
১৩ এপ্রিল, ১৯৮৫। সুইডেনের ভ্যাক্সো শহরে মিছিলের অনুমতি পায় ‘দ্য নরডিক রিয়াল্ম পার্টি’। ১৯৫৬ সালে সুইডেনে গড়ে ওঠা এটি ছিল একটি নব্য-নাৎসি বাহিনী। একই সময় একই স্থানে সমাবেশ করছিল সুইডেনের সমাজতান্ত্রিক দল ‘লেফ্ট পার্টি’। এই পার্টির নেতা লার্স ওয়ের্নার বক্তৃতা শেষ করলেই মিছিল শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয় নব্য-নাৎসিরা। কিন্তু তার আগেই এই দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে কলহ শুরু হয়ে যায়। বামপন্থী কর্মীদের সঙ্গে যোগ দেয় শহরের বাসিন্দারাও। বিপাকে পড়ে যায় নব্য-নাৎসিরা। প্রাণ বাঁচাতে তারা পালাতে শুরু করে।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন ফটোসাংবাদিক হ্যান্স রুনেসন। তিনি ছবি তোলা শুরু করে দিলেন। ছবি তুলতে তুলতে তিনি দেখলেন একজন মধ্য বয়সী নারীও নাৎসিদের সঙ্গে লড়ছেন, সেই নারী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন তার হ্যান্ডব্যাগ! হ্যান্ডব্যাগ দিয়ে ওই নারী এক নব্য-নাৎসিকে আঘাত করছেন—এমন একটি মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি করে ফেলতে সফল হলেন রুনেসন। তিনি কি আর তখন জানতেন, এই ছবিই একদিন ইতিহাস হবে!

ঘটনার পরদিন সেই নারীর ছবি ছাপা হয় সুইডেনের জাতীয় দৈনিক দগেন্স নিহেতার-এর প্রথম পাতায়। ১৫ এপ্রিল ব্রিটেনের দ্য টাইমস ও দ্য ডেইলি এক্সপ্রেস-এ ছবিটি ছাপা হলে চারদিকে আলোড়ন পড়ে যায়। পরে ছবিটিকে ওই বছরের ‘সুইডিশ পিকচার অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরে ভাই ম্যাগাজিন ও ‘ফটোগ্রাফিক হিস্ট্রিক্যাল সোসাইটি অব সুইডেন’ ছবিটিকে শতাব্দীর সেরা ছবি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এখানেই শেষ নয়, সেই আলোকচিত্র অবলম্বনে সুইডেনে তৈরি হয় একাধিক ভাস্কর্য।

যে সাহসী নারীকে নিয়ে এতো কিছু তার পরিচয় তখনো অজানা। প্রায় তিন দশক পর ২০১৪ সালে সাংবাদিকেরা বের করেন সেই নারীর আসল পরিচয়। তার নাম ডানুটা ড্যানিয়েলসন। জন্ম পোল্যান্ডে, ১৯৪৭ সালে। তিনি ছিলেন ইহুদি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার মা নাৎসিদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বন্দি ছিলেন। ১৯৮১ সালে ডানুটা বেসন ড্যানিয়েলসনকে বিয়ে করেন। পরের বছর তারা সুইডেনে পাড়ি জমান। তাদের তিন সন্তান। অনুসন্ধানে জানা যায়, ডানুটা মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন। ঘটনার তিন বছর পর তিনি একটি উঁচু পানির ট্যাংক থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। আর যাকে তিনি ব্যাগ দিয়ে মারছিলেন তার পরিচয়ও পাওয়া গেছে। তার নাম সেপো সেলুস্কা। পরবর্তীতে এই নব্য-নাৎসি একজন সমকামী ব্যক্তিকে নির্যাতন ও হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হন।
ছবিটি কেন এতো বিখ্যাত হল? প্রথমত ছবিটিতে একটি ‘অ্যাকশন’ আছে। এমন এক ‘ডিসাইসিভ’ মুহূর্তকে ধারণ করা হয়েছে যা খালি চোখে লক্ষ্য করা কঠিন। দ্বিতীয়ত, মুহূর্তটি বর্ণবাদের বিরুদ্ধে এটি একটি প্রতীকী প্রতিবাদ। আর তৃতীয়ত এক সাহসী নারীর লড়াই মূর্ত হয়েছে ছবিটিতে। সর্বোপরি, ছবিটি আমাদের অন্যায় ও অশুভর বিরুদ্ধে লড়াই করতে অনুপ্রেরণা যোগায়। ডানুটা না থেকেও আছেন—এই ঐতিহাসিক ছবিতে, ভাস্কর্যে এবং উদ্দীপক হয়ে মানুষের মনে।