্যে নিজেদের ব্যক্তিগত যৌনতার ঝোঁক, রুচি, কামনা, পছন্দও ঠিকই সতর্ক পাঠক ধরে ফেলতে পারবেন।
এসব বিষয়ে মহান দার্শনিক হেগেলও প্রচুর কথা বলেছেন। তিনি পরিবার, ধর্ম, মানুষের যৌনতার নীতির বিষয়গুলো নিয়ে গভীরভাবে ভেবেছেন। কিন্তু সবকিছু এমনভাবে হাজির করেছেন যাতে তার নিজের যৌনতার কোন চিহ্নই নাই। তার নামে বিভিন্ন কথা চালু আছে। তার বোন এবং অন্যদেরকে লেখা হেগেলের চিঠিগুলো তার ছেলে পুড়িয়ে ফেলেছেন। উনি যুক্তি দিয়েছিলেন, এ চিঠিগুলো উনার সম্পর্কে ভুল বোঝাবোঝি তৈরি করতে পারে। এ চিঠিগুলোতে এমন তথ্যও নাকি ছিল যাতে প্রমাণিত হয়ে যাবে তিনি হেগেলের বৈধ পুত্র নন। জন্ম নিয়েছেন বাড়িওলীর গর্ভে। তাই নাকি তিনি এগুলো পুড়িয়ে ফেলেছেন- এমন কথাও শুনতে পাওয়া যায়।
বিশ শতকে এসে আমরা পাচ্ছি মহান দার্শনিক মার্টিন হাইডেগারকে। যিনি ‘কেয়ার’ -এর ধারণা নিয়ে সারাজীবন ভেবেছেন। তার দর্শনে ‘কেয়ার’/যত্ন-এর ধারণা এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। কিন্তু নিজে কোন অভিমত দেন নাই তার ছাত্রী বিখ্যাত দার্শনিক হান্না আরেনডেটের সাথে উনার সম্পর্ক নিয়ে। যদিও তাদের মধ্যে আদান-প্রদান হওয়া চিঠি-পত্রের সূত্র ধরে তাদের এই সম্পর্ক দার্শনিক সম্পর্কের একট নয়া উপাখ্যানের জন্ম দিয়েছে। এমন এক উপাখ্যান যা উপন্যাসের মতোই। মজার ব্যাপার হলো, হান্না হাইডেগারের আন্ডারেই উনার থিসিস, ‘অগাস্টিন এন্ড লাভ’ লিখেছেন। এই চিঠিগুলো ছাড়া এই সম্পর্ক নিয়ে হাইডেগারের কোন অভিমত কোথাও নাই।
জ্যাঁ পল সাত্র এবং সিমোন দ্যা বোভোয়ার তাদের নিজেদের সম্পর্ক, প্রেম, সংগ্রাম নিয়ে প্রচুর কথা বলেছেন। শুধু নিজেদের মধ্যেই নয়, তাদের এই সম্পর্ক ছিল খুবই প্রকাশ্য ও আলোচিত
জ্যাঁ পল সাত্র এবং সিমোন দ্যা বোভোয়ার তাদের নিজেদের সম্পর্ক, প্রেম, সংগ্রাম নিয়ে প্রচুর কথা বলেছেন। শুধু নিজেদের মধ্যেই নয়, তাদের এই সম্পর্ক ছিল খুবই প্রকাশ্য ও আলোচিত। তাদের সময়েই এটা ছিল ফিকশনের উপাদান। সেই সম্পর্ককে তারা ব্যক্তিগত জায়গা থেকে ব্যাখ্যার পাশাপাশি করে তুলেছেন একটি দার্শনিক প্রকল্পের আধার। তাদেরই বন্ধু আরেক মহান দার্শনিক, লেখক, আলবেয়ার ক্যামু তার ফিকশনের আড়ালেই বলেছেন নিজের কথা। এতেই ধরা আছে তার প্রেম ও যৌনতার বয়ান। রোলা বার্থের ‘এলাভার ডিসকোর্স’ তো খুবই পরিচিত একটি কাজ। এটাকে অবশ্যই তার নিজের যৌনতার সাথে মোকাবেলার এক দার্শনিক ফিরিস্তি হিসেবেই পাঠ করা যায়।
সব কিছু ছাপিয়ে অবশ্যই বলতে হয় মিশেল ফুকোই যৌনতার সবচেয়ে বড় দার্শনিক। ১৯৮৪ সালে এইডসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার আগে তিনি যৌনতার ইতিহাসের ৩ টা খণ্ড লিখেছেন। মৃত্যুর পর ২০২০ সালে ৪র্থ খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। উনার কথা বিস্তারিত বলতে হবে লম্বা সময় নিয়ে। সেটা পরের কোন কিস্তিতে করার ইচ্ছে আছে। যার সূত্র ধরে এই আলাপ সেই দেরিদার কাজে আছে যৌনতার সরাসরি প্রকাশ। তিনি হয়তো এই গ্যাপটা ধরতে পেরেছিলেন বলেই নিজের বেলায় এই দিকটা পূরণ করার চেষ্টা করেছেন। নিজের একান্ত যৌনকামনা, যৌন অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে লিখেছেন দার্শনিক কিতাব, ‘দ্যা পোস্ট কার্ড’। কিন্তু ফুকো যৌনতার এতো বড় দার্শনিক হয়েও নিজের যৌনতা নিয়ে ‘ ফিলোসফি অব বেড রুম’ টাইপের কিছু লেখা তো দূরের কথা, তার সমকামী সঙ্গীকে নিয়েও কোন কথা বলেন নাই। তিউনিশিয়াতে তিনি নাকি এক বালককে যৌননিগ্রহ করেছিলেন যা কয়েক বছর আগে নতুন করে আলোচনায় এসেছে। মৃত ফুকোর বিরুদ্ধেও মি টু আন্দোলনের কর্মীরা সোচ্চার হয়েছিল তখন।
সব মিলিয়ে এটা বলাই যায়, চিন্তার ইতিহাসের দিকে তাকালে দার্শনিকরা যে একেবারে নিজেদের যৌনজীবন নিয়ে তেমন কিছু বলেন নাই তা না। খুব বেশি না হলেও কিছু কিছু বয়ান তো পাওয়া যায়ই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এটা কীভাবে আমরা নিশ্চিত হবো যে, এসব বিষয় ও ঘটনা দার্শনিকের চিন্তা ও রচনাকে বুঝতে আমাদের সাহায্য করতে পারে? এ বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা মুশকিল। যদিও অনেকে মনে করেন, আমাদের যৌনতা আমাদের চিন্তাকে ব্যাখ্যা বা বুঝতে কাজে আসে। কিন্তু এটার কোন দার্শনিক জাস্টিফিকেশন নাই। এ ধরণের মতকে ননফিলোসফিক্যাল মতই বলা হবে।
মিশেল ফুকোই যৌনতার সবচেয়ে বড় দার্শনিক। ১৯৮৪ সালে এইডসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার আগে তিনি যৌনতার ইতিহাসের ৩ টা খণ্ড লিখেছেন
কিছু লেখক-দার্শনিদের বেলায় (যেমন, কিয়েরকেগার্ড, বোভোয়ার, দেরিদা ইত্যাদি) আমরা যখন দেখি, তাদের নিজেদের যৌনতাও তাদের কাজের থিম বা চিন্তার বিষয় হয়ে উঠেছে। সাহিত্যিক মোড়কের বাইরে সরাসরি দর্শনের পরিসরে তারা আলোচনা করেছেন নিজের যৌনতাকে, একইসাথে চিন্তার বিষয় আকারে সেটা আমাদের জন্য বেশ কাজের হয়।
সাহিত্যের একটা সুবিধা আছে। ব্যক্তি নিজের কথাও লিখতে পারেন গল্পের ছলে। নিজের কথা বলেও লোকে এটাকে গল্প বা কল্পনা বলেই মনে করবে। কিন্তু দর্শন সাহিত্যের এ আড়ালটা কাজে লাগায় কিন্তু দর্শনে ব্যক্তিচিন্তার অব্যক্তিক প্রকাশ আকারেই দেখার রেওয়াজ তৈরি হয়ে গেছে। কোন দর্শনিকের গোপন যৌনজীবন আমাদের আগহী করতে পারে কিন্তু তাতে উনার চিন্তা বোঝার বা তার চিন্তার সাথে সংযোগের কাজটা সহজ হয়ে যাবে সেটা বলা যায় না। আর এখন তো ডিজিটাল আমল। কোন দার্শনিকের যৌন ভিডিও বা অডিও ফাঁস হতে পারে। তাতে কি তার যৌনতা বিষয়ে চিন্তার পরিচয় পাওয়া যাবে? নিজের যৌনতা ও যৌনতার একটি ধারণা আকারে হাজির করার মধ্যে বেশিরভাগ দার্শনিকই একটি পার্থক্য রাখেন। এটা হতে পারে এই কারণে যে, যৌনতা একটি ধারণা বা চিন্তার বাইরে নিজের ব্যক্তি যৌনতার বিষয়টি তার কাছে তুচ্ছ। কিন্তু আমরা জানি পাবলিকের তুচ্ছ বিষয়েও আগ্রহের শেষ নাই। আর সেই বিষয়টা যদি হয় খ্যাতিমান ব্যক্তির যৌনজীবন তাহলে এটা তো বিনোদন বাজারের এক বিশাল কাঁচামাল হয়ে যায়।
একজন চিন্তক বা দার্শনিকের নিজের জবানিতে ব্যক্তিগত যৌনতার বিষয় জানতে পারা অবশ্যই আগ্রহোদ্দীপক। কিন্তু তাতেই তার বিচার ও তার চিন্তাকে বোঝার কাজ হয়ে যায় না। বরং কোন দার্শনিকের কাজ বুঝতে সহজ হবে তাকে পদ্ধতিগতভাবে পাঠ, পুনঃপাঠের মাধ্যমেই।