Author Picture

সংস্কৃতি ও বিনোদন এখন সমার্থক হয়ে গেছে

এয়া

রাজীব সরকার এই সময়ের শক্তিমান লেখক। প্রাবন্ধিক হিসেবে বেশি পরিচিত হলেও, সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় তার কাজগুলোও সমান গুরুত্বের দাবি রাখে। বিতর্ক বিষয়ে রাজীব সরকারের একাধিক বই মেধাবী তরুণদের প্রয়োজন মিটিয়েছে। খুব অল্পসময়ের মধ্যেই তার রম্যরচনার আলাদা পাঠকশ্রেণী গড়ে উঠেছে। গল্প ভ্রমণকাহিনি ও লিখেছেন। চলমান বিষয়ে দৈনিক পত্রিকায় মতামতধর্মী কলামও লিখে থাকেন বিভিন্ন সময়ে।
জন্ম কিশোরগঞ্জ জেলায়। পড়েছেন- ময়মনসিংহ জিলা স্কুল, নটরডেম কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইংল্যান্ডের নর্দাম্ব্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভ্রমণ করেছেন এশিয়া, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ার ১৭টি দেশে। বাংলাদেশের শিল্পসাহিত্য এবং লেখকের ব্যক্তিগত লেখালেখির বিষয়ে সৃজনের সঙ্গে যে আলোচনা হয়েছে তার অংশবিশেষ এখানে পত্রস্থ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: এয়া

সাহিত্য সমাজের কাজে আসার(প্রচলিত ব্যবস্থার সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা অর্থে) জন্য না সমাজ বিনির্মাণের জন্য? আমাদের সাহিত্য এখন কী কাজ করে? কী করা উচিৎ? কী করতে পারছে?
রাজীব সরকার: ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ না ‘জীবনের জন্য শিল্প’-এই বিতর্ক এক সময় সাহিত্যচর্চাকে প্রভাবিত করেছে গোটা বিশ্বজুড়ে। ভারতীয় উপমহাদেশেও এর ঢেউ আছড়ে পড়েছে। বাঙালি সাহিত্যিকগণও দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে বিতর্ক করেছেন। যারা শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বে বিশ্বাসী তারা কলাকৈবল্যবাদী নামে অভিহিত হয়েছিলেন। এর বিপরীতে ছিলেন মার্কসবাদী সাহিত্যতাত্ত্বিক ও বামপন্থী ঘরানার লেখকগণ। আমি শুধু শিল্প বা শুধু জীবনের পক্ষপাতী নই। সাহিত্য বা যেকোনো শিল্পের অঙ্গীকার যৌথভাবে শিল্পের কাছে ও জীবনের কাছে। সে অর্থে একটি সুন্দর ও ন্যায়পরায়ণ সমাজ নির্মাণে সাহিত্য ভূমিকা পালন করতে পারে। ভলটেয়ার, রুশোর সাহিত্যসম্ভার ফরাসী বিপ্লবে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিল। টলস্টয়ের উপন্যাসকে লেনিন অভিহিত করেছিলেন রুশ বিপ্লবের আয়না হিসেবে।
দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাঙালিরা নানা ক্ষেত্রে সীমাহীন বৈষম্যের শিকার হয়। এর অন্যতম ফলাফল ভাষা আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধকরণের অপপ্রয়াস রুখে দিয়ে ‘ছায়ানট’ প্রতিষ্ঠিত হয়, ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। ষাটের দশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পূর্ণ বিকাশ ঘটে যার প্রত্যক্ষ ফসল মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন। এই অর্জনের নেপথ্যে শিল্প-সাহিত্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। ষাটের দশকের সাহিত্যে বিশেষত কবিতায় ও চলচ্চিত্রে শোষিত বাঙালির মুক্তির আকাঙ্ক্ষা তীব্রভাবে ফুটে উঠেছে। তাই সমাজ পরিবর্তনে সাহিত্য ভূমিকা পালন করতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যতম অঙ্গীকার শোষণমুক্ত ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত সমাজ গঠন। সেই অঙ্গীকার পূরণে সাহিত্য কাজ করতে পারে। আইনী সুরক্ষা থাকার পরও নারী নির্যাতন কমছে না। ধার্মিকতা ও ধর্মমোহ একাকার হয়ে যাচ্ছে। এভাবে সমাজের নানা ক্ষেত্রে রোপিত হচ্ছে উগ্রবাদ ও ধর্মান্ধতার বীজ। এই নেতিবাচক দিকগুলো রাতারাতি নির্মূল করা সম্ভব নয়। তবে এর ভয়ঙ্কর পরিণাম সম্পর্কে সাহিত্য মানুষকে সচেতন করতে পারে, ইতিবাচক ও প্রগতিশীল জীবনদর্শনে একটি জনগোষ্ঠিকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।

