
যে-কোনো দেশেরই সাহিত্য সৃষ্টি নিয়ে যে-সব সমালোচনা আলোচনা হয়েছে- কোনোটি কেবলই বর্ণনামূলক, আবার কোনোটি লেখকের লেখার স্বরূপটির চিত্র, আবার কোনোটি তুলনামূলক আলোচনা আবার কোনোটি তার্কিক দৃষ্টিতে তুলে ধরা হয়েছে; হচ্ছে। বিতার্কিক দৃষ্টিতে যে-বিবেচনা- ‘শনিবারের চিঠি’-কে খারিজ করেই আমার বক্তব্য।
সাহিত্যের সমালোচক বা আলোচক বা বিশ্লেষক তিনি কোন বিবেচনায় বা দৃষ্টির প্রসারণ ঘটিয়ে সাহিত্যকে বিবেচনায় এনেছেন- এবং তাঁর লেখায় জিজ্ঞাসা ও জবাবের ভেতর নিজেকে কতটুক যৌক্তিক করে তুলতে পেরেছেন। এর আলোকে আমি বিতার্কিক বিবেচনার আখ্যা দিয়েছি।
এই ধারায় আমি রাজীব সরকারের প্রবন্ধকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় এনেছি।
রাজীব সরকারের জন্ম ১৯৮০ সালে। পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। ইংরেজি বা বাংলা সাহিত্য নয়। আবার সাহিত্যচর্চা বলবো না সংস্কৃতিচর্চার মধ্য দিয়ে নিজেকে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিতার্কিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। সংস্কৃতিচর্চায় তাকে অন্যতম উপায় হিসেবে পাঠ গ্রহণ করতে হয়েছে সাহিত্যের। আমি মনে করি শুরু থেকেই তার সাহিত্যপাঠে ছিল বিতার্কিক বিবেচনা। সাহিত্য একটি পর্যায়ে ধ্যানজ্ঞান ও প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হয়ে ওঠে। প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থেই-‘বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার ভবিষ্যৎ’ (২০০১) তরুণ গদ্যসাহিত্যিক তাঁর পথের সন্ধান পাঠকদের দেন। পাঠকও খুঁজে পায় তাঁর তারুণ্যের ধর্মকে। তারুণ্যের অন্যতম ধর্ম হয়েছে প্রগতি। প্রগতির পথের সন্ধানই আমরা তাঁর প্রথম গ্রন্থটিতে পেয়ে যাই। শুরুটাই তাঁর মানবিকতা ও বিজ্ঞানের অপূর্ব মেলবন্ধনে।
রাজীব সরকারের প্রবন্ধগুলো সমালোচনা সাহিত্যের ধারায় লিখিত। সাহিত্য ও সাহিত্যিক তাঁর বিষয়ের কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু সাহিত্যিক তাঁর সাহিত্যে কোন কোন বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছেন, তারই আলোকে প্রবন্ধগুলো রচিত। আর এ ক্ষেত্রে আমি লেখার শুরুতেই বলেছি- বিতার্কিকের বিবেচনা রয়েছে। প্রথমে আমরা বিশ্লেষণ করতে পারি তাঁর ‘সাহিত্যিকের সমাজচেতনা ও অন্যান্য ভাবনা’-র লেখাগুলোর। সূচির দিকে তাকালে রাজীব সরকারের স্বচ্ছদৃষ্টি যুগের স্বরূপকে উন্মোচন করে প্রসারিত এবং বিকশিত। সূচিতে রয়েছে-
এক. ‘বঙ্কিমচন্দ্র : যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতা’, ‘বিসর্জন : রবীন্দ্রনাথের যুক্তিবাদী মানস’
দুই. ‘শতাব্দীর ব্যবধানে রবীন্দ্র প্রবন্ধ’, ‘ছড়া ও কবিতায় রবীন্দ্রনাথের ফ্যাসিবাদ- বিরোধিতা’
তিন. ‘নজরুল ও বাঙালি সংস্কৃতি’
