প্রতিবারের মতো এবারও আমি রিমান আর রোমান পুরো গ্রামটা পায়ে হেঁটে দেখার প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়েছি। সামনে পরীক্ষা তাই রায়হান সঙ্গে থাকতে পারেনি।
বছরের শেষ দিনগুলিতে উত্তর পশ্চিম স্পেনের এই অঞ্চলে আসা এখন আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। মনে হয়, বছর শেষে এখানে আমার সময়বাঁধা আছে। প্রতি বছর পাহাড়বেষ্টিত ছোটো ছোটো গ্রামের সমন্বয়ে এই পরিবেশ আমার মধ্যে প্রশান্তি এনে দেয়। সারা বছরের সমস্ত ক্লান্তি, সামান্য কদিনে একটু যেন লাঘব হয়।
অনেক বছর আগে এই জনপদ আনন্দ মুখরিত ছিল, শত শত আদিবাসী,সব সময় নানা কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকায় একটা জীবন্ত পরিবেশ ছিলো। পাঁচ, পাঁচটা ক্যাফে, একটা সুপার মার্কেট, সব সময় গমগম করতো, কিন্তু আজ মাত্র একটা ক্যাফেই সমস্ত গ্রামের মানুষের প্রয়োজন মেটাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে জীবনের প্রয়োজনে সমস্ত তরুণ সমাজ শহরমুখী হওয়ায় গ্রামগুলোর এই অবস্থা, শুধু বয়স্ক অধিবাসীরা তাঁদের পুরোনো স্মৃতি নিয়ে মহাপ্রস্থানের দিন গুনছে এখানে। আর শুধু গ্রীষ্ণকালীন ছুটির সময় তারুণ্যের পদচিহ্নে মুখরিত হয় এই জনপদ, ফিরে আসে এক সাময়িক জীবনের প্রতিশ্রুতি।
পুরো গ্রামটা ঘুরে যখন আমরা একমাত্র গির্জাটা অতিক্রম করতে যাচ্ছি তখন লক্ষ করি এক অচেনা বিড়াল আমাদের সঙ্গ নিয়েছে। হালকা লাল রঙের এই প্রাণী যেনো আমাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অজানা অচেনা জায়গায় একটা অচেনা প্রাণী আমাদের কেমন আপন করে নিল। আমরাও তাকে আন্তরিকভাবে বরণ করে নিলাম। আদর করলাম, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাকে ভালোবেসে ফেলাম। বিড়ালটার উপরে খুব মায়া জন্মে গেল। সমস্যা হলো আমাদের থাকার জায়গায় আরেকটা কুকুর আছে, বাড়ির সবার প্রিয় টনি, সে বিড়ালটাকে মেনে নিতে পারল না। বাধ্য হয়ে বিড়ালটা সারারাত বাইরে কাঁটাল, প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে সে এই বিশাল খামার বাড়িতে কোথায় কীভাবে আছে, সেটা ভেবে সারা রাত মনটা খুব আনচান করতে লাগল।
সকালবেলা রোমান আর রিমানের চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেলো, ওরা খুবই আনন্দিত যে বিড়ালটা আবারো ফিরে এসেছে, তবে কুকুরটা থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকছে, লাফ দিয়েও কুকুর বিড়ালকে ধরতে পারছে না। বিড়াল তার আনন্দের অতিশয্যায় শুয়ে বসে আমাদের সঙ্গে খেলা করছে, বুকের মধ্যে হাত দিতেই সে তার তীক্ষ্ণ দাঁত আর নোখ দিয়ে আঁকড়ে ধরে হালকা কামড় দিচ্ছে এমন ভাবে যেন আমরা তেমন ব্যথা না পাই।
আমরা অনুভব করলাম- প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ হিসেবে আমরা আমাদের পাশের জীবজন্তুর চেয়েও কতো অধম? কতো সময় আমরা মানুষ হয়েও মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারি না। আমরা দেখি, সব সময় মানুষ ভালোবাসার মূল্যায়ন মানুষ দিতে পারে না।
সারা রাত দিন বাইরে থেকে আমাদের অপেক্ষায় থেকে সে বুঝিয়ে দিল কীভাবে ভালোবাসতে হয়
প্রকৃতি বা পরিবেশ আমাদেরকে ভালোবাসার শিক্ষা দেয়। আজ বিড়ালটা সেই শিক্ষা দিল। সারা রাত দিন বাইরে থেকে আমাদের অপেক্ষায় থেকে সে বুঝিয়ে দিল কীভাবে ভালোবাসতে হয়।
বিড়ালটিকে কিছু খেতে দেওয়া সম্ভব হলো না। কারণ বাড়ির সবাই বললো তাকে খাবার দিলে বিড়ালটার প্রকৃত মালিক অসন্তুষ্ট হবে, খাবার না দিলে সে ক্ষুধায় কষ্ট পেয়ে পরে তার মনিবের কাছে ফিরে যাবে। ব্যাপারটা মেনে নিতে আমার আর আমার সন্তানদের বেশ কষ্ট হলেও কোনো উপায় ছিলো না।
রোমানতো প্রস্তাবই করে বসলো যে আমরা বিড়ালটাকে সঙ্গে করে প্যারিস নিয়ে যাব, কিন্তু বিমানের পূর্ব অনুমতি ছাড়া জীবজন্তু নেওয়া অসম্ভব, আর বিড়ালের মালিকের প্রতিও এটা হবে অন্যায়, চুরির মামলায় পড়ার দুর্ভাবনা তো আছেই।
এতো ভালোবাসা যুক্ত এই চতুষ্পদ প্রাণীটি কি বুঝতে পারছে যে তাকে নিয়ে আমি বা আমার সন্তানরা কতোটুকু ব্যথিত? এই বছরের শেষ দিনগুলিতে এই হৃদয়স্পর্শী ঘটনা আমাদের মনের মধ্যে এক বিশেষ স্মৃতি নিয়ে স্থায়ী হয়ে থাকবে অনেকদিন তার কোনো সন্দেহের অবকাশ নাই। কালই আমরা প্যারিস ফিরে যাব। শেষপর্যন্ত আমরা সিদ্বান্ত নিলাম- ভালোবাসার এই প্রাণীটাকে প্রায় চারশো মিটার দূরে যেখান থেকে সে আমাদের সঙ্গ নিয়েছিলো, সেখানে ফেরত দিয়ে আসব। নিশ্চই সে তার পুরোনো মনিবের বাসা খুঁজে পাবে।
সন্তানদের সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, এই জীবনে অনেক কিছুই চাইলেই পাওয়া যায় না।