
লেবানন বংশোদ্ভূত ফরাসী লেখক আমিন মালউফ। ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৯ সালে লেবাননের বৈরুত শহরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। এরপর শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের প্রারম্ভেই স্বদেশ ছেড়ে ফ্রান্সে পাড়ি জমান এবং ১৯৭৬ সাল থেকে এখন অবধি পুরো সময়জুড়ে ফ্রান্সেই বসবাস করেছেন। যদিও তার মাতৃভাষা আরবি কিন্তু ফরাসীতেও লিখেছেন তিনি। তার রচনাসমূহ প্রায় চল্লিশেরও অধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ‘দ্য ক্রুসেডস থ্রো আরব আইজ’ তার সর্ববৃহৎ উল্লেখযোগ্য ও পরিচিত রচনা হিসেবে বিবেচিত। মূলত আমিন মালউফকে আধুনিক আরববিশ্বের অন্যতম শক্তিমান ও প্রভাবশালী লেখক হিসেবে গণ্য করা হয়। তার উপন্যাসগুলোয় অসাধারণ রচনাশৈলী, গল্পের বুনন, ইতিহাস আশ্রিত চরিত্র উপাখ্যান, প্রেম- ভালোবাসা এবং জীবনের জরা জীর্ণতাসহ ফ্যান্টাসী ও রূপকতার এক অসম্ভব মিশেল লক্ষ্য করা যায়। সেইসাথে শৈল্পিক কারুকাজে মোড়ানো তার সৃষ্টিগুলো গভীর অন্তর্দৃষ্টি-সম্পন্ন দার্শনিকতা ও মনস্তাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণের সাথে নিগূঢ়ভাবে সমসাময়িক জীবনের সাথেও জড়ানো। ফলত পাঠক এক অন্তর্নিহিত উপলব্ধি ও একইসাথে বাস্তবতার মুখোমুখিও হয় তার লেখার মাধ্যমে। এছাড়াও মালউফ তার বহু রচনাতেই, পরিচয়সত্তার মৌলিক সমস্যা, ধর্ম ও জাতীয়তাবাদের চাপ, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও ভূমধ্যসাগরীয় বিশ্বের বিভিন্ন সাংস্কৃতির উদ্বেগ ও মূল্যবোধ অনুসন্ধান করে এর বিশ্লেষণ করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যা ও উত্তরণ বিষয়ক আলোচনায় বিশ্বের নানা ভাষায় প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। কর্মমুখর প্রাজ্ঞ এই গবেষক-লেখকের বর্তমান জীবন, লেখালেখি, ফ্রান্স সাহিত্য একাডেমির সদস্য মনোনীত ও মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক নানা বিষয় জানতে তার মুখোমুখি হয়েছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক লেনা বুপ। সাক্ষাতকারটি জার্মান ভাষা থেকে আইঞ্জিয়াল ফ্লানাগানের ইংরেজি অনুবাদে ২০১৯ সালে Qantara.de পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। সেখান থেকে বাংলাভাষী পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন কবি কাউসার মাহমুদ।
জনাব মালউফ! আপনার শেষ প্রবন্ধে, ট্রাম শাসনাধীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রেকসিট, জলবায়ু পরিবর্তন ও মধ্যপ্রাচ্যে বিরাজমান সংঘর্ষ নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। ওখানে এই সবগুলো ইস্যুকেই একই ধাঁধার খণ্ডবিখণ্ড অংশ বলে উল্লেখ করেছেন এবং যে কারণে নিজের শেষ গ্রন্থের নামও দিয়েছেন ‘সভ্যতার নিমজ্জন’ (Le naufrage des civilisations)। আসলে বিষয়গুলোর মাঝে সংযোগটা কী?
আমিন মালউফ : সত্যি বলতে কী, বেশ ক’বছর ধরে আমি কেবল চুপচাপ বসে থেকে নির্দিষ্ট ঘটনাগুলো মনোযোগ দিয়ে পর্যালোচনা করতে চেয়েছি। আপনারা জানেন আমার কিছু বই আছে। যেগুলো লেবাননে কাটানো আমার শৈশবকে কেন্দ্র করে একান্তই ব্যক্তিগত অন্তর্দৃষ্টি-নির্ভর। ওখানেই প্রথম আঞ্চলিক সমস্যার মুখোমুখি হই। তখন আমার ধারণা ছিলো, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যা ঘটেছে; তা পুরো বিশ্বব্যাপীই অস্বাস্থ্যকর উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে।
আপনার রচনাসমূহে দেখা যায় আপনি খুব বেরসিক আর বেশ শক্ত চিত্রাবলি ব্যবহার করেন। যেমন আমরা দেখতে পাই, আপনি লিখেছেন,‘আমার জন্মস্থান থেকে সারা পৃথিবীতে অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ে!’