সাহিত্যকে বলা হয় জীবনের দর্পণ। সকলের জীবনই তো জীবন। সাহিত্য কোন জীবনটাকে তুলে আনবে কোন জীবনের সামনে? কোন মানদন্ডে?
রাজীব সরকার: সাহিত্য নিঃসন্দেহে জীবনের দর্পণ। জীবন বহুমাত্রিক ও বৈচিত্র্যে পূর্ণ। এটি লেখকের সিদ্ধান্ত যে তিনি কোন জীবনকে তুলে আনবেন। শিবনারায়ণ রায় একবার বলেছিলেন, আমাদের নায়ক-নায়িকারা যে হাঁচে, কাশে, মলমূূত্র ত্যাগ করে রবীন্দ্রসাহিত্যের কৃপায় তা আমরা ভুলতে বসেছি। তার অভিযোগ ছিল, রবীন্দ্রসাহিত্য জীবনের সৌন্দর্য ও বর্ণিলতাকেই প্রাধান্য দিয়েছে। জীবনের সংকট, গ্লানি, ক্লেদ, রক্তক্ষরণকে রবীন্দ্রনাথ এড়িয়ে গেছেন। এই অভিযোগ সর্বাংশে সত্য নয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাসাহিত্যে আবার জীবনের অন্যরূপ দেখা যায়। শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, তারাশংকরের সাহিত্যেও জীবনের ভিন্ন ভিন্ন রূপ উন্মেচিত হতে দেখা যায়। একই কথা কবিতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, সুকান্ত, বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় ভিন্ন ভিন্ন জীবনের সুর প্রতিধ্বনিত হয়েছে। বিশ্ব সাহিত্যেও বড় বড় লেখকদের রচনায় এই বৈচিত্র্য লক্ষণীয়।

লেখকের অর্ধসত্য বক্তব্য কি সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে? এতে পাঠক তথা জনগণের লাভ-ক্ষতির হিসেবটি কোথায় এসে দাঁড়ায়?
রাজীব সরকার: অর্ধসত্য মিথ্যার চেয়েও ভয়ঙ্কর। লেখকের অর্ধসত্য বক্তব্য পাঠককে বিভ্রান্ত করে। এভাবে সত্য বিকৃত হয়।

সাধারণত কবিতা দিয়েই হাতেখড়ি। নয়ত গল্প দিয়ে। পরে হাত পাকিয়ে কেউ কেউ প্রবন্ধে আসেন। অথচ আপনি সেই ছোট্টবেলা থেকেই লিখছেন এবং প্রবন্ধের মতো কঠিন চিন্তাশীল লেখাই বেছে নিয়েছেন। প্রবন্ধ দিয়ে সাহিত্যযাত্রা শুরুর কারণ বা লেখালেখি শুরুর গল্পটা…
রাজীব সরকার: কিশোর বয়স পর্যন্ত ছড়া, কবিতা ও গল্প লিখেছি। সংবাদপত্রে ছোটদের পাতায় তা ছাপাও হয়েছে। স্কুলজীবন থেকেই বিভিন্ন অসঙ্গতি নিয়ে ‘সংবাদ’ পত্রিকার ‘চিঠিপত্র’ কলামে চিঠি লিখতাম। এ ক্ষেত্রে আমার বাবা খুব উৎসাহ দিতেন। বিখ্যাত সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত যত্ন সহকারে আমার চিঠি ছাপতেন। বয়সের তুলনায় বেশ গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে লিখতাম বলে অনেকে কৌতূহলী হয়ে আমাকে চিঠি লিখতেন ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের ঠিকানায়। তখন বিতর্ক, রচনা, আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে নিয়মিত পুরস্কার পেতাম। কাকতালীয় হলেও সত্য যে রচনা প্রতিযোগিতায় সব সময় প্রথম পুরস্কার পেয়েছি। এসএসসি পাসের পর যখন নটর ডেম কলেজে ভর্তি হই তখন থেকেই অনুভব করি আমার লেখালেখির ঝোঁক ক্রমশ চিন্তামূলক রচনার দিকে সরে যাচ্ছে। বলা যায়, পত্রিকায় চিঠিপত্র লেখা এবং রচনা প্রতিযোগিতার জন্য রচনা লেখারই সম্প্রসারিত রূপ প্রবন্ধ লেখা। ১৯৯৭ সালে ‘সংবাদ’-এ আমার প্রথম প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় ‘বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার ভবিষ্যৎ’ নামে। এর পরের বছর ‘সংবাদ’-এর সাহিত্য সাময়িকীতে সত্যজিৎ রায়ের ওপর আমার একটি প্রবন্ধ ছাপেন তৎকালীন সাহিত্য সম্পাদক আবুল হাসনাত। সন্তোষ গুপ্ত, আবুল হাসনাত ও সোহরাব হাসান- তৎকালীন ‘সংবাদ’ পত্রিকার এই তিন গুণীজনের পরিচর্যায় আমার প্রাবন্ধিক সত্তার বিকাশ ঘটে।এরপর দেশের অন্যান্য পত্রিকায়ও নিয়মিত প্রবন্ধ ও কলাম লিখতে শুরু করি।

১৯৯৭ সালে ‘সংবাদ’-এ আমার প্রথম প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় ‘বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার ভবিষ্যৎ’ নামে