চার. ‘কবিতার দর্শন : জীবনানন্দ দাশের চিন্তাবিশ্ব’, ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় প্রেমদর্শন’
পাঁচ. ‘বুদ্ধদেব বসুর গদ্যশৈলী’, ‘সাহিত্যিকের সমাজ চেতনা : বুদ্ধদেব ও আইয়ুবের জীবনদর্শন’, ‘কলাকৈবল্যবাদ, ফ্যাসিবাদ ও বুদ্ধদেব বসু’
ছয়. ‘মনীষার দীপ্তি : হুমায়ুন কবিরের বাংলার কাব্য’, ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের প্রবন্ধ’
সাত. ‘হারানের নাতজামাই : বিপ্লবী ও শিল্পী মানিকের সম্মিলন’, ‘লালসালু : আধুনিকতা ও শিল্পিত স্পর্ধা’, ‘প্রাকৃতজনের জীবনদর্শন ও প্রদোষে প্রাকৃতজন’, ‘রূঢ় বাস্তবতা, খটখটে ডাঙা ও সাবিত্রী উপাখ্যান’
‘যুগচিত্রের’ পাশাপাশি সূচির দিকে লক্ষ করলে আমরা প্রত্যক্ষ করি সাহিত্যের বিষয়বৈচিত্র্যকে। বিষয়বৈচিত্র্য যুগের ভেতর থেকেই উঠে এসেছে এবং যুগকে প্রতিনিধিত্ব করেছে।
বঙ্কিম হয়ে হাসান আজিজুল হক পর্যন্ত শতাব্দী যুগের ব্যবধান কিন্তু যুগচিত্রে সাহিত্যের যে বিভিন্ন ধারা তা যুগকে প্রতিনিধিত্ব করেছে। সে ধারায় যুক্ত হয়েছে প্রবন্ধ কবিতা, নাটক, বাঙালি সংস্কৃতি, বিভিন্ন মতবাদ প্রভৃতি।
বঙ্কিমের সাহিত্য বিচার নিয়ে নানা মত রয়েছে। রাজীব সরকার পূর্বসূরী কোনো সমালোচকের কোনো সিদ্ধান্ত বা মন্তব্যকে সহযোগী করে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন না করে সরাসরি বঙ্কিমের সমাজ ও মানুষের কল্যাণে যে সক্রিয় ভূমিকা ছিল এবং এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যটি যে বঙ্কিমের যুক্তিবাদিতা তথা বৈজ্ঞানিক মনোভাব সম্পন্ন তার দিকে আমাদের মনোযোগী করেন। রাজীব সরকার এর সঙ্গে যোগ করে বলেছেন, “ভারতবর্ষে এত জোরের সঙ্গে আর কোনো লেখকের রচনায় উচ্চারিত হয়নি।” [পৃ. ১১]।
মনুষ্যত্বই সত্যের সন্ধান দেয়। সত্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, খণ্ডিত সত্য মিথ্যার চেয়েও ভয়ঙ্কর
রাজীব সরকার তাঁর প্রবন্ধের জন্যে বেছে নিয়েছেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বিজ্ঞানরহস্য’ গ্রন্থটি। বঙ্কিমের সমকালেও সৃষ্টিতত্ত্বের দিক থেকে চন্দ্র-সূর্য, প্রভৃতি নিয়ে যে-পুরাণ কাহিনি বা লোককথা প্রচলিত ছিল সে সময় থেকে বেরিয়ে তিনি বিজ্ঞানকে আশ্রয় করে এসবের যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেন। তাঁর যৌক্তিক ব্যাখ্যার একটি উদাহরণও বঙ্কিমের প্রবন্ধ থেকে রাজীব তুলে ধরেছেন। বঙ্কিম বলেছেন, “যিনি প্রমাণ দেখাইবেন, তাহার কথায় বিশ্বাস করিব। যিনি কেবল আনুমানিক কথা বলিবেন, তাহার কোন প্রমাণ দেখাইবেন না, তিনি পিতৃপিতামহ হইলেও তাঁহার কথায় অশ্রদ্ধা করিব। … বিজ্ঞান আমাদিগকে বলিতেছেন, ‘আমি তোমাকে সহসা বিশ্বাস করিতে বলি না, যে সহসা বিশ্বাস করে, আমি তাহার প্রতি অনুগ্রহ করি না; সে যেন আমার কাছে আইসে না। আমি যাহা তোমার কাছে প্রমাণের দ্বারা প্রতিপন্ন করিব, তুমি তাহাই বিশ্বাস করিও, তাহার তিলার্দ্ধ অধিক বিশ্বাস করিলে তুমি আমার ত্যাজ্য। আমি যে প্রমাণ দিব তাহা প্রত্যক্ষ। … সুতরাং বিজ্ঞানেই আমাদের বিশ্বাস।” [পৃ. ১৪]