আমিন মালউফ : যেমন এ-ও লিখেছি, প্রতিনিয়তই নিজেকে নিজে এই প্রশ্ন করা বন্ধ করে দিয়েছিলাম যে, ‘আমি কী নিজস্ব উপলব্ধ অভিজ্ঞতাগুলো সার্বজনীন করে তুলছি কি-না?’ তবে আমার এটাও মনে হয় যে, বর্তমান বিশ্বের বিকাশে এমনকিছু উপাদান রয়েছে—যেগুলো আরব দেশগুলোতে উদ্ভূত হয়েছিল।
ওই উপাদানগুলো কী?
আমিন মালউফ : উদহারণস্বরূপ, ঊর্ধ্বগামী জনপ্রিয়তা। দেখুন, মূলত বিপদে মানুষ অনেক বেশি সংবেদনশীল। আবার এখানেই এমনকিছু লোক আছেন যারা, অভিবাসন সম্বন্ধে বেশ উদ্বেগ অনুভব করেন। সুতরাং স্পষ্টতই এখানে আরব বিশ্বে অশান্তি এবং নিজেকে রক্ষার প্রয়োজনীয়তার মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে। কিছু অংশে যা ন্যায়সঙ্গত আর কিছুটা নির্দিষ্ট কিছু রাজনৈতিক শক্তি দ্বারা শোষিত।
যেমন আমরা দেখতে পাই, আপনি লিখেছেন,‘আমার জন্মস্থান থেকে সারা পৃথিবীতে অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ে!’
এই সমস্ত ক্ষেত্রে তেল কী ভূমিকা পালন করে?
আমিন মালউফ : দেখুন, আরব বিশ্বেই তো এই পেট্রো-ডলার নির্দিষ্ট কিছু ঐতিহ্যবাহী গোষ্ঠীকে প্রভাবিত করেছে এবং অন্যদের থেকে তাদের দূরে সরিয়ে নিয়েছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী প্রভাব অর্জন করেছে সৌদি আরব; যখন মিশরের কোনও তেল-ই ছিল না। অথচ তারা কিন্তু বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি বুদ্ধিবৃত্তিক এবং রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করেছে। যদিও এখন এর তাৎপর্য ক্ষীণ হয়ে এসেছে। এছাড়াও ওই পেট্রো-ডলার বিভিন্ন অঞ্চলে যে অস্থায়িত্বতা নিয়ে এসেছিল—বিশেষত ইরাকের মত এমন অন্যান্য অঞ্চলগুলোয়, তার প্রভাব কিন্তু বিশ্বের বাকি অংশেও পড়েছে। তদুপরি সত্তরের দশকের ওই তেল সংকট কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বে নতুন এক মানসিকতা বিকাশের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। যার প্রকাশ অন্যান্য অর্থনৈতিক পলিসি, থ্যাটচরিজমে পাওয়া গিয়েছিল।
আপনি একটি ‘আত্মঘাতী নৈরাশ্যের’ কথা লিখেছেন যে, যা ১৯৬৭ সালে ছ’দিনের যুদ্ধে ইজরায়েলের কাছে পরাজয়ের পর আরব বিশ্বে আত্মপ্রকাশ করেছিলে। প্রশ্ন হলো, কেন আর কখনোই এই পরাজয় থেকে পুনরুজ্জীবিত হতে পারেনি আরব বিশ্ব? যেখানে আপনি অন্যান্য দেশগুলোর কথা উল্লেখ করে বলেছেন, যারা তাদের বৃহত্তর পরাজয়ের পরও পুনরায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মান এবং কোরিয়ান যুদ্ধের পর দক্ষিণ কোরিয়া।
আমিন মালউফ : প্রধানত প্যান অ্যারাবিজম বা ‘আরব একাত্মতা’—যেটা কিনা অন্যতম প্রধান এক প্রতিশ্রুতিশীল মতবাদ হিসেবে মিসরে নাসেরের শাসনামলে দেখা হয়েছিল এবং উৎসাহিত মানুষের বিরাট এক দলের উত্থান ঘটিয়েছিল। কিন্ত ৬৭ সালের সে পরাজয় তা একেবারেই নিঃশেষ করে দেয়। এদিকে যুদ্ধের কিছু পরেই নাসের মারা যান এবং পরবর্তীতে কেউই আর তার শূন্যতা পূরণ করতে পারেনি। অথচ প্রবল ওই শূন্যতা পূরণের পরিবর্তে উন্মুক্ত দরজাটি ওখানে জাতীয়তাবাদের এমন এক আকৃতির জন্য খোলা হয়েছিল; যার একটি শক্তিশালী ধর্মীয় উপাদান ছিল। ফলে তখন তেল উৎপাদনকারী রাষ্ট্রগুলো থেকে ছড়িয়ে পড়া ‘রেডিকাল ইসলামিজম’ আরব সমাজের মধ্যে উত্তেজনা ও বিভেদ সৃষ্টি করেছিল। আর স্পষ্টতই যেটা ক্রমশ আরব বসন্ত দ্বারা চিত্রিত হয়েছিল।