প্রবন্ধসাহিত্য শুরু করে সেপথেই হাঁটছেন। রম্যরচনা লিখে পাঠকপ্রিয়তা পেলেও আপনি সেঅর্থে সৃজনশীল সাহিত্য করছেন না। মননশীল সাহিত্যের কঠিন পথকেই আপনার সাহিত্যের প্রধান মাধ্যম হিসেবে নেয়ার বিশেষ কোনো কারণ আছে কী?
রাজীব সরকার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের ছাত্রাবস্থায় আমার প্রথম প্রবন্ধের বই প্রকাশিত হয়। এ সময় আমার মধ্যে একটি উপলব্ধি ঘটে যে বাংলাভাষার সৃজনশীল সাহিত্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। আমি যদি গল্প, কবিতা, উপন্যাস না লিখি তবে বাংলাসাহিত্যের কোনো হ্রাসবৃদ্ধি ঘটবে না। তুলনামূলকভাবে আমাদের মননশীল সাহিত্য অর্থাৎ প্রবন্ধ তেমন সমৃদ্ধ নয়। যদি আমি সততা, পরিশ্রম ও নিষ্ঠা নিয়ে চেষ্টা করি তাহলে হয়তো প্রবন্ধ সাহিত্যে সামান্য হলেও অবদান রাখতে পারব। এ উপলব্ধি থেকেই আমার প্রবন্ধ চর্চা করে যাওয়া। সেই সাথে মাঝে মাঝে রম্যরচনা, ভ্রমণকাহিনি ও কলাম লিখি।

ওই সময়ে কাদের লেখা আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছিল?
রাজীব সরকার: শৈশবেই পারিবারিক পরিবেশে সাহিত্যিক আবহ পেয়েছি। ছাত্রজীবন থেকেই আমার বাবা শ্যামল সরকার প্রগতিশীল রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলন। বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যের বহু চিরায়ত বই তার সংগ্রহে ছিল। বাবার মতো আমার মাও ছিলেন অগ্রসর পাঠক। বাবা পত্রপত্রিকায় লিখতেন। আমার কাকা বিমল সরকার ইতিহাসের অধ্যাপক। তিনিও নানা বিষয়ে চিন্তাশীল প্রবন্ধ লিখেছেন। তাদের কাছ থেকে আমার পড়াশোনার অভ্যাস তৈরী হয়েছিল। বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, সুকুমার রায়, নজরুল, সুকান্ত, জীবনানন্দ, শেক্সপীয়র, টলস্টয়ের বইয়ের সঙ্গে পরিচয় স্কুলে থাকতেই। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সদস্য হওয়াতে দেশ বিদেশের বর্ণিল সৃজনশীলতার দুয়ার আমার সামনে উন্মোচিত হয়ে যায়।
কলকাতার ‘দেশ’ ও ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকা নিয়মিত বাসায় আসত। দেশের দৈনিক সংবাদ, ভোরের কাগজের কলাম ও সাহিত্য সাময়িকীর প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনী বেশ আগ্রহ নিয়ে পড়তাম। সাপ্তাহিক ‘খবরের কাগজ’ও পড়ার সুযোগ হয়েছে। তখন তিনজন লেখকের প্রবন্ধ আমাকে বেশ আকর্ষণ করত। তাঁরা ছিলেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, যতীন সরকার ও আনিসুজ্জামান। সংবাদ পত্রিকায় ‘গাছপাথর’ ছদ্মনামে ‘সময় বহিয়া যায়’ শীর্ষক কলাম লিখতেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ‘খবরের কাগজ’ পত্রিকায় যতীন সরকারের ধারাবাহিক ‘পাকিস্তানের জন্ম মৃত্যু-দর্শন’ নিয়মিত বের হতো। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে আনিসুজ্জামানের প্রবন্ধ থাকত একাধিক পত্রিকায়। এ তিনজনের বিভিন্ন লেখা পড়ে ধারণা হয়েছিল সার্থক প্রাবন্ধিক তারা। যুক্তি, তত্ত্ব, তথ্য ও পাণ্ডিত্যের সমন্বয়ে অসাধারণ সব প্রবন্ধ লিখেছেন তাঁরা। আমার সৌভাগ্য যে, পরবর্তী সময়ে তাদের তিনজনেরই স্নেহ পেয়েছি। বিশেষ করে যতীন সরকার আমার সাহিত্যচর্চায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পথপ্রদর্শক। এ ছাড়া অন্য লেখকদের প্রবন্ধও পড়েছি তখন। এখনও পড়ে যাচ্ছি।

তখনকার সময়ের মননশীল সাহিত্যের সাথে এখনকার সাহিত্যের মননশীলতার তুলনায় কী বলবেন?
রাজীব সরকার: পঁচিশ বছর আগের সাথে বর্তমান সময়ের তুলনা করলে দেখি প্রবন্ধ বা মননশীলতার চর্চা কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছেনি। গত তিন দশকে এক ঝাঁক প্রতিভাবান কথাসাহিত্যিক ও কবির আবির্ভাব ঘটেছে। সে তুলনায় প্রাবন্ধিক, গবেষক ও সাহিত্য সমালোচকের উপস্থিতি কম। প্রবন্ধ লেখার জন্য প্রচুর বই পড়তে হয়, গবেষণা করতে হয়, পরিশ্রম স্বীকারের মানসিকতা থাকতে হয়। তখন বই, পত্রপত্রিকা খুব সুলভ ছিল না। এরপরও প্রাবন্ধিকরা নিজেদের শ্রম ও মেধা দিয়ে সেই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতেন। এখন বই, পত্রপত্রিকা, রেফারেন্স বইয়ের অভাব নেই। ইন্টারনেটের কল্যাণে পৃথিবী হাতের মুঠোয়। কিন্তু চিন্তাশীল, পরিশ্রমী প্রাবন্ধিকের সংখ্যা কম। অস্থির এক সময় পার করছি আমরা। ভোগবাদে নিমজ্জিত থেকে খুব তাড়াতাড়ি সব পেতে অভ্যস্ত আমরা। নিষ্ঠা, শ্রম ও অধ্যয়ন ছাড়া প্রবন্ধসাহিত্য বা মননশীলতার চর্চা সম্ভব নয়।

