Author Picture

মনিরুস সালেহীন এর একগুচ্ছ কবিতা

মনিরুস সালেহীন

নীরবতা এক সাদা খাতা
~
পঁচিশ বছর আগে, যখন হয়নি শুরু আমাদের ব্রাকেট বন্দী জীবন,
আমাদের কথাগুলো ছিল ইথারে ভাসা রঙধনু।

নিবন্ধিত জীবনের প্রথম রাত্রির কথা তোমার মনে পড়ে?
লজ্জা পেলে?
আমি শুধু আমাদের কথার কথাই বলছি।

সে কথাগুলো ছিল সাদা খাতার এক প্রান্ত থেকে
আরেক প্রান্ত পর্যন্ত টানা লম্বা রেখা।
শুধু রেখাই বা কেন?
কত আঁকিবুঁকি
হিবিজিবি, হাবিজাবি
অকারণে তোমার খিল খিল হাসির মতো
কিংবা সকারণে তোমার খামচে ধরা
আমার লোমশ বুকের মতো ঘন, নিবদ্ধ।

সময় যেন ইরেজার।
কীভাবে একটু একটু করে মুছে দিতে থাকে
একটু একটু করে হ্রস্ব করে দিতে সে লাইনগুলো,
সেই লেখাগুলো।
নখের দাগগুলো খিচিয়ে উঠে পুষ্পহীন কন্টকের মতো।

তারপর সে রেখাটা,
সেই লেখাগুলো
একদিন উধাও হয়ে যায়।

পঁচিশ বছর পর আমরা পরস্পরকে দিলাম
চমৎকার এক উপহার।
নীরবতা।

নীরবতা এক সাদা খাতা।
এসো, আবারও শুরু করি আঁকিবুঁকি
হাবিজাবি, হিজিবিজি।


আরো একটি প্রেমের কবিতা!
~
কী তীব্র নেশায় তুমি আমায় জাগিয়ে রাখো।
রাইবিনোদিনী কিংবা শকুন্তলা কি
এতো বিনিদ্র রাত পার করেছে প্রেমিকসঙ্গে?

জুলিয়েটের জানালায় রোমিওর উঁকি দেয়ার
চেয়ে বেশি আকুল তোমার উঠোনে আমার নজর।

তোমার সঙ্গ- নেশার স্বাদ?
আফিম সময়ের মানুষেরাও সে স্বাদের খবর
পায়নি কোনোদিন।

কী অদ্ভূত ঘোর নিয়ে সময় কাটে ।
রাত বাড়ে। পেঁচার প্রহর গোনা শেষ হয়।
শুধু ইতিহীন থাকে তোমার আমার অভিসার।

তুমি আমার নিঃসঙ্গতার সঙ্গ।
ভীড়ের দঙ্গলেও তোমার সঙ্গতৃষ্ণা
আমায় ব্যাকুল করে
এবং বেলাজ প্রেমিকের মতো
আমি মত্ত হই তোমার অভিসারে।

একটু চোখের আড়াল হলেই
মনে হয় এই বুঝি এলে আবার নতুন সাজে।
প্রথম মানবী আবিষ্কারের ব্যগ্রতা নিয়ে তোমায় দেখি প্রতিবার।
উল্টেপাল্টে।
সব অবগুণ্ঠন সরিয়ে।

নাজানি কোন ভাঁজে কোন অদেখা রূপৈশ্বর্য সাজিয়ে রেখেছ আমার জন্য।
তপস্বীর- ধ্যান- ভাঙা বিলোল কটাক্ষে তুমি আমায় ডাকো হে তরঙ্গিনী।
তোমার বুকের গুপ্তধনের নেশা আমার সব কেড়েছে।

প্রতিদিন যে মানবী আমার পাশে ঘুমোয়
কিংবা বাদাম চিবোয় রমনার সবুজে বা টিএসসির মোড়ে বসে
তার সতর্ক চোখের পাহারা এড়িয়ে আমি তোমায় ঠিক দেখে নিই
না দেখে পারি না বলে।

