
‘‘সুধা হতে সুধাময় দুগ্ধ তার ; দেখে তারে পাপ ক্ষয় হয়,
মাতৃরূপা, শান্তিস্বরূপিনী, শুভ্রকান্তি, পয়স্বিনী।’’
রবীন্দ্রনাথ এ ভাবেই গরুর গুন কীর্তন করেছেন। শুধু গরু না, আমার ধারণা কিছু কিছু মানুষ দেখেও পাপ ক্ষয় হতে পারে- যেমন বুড়ি মা খোয়া ভাঙছেন, বুড়ো রিক্সা চালক, গার্মেন্টস কারখানার কিশোরী শ্রমিক, বাড়ির কাজের মেয়ে। আর কাদের দেখলে পাপ বেড়ে যায়? এদেরকে যারা অসন্মান করে তাদের। অতি সামান্য মজুরির বিনিময়ে ক্লান্ত দেহে, বিনা অভিযোগে এই মানুষগুলো সবার কাজের বোঝা বয়ে বেড়ায়। গরুর মতই পরোপকারী, সংবেদনশীল, কোমলপ্রাণ। জীবনে পূণ্য সঞ্চয় তেমন ঘটেনি, তাই সুযোগ পেলেই এদের দিকে তাকিয়ে থাকি, পাপের বোঝা কিছুটা যদি হাল্কা হয়।
দশ হাজার বছর আগে মেসপটামিয়ার ইউফ্রেটিস-টাইগ্রীস, মিশরের নীলনদ, ভারতের সিন্ধু, চীনের হুয়াং-ইয়াংযী নদীর আশেপাশে মানুষ প্রথম ঘর বাঁধলো। শুরু হলো কৃষিকাজ, সেই সাথে পশুপালন। যে কয়েকটি বন্য প্রানীকে বশ করা গেলো গরু তাদের মধ্যে প্রধান। গরুকে কাজে লাগিয়ে মানুষের কপাল গেল খুলে। লাঙ্গলের সামনে গরু, গাড়ির সামনে গরু, গরুর দুধ, মাংস, রক্ত, চামড়া, হাড়, গোবর সবই মানুষের কাজে লাগে। গরু ছাড়া জীবন চলে না। গরু হয়ে পড়লো সম্পদ আর প্রাচুর্যের প্রতীক।
শুধু গরু না, আমার ধারণা কিছু কিছু মানুষ দেখেও পাপ ক্ষয় হতে পারে- যেমন বুড়ি মা খোয়া ভাঙছেন, বুড়ো রিক্সা চালক, গার্মেন্টস কারখানার কিশোরী শ্রমিক, বাড়ির কাজের মেয়ে। আর কাদের দেখলে পাপ বেড়ে যায়? এদেরকে যারা অসন্মান করে তাদের
টাকা আবিষ্কারের আগে গরুই ছিলো টাকা। যে বন্য গরু থেকে আজকের গৃহপালিত গরুর জন্ম, তারা চার’শ বছর আগেই পৃথিবী থেকে লুপ্ত হয়ে গেছে। ঠিক গরু নয়, তবে গরুর মতো কিছু প্রাণী- আমেরিকার বাইসন, আফ্রিকার বিশাল আকৃতির মহিষ, ভারতের জল-মহিষ এখনো বনজঙ্গলে নিজের দায়ে কোনোরকমে টিকে আছে।
“Cowards die many times before their deaths;
The valiant never taste of death but once.”