পাড়ায় মহল্লায় যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো হতো এখন তা কমে গেছে। বিশেষ করে- নাটক, থিয়েটার, গান-নাচ, আবৃত্তি, রচনা এবং বিতর্ক প্রতিযোগিতা; এই বিষয়গুলো নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশে যেমন সহায়ক, তেমনি জ্ঞানার্জনেরও বিশেষ মাধ্যম। প্রযুক্তির কারণে বাস্তবিক অর্থে শুধু বিনোদনের প্রয়োজনটুকু মেটানোর মতো কিছু একটা এখন হচ্ছে। কেন এবং কখন থেকে আমাদের সংস্কৃতি চর্চার এ হাল? এই পরিস্থিতি থেকে কীভাবে বের হতে পারব?
রাজীব সরকার: দুর্ভাগ্যজনকভাবে সংস্কৃতি ও বিনোদন এখন সমার্থক হয়ে গেছে। সংস্কৃতি একটি জাতির সামগ্রিক জীবনবোধের পরিচায়ক। এর বস্তুগত ও ভাবগত রূপ হয়েছে। সংস্কৃতির একটি উপাদান হচ্ছে বিনোদন। নাচ, গান, অভিনয়, আবৃত্তি প্রভৃতিকে নিছক পারফরমিং আর্ট হিসেবে দেখার ফলে সংস্কৃতির ধারণা খন্ডিত হয়ে গেছে। যারা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত, শিল্পী হিসেবে পরিচিত তাদের অনেকেই সংস্কৃতি বলতে শুধু বিনোদনকেই বোঝেন। এ ভ্রান্ত ধারণা দর্শক-শ্রোতার মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে।
কোনো সন্দেহ নেই, আগের তুলনায় পাড়ায়, মহল্লায় সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, লাইব্রেরির তৎপরতা কমে গেছে। এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই। এর প্রধান কারণ হচ্ছে বিশ্বায়নের ফলে সৃষ্ট অসুস্থ প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব। অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই মনে করে সহপাঠ্যক্রমিক কার্যক্রম প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়াকে ব্যাহত করে।

পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই। এর প্রধান কারণ হচ্ছে বিশ্বায়নের ফলে সৃষ্ট অসুস্থ প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব

জিপিএ-৫ নামক সোনার হরিণের পেছনে ছুটছে সবাই। তারা ভেবে দেখছেন না যে, স্কুল-কলেজের পরীক্ষার চেয়ে জীবনের পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া কম জরুরি নয়। সন্তানকে প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও বিজ্ঞানের বর্ণিল ভুবনের সঙ্গে তাদেরকে একাত্ম হতে দিতে হবে। মাদক, নারী নির্যাতন, জঙ্গিবাদের মতো অপরাধের করাল গ্রাস থেকে তরুণদের মুক্ত করতে হলে সহপাঠ্যক্রমিক কার্যক্রমের গুরুত্ব বৃদ্ধি করতে হবে।

স্কুল কলেজে বার্ষিক ম্যাগাজিন প্রকাশের ফলে ছাত্রাবস্থায়ই অনেকের লেখালেখির হাতেখড়িও হয়ে যেতো। অথচ, এখন স্কুল ম্যাগাজিন আর বের হচ্ছেনা বললেই চলে…
এমন একটা ক্ষতিকর পরিস্থিতির তৈরি হওয়ার বিশেষ কারণগুলো কী মনে হয়?
রাজীব সরকার: আগে স্কুল, কলেজ থেকে দেয়ালিকা বা বার্ষিক ম্যাগাজিন বের হতো। এভাবে অনেক বড় সাহিত্যিকের হাতেখড়ি হয়েছে। সুকুমারবৃত্তি চর্চার এ সংস্কৃতি এখন অনেকটাই কমে গেছে। এর কারণ আগেই বলেছি। পরীক্ষা নামক বৈতরণী পার হওয়াই এখন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের একমাত্র লক্ষ্য। শিক্ষার্থী নয়, পরীক্ষার্থী তৈরি হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্যোগী হতে হবে। একজন অধ্যক্ষ বা প্রধান শিক্ষক যদি সাহিত্যানুরাগী বা সংস্কৃতিমনস্ক হন তবে তিনি স্বভাবতই এ উদ্যোগ নেবেন। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যদি অন্তত একজনও নিবেদিতপ্রাণ ও উদ্যমী শিক্ষক থাকেন তবে এর ইতিবাচক প্রভাব প্রতিষ্ঠানে পড়ে।