সত্যি বলতে অনেক দেশেই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রকৃতই গণতান্ত্রিক আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। যদিও শক্তিশালী কঠোর ইসলামি অঙ্গদলগুলো এই প্রয়াসটিকে বাস্তবায়নে বাধা দিয়েছে। অধিকন্তু বেশ কিছু নামধারী ইসলামপন্থী দলের সন্ত্রাসী হামলা বাস্তবিকভাবেই বিশ্বজুড়ে চরমভাবে আরবদের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। যে কারণটিই নজিরবিহীন, অপূরণীয় এক বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দিয়েছে তাদের। তাছাড়া ওইদিকে আরবদের শুধু কেবল পশ্চিমাদের সাথেই বিরোধ নয় বরং অন্যান্য দেশ বিশেষত নাসেরের মিত্র হিসেবে পরিচিত, চীন, ভারত ও রাশিয়ার সাথেও বৈরীতা ছিল। দেখুন! কট্টরপন্থা মূলত মানুষের একে অপরকে ছাড়িয়ে যাবার একটা তীব্র প্রচেষ্টা। যেগুলোর একটিকে আপনি আরব বিশ্বে রাজনৈতিক জীবনের বৈশিষ্ট্য হিসেবে বর্ণনা করেছেন!
আমিন মালউফ : আমার মনে হয়, মূল রাজনৈতিক আলোচনাটি বিকৃত হয়েছে। অভিরুচি বা বিকল্পগুলোর ব্যাপারে যুক্তিসঙ্গত আলোচনা সম্ভব নয়। এখানে কিছু মৌলিক শব্দমাল আছে, যত দ্রুত মানুষ তা শোনে আশ্চর্যভাবে তারা যেন প্রান্তিক অথবা তাদের বিশ্বাসঘাতক হিসেবে দেখা হচ্ছে—এই ভয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এমনকি কেউ একজন জিজ্ঞেসও করে না যে, কোন দিকে যেতে চাই আমরা? কী সৃষ্টি করতে চাই? আলোচনাটি মূলত স্লোগান দ্বারা অচল হয়ে গিয়েছিল। জননেতাসুলভ অতিরঞ্জন ও মধুভাষী যৌক্তিক বিতর্কের সাহায্যে জোরপূর্বক যা করা হয়েছিল।
ফলে তখন তেল উৎপাদনকারী রাষ্ট্রগুলো থেকে ছড়িয়ে পড়া ‘রেডিকাল ইসলামিজম’ আরব সমাজের মধ্যে উত্তেজনা ও বিভেদ সৃষ্টি করেছিল
তবু আপনি আপনার বইয়ের আত্মজীবনীমূলক জায়গাগুলোয়, লেবাননে আপনার জীবনের শুরুর স্মৃতিচারণ করেছেন যে, সেখানে আপনি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মাঝে সহাবস্থানের এমন এক অভূতপূর্ব রূপের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন; যা কেবল মধ্যপ্রাচ্যই নয় বরং সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি আদর্শ হিসেবে কাজ করতে পারতো। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে লেবাননের সাথে আপনি কি এমন কোনো বিশেষ তাৎপর্য যুক্ত করছেন না যা সেখানে কখনোই ছিলো না বা থাকতে পারে না! তাছাড়া এই সহাবস্থানের আদর্শ কী প্রকৃত অর্থে কখনো উপস্থিত ছিল ওখানে? বর্তমানে এই লেবাননের দিকে তাকিয়ে দেখুন না! যেখানে এই সহাবস্থান নামক বিষয়টি অতীব অসম্ভব মনে হচ্ছে।