‘বিজ্ঞানরহস্য’ গ্রন্থের প্রবন্ধ থেকে রাজীব বস্তুর, পৃথিবীর, চন্দ্র-সূর্যের, আকাশের, জৈবিকতার যৌক্তিকতার মৌল ধারণাকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। যেমন- তিনি দেখিয়ে দেন বঙ্কিম কীভাবে তাঁর ‘ধুলা’ প্রবন্ধে পৃথিবীতে ধুলার সর্বত্রগামিতাকে উপস্থাপন করেছেন, ‘গগন পর্য্যটন’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন ‘আকাশ কেন নীল’, ‘আশ্চর্য্য সৌরোৎপাত’ প্রবন্ধে সহজবোধ্যভাবে দেখিয়েছেন পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বের প্রাসঙ্গিকতা। এই প্রাসঙ্গিকতা এসে সমাজের অন্ধকার ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের উপলব্ধির জন্য এবং তা যে, যৌক্তিক ও বিজ্ঞান সম্মত তা বোঝাবার জন্য, শুধু কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও অন্ধকার সমাজজগৎকে টেনে আনেননি বঙ্কিম। প্রাচীন দর্শনশাস্ত্রকেও টেনে এনে দেখিয়েছেন যে, আধুনিক বিজ্ঞানের যুক্তি ও পদ্ধতিই শ্রেষ্ঠ, দর্শন নয়। এক্ষেত্রে গোঁড়াপন্থী ও ফ্যাশনসর্বস্ব আধুনিকপন্থী- উভয় পন্থীদের খারিজ করে দিয়ে নতুন যুগের উপযোগী মুক্তচিন্তা সম্পন্ন যুক্তিবাদের আশ্রয় নিয়েছেন।

খুব প্রাসঙ্গিকতায় রাজীব সরকার আরেকটি বিষয়কে তুলে এনেছেন তাঁর প্রবন্ধে সেটি হলো বঙ্কিমের যুগের দর্শন ও ধর্মকে। এটি আনার কারণ আমরা প্রবন্ধের শেষে উপলব্ধি করতে পারি। বঙ্কিমের বিজ্ঞান ও যৌক্তিকতাকে ভারত কতটুকু গ্রহণ করতে পেরেছে বা গ্রহণে কতটুকু ব্যর্থ হয়েছে বা বঙ্কিমের দর্শন ধর্মকে কী ভাবে অপব্যবহার করেছে তার চিত্র।
কাজী নজরুলকে বাঙালি সংস্কৃতির বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করা হয়নি বলে তাঁকে খন্ডিত ভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন রাজীব সরকার তাঁর ‘নজরুল ও বাঙালি সংস্কৃতি’ প্রবন্ধে।
প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী বিনয় সরকার বাঙালি সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা ও লৌকিক ঐতিহ্য সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, সেই মন্তব্যকে গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, বিনয় সরকারের মতো প্রখর মনীষার দীপ্তি সব বুদ্ধিজীবীর নেই। বাঙালি ধর্মের তাৎপর্যটি বুঝে উঠতে পারেন না বলে তারা বুঝতে পারেন না নজরুলকেও। কবি ও প্রাবন্ধিক হুমায়ুন আজাদ নজরুলের সংস্কৃতিকে অনুধাবন করতে পারেনি। আর তাই তাকে অভিহিত করেছেন, ‘বাঙলা ভাষার বিভ্রান্ত