“প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে,
কে কোথা ধরা পড়ে, কে জানে…
গরব সব হায় কখন টুটে যায়,
সলিল বহে যায় নয়নে।”
আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষক-শিক্ষিকারা খুব কাছাকাছি থেকে পরস্পরকে জানাজানির সুযোগ পায়, তাই প্রেমের জাল এখানে বিশেষ ভাবে ছড়ানো। অনেকে এই জালে বারে বারে জড়িয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-ছাত্রীরা সাধারণত নিজেদের মধ্যেই প্রেম বিনিময় করে, তবে শিক্ষক-শিক্ষিকারাও কখনো কখনো এই প্রেমের ফাঁদে ধরা পড়তে পারেন।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু নীতিমালা থাকে। যেমন, ক্লাসের কোনো ছাত্রী যদি শিক্ষকের প্রেমিকা হয়ে থাকে, তবে তা আগেভাগেই উর্ধতন কতৃপক্ষের কাছে জানিয়ে রাখা বাঞ্চনীয়। যে ছাত্রী আর সব ক্লাসে ফেল মারছে, সে যদি প্রেমিক শিক্ষকের ক্লাসে অ গ্রেড পায় তবে উর্ধতন কতৃপক্ষ ব্যাপারটা হয়তো একটু তলিয়ে দেখার কথা ভাববেন!
আমি তখন আমেরিকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা পড়াই। আমেরিকায় বাংলাদেশের মতো ইঞ্জিনিয়ারিং, কৃষি, মেডিক্যাল বলে আলাদা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। ইউরোপের শিক্ষাব্যবস্থা থেকেও মার্কিন শিক্ষাব্যবস্থা আলাদা। আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-কৃষিবিদকে যেমন কিছু সাহিত্য-দর্শন-ইতিহাসের ক্লাস নিতে হয়, তেমনি সাহিত্য-ইতিহাস-দর্শনের ছাত্রকে বিজ্ঞান পড়তে বাধ্য করা হয়। সব বিষয়ে কিছুটা শিক্ষা না থাকলে শিক্ষা আর হলো কোথায়?
ছাত্রী ঘরে আসলেই, আমি তাকে দরজাটি হাট করে খোলা রাখতে নির্দেশ দিই। এটা আমি ঠেকে শিখেছি
আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয় মানে বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে সাধারণত সাহিত্য, বিজ্ঞান, বাণিজ্য, চারুকলা, কৃষি, ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং সবই পড়ানো হয়। তাই ‘ডাক্তারদের জন্যে পদার্থবিদ্যা’, ‘ইঞ্জিনিয়ারদের জন্যে পদার্থবিদ্যা’, ‘কবিদের জন্যে পদাথবিদ্যা’ জাতীয় অনেক ক্লাস থাকে। আমি একবার ‘কবিদের জন্যে পদার্থবিদ্যা’ ক্লাসটি পড়াচ্ছি। আমি কবিতা ভালোবাসি, তাই এই ক্লাসটি আমার প্রিয়। ক্লাসে শিক্ষর্থীদের সংখ্যা প্রায় একশ, ছাত্রদের তুলনায় ছাত্রীদের সংখ্যা বেশি। এরা অনেকেই আবার প্রেম-রোগে আক্রান্ত। এক ছাত্রী ঘন ঘন আমার ঘরে আসা শুরু করলো, ক্লাসের পড়া বোঝেনি, এই অজুহাতে। মেয়েটির বয়স হয়তো আমার বয়সের অর্ধেক হবে। এই মেয়ের মাথা থেকে প্রেমের ভুত তাড়ানো যায় কি ভাবে?
কোনো ছাত্র-ছাত্রী ঘরে আসলেই, আমি তাকে দরজাটি হাট করে খোলা রাখতে নির্দেশ দিই। এটা আমি ঠেকে শিখেছি। কেউ দরজা বন্ধ করতে চাইলে ধরে নিতে হবে যে তার উদ্দেশ্য পরীক্ষার গ্রেড নিয়ে ঝগড়া, অনুনয়, অসঙ্গত আবেদন, চোখের জল ফেলা। চোখের জলের পালা শেষ হবার পরে ছাত্র-ছাত্রীদের মুখে ‘ইউ রুইনড মাই লাইফ’ কথাটি আমি অনেকবার শুনেছি। তবে হাবেভাবে বোঝা গেলো যে এই মেয়েটি গ্রেডের কাঙাল নয়, প্রেমের কাঙাল!
