‘‘কি কব মোর দুঃখের কথা।
আমার বঁধুয়া আনবাড়ি যায়,
আমার আঙিনা দিয়া ঘাঁটা।’’
আমার কম্পিউটার আনবাড়ি যায়। ওর ভারী মন্দ স্বভাব। নিজের সুন্দরী আধুনিকা মাউসকে ফেলে পাশের ঘরের ল্যাপটপের বেঢপ স্থূলকায়া মাউসের সাথে প্রেম করছে! বেহায়া, বেলাজ। আমার চোখের সামনে দুই সপ্তাহ ধরে এই প্রেমলীলা চলছিল। ভেবেছিলাম কম্পিউটারটিকে অন্য কোনো রোগে ধরেছে, প্রেমরোগের কথা ভাবি নি। ব্যাপারটা অদ্ভুত, তাই ধরতে এতো দেরী হলো। কম্পিউটারের পরকীয়া প্রেম! এসব কম্পিউটার যারা বানায় এমন এক বন্ধুকে ফোন করলাম:
‘তোরা কি এখন প্রেমিক কম্পিউটার বানানো শুরু করেছিস? আমার কম্পিউটার পরকীয়া প্রেমে মত্ত, কাজেকর্মে মন নেই।’
‘বলিস কি? এই কম্পিউটারের লজিক গেটস, নকশা আমার মুখস্ত, পরকীয়া প্রেমের মতলব ওর মাথায় আসা সম্ভব নয়।’
‘আমি কি আর মিথ্যে কথা বলছি! হাতেনাতে ধরেছি। কম্পিউটার থেকে ওর নিজের মাউসের দূরত্ব এক ফুটেরও কম, পাশের ঘরের মাউসটির দূরত্ব পঞ্চাশ ফুটের মতো হবে। মাঝে আছে নিচ্ছিদ্র পুরু দেয়াল। কাছের চেনা সুন্দরীর চেয়ে দূরের না-দেখা সুন্দরীর টান কি বেশি?’
‘এমন স্বভাব শুধু মানুষের হয়। ব্যাপারটা রীতিমতো গোলমেলে। তোর সাথে থেকে থেকে আমাদের বানানো সচ্চরিত্র কম্পিউটার চরিত্রহীন হয়ে পড়েছে। তোর লুচ্চামীর অভ্যাস নেই তো? কথায় বলে, সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ!’
‘এসব কথা ফোনে না বলাই ভালো, আই-ফোন ব্যাটাও তো একটা কম্পিউটার, সব কথা মনে রাখতে পারে। আমার বদকর্মের সব ইতিহাস ওর জানা। হাটে হাড়ি ভেঙে গেলে কপালে অনেক দুর্ভোগ আছে।’
‘তা তুই তো এক সময় artificial intelligence, neural network, এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটার নিয়ে অনেক পড়াশুনা করেছিস, কম্পিউটারকে মানবিক গুণাবলী দেয়া কি সম্ভব?’
তুই তো জানিস যে কোয়ান্টাম কম্পিউটার সংবাদের আদানপ্রদানে বিট এর বদলে কিউবিট ব্যবহার করে। আমার ধারণা প্রণয়ের ক্ষেত্রে কিউবিট এক মোক্ষম ভাষা
‘কেন নয়? মানুষ ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে, কম্পিউটারকে সেই সুযোগ দিতে হবে।
ধরা যাক কম্পিউটারকে প্রেম করার স্বাধীনতা দেয়া হলো। সব ধরণের প্রেম : বাল্য প্রেম, যৌবনের প্রেম, বুড়ো বয়েসের প্রেম, রজকিনী প্রেম, পরকীয়া প্রেম, সিনেমার প্রেম, বিয়ের আগের প্রেম, বিয়ের পরের প্রেম, দেশি প্রেম, বিদেশী প্রেম, গ্রাম্য প্রেম, শহুরে প্রেম, ভীরুর প্রেম, বীরপুরুষের প্রেম, ধনীর প্রেম, গরিবের প্রেম; রাধা-শ্যাম, লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদ, রোমিও-জুলিয়েট, ইউসুফ-জুলেখার প্রেম। এই সব প্রেমের