কুসংস্কার-উদ্দীপ্ত লেখকদের মধ্যে প্রধান’ হিসেবে। তাঁর খন্ডিত বিবেচনাকে গ্রাহ্য করা হয়নি এবং হুমায়ুন আজাদের মন্তব্যের বিপক্ষে যৌক্তিক মন্তব্য করেছেন। বুদ্ধদেব বসু যে নজরুলকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তার একটি উদাহরণও দিয়েছেন রাজীব সরকার। বুদ্ধদেব বসুর মন্তব্য, “সত্যেন্দ্রনাথকে মনে হয় রবীন্দ্রনাথেরই সংলগ্ন। কিংবা অন্তর্গত, আর নজরুল ইসলামকে মনে হয় রবীন্দ্রনাথের পরে অন্য একজন কবি ক্ষুদ্রতর নিশ্চয়ই, কিন্তু নতুন …।”
সাহিত্য ও সাহিত্যিক তাঁর বিষয়ের কেন্দ্রবিন্দু কিন্তু সাহিত্যিক তাঁর সাহিত্যে কোন কোন বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছেন, তারই আলোকে প্রবন্ধগুলো রচিত
রাজীব সরকার তাই প্রকৃত সত্যটি উদ্ঘাটন করেছেন, “বাংলা কবিতায় নতুন রক্তের ধারা নজরুল বইয়ে দিতে পেরেছিলেন বাঙালি সংস্কৃতি ও বাঙালি ধর্মের প্রকৃত স্বরূপকে চিনতে পেরেছেন বলে।”
‘উগ্রবাদ ফ্যাসিবাদ ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে ১০টি প্রবন্ধ রয়েছে। প্রবন্ধগুলোর শিরোনাম থেকেই রাজীব সরকারের গদ্য সাহিত্যের যে-যৌক্তিক বিবেচনা তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন- ‘আত্মপরিচয়’-এর জীবনদর্শন, কবিতা : মানবধর্মের দীপ্তিময় প্রকাশ, ছোট গল্প : অসাম্প্রদায়িকতার উজ্জ্বল প্রতীক, উপন্যাস : যুক্তিবাদ ও মানবধর্মের সমন্বয়, নাটক : ধর্মীয় উগ্রবাদের স্বরূপ উন্মোচন, প্রবন্ধ : বিজ্ঞানমনস্কতা ও যুক্তিবাদের প্রতীক, চিঠিপত্র : মুক্তচিন্তার প্রতিচ্ছবি, ভাষণ-বিবৃতি : ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে স্পর্ধিত উচ্চারণ, ভ্রমণ : পরিব্রাজকের মুক্ত বিবেক, ছড়া ও কবিতায় ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ জীবনের রচনা ‘আত্মপরিচয়’। এই গ্রন্থ পাঠের ভেতর দিয়ে রবীন্দ্রনাথের যে নিজস্ব একটি ধর্ম অর্থাৎ প্রাণের ভেতরকার ধর্ম বলে যাকে রবীন্দ্রনাথ নিজেই উল্লেখ করেছেন- সে ধর্মের স্বরূপকে রাজীব উন্মোচন করেছেন। আত্মপরিচয়ে কোনো ভাবাবেগ নেই। যা আছে শাশ্বত রূপ। সে রূপটি মনুষ্যত্ব দিয়ে গড়া, যা অভ্যাসের দিক থেকে পাওয়া যায় না, পাওয়া যায় সৃজনশীল শক্তির মাধ্যমে। আর মনুষ্যত্বই সত্যের সন্ধান দেয়। সত্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, খন্ডিত সত্য মিথ্যার চেয়েও ভয়ঙ্কর।
ধর্মান্ধতা নিয়েও তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। যা মনুষ্যত্ব ও সত্যাসত্যকে পুরোপুরি বুঝতে সহায়ক। রাজীব সরকারও সে দিকটিকে উন্মোচিত করে মন্তব্য করেছেন, “ অন্তরের সত্যকে বিসর্জন দিলে ধর্ম প্রাণহীন আচারে পরিণত হয়। এভাইে জন্ম নেয় ধর্মমোহ বা ধর্মান্ধতা। সে জন্য শাস্ত্রসর্বস্ব আচার ধর্ম বলে সে নিতে কখনো প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। বাহ্যিক আচরণ বা অভ্যাস কখনো ধর্মের অন্তঃসার হতে পারে না।” [পৃ. ১৩]
