Author Picture

ত্রিভুজ প্রেমের মামলা

খন্দকার রেজাউল করিম

কালো ধোঁয়া

 

‘আর যদি দ্যাখোম, আর যদি শুনম, অন্য জনের সাথে কথা,
এ হেন যৌবন সাগরে ভাসাবো, পাষাণে ভাঙিব মাথা।’

সেই ‘হটাৎ দেখার’ পর প্রতি রবিবার বিকালে বেসবল ক্যাম্পে সুজানের সাথে কেভিনের দেখা হয়। আর সব মায়ের মতো সুজান দর্শকের গ্যালারিতে বসে থাকে। জেসি একটা রান করলে উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ায়, হাততালি দেয়। রবিবারের এক সকালে সুজানের কাছ থেকে ফোন এলো, ‘আজ বিকেলে বেসবল ক্যাম্পে আমাদের সাথে এখানকার চার্চের পাদ্রী আসছেন। তোমার সাথে দেখা করতে চান। তুমি তিন মাস হলো এখানে এসেছো অথচ চার্চের চৌকাঠ একবারও মাড়াও নি। উনি তোমার পরকালের নরকবাসের কথা ভেবে ভীষণ ভাবনায় পড়েছেন।’
জেসির হাত ধরে সুজান আজ পর্যন্ত একাই এসেছে। সুজানের পালন করা সাধের কুকুর ‘হাউন্ডকে’ ওদের সাথে প্রায় দেখা যায়, কিন্তু ওর পতিদেবতার কোনো পাত্তা নেই। সুজান কি বিবাহিত, না কি একজন অবিবাহিত মাতা? হয়তোবা স্বামীর সাথে ওর বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেছে। এসব খবর জানার জন্যে কেভিন ভিতরে ভিতরে ব্যাকুল হয়ে আছে, কিন্তু সুজান এ নিয়ে কখনো কোনো কথা বলে না, ও যেন ইচ্ছে করেই কেভিনের অন্তরের তুষের আগুনটা জ্বালিয়ে রেখেছে। সুজান যদি অবিবাবিত মাতা বা তালাকপ্রাপ্ত মহিলা হয়? কেভিন তাহলে এই নিষিদ্ধ প্রেমের দহন থেকে মুক্তি পেয়ে আবার স্বপ্ন দেখা শুরু করতে পারে। আশা করতে দোষ কি? ‘চলছে ভেসে মিলন-আশা-তরী অনাদীস্রোত বয়ে।’

বিকেলে বেসবল ক্যাম্পে পাদ্রী সাহেবের সাথে কেভিনের দেখা হলো। তিনি তাঁর স্ত্রী-কন্যা নিয়ে এসেছেন। তাঁর অষ্টাদশী কন্যাটি এই স্কুলের সিনিয়র ছাত্রী, কেভিনের সাথে আগেই পরিচয় ছিল। ভদ্রলোকের বয়স হয়তো পঞ্চাশের উপরে, সবাই তাঁকে ‘ফাদার’ বলে ডাকছিলে। ফাদার কথা বলতে খুব ভালোবাসেন, তাঁর চারদিকে জড়ো হওয়া লোকের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময়ের সাথে সাথে ক্রমাগত উপদেশ বিলিয়ে চলেছেন।

একালের কলেজে পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের নৈতিক অবনতি নিয়ে উনি বেজায় চিন্তিত। প্রতি রবিবারে চার্চে না আসাই যে এই মানবিক অবক্ষয়ের কারণ সে নিয়ে ফাদারের মনে কোনো সন্দেহ নাই। যারা চার্চে নিয়মিত যায় না তাদের নরকপ্রাপ্তি সম্পর্কেও ফাদার নিশ্চিত। ফাদারের কাছেই জানা গেলো যে সুজান খুব লক্ষী মেয়ে, প্রতি রবিবারে চার্চের সামনের বেঞ্চে বসে মনোযোগ দিয়ে ধর্মের বাণী শোনে। স্বর্গ-নরক নিয়ে এতদিন কেভিনের তেমন কোনো উৎসাহ ছিল না, কিন্তু সুজানের ধর্মভক্তির কথা শুনে ও সাথে সাথে চার্চের সদস্য হয়ে গেলো। প্রতিমাসে এক’শ ডলার করে চার্চের ফান্ডে জমা দিতে হবে। তবে বছরশেষে কর দেয়ার সময় এই টাকাটা দান হিসেবে ঘোষণা করা যাবে, তাতে কিছুটা কর মৌকুফ হয়ে যায়। জাগতিক লাভ এবং পরলৌকিক মুক্তির মণিকাঞ্চন যোগ, ইহকালের কর-সুবিধার সাথে বিনা-করে পরলোকে স্বর্গবাস!