আপনি লেখক হলেও সরকারী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। সকল স্কুল-কলেজে বার্ষিক ম্যাগাজিন প্রকাশে কীভাবে উৎসাহিত করা যায়? সরকারি নির্দেশনা দেয়া যায় কি? যাতে প্রত্যেক বছর কমপক্ষে একটা হলেও স্কুল ম্যগাজিন বের হয়?
রাজীব সরকার: আসলে নির্দেশনা দিয়ে, পরিপত্র জারি করে সৃজনশীল কাজ করানো কঠিন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের বাজেট থেকেই বার্ষিক ম্যাগাজিন প্রকাশ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হলে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করতে পারে। যেমন ধরুন দুই বছর আগে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) একটি নির্দেশনা দিয়ে সব প্রতিষ্ঠানকে জানিয়েছে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার পুরস্কার হিসেবে যেন আবশ্যিকভাবে বই দেয়া হয়। আমি কিন্তু এর আগেই দুই উপজেলায় এটি চালু করেছিলাম। ক্রোকারিজ, ক্রেস্টের পরিবর্তে পুরস্কার হিসেবে বই চালু করেছিলাম। কিন্তু আদৌ এটি বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না, হলেও কতটুকু হচ্ছে তা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে প্রতিষ্ঠান প্রধান ও পরিচালনা কমিটির সদস্যদের ওপর।

যে এলাকায় ইউএনও’র দায়িত্বে ছিলেন সেই এলাকায় প্রতিবছর বইমেলার আয়োজন করেছিলেন। আরও অনেক ইউএনও’ও করছেন। এটা কী সকল উপজেলায় করা সম্ভব না? শুধু বইমেলা না করে আমাদের আর যে যে প্রধান উৎসব আছে সেগুলোকে উপলক্ষ করেও কী করা যায়না?
রাজীব সরকার: ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলায় দুই বছর ও শেরপুরের নকলা উপজেলায় দেড় বছর ইউএনও ছিলাম। এ সময় তিনটি বইমেলার আয়োজন করেছিলাম। বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল এ বইমেলাগুলো। প্রতিবারই স্থানীয় জনগণের আগ্রহে বইমেলার সময় বৃদ্ধি করতে হয়েছিল। বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, স্বরচিত কবিতা পাঠ, বিতর্ক, নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে প্রতিটি বইমেলা উৎসবের আকার ধারণ করেছিল। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল এটি। গড়ে প্রতিটি বইমেলায় ৭-৮ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়েছিল। উপজেলা পর্যায়ে এমন চিত্র সত্যিই আশাব্যঞ্জক। দেশের অনেক জেলা ও উপজেলায়ই এখন স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে বইমেলা আয়োজিত হচ্ছে। এর ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে সমাজে। বর্ষাবরণ, নবান্ন উৎসব, বসন্ত উৎসব করেছি উপজেলায়। বাংলা বর্ষবরণ সরকারি উদ্যোগেই পালিত হয়। সাংস্কৃতিক উৎসবগুলো পালনের উদ্যোগ অবশ্যই নেয়া যায়। তবে এ ক্ষেত্রে সরকার বা প্রশাসনের ওপর সার্বক্ষণিক নির্ভরতা কাম্য নয়। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোরও দায়িত্ব রয়েছে এ ক্ষেত্রে। উপজেলা বা জেলা পর্যায়ে সাংস্কৃতিক সংগঠনের অভাব নেই। এদের মধ্যে কম সংখ্যক সংগঠনই রয়েছে যারা নিয়মিত সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনা করে।

লেখালেখির পাশাপাশি আপনার বিতার্কিক পরিচয়টিও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিতার্কিক উত্তম রায়ের লেখার মাধ্যমে জানতে পেরেছি আপনার নেতৃত্বেই জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল প্রথম চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনেকগুলো বিতর্ক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে আপনার নেতৃত্বে। বিতর্ক নিয়ে আপনার মূল্যবান তিনটি বইও আছে। বাংলাদেশের বিতর্ক-শিল্প নিয়ে আপনার নিশ্চয়ই বিশেষ কিছু পরিকল্পনা আছে?
রাজীব সরকার: শুধু বিতর্ক কেন, সঙ্গীত, চিত্রকলা, অভিনয়, নৃত্য, আবৃত্তি- কোনো শিল্পকেই আমি নিছক পারফরমিং আর্ট হিসেবে দেখি না। শিল্পচর্চা আমরা কেন করি? মানুষকে আরও উন্নত ও আরও সুন্দর হতে শেখায় শিল্প। এ ক্ষেত্রে বিতর্কের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিতর্কের প্রাণ হচ্ছে যুক্তি। সভ্যতার ইতিহাস কিন্তু যুক্তিবাদিতার ইতিহাস। আদিম যুগ থেকে ধীরে ধীরে বিভিন্ন যুগান্তর পেরিয়ে আধুনিক যুগে আমরা প্রবেশ করেছি যুক্তিকে অবলম্বন করে। যুক্তি মানে কার্যকারণ ও বিজ্ঞানমনস্কতাকে নিজের মধ্যে ধারণ করা।।
বিতর্ক সম্পর্কে আমার সামগ্রিক চিন্তা-ভাবনার পরিচয় দিয়েছি বিতর্ক নিয়ে লেখা আমার তিনটি বইয়ে। আমি স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে বিতর্কের চর্চা হবে। যুক্তি, পাল্টা যুক্তির মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেধা ও মুক্তবুদ্ধির বিকাশ ঘটবে। বিতর্কশিল্প যেন পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হয় সেদিকেও আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে। নাটক, আবৃত্তির মতো বিতর্ক দেখার জন্যও একদিন মানুষ টিকিট কিনবে এটিও আমার একটি পরিকল্পনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো আমাদের দেশেও একদিন নির্বাচনের আগে নির্বাচনী বিতর্ক হবে- এ স্বপ্নও আমাদের রয়েছে।