আত্মপরিচয় রচনার আগেই যে রবীন্দ্রনাথ তার কবিতায় ধর্ম, ধর্মের মোহ ও মোহ থেকে মুক্তি- সে চিন্তার জগতকে রাজীব সরকার রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখিয়েছেন। ‘কবিতা :মানবধর্মের দীপ্তিময় প্রকাশ’ প্রবন্ধে। এক্ষেত্রে ধর্মান্ধ ও নাস্তিক মানুষের ভেতরের স্বরূপটিও উঠে আসে-
ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে
অন্ধ সে জন মোরে আর শুধু মরে।
নাস্তিক সেও পায় বিধাতার বর,
ধার্মিকতার করে না আড়ম্বর।
শ্রদ্ধা করিয়া জ্বালে বুদ্ধির আলো,
শাস্ত্র মানে না, মানে মানুষের ভালো।
রবীন্দ্রনাথের মনুষ্যত্বের ও মানবতার এবং সত্যের ধর্মকে নানান সাধক, মন্দির উপাসনা, নিপীড়িত মানুষ; বিভিন্ন সম্প্রদায়- চন্ডাল, মুসলমান, জোলা, রবিদাস সবার নিজ নিজ ধর্মের সাথে বোঝাপড়া করে একটি সত্যেই উপনীত হয়েছেন যে, মনুষ্যত্বকে পদদলিত করা যাবে না। রাজীব সরকার বিশেষ এই দিকটি পুনরায় পাঠকের সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে তাঁর যৌক্তিক বোধ ও উপলব্ধিই অন্যতম অবলম্বন হিসেবে কাজ করেছে।
যিশুখ্রিস্টকেও উদাহরণ হিসেবে সামনে তুলে এনেছেন। কারণ অধর্ম লালনকারীরা ভ্রাতৃহত্যার মধ্য দিয়ে যে পৃথিবীকে রক্তাক্ত করছে সেই পৃথিবীকে রবীন্দ্রনাথ তুলনা করেছেন যিশুখ্রিস্টের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতিকে রাজীব ব্যবহার করেছেন এভাবে- “ আজও তিনি মানুষের ইতিহাসে প্রতি মুহূর্তে ক্রুশে বিদ্ধ হচ্ছেন।” ‘মানবপুত্র’ কবিতার উদ্ধৃতি এক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে-
“… দারুণতম যে মৃত্যুবাণ নূতন তৈরি হল,
খ্রিস্ট বুকে হাত চেপে ধরলেন;
বুঝলেন শেষ হয়নি তার নিরবচ্ছিন্ন মুহূর্ত,
নূতন শূল তৈরি হচ্ছে বিজ্ঞানশালায়-
বিঁধছে তাঁর গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে।”
মনুষ্যত্ব এবং সত্যের সন্ধানের জন্য প্রয়োজন শুভবুদ্ধির। ‘জ্ঞান যেখানে সীমিত হয় বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট হয়, মুক্তিও অসম্ভব হয়ে পড়ে- এই যে বোধ তা বিশ শতকের বিশের দশকে বাঙালি মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণ যে উপলব্ধি করেছিলেন তারও মূলে রবীন্দ্রনাথের প্রেরণা ছিল। শুভবুদ্ধি সকল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান রবীন্দ্রনাথের ছিল’ ছিল একারণে যে, ধর্মীয় উগ্রবাদ ও রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িকতাকে প্রতিরোধ সম্ভব শুভবুদ্ধির সম্মিলনে। ‘ধর্মমোহ’ কবিতা-র উদ্ধৃতি যথার্থ বলে মনে হবে সবার-
‘যে পূজার বেদি রক্তে গিয়েছে ভেসে
ভাঙো ভাঙো, আজি ভাঙো তারে নিঃশেষে-
