Author Picture

নেত্রকোনার সোমেশ্বরী নদী

মাহবুবা হোসেইন

সোমেশ্বরী নদী পার হয়ে বিরিশিরি যাওয়া এক মহা যজ্ঞ। সে কেবল পারা যায় সুসং দুর্গাপুর আর বিরিশিরি যদি আকুল হয়ে ডাকে। সে ডাক শুনতে পায় মুষ্টিমেয় কিছু পাগল পর্যটক। আমি শুনতে পেয়েছিলাম অনেক আগে, জানতাম একদিন না একদিন সাড়া দিবই। সুযোগ হচ্ছিল না। এখন অপার অবসর-বাঁধা বন্ধনহীন। ফয়সালকে ফোন দিলাম- আমাদের নেত্রকোনার সহকারি কর কমিশনার, বলল, ‘ম্যাডাম জাষ্ট চলে আসেন বাকিটা আমি দেখছি।’ সাথে দাঁড়িয়ে গেল হাবিব ও তার পরিবার- ওরা ঘুরাঘুরির মাষ্টার, নুর কামরুন নাহার আপা- কবি, লেখক, সাহিত্যিক- সঙ্গে নিলে জাতি উপকৃত হবে আমি জানি, দু’চারটা দুর্দান্ত কবিতা বা ভ্রমণ বৃত্তান্ত নিশ্চিত বেরিয়ে যাবে। আমার ছোট ছেলে ফাইয়াজ আর নুর আপার বড় ছেলে তুর্য সঙ্গত করার জন্য সঙ্গে গেল। পরে জানবেন ছেলে দুটোকে সঙ্গে নেওয়ায় কি যে জমে গেল। আমার ড্রাইভার আরিফ- বয়স ষাটের কাছাকাছি কিন্তু কৌতুহলের বয়স তার ছয়, সব কিছুতেই বিস্ময়-কৌতুহল আকাশ পরিমান। সাথে হাবিবের ড্রাইভার সমির- পিতৃদত্ত নামটা তার পছন্দ নয় তাই চেঞ্চ করে রেখেছে শাকিল। নামে ভুল করলে মনে করিয়ে দিতে মুহূর্তমাত্র। বাড়ি নেত্রকোনায় তাই উৎসাহ তার বাঁধভাঙা।

দিগন্তে মেঘালয়-পাহাড় শ্রেনী আমার ছোট ছেলেটার মতই সোমেস্বরীকে আদরে আগলে রাখে

ঢাকা থেকে সকাল ছয়টায় রওনা হয়ে নেত্রকোনা না গিয়ে সরাসরি সুসং দুর্গাপুর। সেখানে গ্রেন্ড লক্সারি হোটেলে ব্রাঞ্চ তারপর উদ্দেশ্য বিরিসিরি। আহ সেই সোমেস্বরী নদী-যার নামের আকর্ষণ পর্যটককে পথে নামায়। সার্থক তার নাম। শান্ত মৌন গম্ভীর। দিগন্তে মেঘালয়-পাহাড় শ্রেনী আমার ছোট ছেলেটার মতই সোমেস্বরীকে আদরে আগলে রাখে। সোমেস্বরীর পাড়ে দাঁড়িয়ে বড় করে শ্বাস নিতে হয়-প্রকৃতির বিস্তৃতি বুকে ধারন করতে। নদীতে হাটু বড় জোড় কোমর পানি তারপরও পার হতে নৌকাতো লাগেই। ফয়সালের ভাবনা-অশেষ, আরাম দেবার কায়দাও ভিন্ন। কোথ্থেকে নৌকায় বিছিয়ে দিল শীতলপাটি, মাথার উপর ধরে দিল ছাতা। পায়ের নীচে শান্ত নদী কিন্তু মাথার উপর সূর্য মার্তন্ড, ছাতার আড়াল খুব দরকার। নৌকা তো ভটভট করে চলল কিন্তু সে আওয়াজ শহুরে আওয়াজ নয় কারণ শান্ত প্রকৃতি তার বেশ কিছুটা শুষে নেয়। দিগন্ত বিস্তৃত মেঘালয়ের হাতছানি, সেই শব্দ শোনার সময় কোথায়। নৌকা থেকে নামতে কিছু কসরত কিন্তু করতেই হয় তবে সাহায্যের হাতগুলো বাড়ানো থাকলে সে কিছুই নয়। ওপারে ইজি বাইকে উঠে পড়লে তারপর দুপাশে প্রকৃতিতে নিজেকে কেবল ছেড়ে দাও যতক্ষন না বিস্ময়ে হতবাক হতে হতে বিরিসিরির লাল, নীল হলুদ আর সবুজ পানি পাহাড়ের অপরূপ কারুকাজে মিশে যাবে। প্রকৃতির এ এক অপার বিস্ময়-শুধু চেয়ে দেখ আর থেমে যাও, অপেক্ষা করতে থাক দিন পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রকৃতির রূপ পরিবর্তনের সময়টা ক্যামেরায় ধরে রাখতে।
ততক্ষনে গাছের নীচে শীতল পাটি পরে গেছে, ছোট একটা স্পিকারও রেডি হয়ে গেছে। প্রতিভা কোথায় না লুকিয়ে থাকে। নুর কামরুন নাহার আপার ছেলে তুর্য, আমার ছেলে ফাইয়াজ মুগ্ধ করল গেয়ে। অবাক হতে হল হাবিবের বড় মেয়ে রোজার গান গাওয়ার ক্ষমতা দেখে। সত্যি বলছি তালিম দেয়া গেলে সন্ধ্যার কাছাকাছি পৌঁছে যেত। হাবিবের ছোট ছেলে-মেয়ে দুটোর গানও মনে মায়া ছড়ায়। বাশিতে সুর তুলল ফয়সাল, স্বকৃত সেই সুর প্রকৃতিকে একেবার কাছে টেনে নিল। আমাদেরও ছাড়াছাড়ি নেই। নুর আপা আর আমাকে গাইতে হল রবীন্দ্রসংগীত। ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথ বেঁচে নেই তানা হলে কি হত কে জানে। দিগন্তে পৃথিবী ঘোমটা টেনে দিলে সেই গান আমরা নিয়ে এলাম নেত্রকোনার হোটেলে। রাত দুটোয় শেষ হল আসর কিন্তু রেশ শেষ হল না এখনও।