আমিন মালউফ : হ্যাঁ! সেখানে অবশ্যই এমন কোনো বিশেষ মুহূর্ত ছিলো না যাতে জাদুবলেই সবকিছু সুন্দর হয়ে যাবে। অথচ আমি কিন্তু রাস বৈরুতেই (‘রাস’ বৈরুতের উচ্চবর্গ শ্রেণীর স্বনামধন্য এক আবাসিক পাড়া। যেখানে সর্বধর্মীয় মানুষজনেরই স্বাধীন বসবাস ছিল) বেড়ে উঠেছি। যেটা বৈরুতে অবস্থিত আমেরিকান ইউনিভার্সিটি থেকে খুব বেশি দূরে ছিলো না। সেখানে অমন একটা পরিবেশে পৃথিবীর নানা দেশের, বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন সমাজের লোকেরা বসবাস করতো। অসংখ্য অধ্যাপক আর ছাত্রদের কোলাহলে জ্ঞানের সুনিশ্চিত একটা ধারা ছিল সেখানে। এবং ছিল সহাবস্থানের এক অভূতপূর্ব বিন্যাস—যা অন্য কোথাও কখনোই পাইনি আমি। আমার মনে হয় তা ছিল ‘সহাবস্থান আদর্শের’ অনুপম উপাদান।
কীভাবে অন্যত্র এই উপাদানগুলোর প্রভাব থাকতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
আমিন মালউফ : আসলে অনেকগুলো বলিষ্ঠ আদর্শই রয়েছে এখানে। দেখুন! লেবানন যদি একটি কার্যকরী পদ্ধতি বিকাশ করতে সক্ষম হয়েছিল—তাহলে অবশ্যই এই উন্নতিটা অঞ্চলটিকে ধ্বসিয়ে দেবার পরিবর্তে টেনে তুলতে সহায়তা করেছিল এবং ঠিক যেমনটা ঘটেওছিল দেশটিতে। তারচেয়েও বড় কথা এটি কেবল বিশ্বের কোনও পুরনো অঞ্চলই নয় বরং বলা যায় একেশ্বরবাদী তিনটি বিশ্বধর্মের শৈশবাবস্থার এক প্রকার প্রদর্শনীও। সুতরাং সত্যিই যদি এ অঞ্চলে তার ইতিহাস ও সমস্যার সাথে সাথে প্রকৃত সহাবস্থানটি স্থির থাকতোই তাহলে অন্যান্য অঞ্চলগুলোতেও তা বিচ্ছুরিত হত।
আপনি নিজে এর প্রত্যক্ষদর্শী যে, লেবাননে কীভাবে সমস্ত বিষয়গুলো ধারাবাহিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল। ১৯৭৫ সালে ঘৃণ্য ওই বাসে হামলার সময় আপনি সেখানে ছিলেন। এমনকি খ্রিষ্টানরা তখন ফিলিস্তিনিদের ওপর আক্রমণের সময়ও আপনি সেখানেই উপস্থিত। যে ঘটনাটিই মূলত সাধারণ গৃহযুদ্ধের সূচনা হিসিবে বিবেচিত হয়।
আমিন মালউফ : সে এক ভয়াবহ স্মৃতি। তার আগে বলে রাখি যে, আমি ও আমার স্ত্রী বিয়ের পর এল রেমনেহ এলাকায় একটি ফ্লাট ভাড়া নিই। যেখানে ওই আক্রমণ হয়েছিল সেখান থেকে পঞ্চাশ মিটারেরও কম দূরত্ব ছিল রেমনাহ। তো ১৩ এপ্রিল ১৯৭৫ সালের ওই ভোরে আচমকাই শহরের রাস্তাজুড়ে আমরা মানুষের গগণবিদারী চিৎকার ও ভয়ানক আওয়াজ শুনতে পাই। যদিও আমি বুঝতে পারছিলাম না যে কী বলছিল তারা! তবে এটা স্পষ্ট ছিল যে, একে-অপরের সঙ্গে লড়াই করছে এবং পাগলের মত উচ্চ নিনাদে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তুলছে। এটাই হয়তো আমাকে আরো গভীর উপলব্ধি দিয়েছিল যে কী ঘটে চলছে! এবং এরপরই খুব দ্রুত বুঝতে পারি যে অসম্ভব ভয়াবহ কিছু ঘনিয়ে আসছে।
আলোচনাটি মূলত স্লোগান দ্বারা অচল হয়ে গিয়েছিল। জননেতাসুলভ অতিরঞ্জন ও মধুভাষী যৌক্তিক বিতর্কের সাহায্যে জোরপূর্বক যা করা হয়েছিল
আচ্ছা এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি। তা আপনি তো প্রায় চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে ফ্রান্সে। আবার কী কখনো স্বদেশে ফিরে যাওয়ার চিন্তা করেছেন?
