মেয়েটি অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার পরনে লুঙ্গি-পাঞ্জাবি, পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল, মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি, হাতে একটি বোঁচকা। ইচ্ছে করেই এই বেশ ধরেছি, পাকিস্তানী আর্মির নজরে পড়ার সম্ভবনা কম। বাসে উঠছিলাম। মেয়েটি সামনের সিটে বসে মা-বাবার সাথে কথা বলছিলো। মেয়েটি আমার পূর্বপরিচিতা। ওর মা-বাবার সাথে এককালে অল্পসল্প পরিচয় ছিল। মাঝে তিন বছর দেখা নেই। আমার এই অভূতপূর্ব বেশভূষা এবং চেহারা দেখে মেয়েটির মা-বাবা আমাকে চিনতে না পারলেও মেয়েটি যে আমাকে ঠিক চিনেছে তা ওর চোখের বিস্মিত চাউনি দেখেই বোঝা গেলো।
ওর মা-বাবা পাকিস্তানী, মেয়েটি বাংলাদেশেই জন্মেছে, এই শহরেই বড় হয়েছে। জনা দশেক পাকিস্তানী আর্মির লোক বাসটিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। উদ্ধত চেহারা, ভ্রু কুঁচকে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে, সন্দেহপূর্ণ দৃষ্টিতে ইতিউতি তাকাচ্ছে। হাতে বন্দুক, বেয়োনেটের সুচালো ফলা আকাশের দিকে তাক করা। আন্তঃনগর বাস, সকাল আটটায় রাজশাহী থেকে ছাড়বে, সন্ধ্যার আগেই ঢাকা পৌঁছানোর কথা। বাসের সব পিছনের সারিতে এসে বসলাম।
বাস ছাড়ার প্রস্তুতি চলছে। বাসের যাত্রীদের মধ্যে বাঙালি নেই বললেই চলে। একজন মিলিটারি পুলিশ শেষ বারের মতো বাসে উঠে সবার মালপত্র তল্লাশি করছে। পুলিশ বাসে উঠামাত্র সবাই সমস্বরে বলে উঠলো, ‘হাম বিহারি হ্যায়।’ মেয়েটির বাবা বললেন, ‘হাম পাঞ্জাবি হ্যায়।’ পুলিশটি বললো, ‘বিহারি হ্যায়, আওর পাঞ্জাবি হ্যায় তো একই বাত হ্যায়, হাম তো বাঙালিকে ঢুরনে সাক্তা।’ মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে দুবার তাকালো, মা-বাবার কানেকানে কি যেন বললো। মেয়েটির সাথে রাজশাহী কলেজে একসাথে পড়তাম, সুন্দরী বলে ওর খ্যাতি ছিল, ওকে দেখে ছেলেদের হৃদপিণ্ডের স্পন্দন যেত বেড়ে। আমার নাড়িও দ্রুত বেগে চলা শুরু করলো, তবে অনুরাগে নয়, আমার বাঙালি-পরিচয় ফাঁস হবার ভয়ে। মেয়েটি কি এখন আমার শত্রু?
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়। পঁচিশে মার্চ রাত বারোটায় পাকিস্তানী আর্মি ঢাকা এবং চট্টগ্রামে হত্যার তান্ডব শুরু করে। ঢাকা উনিভার্সিটির ছাত্রাবাস থেকে হাঁটাপথে পালিয়ে রাজশাহী এসেছি। পাকিস্তানী আর্মি পেট্রল ঢেলে আমাদের রাজশাহী শহরের পৈতৃক বাড়িটি পুড়িয়ে দিয়েছে। আর্মির গোয়েন্দা বাহিনী নাকি আমাদের খোঁজ করে বেড়াচ্ছে! গৃহযুদ্ধ নাম হলেও প্রথম চার মাস এ ছিল শুধুই একতরফা খুন, ধর্ষণ, এবং অগ্নিসংযোগ। ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস কিছু সৈনিক আমাদের ফাঁকা বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল, ওরাই প্রথম রাজশাহীতে পাকিস্তানী আর্মির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিলো। ওদের ঠুনকো রাইফেল দিয়ে পাক বাহিনীর আধুনিক অস্ত্রের সাথে সামনাসামনি লড়াই সম্ভব ছিল না। পালিয়ে যাওয়ার সময় ওরা আমাদের বাড়িতে যুদ্ধের কিছু সরঞ্জাম ফেলে রেখে গিয়েছিলো। আমাদের বিরুদ্ধে পাক সেনাদের আক্রোশের ওটাই ছিল প্রধান কারণ। বাড়িটিতে অগ্নিসংযোগের আগে আমার মৃত বাবার অনেকগুলো কোরান শরীফ দেখে পাক সেনারা নাকি বিস্ময় প্রকাশ করেছিল, ‘শালা কাফেরের দল, কাফেরের সাথে দোস্তি, এখানে কোরান কেন?’