অল্প কিছু (উচ্চবিত্ত শ্রেণীর সন্তানরা পড়ে এমন) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিতর্ক থাকলেও বেশিরভাগ স্কুল কলেজে বিতর্ক প্রতিযোগিতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। বিশেষ করে মফস্বলে বিতর্ক চর্চা খুব কম হচ্ছে। কেন?
রাজীব সরকার: স্থানীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে বিতর্ক ক্লাব তৈরি করতে হবে। সপ্তাহে অন্তত একদিন কোনো একটি বিষয় নির্ধারণ করে শিক্ষার্থীদের বিতর্ক চর্চার সুযোগ করে দিতে হবে। আজকাল প্রশাসনসহ সরকারি, বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে। আয়োজকদের লক্ষ্য রাখতে হবে শহরের নামিদামি প্রতিষ্ঠানের বাইরে তৃণমূল পর্যায়ের শিক্ষার্থীরাও যেন এতে অংশগ্রহণ করতে পারে। মেধা, প্রতিভা দেশের আনাচে কানাচেও লুকিয়ে থাকে। সেই মেধা ও প্রতিভার পরিচর্যা করার দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে। আমি ইউএনও থাকার সময় দুই উপজেলায় নানা উপলক্ষে বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করছি। দুই উপজেলায় ডিবেটিং সোসাইটি গঠন করেছিলাম। এমন উদ্যোগ সারা দেশে নেয়া হলে বিতর্ক চর্চা বেগবান হবে।

একজন চিন্তাশীল নাগরিক গড়ে তুলতে বিতর্কের ভূমিকা সম্পর্কে সন্তানদের অভিবাভক বা শিক্ষকদের কী পরামর্শ দেবেন?
রাজীব সরকার: অভিভাবক এবং শিক্ষকদের এটি বুঝতে হবে ফলাফলসর্বস্ব যান্ত্রিক মানুষ তৈরি শিক্ষার উদ্দেশ্য নয়। ভালো-মন্দের পার্থক্য বোঝার বোধ শিক্ষার্থীদের থাকতে হবে। বর্তমান সময়ে চারপাশে অসহিষ্ণুতা ও কুসংস্কারের প্রাবল্য। ধর্মকে পুঁজি করে উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদ বিস্তার লাভ করছে। এ নেতিবাচক মানসিকতায় যারা আক্রান্ত তাদের অধিকাংশই তরুণ। এ অন্ধ ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মুক্তচিন্তার বিকাশ জরুরি। মুক্তচিন্তা ও যুক্তিবাদিতা অর্জিত হতে পারে বিতর্কের মধ্য দিয়ে।

আদিম যুগ থেকে ধীরে ধীরে বিভিন্ন যুগান্তর পেরিয়ে আধুনিক যুগে আমরা প্রবেশ করেছি যুক্তিকে অবলম্বন করে

ষোড়শ শতকে ইউরোপীয় রেনেসাঁসের মধ্য দিয়ে আধুনিক সভ্যতার গতিপথ রচিত হয়েছিল। ধর্মীয় কুসংস্কারকে বর্জন করে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শনকে ধারণ করে পৃথিবীকে নেতৃত্ব দিয়েছিল ইউরোপ। ঊনবিংশ শতাব্দীতে রেনেসাঁসের আদলে কলকাতায় নবজাগরণ সংঘটিত হয়েছিল। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ এ জাগরণের শ্রেষ্ঠ ফসল। বিংশ শতাব্দীতে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ঢাকায় মুসলিম মধ্যবিত্তের মধ্যে নতুন জীবনবোধের উন্মেষ ঘটেছিল। তাদের মুখপত্র ‘শিখা’য় লেখা থাকত-‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’। ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতাকে প্রত্যাখ্যান করেই মুক্তচিন্তা ও যুক্তির বিকাশ ঘটে। ভাষা আন্দোলন, ষাটের দশকের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতাতেই মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
বিতর্কচর্চার মধ্য দিয়ে যুক্তিবাদী মানসিকতা ও পরমতসহিষ্ণুতা তৈরি হয়। এটি গণতন্ত্রেরও বৈশিষ্ট্য। তাই বলা যেতে পারে বিতর্ক ও গণতন্ত্র পরিপূরক। পরমতের প্রতি অশ্রদ্ধা ও যুক্তিহীনতার কারণে সমাজে সহিংসতা ঘটে, মধ্যযুগীয় বর্বরতায় লিপ্ত হয় মানুষ। আমরা একটি উদার, অসাম্প্রদায়িক ও বিজ্ঞানমনস্ক প্রজন্ম চাই যাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের শিখরে আরোহণ করবে। এক্ষেত্রে বিতর্ক অসামান্য ভূমিকা পালন করতে পারে। শুভবুদ্ধি সম্পন্ন ও চিন্তাশীল নাগরিক হিসেবে নতুন প্রজন্মকে গড়ে তুলতে চাইলে বিতর্ক চর্চার বিকল্প নেই।