১৮/১০/২০২০, শাহজাহানপুর।
বি:দ্র: আগে থেকে এরেঞ্জ করে না গেলে যাওয়া কঠিন।

আরো পড়তে পারেন

আগ্নেয়গিরি থেকে পায়ে হেঁটে বেস-ক্যাম্পে ফেরা

ইথিওপিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে আছে ‘অ্যারতে-আলে’ নামে লাভা উৎক্ষেপণে প্রজ্বলিত একটি আগ্নেয়গিরি। আমরা বেশ কয়েকজন পর্যটক আজ জোট বেঁধে, একটি ট্যুর কোম্পানির গাইডের তত্ত্বাবধানে ওই আগ্নেয়গিরির পাশের একটি লাভা-হ্রদের পাড়ে ক্যাম্পিং করার উদ্যোগ নিয়েছি। ওখানে যেতে হলে প্রথমে একটি বেস-ক্যাম্পে এসে প্রস্তুতি নিয়ে ট্র্যাক করতে হয় ঘণ্টাকয়েক। বেস-ক্যাম্পে পৌঁছানোও ঝকমারি বিশেষ, আমরা ঘণ্টাকয়েক ল্যান্ডরাবারে প্রায়-দুর্গম এক….

মনে করি আসাম যাব

আফ্রিকার মাসাইমারা সাফারিতে যাওয়ার পর আর কোনো বড় সাফারিতে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। অপর্না সেনের ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার’ সিনেমাতে ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার চরিত্রে রাহুল বোসের মুখে কাজিরাঙার কথা শোনার পর এ রিজার্ভ ফরেস্টে সাফারি করার ইচ্ছা জেগেছিল। মনে হচ্ছিল বাড়ির খুব কাছের এ জায়গাটাতে যে কোনো সময়েই যাওয়া যায়, আমাদের উত্তর পূর্ব সীমান্ত পেরিয়ে আর….

শিল্পের দেশে সৌন্দর্যের দেশে

অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি ভেনিসে পা রেখেছিলাম এক রৌদ্রোজ্জ্বল গ্রীষ্মের দুপুরে। যাত্রীবোঝাই পাবলিক বাসে চেপে যাত্রা করলাম সেন্ট মার্কোসের উদ্দেশে। সেন্ট মার্কোসে অবস্থিত বিখ্যাত স্থাপত্য ক্যাথেড্রাল। ক্যাথেড্রালের চারদিকের দেয়াল সুসজ্জিত কারুকার্যে খচিত। চিত্রকর্ম ও অক্ষরে লিপিবদ্ধ বিভিন্ন কাহিনি মুগ্ধতা তৈরি করে। এখানেই ভেনিসের প্রাণভোমরা, সেই বিখ্যাত গ্র্যান্ড ক্যানেল যা যুক্ত করেছে শতাধিক জলরাশিকে। বিশাল খাল ভেনিসকে….

error: Content is protected !!