Author Picture

ত্রিভুজ প্রেমের মামলা

খন্দকার রেজাউল করিম

বুনো হাঁস

 

আরাধনার পর্ব শেষ হয়ে গেছে। প্রায় দশটা বাজে। গির্জার পার্কিং লট থেকে গাড়িগুলো একে একে বের হয়ে যাচ্ছে। সুজানও জেসিকে নিয়ে চলে গেলো। যাবার আগে গাড়ির জানলা খুলে কেভিনের দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে বললো, ‘চললাম, আজ বিকেল পাঁচটায় তো বেসবল ক্যাম্পে তোমার সাথে জেসি এবং আমার আবার দেখা হবে। এখন জেসিকে ওর বাবার কাছে পৌঁছে দিতে যাচ্ছি। লাঞ্চের এপয়েন্টমেন্ট, দুই ঘন্টার জন্যে। মাঝের সময়টুকু ক্যারোলের সঙ্গ উপভোগ করো। ক্যারোল, তুই কেভিনকে লেকের এলাকাটা ঘুরিয়ে দেখাতে ভুলিস না যেন।’

‘একটা ডেঁপো মেয়ে! সারাক্ষন উপদেশ দিচ্ছে। আমি যেন কচি খুকি, ‘ক্যারোল ফোড়ন কাটলো। পাদ্রী সাহেবের বাড়ি গির্জা থেকে এক কিলোমিটার দূরে। ‘তোমরা গাড়ি নিয়ে যাও, আমি কেভিনকে নিয়ে লেকের ধার দিয়ে হেঁটে আসছি’, ক্যারোল ওর মাকে জানালো।

গির্জার পিছনেই এক বিশাল লেক, লেকের নীল পানিতে অনেকগুলো নৌকা পাল তুলে ভাসছে। কয়েকটি স্পিড বোট পানি ছিটিয়ে এঁকেবেঁকে ছুটছে। চারিদিকে ছোট খাটো পাহাড়। কয়েক মাইল লম্বা লেকটি পাহাড়গুলোর মাঝদিয়ে নদীর মতো বাঁকা পথে কোথায় যে হারিয়ে গেছে তার হদিশ পাওয়া যায় না। লেকের পাশে উঁচুউঁচু সব গাছ আর জঙ্গল, মাঝখানে সরু পায়ে চলার পথ। অনেক স্থানে পথের চিহ্ন একেবারেই হারিয়ে গেছে।

‘হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে না তো? শহরের বাবু-ছেলে বলে কথা!’ ক্যারোল বললো।
‘তুমি ভুলে যাচ্ছ যে দুবছর আগেও আমি UCLA এর বাস্কেটবল দলের সদস্য ছিলাম। এখনো প্রতিদিন সকালে পাঁচ কিলোমিটার দৌড়াই।’
‘একদিন আমাকে সঙ্গে নিবে?’
‘যে কোনো দিন। তবে তোমাকে সকাল ছটায় উঠতে হবে। তার চেয়ে চলোনা এখনই তোমাদের বাড়ি পর্যন্ত দিই এক দৌড়!’
‘কি যে বলো? কোনো কিছুই তোমার চোখে পড়ে না। আমার এই হাই-হিল স্যান্ডেল পায়ে দৌড়াবো কি করে?’

আমি আবার কবে এমন দুর্লভ বস্তু হয়ে গেলাম? তোমার বান্ধবীদের বোলো যে কেউ ইচ্ছে করলেই আমার সাথে সাঁতার কাটতে পারে।’ ‘সেটা যে আবার আমার সইবে না।’ ক্যারোল বললো

তা বটে! ফ্যাশন করার দণ্ড! আধ ঘন্টা হাঁটার পরে ক্যারোলদের বাড়ির দেখা মিললো। বাড়ির সামনে একটি পুকুর, চারদিকে ফুলের বাগান।