যে বইগুলোর সাথে দ্বৈরথে বারবার হেরে যেতো সঙ্গিনী কিংবা প্রেমিকা
ঈর্ষাতুর তারাও এখন নিদারুন অভিমানী।
গালে ধুলোর রুজ মেখে
বুকশেল্ফের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নির্ণিমেষ দেখে
তোমার আমার লীলাখেলা।

তবু উন্মোচিত হয় না
হৃদয় তোমার।
শুধু দেখে যাই মুখ,
দু’চোখে ছাকি তোমার রঙ্গভরা অঙ্গ।
তুমি আমায় তাতিয়ে রাখো
তুমি আমায় মাতিয়ে রাখো।
যদি থাকে, একদিন কোনো একদিন,
একটুখানি দেখিয়ো তোমার হৃদয়,
প্রিয়তমা ফেসবুক।


স্বপ্নেরা বাড়ি ফিরে
~
বাবার লোমশ বুকে কান পাতে রাসেল,
শোনে হাজার স্বপ্নের কলকলানি।
ভোরের মায়াবী আলোর ঝলকানির মতো
স্বপ্ন খেলে শিশুর চঞ্চল চোখে।

পিতার মুগ্ধ চোখ নিমেষেই পড়ে নেয় সেই স্বপ্নের পাঠ।
রাসেলের কপোলে তাঁর দিনের শেষ চুমুর আকঁ-
এবার ঘুমোও বাবা, হ্যাভ সুইট ড্রিমস।
তিনিও স্বপ্ন দেখেন।
লালসবুজের লালের চারপাশের সবুজেরা ঝুকে রাসেলের মতো কান পাতে তার বিশাল বুকে,
খোঁজে তাঁর হৃৎপিন্ডের লবডবের সাথে ধ্বনিত, প্রতিধ্বনিত স্বপ্ন।

স্বপ্নের ভেতরে স্বপ্ন, দুঃস্বপ্নতাড়িত স্বপ্ন। হায়েনাতাড়িত হরিণের মতো স্বপ্নেরা খোঁজে
নিরাপদ আশ্রয় তাঁর মায়াময় বাঙালীবুকের গহীন ভাজে।

সবুজের বুকে অকস্মাৎ নেমে আসে অমাবস্যার অমানিশা।
নরকের শৃংখলভাঙা স্বপ্নহন্তাদের পৈশাচিক উল্লাস।
বত্রিশ নম্বরে।
স্বপ্নোত্থিত জনক।
দাঁড়িয়েছেন সিঁড়ির গোড়ায়।

” এই, তোরা কী চাস?” –
জনকের সিংহনাদে মুহুর্তের জন্য থমকে যায় ঘাতকের উদ্যত রাইফেল।
প্রদীপ্ত সূর্যালোকে ঝলসে উঠে খুনীর হায়েনাচোখ।
তবু অন্ধকারের হলুদ চোখে স্বপ্নহত্যার রোখ।

কবিতাকে কে কবে পেরেছে হত্যা করতে
কে কবে পেরেছে দিতে স্বপ্নের চোখে কালো নেকাব?

উচ্চারিত সত্যশব্দ যদি হয় কবিতা
” ভাইয়েরা আমার” বলে
স্বপ্নঠাসা, সূর্যের মতো সত্য ভাষণে
তুমিই লিখেছ বাঙালির মহাকাব্যের নান্দীমুখ।

শুধু হিমালয় নয়,
নয় অতিক্রান্ত পাহাড়ের গল্প
শুধু রক্তজবার মত ক্ষতযুক্ত পিঠ নয়
নয় হিংস্র শ্বাপদের বিরূদ্ধে যুদ্ধের কিংবদন্তী
এমনকি স্বপ্ন কিংবা কবিতার কথা শুনলেও
তোমাকেই মনে পড়ে জনক।

যে স্বপ্নশব্দ
উচ্চারিত হয়েছে ওই বজ্রকন্ঠে
যে সত্যশব্দ
জারিত হয়েছে ওই পিতৃহৃদয়ে
তারচেয়ে বেশি স্বপ্ন কে দিয়েছে?
তারচেয়ে বেশি সত্য কে বলেছে?