জুলিয়াস সিজারের মতো বীর আর কজনেই বা আছে, আমরা মরার আগেই অনেকবার মরি। মরার দুশ্চিন্তা সারা জীবন মানুষকে তাড়া করে বেড়ায়। গরু-মোষ-মেষ এদিক দিয়ে বেশ আছে, মরার কষ্ট একবারই পায়।
শিকারী প্রানীদের চোখ থাকে মাথার সামনে, চোখের মনি হয় গোলাকার – যেমন মানুষ, সিংহ, শেয়াল, পেঁচা। শিকারের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য সামনে দেখা এবং শিকারের দূরত্ব বোঝা ভীষণ জরুরী। যে প্রাণীরা শিকার, তাদের চোখ থাকে মাথার দুধারে, চোখের মনি হবে লম্বাটে- যেমন গরু-মোষ-হরিন। ওদের বিপদ আসে প্রধানত পেছন থেকে, সামনে পেছনে দু-দিকে দেখার জন্য এটাই চোখের মোক্ষম অবস্থান।
শিকার আর শিকারী দু’দলকেই একদিন মরতে হবে, তবে শিকারী প্রানীদের মরার কষ্ট বেশী। বৃদ্ধ বয়েসে দীর্ঘ সময় ধরে মানুষকে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হয়। বুড়ো বয়েসে সিংহের একই দুর্দশা। কয়েক মিনিটের মধ্যে বাঘের হাতে একটা হরিনের মৃত্যু ঘটে। মানুষের হাতে গরুর মরণ ঘটে মিনিট দুয়ের মধ্যে। যে প্রাণীরা শিকার তাদের প্রতি আমাদের সহানুভূতি বেশী, কিন্তু শিকারী প্রাণীর জীবনেও দুঃখ কিছু কম নয়, তার উপরে আছে দীর্ঘ দিনের মরণ যন্ত্রণার পালা।
মরার দুশ্চিন্তা সারা জীবন মানুষকে তাড়া করে বেড়ায়। গরু-মোষ-মেষ এদিক দিয়ে বেশ আছে, মরার কষ্ট একবারই পায়
পৃথিবীতে প্রতি বছর মানুষের খাদ্যের প্রয়োজনে তিরিশ কোটি গরু, ষাট লক্ষ কোটি মুরগী, এবং বিশ লক্ষ কোটি শুকর বধ করা হয়। সবচেয়ে গরু-খেকো দেশ হচ্ছে হংকং, ওখানে একজন লোক গড়ে বছরে ষাট কেজি গোমাংস খায়, তারপরেই আছে আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিল। আমেরিকা এবং ইউরোপের ধনী দেশগুলো খুব পিছিয়ে নেই- ওদের পেটে যায় প্রায় পঁচিশ কেজি। গরু-খাওয়া মুসলমান বলে যে কথাটা প্রচলিত আছে সেটা ঠিক নয়। জনবহুল মুসলিম দেশগুলো- যেমন ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ভারত, মিশর, সৌদি আরব, এবং ইরানে গড়ে প্রতিবছর একজন মানুষ খায় মাত্র চার থেকে দেড় কেজি গরুর মাংস।
পৃথিবীর সব প্রাণীর প্রাকৃতিক খাদক (natural predator) আছে, মানুষের নেই। মানুষ খাদ্য শিকলের একেবারে উপরে বসে আছে। শিকলের মাঝে যারা আছে তারা উপরের প্রানীদের খাদ্য আর নীচের প্রানীদের খাদক। একমাত্র ঘাস বা গাছের পাতা সূর্যের আলো, বাতাসের কার্বন ডাই অক্সাইড, আর জল মিশিয়ে খাদ্য বানাতে পারে। আমরা সবাই সেই খাবারে ভাগ বসাই। মানুষের প্রাকৃতিক খাদক নেই বলে মানুষের সংখ্যা অন্য প্রাণীর তুলনায় ভয়ানক বেগে বেড়ে চলেছে। আগে কলেরা, বসন্ত, প্লেগ জাতীয় মহামারীতে লক্ষ লক্ষ লোক মরতো। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির কারণে তা আর এখন হয় না, মানুষের গড় আয়ু অনেক বেড়ে গেছে। মানুষের খাবার যোগাড়ের আয়োজনে বনাঞ্চল উঠে যাচ্ছে, আকাশের ওজোন স্তরে ফাটল ধরেছে, পৃথিবীর তাপমাত্রা যাচ্ছে বেড়ে। এরকম চললে একসময় এই পৃথিবী মানুষের বসবাসযোগ্য থাকবে না, অগনিত মানুষকে মরতে হবে, সমগ্র মানুষ জাতি-ই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। পরিবেশ বদলে গেলে অনেক প্রাণী লুপ্ত হয়ে যায়। মানুষ জাতিকে বাঁচাতে হলে মানুষের সংখ্যা আর বাড়তে দেওয়া যায় না। তার জন্য চাই জন্ম নিয়ন্ত্রণ- পরিবার পরিকল্পনা।