প্রতিমাসে এক’শ ডলার করে চার্চের ফান্ডে জমা দিতে হবে। তবে বছরশেষে কর দেয়ার সময় এই টাকাটা দান হিসেবে ঘোষণা করা যাবে, তাতে কিছুটা কর মৌকুফ হয়ে যায়। জাগতিক লাভ এবং পরলৌকিক মুক্তির মণিকাঞ্চন যোগ, ইহকালের কর-সুবিধার সাথে বিনা-করে পরলোকে স্বর্গবাস!

মাঠের পাশেই স্কুলের পার্ক, সেখানে আছে লোহার বেঞ্চ, টেবিল, দোলনা, রান্না করার বারবিকিউ স্টল। বেসবল ক্যাম্পের পরে সবাই জুটলো সেখানে। পাদ্রী সাহেবের স্ত্রী ঘাসের উপরে চাদর বিছিয়ে দিয়ে স্বামীর সাথে প্রেমালাপ শুরু করলেন। পাদ্রী সাহেবের মেয়ে ক্যারোল তখন গাড়ি থেকে পিকনিকের খাবার বের করছে। পাউরুটি, পোটাটো চিপস, কাবাব বানানোর মাংস, কোল্ড ড্রিঙ্কস। কেভিন হাত লাগলো ওর সাথে, ‘এতো খাবার কার পেটে ঢুকবে?’ প্রাচুর্যের দেশ আমেরিকা, এখানে গ্রামে খাবারের কোনো অভাব নেই, ক্ষেতের ফসলের সিকিভাগ ক্ষেতেই পচে!

‘আমার স্কুলের জীবন তো শেষ হতে চললো, তিন মাস পরে দূরে কোন উনিভার্সিটিতে পড়তে যাবো, কি খেতে পাবো, কে জানে! এ কদিন অন্তত পেট পুরে খেয়ে নিই,’ ক্যারোল জানালো। মেয়েটি দেখতে খুব মিষ্টি, যৌবনে পদার্পন করেছে, আচরণ এখনো কিশোরীদের মতো। প্রতিটি ব্যাক্যের সামনে পিছনে অকারণে ‘আই লাইক’ কথাটি জুড়ে দিচ্ছে, সারাক্ষন চ্যাটাস চ্যাটাস করে বাবল গাম চিবাচ্ছে।

সুজান গেছে বারবিকিউ গ্রিলে আগুন ধরাতে। সুজানের কুকুর পাশে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত লেজ নাড়াচ্ছে। কেভিনের মনটাও সুজানের চারপাশেই ঘুরে মরছে। গাড়ি থেকে পিকনিক টেবিল পর্যন্ত খাবার ফেরি করতে যেয়ে কেভিন দুবার হোঁচট খেলো, হাতের ব্যাগভর্তি চিপসের প্যাকেট পথের ধুলায় ছিটকে পড়লো। ‘তুমি একটা অকর্মার ঢেঁকি,’ ক্যারোল জানালো। ‘একেবারে সত্যি কথা, এখানে যা ক্ষতি করার, তা তো করেই ফেলেছি, এবার দেখি সুজানের বারবিকিউ গ্রিলের কোনো সর্বনাশ করতে পারি কি না।’