বিতর্ক সম্পর্কে আপনার বইগুলোতে অনেক কথাই আছে। তবুও পাঠকদের উদ্দেশ্যে বিতর্কের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কিছু বলুন
রাজীব সরকার: যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত শিক্ষাবিদ Norman Cousins বলেছিলেন, ‘The first purpose of education is to enable a person to speak clearly and confidently’. স্পষ্টতা ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলতে পারার সামর্থ্য অর্জনকে যদি শিক্ষার উদ্দেশ্য বলে অভিহিত করা হয় তবে এ দেশে কতজন শিক্ষিত মানুষ রয়েছেন বলা শক্ত। একাডেমিক ডিগ্রিধারী শিক্ষিত মানুষের অভাব নেই। কিন্তু স্পষ্ট করে নিজেকে তুলে ধরা বা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজেকে উপস্থাপন করা- এ বৈশিষ্ট্য খুব বেশি মানুষের নেই। অথচ এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যোগ্যতা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কোনো স্তরেই শিক্ষার এ প্রাথমিক উদ্দেশ্য অর্জনের কোনো উপায় রাখা হয়নি। তাই বলে এ যোগ্যতা অর্জন অসম্ভব এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। শিক্ষার এই উদ্দেশ্য অর্জনে বিতর্ক সহায়ক। মানুষ মাত্রই তর্ক করে। সভ্যতার সুচনালগ্ন থেকেই মানুষ তর্ক করে এসেছে। নিজের কৃতকর্মের পক্ষে কারণ তুলে ধরা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। এমন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি কখনও তর্ক করেননি। বাঙালিদের মধ্যে তো আরও পাওয়া যাবে না। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে, সামাজিক ও রাজনৈতিক আচারে তর্কই সবচেয়ে দৃশ্যমান বস্তু। বাঙালি তর্কপ্রিয় জাতি বলেই সম্ভবত টেলিভিশনে টকশো এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান।
তর্ক নয়, বিতর্কই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।। তর্কের সঙ্গে আবেগ, একগুঁয়েমি ও অন্ধবিশ্বাস জড়িত। কখনও কখনও পেশিশক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটে তর্কের পরিণতিতে। তর্ক আর কুতর্কে জড়িয়ে পড়ার অসংখ্য নজির রয়েছে আমাদের সমাজে। সেই অর্থহীন তর্কের সংস্কৃতি থেকে বের হতে হবে। বিতর্ক শিল্প হিসেবে নবীন হলেও শিক্ষিত ও সচেতন সমাজের কাছে এ শিল্প যথেষ্ট সমাদৃত। বিতর্কে তর্ক থাকে, তবে সে তর্ক যুক্তিসিদ্ধ ও কার্যকারণ সংশ্লিষ্ট। বিতর্কে অন্ধ বিশ্বাস বা কুসংস্কারের কোনো ঠাঁই নেই।

তর্ক নয়, বিতর্কই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। তর্কের সঙ্গে আবেগ, একগুঁয়েমি ও অন্ধবিশ্বাস জড়িত

বিতর্কে উত্তেজনা থাকে। সে উত্তেজনা পরিশীলিত। আক্রমণ থাকে। সে আক্রমণ শিল্পিত। বিতর্কে দ্বন্দ্ব থাকলেও তা পরমতসহিষ্ণু ও উদার হতে শেখায়। সমাজে বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মধ্যে মতপার্থক্য থাকবেই। শক্তিমান মতপার্থক্য একটি সমাজের প্রাণশক্তির পরিচায়ক। বিতর্কে এ মতপার্থক্য চিহ্নিত হয় যুক্তি দ্বারা। এটি অত্যন্ত আশার কথা যে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত বিতর্কের চর্চা হচ্ছে। বিতর্ক প্রতিযোগিতা এখন একটি সংঘবদ্ধ রূপ পেয়েছে। শিক্ষার্থীরা যেন নিয়ম জেনে ও মেনে এ বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন এবং সাফল্য অর্জন করেন সেটিই কাম্য। তবে প্রতিযোগিতার মঞ্চে জয়লাভই বিতার্কিকের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। জীবনের মঞ্চেও বিতার্কিককে জয়ী হওয়া চাই। সেই জয়ের পূর্বশর্ত প্রতিনিয়ত যুক্তির অনুশীলন। মননে ও ব্যক্তিত্বে যুক্তিবাদী হওয়াই বিতার্কিকের চূড়ান্ত অর্জন, জয়-পরাজয় নয়।
বিতর্কের জন্য বিতর্ক নয়, এমন এক সমাজ নির্মাণের জন্য বিতার্কিক বিতর্ক করবেন যেখানে জোর নয়, যুক্তি বিজয়ী হয়। যেখানে জোরের যুক্তি নয়, যুক্তির জোর প্রতিষ্ঠিত হয়। যুক্তিবাদী, উদার ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে বিতর্ক অপরিহার্য।