এরকম চললে একসময় এই পৃথিবী মানুষের বসবাসযোগ্য থাকবে না, অগনিত মানুষকে মরতে হবে, সমগ্র মানুষ জাতি-ই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে
ধরা যাক মানুষ গরুর মাংস খাওয়া বন্ধ করে দিল। বলদ বা ষাঁড় দিয়ে লাঙ্গল এবং গাড়ী চালনোর প্রয়োজন আজ আর নেই। ওদেরকে পালন করে কৃষকের কি লাভ? ওদেরকে মুক্তি দেওয়া হবে। কিন্তু ওরা যাবে কোথায়? একটা গরু যতদিন দুধ দিচ্ছে ততদিন তাকে পোষা লাভজনক, কিন্তু বুড়ো বয়েসে কৃষক ওর গলার বাঁধন খুলে দিবে। ও যাবে কোথায়, খাবে কি? ওদের জন্য বৃদ্ধাশ্রম খুলতে হবে। পৃথিবীর আর কোথায় না হলেও, ধর্মীয় কারণে ভারতে হয়তো এরকম গোশালা খোলা সম্ভব যেখানে বিনা পরিশ্রমে বলদ এবং বুড়ো গরুদের খাবার মিলবে। তবে আমার সন্দেহ আছে। একজন সংখ্যালঘু বৃদ্ধ গোমাংস খেয়েছে এই গুজব শুনে তাকে পিটিয়ে হত্যা করার মতো বীরপুরুষের অভাব হয়তো নেই, কিন্তু নিজের পরিশ্রমের টাকা নি:স্বার্থভাবে গরুর পেছনে দীর্ঘদিন ব্যায় করবে এমন মহানুভব লোক খুব বেশী নেই। গরুভক্ত বকধার্মিকদের মুখোশ দ্রুত খুলে যাবে। শরৎচন্দ্রের মহেশ তার স্বাক্ষী। গফুরের কান্না মনে আছে কি- ‘‘আল্লাহ! আমাকে যত খুশি সাজা দিয়ো, কিন্তু মহেশ আমার তেষ্টা নিয়ে মরেছে। তার চ’রে খাবার এতটুকু জমি কেউ রাখেনি। যে তোমার দেওয়া মাঠের ঘাস, তোমার দেওয়া তেষ্টার জল তাকে খেতে দেয়নি, তার কসুর তুমি যেন কখনো মাপ ক’রো না।’’
একজন সংখ্যালঘু বৃদ্ধ গোমাংস খেয়েছে এই গুজব শুনে তাকে পিটিয়ে হত্যা করার মতো বীরপুরুষের অভাব হয়তো নেই, কিন্তু নিজের পরিশ্রমের টাকা নি:স্বার্থভাবে গরুর পেছনে দীর্ঘদিন ব্যায় করবে এমন মহানুভব লোক খুব বেশী নেই
একটা গরু বেঁচে থাকে প্রায় বিশ বছর এবং প্রতি বছর সন্তান জন্ম দেয়। তার কন্যা দুই বছর বয়সে মা হবে, তারপরে তার নাতনির পালা। বুড়ো বয়েসে মরার আগে একটি গরু থেকে জন্ম নেবে অসংখ্য গরু। কয়েকশ’ বছরের মধ্যে ভারত গরুতে ছেয়ে যাবে, মানুষের ঠাঁই হবে না। প্রানীদের পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে, অগনিত প্রাণী প্রাণ হারাবে, অনেক প্রজাতি চিরতরে লুপ্ত হয়ে যাবে। শেষপর্যন্ত গরুরা ধ্বংশ করে ফেলবে নিজেদের আবাসস্থল এবং পরিবেশ, অসংখ্য গরুকে মরে যেতে হবে। গরুকে বাঁচাতে হলে গরুর সংখ্যা আর বাড়তে দেওয়া যায় না। প্রাকৃতিক নিয়মে মানুষ হচ্ছে গরুর খাদক, গরুর মাংস খেয়েই সে বাঁচাতে পারে আরো অনেক গরুকে। অথবা মানুষের মত গরুর জন্যেও চাই জন্ম নিয়ন্ত্রণ- পরিবার পরিকল্পনা।
একটি গরু দিনে প্রায় তিন’শ লিটার মিথেন গ্যাস বাতাসে ছড়ায়। সেই সাথে আছে এমনিয়া এবং নাইট্রাস অক্সাইড। জাবর-কাটা প্রানী গরুর পাকস্থলীতে আছে চারটি কক্ষ, যেখানে ব্যাকটেরিয়ার সাহায্যে খাবার হজম করা হয়। এই প্রক্রিয়া তৈরি করে প্রচুর মিথেন গ্যাস। পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিতে মিথেন গ্যাসের জুড়ি নেই, এই গ্যাস কার্বন ডাই অক্সাইডের চেয়েও অনেক গুন ভয়ঙ্কর। পৃথিবী জুড়ে যদি গরুকে রক্ষিত প্রাণী করে রাখা হয় তবে বাতাসে বাড়তে থাকবে মিথেনের পরিমান, সেই সাথে বাড়বে পৃথিবীর তাপমাত্রা, গলতে থাকবে মেরু অঞ্চলের বরফ, সমুদ্র গ্রাস করবে পৃথিবীর নীচু অঞ্চলগুলি, ভারত মহাসাগর হিমালয় পর্যন্ত পোঁছে যাবে, মানুষ-গরু, হিন্দু-মুসলমান, গরু-ভক্ত, গরু-খাদক কেউ রেহাই পাবে না।