ধর্মকারার প্রাচীর বজ্র হানো,
এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক জ্বালো’।
ধর্ম যে যুদ্ধক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয় ধর্মকে পুঁজি করা হয় রবীন্দ্রনাথের কবিতায় এদিকটিও স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। আর ফ্যাসিবাদ বিরোধী অন্যতম কবিতা হিসেবে রাজীব বেঁছে নিয়েছেন ‘বুদ্ধ ভক্তি’ কবিতাটি।
ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে বুদ্ধকে কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তার একটি রূপ তুলে ধরা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ সময়কে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে শুভকেই যৌক্তিকতার সাথে গ্রহণ করেছেন বলেই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের একটি উদ্ধৃতি ব্যবহার করে রবীন্দ্রনাথের ফ্যাসিবাদ বিরোধী কবিতা ‘বুদ্ধভক্তি’-র উদাহরণ দিয়েছেন রাজীব সরকার। ‘বুদ্ধভক্তি’ কবিতার প্রারম্ভে রবীন্দ্রনাথের যে ভূমিকা তার উদ্ধৃতি- “জাপানের কোনো কাগজে পড়েছি জাপানি সৈনিক যুদ্ধের সাফল্য কামনা করে বুদ্ধ মন্দিরে পূজা দিতে গিয়েছিল। ওরা শক্তির বাণ মারছে চীনকে, ভক্তির বাণ বুদ্ধকে।’’ ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’ কবিতা থেকে উদ্ধৃতি-
যুদ্ধের দামামা উঠল বেজে
…
সবার আগে চলল দয়াময় বুদ্ধের মন্দিরে
তাঁর পবিত্র আশীর্বাদের আশায়
ছিঁড়ে ফেলবে ঘরে ঘরে ভালোবাসার বাঁধন সূত্র
তাইতো চলেছে ওরা দয়াময় বুদ্ধের নিতে আশীর্বাদ।
‘বুদ্ধভক্তি’ কবিতা থেকে উদ্ধৃতি-
সিদ্ধির বর চায় করুণা নিধির-
ওরা তাই সুধায় চলে
বুদ্ধের মন্দির তলে।
…
হত-আহত গণি সংখ্যা
তালে তালে মন্ত্রিত হবে জয়ডঙ্কা
…
মুষ্টি উঁচায়ে তাই চলে।
বুদ্ধেরে নিতে নিজ দলে।
বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্য নিয়েও তাঁর একটি প্রবন্ধের বই রয়েছে। বইটির শিরোনাম ‘বহুমাত্রিক বুদ্ধদেব বসু : বৈচিত্র্যে বৈশিষ্ট্যে’ (২০১৭)। এই গ্রন্থে ১০টি প্রবন্ধ রয়েছে। প্রবন্ধগুলো হলো- কবি বুদ্ধদেব বসু, গল্পকার বুদ্ধদেব বসু, ঔপন্যাসিক বুদ্ধদেব বসু, নাট্যকার বুদ্ধদেব বসু, রম্য রচনাকার বুদ্ধদেব বসু, প্রাবন্ধিক বুদ্ধদেব বসু, সাহিত্য সমালোচক বুদ্ধদেব বসু, ভ্রমণ সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু, অনুবাদক বুদ্ধদেব বসু, সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু।
বুদ্ধদেব বসু কবিতার জন্যে বিশেষ করে রবীন্দ্র বলয় থেকে বেরিয়ে নতুন কবিতার জগত নির্মাণের জন্যে যে মেধা, প্রজ্ঞা, সৃজনশীলতার প্রকাশ দেখিয়েছেন তা ছিল ঐশ্বর্যপূর্ণ।