এখন কী বিষয়ে লেখা উচিৎ? সে বিষয়ে লেখার অভাব দেখতে পাচ্ছেন? যদি তা’ই হয়, তবে এর সমাধান কি?
রাজীব সরকার: মন ভোলানোর জন্য প্রচুর বই প্রকাশিত হচ্ছে প্রতিবছর। সেই তুলনায় মন জাগানোর বইয়ের সংখ্যা কম। মানহীন বইয়ের পাশাপাশি মানহীন প্রকাশনা সংস্থা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাঠককে চিন্তার খোরাক না যোগাতে পারলে, সৌন্দর্যের সন্ধান দিতে না পারলে বইয়ের সার্থকতা থাকে না। সেই বিষয় নিয়ে লেখা উচিত যা পাঠকের মধ্যে মুক্তচিন্তা, শুভবুদ্ধি ও ইতিবাচক দর্শনের জন্ম দেয়। সস্তা, চটুল, চটকদার বইয়ের চেয়ে গভীর জীবনবোধসম্পন্ন বইয়ের গুরুত্ব অনেক বেশি। এ ধরনের বইয়ের স্বল্পতা রয়েছে। যারা এ ধরনের বই লিখবেন তাদেরকে ব্যাপক পঠন-পাঠন ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। উপযুক্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করে একজন লেখক এ ধরনের বই লিখতে পারেন।

লেখালেখি নিয়ে নতুন কোনো পরিকল্পনা আছে? এবছর বইমেলায় আপনার কি কি বই আসছে? সেসব বইয়ের বিষয়বস্তু পাঠকদের জন্য কেন এবং কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ হবে বলে আশা করছেন?
রাজীব সরকার: এবছর ‘কথাপ্রকাশ’ থেকে থেকে আমার একমাত্র প্রবন্ধগ্রন্থ‘বিদ্যাসাগরের ইহজাগতিকতা ও অন্যান্য’ প্রকাশিত হয়েছে। বিদ্যাসাগরের দ্বিশততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে দেশে বিদেশে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ লেখা প্রকাশিত হয়েছে। বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বিস্তৃত পড়াশোনা করতে গিয়ে ইউরোপের রেনেসাঁস, বাংলার নবজাগরণের আর্র্থসামাজিক পটভূমি নিয়ে জানার সুযোগ পেয়েছি। এই জাগরণের উত্তরসূরী হিসেবে ঢাকায় বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন কাজ করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়ে ভাষাভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের উন্মেষ ঘটেছে। এর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে। কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িক মনোভাব থেকেই ধর্মীয় উগ্রবাদের জন্ম হয় যার ভয়ংকর পরিণাম আমরা দেশে বিদেশে দেখতে পাচ্ছি। এর বিপরীতে মুক্তচিন্তা, যুক্তিবাদিতা ও বিজ্ঞানমনস্কতা যদি সমাজে বিকশিত হয় তাহলে যথার্থই সভ্য ও প্রগতিশীল সমাজ আমরা গড়তে পারবো। এ লক্ষ্য নিয়েই আমি লেখালেখির চেষ্টা করি। এ বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে লেখার পরিকল্পনা আমার রয়েছে। এছাড়া রম্যরচনা ও ভ্রমণকাহিনিও লিখছি।

আরো পড়তে পারেন

বিস্তৃত পাঠ সবচেয়ে আনন্দের : ইমান মিরসাল

ইমান মিরসাল ১৯৬৫ সালে মিসরে জন্মগ্রহণ করেন। একজন আধুনিক আরব কবি, প্রবন্ধকার, অনুবাদক, সাহিত্য গবেষক এবং কানাডার আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ভাষা ও সাহিত্যের সহযোগী অধ্যাপক। নব্বই দশকের উজ্জ্বল তরুণ লেখকদের একজন। সমসাময়িক আরবি কবিতার অন্যতম আকর্ষণীয় কণ্ঠ ইমান মিরসালের বহু কবিতাই এক ডজনেরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিখ্যাত লিটারারি জার্নালগুলোয় নিয়মিত লেখাপত্র প্রকাশের পাশাপাশি পৃথিবীর….

‘পেশাদার খুনিরা, তোমরা সৈনিক নও।’ এটা ছিল কবিতাটির শেষ লাইন -আহমাদ ফারাজ

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উর্দু কবি আহমাদ ফারাজ। ১৯৩১ সালের ১৪ জানুয়ারী পাকিস্তানের কোহাতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পুরোদস্তুর কবিতা লেখার সূচনা তাঁর কলেজে থাকতেই। যেগুলো পাঠ করলে দেখা যায়, তিনি তাঁর স্বতন্ত্র নিয়েই আবির্ভূত হয়েছিলেন। আধুনিক উর্দু গযলেও রয়েছে তাঁর অসামান্য প্রভাব। শিক্ষা জীবনে পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্সি ও উর্দু সাহিত্য অধ্যয়ন করেন। পরে এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই….

আমি চেয়েছি কল্পনার ডানায় ভর করে বিজ্ঞানের আনন্দ সবার কাছে পৌঁছে দিতে

খন্দকার রেজাউল করিম শিক্ষক, গবেষক, লেখক। তাঁর শিক্ষকতা জীবনের শুরু ১৯৭৫ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭৮ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকা যান। ১৯৮৩ সালে ইউনিভার্সিটি অব অরিগন থেকে পদার্থবিদ্যায় ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপরে ৩০ বছর কাটিয়েছেন আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষনা ও শিক্ষকতার কাজে। বর্তমানে তিনি আমেরিকার ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ইমিরেটাস প্রফেসর। ড. করিম গবেষনার কাজে জড়িত….

error: Content is protected !!