উনিভার্সিটির ছাত্রাবাস থেকে হাঁটাপথে পালিয়ে রাজশাহী এসেছি। পাকিস্তানী আর্মি পেট্রল ঢেলে আমাদের রাজশাহী শহরের পৈতৃক বাড়িটি পুড়িয়ে দিয়েছে
মেয়েটির বাবা আর্মি অফিসার ছিলেন, চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পরে আর পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যান নি। তাঁকে এলাকার সবাই খান সাহেব বলে ডাকতো। সুবেশধারী মিশুকে লোক, সবার সাথেই ছিল দোস্তি। বাসটি যখন প্রায় ছাড়েছাড়ে তখন খান সাহেব জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে কি যেন বললেন। একজন সেপাই বাসে ঢুকে সবাইকে বাস থেকে নামার নির্দেশ দিলো। ভয় পেয়ে গেলাম, আমার পরিচয় হয়তো ফাঁস হয় গেছে, আমি যে সেই পোড়া-বাড়ির ছেলে সেটা হয়তো খান সাহেব মেয়ের কাছে জেনে গেছেন। যাত্রী, সেপাই, সবাই বাসের বাইরে গোল হয়ে দাঁড়ালো, গোলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে খান সাহেব দুহাত তুলে মোনাজাত শুরু করলেন, ‘ইয়া আল্লাহ, পাকিস্তান কো হেফাজত করো।’ তারপরে প্রতিটি সেনার মাথায় হাত রেখে খান সাহেব দোয়া করলেন। আবার বাসে উঠার পালা। আমাকে একটু আলাদা করে ডেকে খান সাহেব কানে কানে বললেন, ‘সুরাইয়া তোমার কথা বলেছে। আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি। ভয় করো না, আমি তোমার সাথে আছি।’
আমাদের বাড়ি দুটো ছিল বড়োই কাছাকাছি। ভালো ছাত্র বলে আমার সুনাম ছিল, আরো অনেকের মতো ‘নোটস’ নেয়ার সুবাদে আমার কাছে সুরাইয়ার আনাগোনা ছিল। মেয়েটিকে আমার ভালো লাগতো, তবে সে শুধু ওর রূপের জন্যে নয়! ‘কর্নেল সাহেবের’ মেয়ে হয়েও ওকে দেখেছি রান্না ঘরের পিঁড়িতে বসে আমার মায়ের সাথে গল্প করতে, এক পেয়ালা চা পেয়ে কাজের মেয়েকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে। মেয়েটি আমার অনুরাগিণী ছিল কি না তা জানার সুযোগ কখনো হয় নি। রাজশাহী কলেজ থেকে পাশ করে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি, মেয়েটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিন বছর পরে বাসে আজ হঠাৎ দেখা। ওরা ঢাকা হয়ে পাকিস্তানের পথে রওনা হয়েছে। আমার ইচ্ছে ঢাকা হয়ে চট্টগ্রাম পৌঁছানো। ওখানে আমার ভাইয়ের পরিবারের সাথে মা বাস করতেন। তাঁদের কোনো খবর নেই। যে বিহারি-প্রধান এলাকায় তাঁদের বাস সেখানে নাকি বাঙালিদের কচুকাটা করা হয়েছে। আমার বন্ধুরা অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে ওপার বাংলায় চলে গেছে। মায়ের খবর না নিয়ে আমি যেতে পারি নি। এই চিরপরিচিত শহরে সুরাইয়া হয়তো আর ফিরবে না। মায়ের খবরটা জানা হয়ে গেলে, আমি হয়তো মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে ওপার বাংলায় চলে যাবো। হয়তো সুরাইয়ার সাথে এটাই আমার শেষ দেখা। আমরা এখন দুই শত্রু দেশের নাগরিক। ‘আমাদের গেছে যে দিন, একেবারেই কি গেছে; কিছুই কি নেই বাঁকি?’