‘ওই দেখো আমাদের পুকুর। যে হাঁসগুলো সাঁতার কাটছে, তাদের সবার একটা করে নাম দিয়েছি। বুনো, পেটুক, ক্যাবলাকান্ত, দুষ্টু, প্রেমিক, ইত্যাদি। বুনো হাঁসটা সারাক্ষন পাখা ঝাপটাচ্ছে, উড়ুউড়ু ভাব, এই পুকুরটা ওর পছন্দ নয়, উড়ে যেতে চায় অন্য কোনো পুকুরে বা নদীতে। পেটুক হাঁসটা সারাদিন কাদার মধ্যে ঠোঁট ডুবিয়ে শামুক খুঁজছে। আরো শুনবে?’ ক্যারোল আবার কথা শুরু করলো।

‘না, না, তোমার হাতে যে যথেষ্ট সময় আছে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে,’ কেভিন বললো, ‘তা, তোমার প্রেমিক হাঁসটি নিশ্চয় সারাদিন প্রেম করে বেড়ায়!’
‘হ্যা, ও একদম তোমার মতো না। তুমি অনেকটা ওই ক্যাবলা হাঁসটির মতো, যার মাথায় সহজে কোনো কিছুই ঢোকে না। আর আমি হলাম বুনো হাঁস, উড়ে যেতে চাই অন্য কোথা, অন্য কোনখানে।’
‘আর যে দুটি বক-পাখি লম্বা পা ফেলে মাছ ধরার আশায় পুকুরের পারে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ওদেরও নাম আছে নিশ্চয়?’ কেভিন জিজ্ঞাসা করলো।
‘হ্যা, একজনের নাম শার্প-শুটার, অন্যজনের নাম ভোলানাথ। তুমি কোনটা তা নিশ্চয় বুঝতে পারছো।’
‘বিলক্ষণ! সবাই যে আমাকে বোকা ভাবে, সে আমি জানি!’ কেভিন জানালো।
‘তুমি কচু বোঝো! তবে ঝগড়া না করে, চলো তোমাকে লেকের ধারে আরেকবার ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।’

ক্যারোলদের বাড়ির ঘাটে বাঁধা স্পিড বোটটি ঢেউয়ের তালে তালে দুলছে।

‘এটা আমাদের স্পিড বোট, যাবে নাকি একটা চক্কর দিতে? তাহলে বাড়ি থেকে এক দৌড়ে দুটো লাইফ জ্যাকেট নিয়ে আসি। তুমি তো আবার শহুরে ছেলে, হয়তো সাঁতারই জানো না।’ ক্যারোল বললো।
‘আরে, না। সুইমিং পুলে অনেক সাঁতার কেটেছি, তোমাকে হারিয়ে দিবো, এমন ভরসা রাখি। তবে লেকে কোনোদিন সাঁতার কাটি নি।’ কেভিন জানালো।
‘ঠিক আছে, বাজি রইলো। যে কোনো সুইমিং পুলে, যে কোনো দিন। শহুরে বাবু, তুমি গ্রামের মেয়েদের এখনো চিনে উঠতে পারো নি। তবে স্কুলের সুইমিং পুল হলেই ভালো হয়। তোমার সঙ্গে সাঁতার কাটতে দেখলে আমার স্কুলের বান্ধবীরা সব হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরবে!’ ক্যারোল বললো।
‘সে কি কথা? আমি আবার কবে এমন দুর্লভ বস্তু হয়ে গেলাম? তোমার বান্ধবীদের বোলো যে কেউ ইচ্ছে করলেই আমার সাথে সাঁতার কাটতে পারে।’
‘সেটা যে আবার আমার সইবে না।’ ক্যারোল বললো।

কেভিন একটু ঘাবড়ে গেলো। এই মেয়েটি আবার তার প্রেমে পড়ে যাচ্ছে না কি? কথা ঘুরিয়ে ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে আসলো, ‘বারোটা প্রায় বেজে গেছে। তোমার মা হয়তো টেবিলে খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছেন। চলো ফেরা যাক।’