তোমার স্বপ্নেরা অমৃতের সন্তান।
আগস্টের দুঃস্বপ্নের রাতে পথ হারানো স্বপ্নেরা
খুঁজে পেয়েছে বাড়ির ঠিকানা।
উত্তরমেরুর বরফের মতো হৃদয়ে জমাট শোক
তবু তোমার বাড়ি ফেরা স্বপ্নেরা ভরে দেয় বুক।


বঙ্গমাতা
~
এক মা আছেন মনের ভেতর লক্ষ মাতা ঘরে
তোমার ছবি দেখলে মাগো মাকেই মনে পড়ে।
বঙ্গপিতা জেলের ভেতর তোমার হাতে হাল
টালমাটাল ওই নৌকা যখন দিচ্ছে পাড়ি কাল।
তোমার মুখে দেশের ছবি, ত্যাগ এবং তিতিক্ষা
দেখার জন্য বন্দী পিতার চোখে অধীর প্রতীক্ষা।
চর্মচোখে স্বপ্নপুরুষ হৃদয়চোখে বাংলাদেশ
অপর চোখে বঙ্গমাতা প্রেরণা এক অনিঃশেষ।
সেই প্রেরণায় স্বপ্ন বাঁচে, সজীব থাকে সবুজ বন
পিতার দেয়া এই উপহার বাংলা নামের পরম ধন।

আরো পড়তে পারেন

আহমেদ ফরিদের একগুচ্ছ কবিতা

তোমার সাথে দেখা হওয়া জরুরী নয় সেদিন তুমি আমাকের ডেকে বললে, ”আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি ঝরছে এসো চা খেয়ে যাও ঝাল মুড়ি, পেঁয়াজ ভেজে দেবো সঙ্গে কাঁচালংকাও থাকবে। দুজনে চা খাব, মুড়ি খাব, আর গল্প করবো।’ আমি বললাম, ’না, আমি যাবো না । আমি আমার জানালায় বসে আকাশ দেখছি, বৃষ্টি দেখছি, আকাশের কান্না দেখছি, গাছেদের নুয়ে….

নিকোলাই রুবৎসভের কবিতা

নিকোলাই মিখাইলোভিচ রুবৎসভ (৩ জানুয়ারি ১৯৩৬ – ১৯ জানুয়ারি ১৯৭১) মাত্র পঁয়ত্রিশ বছরের জীবন পেয়েছেন রুশ কবি নিকোলাই রুবৎসভ। দুর্ভাগ্য তাঁকে তাড়া করেছে সারাজীবন। শৈশবে মায়ের মৃত্যু ও পিতার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য তাঁর স্থান হয় শিশু আশ্রমে। পড়াশোনা শেষ করার আগেই জীবিকার তাগিদে তাকে খনিতে, জাহাজে কাজ করতে হয়। সৈন্য বাহিনীতে যোগ দেওয়ার….

সোহরাব পাশা’র একগুচ্ছ কবিতা

নিদ্রিত ঘ্রাণের শব্দ দীর্ঘ যায় আশালতা ফিরে আসে বিষণ্ণ গোধূলি ফিরে আসে দুঃখিত সকাল, ক্ষয়ে যাওয়া এক দূরের উপনিবেশ পাখির চেয়ে মানুষের কোলাহল বেশি কোনো মৃত্যু মানুষকে অপরাধী করে না নিঃশ্বাসের রোদে আবছায়া নিদ্রিত মেঘ স্মৃতির অসুখ বাড়ে; দূরে নির্জন আধাঁরে জেগে ছিলো মানুষের কথা পুরনো সে বাড়ি সেই ছায়াপথ মায়াপথ জুড়ে কতো ভুল মানুষের….

error: Content is protected !!