পরিণতি কম্পিউটারের লজিক সার্কিটে বিভিন্ন বৈদ্যুতিক অনুভূতি সৃষ্টি করলো। আনন্দ, উল্লাস, যাতনা, বিরহ, অভিমান, হতাশা, জীবন-বোধ, মৃত্যু-চেতনা। এইসব অনুভূতি থেকে কম্পিউটার শিখে ফেলবে যে বাল্য প্রণয়ে অভিশাপ, পরকীয়া প্রেমে সর্বনাশ, রজকিনী প্রেমে স্বর্গবাস, বিয়ের আগের প্রেমে রসায়ন, বিয়ের পরের প্রেমে পলায়ন, মূর্খের প্রেমে সততা, জ্ঞানীর প্রেমে শঠতা, ভক্তের প্রেম ভক্তি, নাস্তিকের প্রেম যুক্তি, ফ্রয়েডের প্রেম যৌনতা, নারীর প্রেম সখ্যতা, বিরহীর প্রেম যাতনা, পুরুষের প্রেম কামনা, গরিবের প্রেমে অনটন, বীরের প্রেমে অঘটন, রোমান্টিক প্রেমে বিষ ও মরণ, সাদামাটা প্রেমে সন্তান ও জীবন, ইত্যাদি।’
তুই তো জানিস যে কোয়ান্টাম কম্পিউটার সংবাদের আদানপ্রদানে বিট এর বদলে কিউবিট ব্যবহার করে। আমার ধারণা প্রণয়ের ক্ষেত্রে কিউবিট এক মোক্ষম ভাষা। দোদুল্যমান হৃদয়ের কথা জানাতে কোয়ান্টাম জড়াজড়ির তুলনা নেই। কোয়ান্টাম তত্ত্বে কোনো কিছুই নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না, তাই যে কোনো প্রেম লিখতে হবে আর সব প্রেমের উপরিপাত হিসাবে। হায়, রবীন্দ্রনাথ এই ভাষা জানতেন না। তাই তো দেবযানীর মনের কথা তিনি এমন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে লিখলেন,
বিদ্যা এক ধারে,
আমি এক ধারে- কভু মোরে কভু তারে
চেয়েছ সোৎসুকে; তব অনিশ্চিত মন
দোঁহারেই করিয়াছে যত্নে আরাধন
সংগোপনে। আজ মোরা দোঁহে এক দিনে
আসিয়াছি ধরা দিতে। লহো, সখা, চিনে
যারে চাও। বল যদি সরল সাহসে
‘বিদ্যায় নাহিকো সুখ, নাহি সুখ যশে-
দেবযানী, তুমি শুধু সিদ্ধি মূর্তিমতী,
তোমারেই করিনু বরণ’, নাহি ক্ষতি,
নাহি কোনো লজ্জা তাহে। রমণীর মন
সহস্রবর্ষেরই, সখা, সাধনার ধন।
এই কথাগুলো কিউবিট মেট্রিক্সে কত সহজেই না বলা যেত!’
‘মানুষ ভালো মন্দ দুই কাজেরই কাজী। এমন কোনো কম্পিউটার বানানো যায় কি যে মানুষেরই মতো, কিন্তু শুধুই ভালো কাজ করে, মন্দ নয়।’
‘ঈশ্বর যা করেন নি বা পারেন নি, মানুষ কি তা পারবে?’
কম্পিউটারটা বন্ধুর কাছ থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছি। এ বছরের সবচেয়ে আধুনিক কম্পিউটার; আধখাওয়া আপেলের ছবি আঁকা বিশাল স্ক্রিন। যেমন তার রং, তেমনি তার ঢং। ওর স্মৃতি, কারিগরিবিদ্যা, এবং দ্রুত গণনা করার ক্ষমতা দেখে তাক লেগে যায়। মাঝে মাঝে ভাবি ও কি আমার ঘরে এসে সুখী হয়েছে? আমি ওর যোগ্য নই, তাই হয়তো ওর মন কেমন কেমন করছে। আমার পুরানো কম্পিউটারের কোনো ত্রুটি ছিল না, তবুও বেচারাকে বিনা অপরাধে বিসর্জন দিয়েছি। বহুদিনের রংচটা বিশ্বস্ত সাথীকে ছেড়ে যারা রংচঙে নবীনার পিছনে ছোটে তাদের কপালে হয়তো এমনটিই ঘটে।