‘তোমাকে একটু সাহায্য করা যাক। আমি আগুন জ্বালাতে ওস্তাদ, হাজার হোক পুরুষ মানুষ তো, ‘কেভিন সুজানের কাছে এসে বললো।
‘না, না, তুমি বরং ক্যারোলকে একটু সঙ্গ দাও, বেচারা একা একা বিরক্ত হবে। তুমি তো UCLA (University of California, Los Angeles) থেকে পড়াশুনা করেছো। ওখানে না কি আবেদনকারী ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মাত্র সতেরো পার্সেন্ট ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়! ক্যারোলের বাবা বলছিলেন। আমি অবশ্য মূর্খ মানুষ, এসব কিছুই জানি না। ক্যারোল ওখানে ভর্তি হতে চায়, খুব দুশ্চিন্তায় ভুগছে, তুমি এ নিয়ে ওর সাথে একটু কথা বলো।’
‘বুঝেছি, তুমি আমাকে তাড়াতে চাচ্ছো। কারণটা আমি ঠিক জানিনা। তবে বলতে দ্বিধা নেই যে ক্যারোলের চেয়ে তোমার সঙ্গটাই আমার বেশি পছন্দ।’
‘আমার মতো বয়স্ক বিবাহিতা মেয়ের পিছনে সময় নষ্ট না করে, ক্যারোলের মতো সুন্দরী যুবতীর সাথে গল্প করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। না হলে পরে পস্তাবে। তুমি একজন সুদর্শন শিক্ষিত যুবক, নিশ্চয় বুঝতে পারছো ক্যারোল তোমাকে বেশ পছন্দ করছে।’

কেভিনের চোখের সামনে পৃথিবীটা আবার আঁধার হয়ে এলো। এই প্রথম সুজানের মুখেই জানতে পারলো যে সে বিবাহিতা। পরান যায় জ্বলিয়া রে। বারবিকিউ গ্রিলের জ্বলন্ত কয়লা থেকে তখন গলগল করে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে।

আরো পড়তে পারেন

শেষ বিকেলের অতিথি

আজ চন্দ্রার কথা মনে পড়তেই ছল ছল চোখে অশ্রুবিন্দু ঝড়ছে। তার অভিমানের শেষ আকুতি মনের মধ্যে বারবার ধাক্কা দেয়। তার প্রস্থান শেষ পর্যন্ত এতো কঠিন হবে বুঝতে পারিনি। আগেও চন্দ্রার সাথে হয়েছে অভিমানের খুনসুটি। নিজেকে মেঘের আড়ালে ঢাকতে চেয়েছে, কিন্তু সে মানাভিমান ক্ষণিকেই ইতি ঘটে গেছে। জোছনা হয়ে সে ধরা দিয়েছে। খুব ছোট্ট বিষয় নিয়ে….

স্মৃতি এখন কী করবে

জেলখানা থেকে বেরিয়ে স্মৃতি বাসে চড়ে বসে। সঙ্গে ওর মেয়ে ফাতেমা। বেশিক্ষণ কথা বলতে পারেনি হায়দারের সঙ্গে। শুধুই চোখ বেয়ে পানি পড়েছে। ফাতেমাও ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে। আর হয়তো দেখা হবে না বাবার সঙ্গে। হায়দারের চোখও ভেজা ছিল। আজই হয়তো ওদের শেষ দেখা। হায়দার বারবার স্মৃতির হাত ধরে অনুরোধ করেছে ওকে ক্ষমা করে দিতে।….

ইন্টারভিউ

কত দিন পর দেখা হলো রূপার সঙ্গে। তা মনে করতে পারছি না। চোখে চোখ পড়তেই কিছুটা থমকে গেলাম। চিন চিন করে উঠল বুকের ভেতর। ভেতর-বাইর শুরু হলো জ্বলন-পোড়ন। কথা বলব কি-না তা বুঝে ওঠার আগেই সে এলো এগিয়ে। আমাকে বলল, সায়েম তুমি এখানে? আমার ইন্টারভিউ আজ। তোমারও কি তাই? হ্যাঁ। আমারও তাই। কেমন আছ তুমি?….

error: Content is protected !!