আমিন মালউফ : আসলে এক দুইবার আমার কাছে তা সম্ভবপর মনে হয়েছিল। তবে অবশ্যই ওই অবস্থাগুলো খুব দ্রুত কেটে গেছে। তাছাড়া যখন আমি লেবানন ছেড়ে আসি, আমি জানতাম যে খুব দীর্ঘ সময়ের জন্য এই দেশ ছেড়ে যাচ্ছি। অথচ যখন ছোট ছিলাম তখন কেউ যদি আমায় দেশত্যাগের কথা বলতো; আমি তা একেবারে অসম্ভব মনে করতাম।
ফ্রান্সে অনেক সাহিত্য পুরস্কারই অর্জন করেছেন, এমনকি বিগত কয়েক বছর থেকে এখন Académie Française এর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবেও আছেন। ঐতিহ্যগতভাবে এই প্রতিষ্ঠানগুলো শেষপর্যন্ত তাদের সদস্য হওয়ার আগে দুই তিনবার প্রার্থীদের প্রত্যাখ্যান করে। আপনার সঙ্গেও কী এমনটা হয়েছিল? তাছাড়া কেনইবা কেউ একজন এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে নিজেকে এর সঙ্গে যুক্ত রাখবে?
আমিন মালউফ : যখন ফ্রান্সে আসি তখন ঠিক লেবাননে যেমন ছিলাম, তেমনই একজন সংবাদকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করি এখানে। যাহোক, যেহেতু সবসময় লেখাই আমার এক ও অনন্য স্বপ্ন ছিল; তাই একসময় মৌলিকভাবে প্রধানত লেখালেখিই শুরু করি। এদিকে খুব ভালোভাবেই জানতাম যে, মূলত এই লেখালেখিকেই আমি আমার জীবন বানাতে চাই। অতএব আপনি যদি ফ্রান্সে বসবাস করেন এবং একজন লেখক হন তাহলে এটাই একমাত্র যৌক্তিকতা যে আপনি ‘প্রিন্স গণকোর্ট’ জিততে চান এবং Académie Française এর সদস্য হতে চান। আর আমিও সেটাই করেছি।
প্রায় দশ বছর আগে শেষবার একাডেমির কোনো সদস্যের সঙ্গে কথা বলেছিলাম আমি। তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন, তাদের অভিধানের কাজটি এগিয়ে চলছে এবং তা R পর্যন্ত পৌঁছেছে।
আমিন মালউফ : হ্যাঁ! এটা দু’হাজার বারো সালের কথা। আমি যখন জয়েন করি তখন তারা ঠিক ওখানেই ছিল।
আসলে খুব বেশি এগুতে পারিনি আমরা। যেমন উদহারণস্বরূপ আজ সকালে আমি T শব্দের ওপর কাজ করেছি। কিন্তু ওখানে আবার দুটি গ্রুপ আছে। এদের একদল বেশ ভালোই এগিয়েছে। তারা এখন পর্যন্ত W পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েছে। সুতরাং ব্যক্তিগতভাবে আমি আশা করি যে আগামী তিন চার বছরের মধ্যেই পুরো বর্ণমালার কাজটি শেষ করতে পারবো আমরা এবং তারপর আবার শুরু করবো।