Author Picture

জনৈক নিরামিষ-ভোজী বন্ধুর প্রতি

খন্দকার রেজাউল করিম

‘‘নিরামিষ খেয়ে জীবন কাটালে কোনো ক্ষতি নেই। তবে শুধু নিরামিষ ভোজন মানুষের বায়ু-পথে প্রচুর গ্যাস, এবং হৃদয়ে অকারণ অহংকার সৃষ্টি করে।’’ (Sir Robert Hutchinson, in an address to the British Medical Association.)

ব্যাঙ্ খায় পোকা, সাপ খায় ব্যাঙ্, সাপকে খায় আরো বড় সাপ, বড় সাপকে খায় নেকড়ের দল, নেকড়েকে মারতে পারে বনের রাজা সিংহ। সিংহকে মারতে পারে মানুষ- ঠিক খাওয়ার জন্যে নয়, সখ করে, বীরত্ব ফলাতে। মানুষের মাংসও শেষ পর্যন্ত পোকারা খাবে, তবে মরার আগে নয়।
ধারালো দাঁত নেই, গায়ে তেমন জোর নেই, শুধু বুদ্ধি আর দলবদ্ধ হয়ে মারামারি বা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কারণে মানুষ খাদ্য-শেকলে (food chain) সবার উপরে বসে আছে। আমরা প্রায় যাকে ইচ্ছে খেতে পারি ! গাছ-পালা-সবজি-ফল-মূল, পোকামাকড়, ব্যাঙ্, সাপ, নেকড়ে, সিংহ; তবে এসব খাবার সমান মজাদার বা সুলভ না ও হতে পারে। এ এক বিস্ময়কর ক্ষমতা, পৃথিবীর আর কোনো প্রাণীর এমন ক্ষমতা নেই।
আমার কিছু নিরামিষাশী বন্ধু আছে যারা এই ক্ষমতা পুরোপুরি উপভোগ করতে রাজী নন। আমি ঠিক তাদের উল্টো- যা পাই তাই খাই- অন্য প্রাণীর মৃত দেহের অংশে দাঁত বসাতে আমার যেমন কোনো আপত্তি নেই, তেমনি সবজি-ফল সবই আছে আমার প্রিয় খাবারের তালিকায়। আমি কি পাষণ্ড, বর্বর, রুচিহীন এক লোক? আমার এক নিরামিষ-ভোজী বন্ধুর তাই ধারণা।
সুন্দরবনের একটি বাঘ হরিনের দলকে তাড়া করছে। এক হতভাগা হরিনী কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। বাঘটি হরিনীর ঘাড়ে লাফিয়ে উঠে টুঁটি চিপে ওকে মাটিতে ফেলে দিলো। তারপরে দলবল নিয়ে দাঁত বসলো ওর গায়ে। নিষ্ঠুর, হিংস্র, রক্তাক্ত, ভয়াবহ দৃশ্য। দুই মিনিটেই হরিনীর মৃত্যু-যন্ত্রণা শেষ, আধ ঘন্টার মধ্যে ওর রক্ত-মাংস খেয়ে ফেলেছে বাঘের দল। যা পড়ে রইলো তাও যাবে খাদ্য-শেকলের পেছনে যে প্রাণীরা আছে তাদের পেটে।
বাঘ যদি হঠাৎ হরিণ খাওয়া বন্ধ করে দেয়? শুরুতে হরিনের সংখ্যা বাড়তে থাকবে, আর হরিণ যা খায়- ঘাস, পাতা, গাছপালা- তাদের সংখ্যা কমতে থাকবে। একসময়ে হরিনের সংখ্যা এতো বেড়ে যাবে যে চারা গাছ আর বেড়ে ওঠার সুযোগ পাবে না, হরিনের আবাস-ভূমি ধ্বংস হয়ে যাবে। হরিনের মড়ক লাগবে, অসংখ্য ক্ষুধার্ত হরিন ধুঁকে ধুঁকে মরবে। এই ভারসাম্যহীন পরিবেশ মৃত্যু বয়ে আনবে আরো অনেক প্রাণীর জীবনে- যারা গাছগাছালি থেকে খাদ্য সংগ্রহ করতো, আর তাদেরকে খেয়ে যারা বাঁচতো।
একটি বাঘ যখন গোগ্রাসে একটি হরিনকে খায়, তখন সে আরো অনেক হরিন এবং আরো অনেক প্রানীকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচায়। কি ভাবে মরতে চান? দুই মিনিটে, নাকি অনাহারে ধুঁকে ধুঁকে দীর্ঘ দিন ধরে? জীবনের শুরু এবং শেষ যন্ত্রনাময়, মাঝের অংশে সুখ-দুঃখ ঘুরতে থাকে চাকার মতো।