ফেরার পথে ক্যারোল আবার সেই প্রেমের গল্প শুরু করলো,
‘কেভিন, শহুরে মেয়েরা কি নিয়ে কথা বলে?’
‘হরেক রকম বিষয়ে, তবে হাঁস এবং বক-পাখির নাম নিয়ে যে কখনো আলোচনা হয় না, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত।’
‘উনিভার্সিটিতে তোমার কোনো মেয়েবান্ধবী ছিল না? কারো সাথে কি কখনো স্টেডি ছিলে?’
‘হ্যা, একজনের সাথে দুই বছর স্টেডি ছিলাম। তবে আমার গ্রামের স্কুলের চাকরির খবর পেয়ে সে বেচারা সময়মতো সরে পড়েছে। ওকে কোনো দোষ দিই না। গ্রামে কে কবে আসতে চায়, বলো?’
‘ভাবছি, মেয়েটি কি বোকা!’
‘ও বোকা নয়, বলতে পারো একজন বাস্তববাদী বুদ্ধিমান মেয়ে। হাইস্কুলের প্রথম ধাপ থেকে শুরু করে উনিভার্সিটির শেষ সিঁড়িটি পার হতে প্রায় আট বছর লেগে যায়। এর মধ্যে ছেলেমেয়েরা আদর্শবাদী থেকে বাস্তববাদী হয়ে পড়ে। এ সব এখন বুঝবে না, তুমি একেবারেই বাচ্চা একটি মেয়ে।’
‘আমি মোটেই বাচ্চা মেয়ে নই। আগামী মাসে আমার জন্মদিন, উনিশ বছরে পড়বো।’

মেয়েরা বয়স কমাতে চায়, ক্যারোল চেষ্টা করছে তার বয়সটা যতদূর সম্ভব বাড়াতে।

আরো পড়তে পারেন

শেষ বিকেলের অতিথি

আজ চন্দ্রার কথা মনে পড়তেই ছল ছল চোখে অশ্রুবিন্দু ঝড়ছে। তার অভিমানের শেষ আকুতি মনের মধ্যে বারবার ধাক্কা দেয়। তার প্রস্থান শেষ পর্যন্ত এতো কঠিন হবে বুঝতে পারিনি। আগেও চন্দ্রার সাথে হয়েছে অভিমানের খুনসুটি। নিজেকে মেঘের আড়ালে ঢাকতে চেয়েছে, কিন্তু সে মানাভিমান ক্ষণিকেই ইতি ঘটে গেছে। জোছনা হয়ে সে ধরা দিয়েছে। খুব ছোট্ট বিষয় নিয়ে….

স্মৃতি এখন কী করবে

জেলখানা থেকে বেরিয়ে স্মৃতি বাসে চড়ে বসে। সঙ্গে ওর মেয়ে ফাতেমা। বেশিক্ষণ কথা বলতে পারেনি হায়দারের সঙ্গে। শুধুই চোখ বেয়ে পানি পড়েছে। ফাতেমাও ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে। আর হয়তো দেখা হবে না বাবার সঙ্গে। হায়দারের চোখও ভেজা ছিল। আজই হয়তো ওদের শেষ দেখা। হায়দার বারবার স্মৃতির হাত ধরে অনুরোধ করেছে ওকে ক্ষমা করে দিতে।….

ইন্টারভিউ

কত দিন পর দেখা হলো রূপার সঙ্গে। তা মনে করতে পারছি না। চোখে চোখ পড়তেই কিছুটা থমকে গেলাম। চিন চিন করে উঠল বুকের ভেতর। ভেতর-বাইর শুরু হলো জ্বলন-পোড়ন। কথা বলব কি-না তা বুঝে ওঠার আগেই সে এলো এগিয়ে। আমাকে বলল, সায়েম তুমি এখানে? আমার ইন্টারভিউ আজ। তোমারও কি তাই? হ্যাঁ। আমারও তাই। কেমন আছ তুমি?….

error: Content is protected !!