ওগো বাঙাল, আমারে কাঙাল করেছো। ওগো কাঙাল, আমারে কাঙাল করেছো। নাকি, ওগো কাঙাল, আমারে বাঙাল করেছো? রবি ঠাকুরের গানটি মনে করার চেষ্টা করছি। কোনো বাঙালের প্রেমে পড়ে কাঙাল হওয়া একেবারেই নির্বুদ্ধিতা। কাঙালের সাথে বাঙালের বা বাঙালের সাথে কাঙালের যে একটা গভীর সম্পর্ক আছে, আমেরিকার বুদ্ধিহীন ধনী মেয়েরা তার খবর রাখে কি? বিদেশ-বিভুঁয়ে এই কাঙাল বাঙাল একি ঝামেলায় পড়লো!
‘প্রেমে পড়বো কি করে, আমার তো বউ আছে!’
‘ Yeah, right! আমাকে এড়াতে চাচ্ছ! বিবাহিত হলে তোমার আঙুলে বিয়ের আংটি নেই কেন?’
‘আমাদের দেশে ছেলেরা আংটি পরে না!’
‘ÔMy foot! চাপা মারার জায়গা পাও না! আমি গুগল চেক করে দেখবো।’
‘গুগল অনেক আজগুবি খবর ছাপে।’
‘Googly-moogly! আবার চাপা মারছো। তোমার বউয়ের ফোন নম্বর দাও, ফোন করে দেখবো তোমার বউ বলে সত্যি কেউ আছে কি না।’
‘সেটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, আমাদের দেশের মেয়েরা ঝাঁটা চালাতে ওস্তাদ।’
‘আমি কাউকে ভয় করি না।’
‘কিন্তু আমি ভয় পাই।’
‘ OMG! কেন?’
‘স্বামীরা স্ত্রীকে ভয় পায়।’
‘ Sweet mother of Jesus! কেন?’
‘সেটা বোঝার জন্যে শিক্ষকের প্রয়োজন হয় না, তোমার বাবাকে জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারবে। তাছাড়া নেড়া কি কখনো দু’বার বেলতলায় যায়?’
‘তার মানে?’
‘নেড়া মানে মুন্ডিত মাথা। বেল গাছ অনেক উঁচু, এবং বেল হলো বেজায় শক্ত, ভারী, এবং গোলাকার একটি ফল।’
বাংলাদেশে বখাটে ছেলেদের উৎপাতে মেয়েদের নিরাপদে চলাফেরা মুশকিল। ওদিকে জর্জ বার্নার্ড শ এর ‘Man and Superman’ নাটকের নায়ক ইংল্যান্ড থেকে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো মুসলমান দেশে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলো, কারণ সেখানে ‘মেয়েদের হাত থেকে ছেলেরা নিরাপদে বাস করতে পারে।’ আমেরিকায় ছেলেমেয়েরা কেউ কারো হাত থেকে নিরাপদ নয়। তবে ওদের একটুও দোষ নেই। আমেরিকায় ‘এরেঞ্জড বিয়ে’ উঠে গেছে। মা, বাবা, সমাজ আশা করে বসে আছে যে ছেলেমেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পডাশুনা করবে, ডিগ্রি নিবে, সেই সাথে প্রেম করবে, বিয়ে করবে। ছাত্রছাত্রীদের পেরেশানির শেষ নেই। হোমওয়ার্ক করতে হবে, পরীক্ষার পড়া মুখস্ত করতে হবে, মনের মানুষ খুঁজে বের করতে হবে, প্রেম করতে হবে, কনসার্ট দেখতে হবে, ফেসবুকের পাতায় চোখ রাখতে হবে, আড্ডা মারতে হবে, মা-বাবা বন্ধুদের সাথে ফোনে কথা বলতে হবে, চাকরি খুঁজতে হবে, খেতে হবে, ঘুমাতে হবে। এত সব কাজ একসাথে চালিয়ে যাওয়া সহজ নয়। ওরা চাপের মুখে আছে।