রবীন্দ্রনাথ যে মনুষ্যধর্মকে তাঁর অন্তরের গভীরতম নিজস্ব ধর্ম বলে অভিহিত করেছেন- সেখানে প্রেমটা ছিল অনেকটা সৌন্দর্য চেতনার মধ্যেই সীমায়িত। রাজীব সরকার বিষয়টিকে এভাবে বলেছেন, “ভিক্টোরীয় রুচিবোধ ও ব্রাহ্ম সমাজ প্রবর্তিত অনুশাসনের প্রভাবে শারীরিক ভালোবাসাকে এড়িয়ে গিয়ে পুরুষের কল্পনা ডানা মেলেছিল এক অশরীরী স্বর্গীয় সুষমায়। নারীর দৈহিক সৌন্দর্যের যে চিরন্তর প্রতিমা রবীন্দ্রনাথ গড়েছিলেন, সেখানেও নারী অলৌকিক স্বপ্ন সঙ্গিনী, যৌবন চিৎকৃত হাহাকার সত্ত্বেও অপ্রাপনীয়”।
বুদ্ধদেব বসু ওখান থেকে সঙ্গত ও যৌক্তিক ভাবেই সরে এসে ‘প্রেমের কবিতা’ প্রবন্ধে যা বলেছেন তা মনুষ্যধর্মকেই প্রাধান্য করে যথার্থই বলেছেন। বুদ্ধদেব বসুর মন্তব্য গ্রহণ করছি এক্ষেত্রে- “ যা-ই হোক, এতদিন এই আধুনিক সময়ে যৌনপ্রেমের এমন একটি আদর্শ অন্তত আমরা সৃষ্টি করতে পেরেছি যা মনুষ্যধর্ম সঙ্গত অর্থাৎ যা কোনোখানেই দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয় না”। এই মন্তব্যের আলোকে আমরা বলতেই পারি প্রেমটা বুদ্ধদেব বসুর নিজস্ব ধর্ম এবং একান্ত অন্তর্গত অভিব্যক্তি। তাঁর প্রেমে কাম আছে, দেহ আছে। সৌন্দর্য চেতনাও আছে এবং আকাঙ্খার পরিসমাপ্তিও দেখতে চেয়েছেন। এর জন্য রাজীব সরকার কয়েকটি কবিতার উদ্ধৃতি তুলে ধরেছেন প্রাসঙ্গিকতায়। তাঁর নির্বাচিত দুটি কবিতার পরপর উদ্ধৃতি তুলে ধরছি। এসব উদ্ধৃতি থেকেও বুদ্ধদেব বসুর নিজস্ব প্রেমধর্মকে উপলব্ধি করা যাবে।
১. বাসনার বক্ষোমাঝে কেঁদে মরে ক্ষুধিত যৌবন,
দুর্গম বেদনা আর স্ফুটনের আগ্রহে অধীর।
রক্তের আরক্ত লাজে লক্ষবর্ষ-উপবাসী শৃঙ্গার কামনা
রমণীরমণ-রণে পরাজয় ভিক্ষা মাগে নিতি; [বন্দীর বন্দনা]
২. এসো, চলে এসো; যেখানে সময় সীমানাহীন,
হঠাৎ-ব্যথায় নয়, দ্বিখন্ড রাত্রিদিন;
সেখানে মোদের প্রেমের সময় সময়হীন-
কঙ্কা, শঙ্কা কোরো না। [শেষের রাত্রি]
ধর্মীয় পরিচিতির দিক থেকে সমাজে আমরা কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান বা খ্রিষ্টান বা বৌদ্ধ। ধর্মীয় চিন্তার গন্ডিবদ্ধতার কারণে অনেকে ধর্মান্ধ হয়ে পড়েন, গোঁড়ামি পর্যায়ভুক্ত হন। এই যে ধর্ম-তা নিয়ে প্রগতিপন্থি লেখক, বুদ্ধিজীবীগণ ধর্মসাধনা বা চর্চা করেন না। ফলে একশ্রেণির মানুষ যারা ধর্মকে আশ্রয় করে মানুষকে পশ্চাৎপদ রেখে সমাজে নিজেকে এবং নিজের মতকে প্রতিষ্ঠা করতে চান তারা সফল হচ্ছেন। এই ধারার বিপরীতে প্রগতিশীল লেখকদেরও ধর্মসাধনার প্রয়োজন এজন্যে যে, তাদের যৌক্তিক বিবেচনা এবং মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত করার ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা পালন করতে পারবে। এই বিষয়টিও রাজীব সরকারের দৃষ্টি এড়ায়নি। ‘নিহত রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে ‘যতীন সরকারের ধর্মচিন্তা’ এর যথার্থ উদাহরণ।