‘‘তোমার মোহন রূপে কে রয় ভুলে।
জানিনাকি মরণ নাচে, নাচে গো ওই চরনমূলে।
জানিগো আজ হাহারবে তোমার পুজা সারা হবে
নিখিল অশ্রু-সাগর কুলে।’’
শুধু উদ্ভিদ পারে আলো, পানি, এবং কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস মিশিয়ে খাদ্য রান্না করতে। আমরা সবাই ভাগ বসাই সেই খাবারে। মানুষ এবং পৃথিবীর আর সব প্রাণীই পরান্নভোজী পরগাছা। উদ্ভিদভোজীরা সরাসরি সেই খাবারে ভাগ বসায়, আমিষাসীরা সে খাবার খায় পরোক্ষ ভাবে। পৃথিবীর বিস্তর্ণ মরুপ্রধান এবং সাভানা অঞ্চলে আহারযোগ্য পশু উৎপাদন যেমন সহজ, নিরামিষভোজীদের সবজি, কলা, বেগুন উৎপাদন তেমনি কঠিন। ওখানে বেগুনের খামার বানাতে বিপুল পরিমান স্থান ও জলের প্রয়োজন, বহু প্রানীকে গৃহহীন করতে হবে- ওরা ক্ষুধায় তৃষ্ণায় মারা যাবে। বেগুন-গাছের পোকা মারতে আবার কীটনাষক ঔষধ ছড়াতে হবে। একটা নিরীহ বেগুনের আড়ালেও লুকিয়ে আছে আনেকের মৃত্যু-যন্ত্রণা। উত্তর ও দক্ষিন মেরুর কাছাকাছি অঞ্চলগুলিতে শুধু নিরামিষ খেয়ে সারা বছর কাটানো সম্ভব নয়। ‘‘প্রাণী হত্যা মহাপাপ’’ জাতীয় কোনো ধর্ম এসব অঞ্চলে টিকবে না।
আমি যদি হতাম সেই হতভাগ্য হরিন, আর হরিনটি হতো আমি। কার জীবন বেশী কষ্টের, কার মৃত্যু বেশী যন্ত্রনাময়? মানুষের না হরিনের?

‘‘আমার খাবার ডিশে হরিনের মাংসের ঘ্রাণ আমি পাবো,
মাংস খাওয়া হলো তবু শেষ?
কেন এই মৃগদের কথা ভেবে ব্যথা পেতে হবে
তাদের মতন নই আমিও কি?’’
গাছের কাছে আমরা সবাই ঋণী। ওরা দেয় আমাদের প্রতি নিশ্বাসের অক্সিজেন আর প্রতিদিনের খাবার। আমরা দিই কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস। ইশ্বরকে অনেক ধন্যবাদ যে গাছের কোনো স্নায়ুতন্ত্র নেই। আমাদের মতো ওদের কষ্ট পেতে হয় না।

আরো পড়তে পারেন

শেষ বিকেলের অতিথি

আজ চন্দ্রার কথা মনে পড়তেই ছল ছল চোখে অশ্রুবিন্দু ঝড়ছে। তার অভিমানের শেষ আকুতি মনের মধ্যে বারবার ধাক্কা দেয়। তার প্রস্থান শেষ পর্যন্ত এতো কঠিন হবে বুঝতে পারিনি। আগেও চন্দ্রার সাথে হয়েছে অভিমানের খুনসুটি। নিজেকে মেঘের আড়ালে ঢাকতে চেয়েছে, কিন্তু সে মানাভিমান ক্ষণিকেই ইতি ঘটে গেছে। জোছনা হয়ে সে ধরা দিয়েছে। খুব ছোট্ট বিষয় নিয়ে….

স্মৃতি এখন কী করবে

জেলখানা থেকে বেরিয়ে স্মৃতি বাসে চড়ে বসে। সঙ্গে ওর মেয়ে ফাতেমা। বেশিক্ষণ কথা বলতে পারেনি হায়দারের সঙ্গে। শুধুই চোখ বেয়ে পানি পড়েছে। ফাতেমাও ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে। আর হয়তো দেখা হবে না বাবার সঙ্গে। হায়দারের চোখও ভেজা ছিল। আজই হয়তো ওদের শেষ দেখা। হায়দার বারবার স্মৃতির হাত ধরে অনুরোধ করেছে ওকে ক্ষমা করে দিতে।….

ইন্টারভিউ

কত দিন পর দেখা হলো রূপার সঙ্গে। তা মনে করতে পারছি না। চোখে চোখ পড়তেই কিছুটা থমকে গেলাম। চিন চিন করে উঠল বুকের ভেতর। ভেতর-বাইর শুরু হলো জ্বলন-পোড়ন। কথা বলব কি-না তা বুঝে ওঠার আগেই সে এলো এগিয়ে। আমাকে বলল, সায়েম তুমি এখানে? আমার ইন্টারভিউ আজ। তোমারও কি তাই? হ্যাঁ। আমারও তাই। কেমন আছ তুমি?….

error: Content is protected !!