রাজীব সরকার প্রবন্ধের শুরুতেই যতীন সরকারের পরিচয় তুলে ধরেছেন এভাবে-“স্রোতের বিপরীতে এমন কয়েকজন বুদ্ধিজীবী রয়েছেন যাঁরা ‘নাস্তিক্য প্রচারের গৌরবে’ গৌরবান্বিত নন, যারা ব্যাপক ও বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মনোজগতের খবর রাখেন, ধর্মের মর্মকে যথার্থই উপলব্ধি করেন এবং ধর্মের নামে যাবতীয় অধর্ম ও অনাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান বক্তৃতায় ও লেখনীতে। সেই স্বল্পসংখ্যক লেখক বুদ্ধিজীবীদের অন্যতম যতীন সরকার”।
অবশ্য এই পরিচয়ের বাইরেও তিনি সমকালীন প্রবন্ধ সাহিত্যে নিজেকে উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন- এটিও সত্য। সাম্যচেতনার সঙ্গে প্রকৃত ধর্মচেতনার যে কোনো বিরোধ নেই তা তিনি তার কয়েকটি গ্রন্থে স্বাক্ষর রেখেছেন- এ সম্পর্কেও মন্তব্য রয়েছে রাজীব সরকারের। তবে রাজীব সরকার তাঁর প্রবন্ধের বিষয় করেছেন- যতীন সরকারের ‘ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের ভূত ভবিষ্যৎ’ গ্রন্থকে কেন্দ্র করে। এই গ্রন্থে কয়েকটি প্রবন্ধ রয়েছে যা ধর্ম, রিলিজিয়ন, ধর্মতন্ত্র, মৌলবাদ, মৌলবাদী প্রভৃতি বিষয়ে মৌলিক ভাবনা-চিন্তার।
প্রবন্ধগুলোতে যতীন সরকারের ধর্মচিন্তার সার খুঁজে নিয়ে রাজীব সরকার পরিসমাপ্তিতে যথার্থই বলেছেন, “যতীন সরকার জানেন, তত্ত্বকে তত্ত্ব-বহির্ভূত কোন শক্তি দিয়ে প্রতিহত করা যায় না। যে-কোন তত্ত্বের প্রতিষেধক হতে পারে অন্যতর ও অধিকতর শক্তিধর কোন তত্ত্ব। ধর্মতন্ত্রী জঙ্গি মৌলবাদকে প্রতিহত করতে সে-ই তত্ত্ব আজ একান্ত প্রয়োজন। সেই তত্ত্বের সন্ধান পেতে হলে ধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখলে চলবে না। ধর্ম ও ধর্মতন্ত্রের যুগোপযোগী বিচার বিশ্লেষণ করতে হবে। উনিশ শতকে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ প্রমুখ হিন্দু মনীষী ‘হিন্দু ধর্মতন্ত্রে’র বিভিন্ন দিক নিয়ে সংস্কারমুক্ত দৃষ্টিতে ভেবেছিলেন এবং কাজ করেছিলেন। এরই প্রতিক্রিয়ায় খন্ডিত আকারে হলেও বাংলার রেনেসাঁসের আবির্ভাব ঘটেছিল। বাঙালি মুসলমান সমাজে অর্থবহ রেনেসাঁস না ঘটার প্রধান কারণ প্রগতিশীল বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের ‘ইসলামি চিন্তার পুনর্পঠন’ সম্পর্কে নির্লিপ্তি।” [পৃ. ৯২]
মানুষের ধর্ম, সম্প্রদায় এবং বিজ্ঞানমনস্কতা অবলম্বন করে বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসু থেকে শুরু করে হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, যতীন সরকার তাদের সাহিত্যকে যেভাবে সমৃদ্ধ করেছেন তা রাজীব সরকার তার লেখায় যৌক্তিক এবং বিতার্কিক বোধের আলোয় আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। রাজীব সরকারের মৌলিক প্রবন্ধও এই পূর্বসুরীদের মতোই পাঠককে টেনে নিয়ে যায় সৃষ্টিশীলতার গভীর উপলব্ধিতে।