
লেখক : শ্রোডিঙ্গারের তত্ত্ব এবং কোপেনহাগেন মতবাদ থেকে জানা গেলো যে হাইড্রোজেন পরমাণু ইলেক্ট্রনের মেঘে ঢাকা মাঝখানে বসে আছে নিউক্লিয়াস। ইলেক্ট্রনকে কোথায় পাওয়া যাবে তা আগেভাগে বলা সম্ভব নয়। ধরে নিতে হবে যে একটা ইলেক্ট্রন সব জায়গাতেই আছে! এই মেঘের জগতে ইলেক্ট্রনের জন্য বিভিন্ন কোয়ান্টাম ঘরের ব্যবস্থা আছে। ওদের নাম 1s, 2s, 2p, ইত্যাদি। ইলেক্ট্রন ওপরের (বেশি শক্তির) ঘর থেকে নিচের (কম শক্তির) ঘরে লাফ দিলে আলো জ্বলে উঠে।
এই আলোর তরঙ্গদৈর্খ্য মেপে যা পাওয়া গেলো তা শ্রোডিঙ্গারের সমীকরণ থেকে অংক করে পাওয়া ফলাফলের সাথে হুবহু মিলে গেলো। সব্বাই খুশি। কিন্তু বিজ্ঞানে সাধারণত যেমন হয়, মাপামাপির যন্ত্র যতই চোখা হতে থাকে ততই নতুন সব ভুল চোখে পড়ে। দেখা গেলো কোনো কোনো কোয়ান্টাম লাফ থেকে একটার বদলে দুই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো বের হচ্ছে। তাহলে এমন কোয়ান্টাম ঘর আছে যেখানে ইলেক্ট্রন দুই শক্তি নিয়ে বসবাস করতে পারে। শ্রোডিঙ্গারের তত্ত্ব হয়তো সত্যি নয়! ভুলটা কোথায় তা খুঁজে বের করার জন্যে তোলপাড় কান্ড শুরু হলো।
গাউডস্মিট (Samuel Goudsmit, ১৯০২-১৯৭৮): আমি তখন ছাত্র। কোয়ান্টাম ঘরের এই নতুন শক্তি নিয়ে আমাদের প্রফেসরদের হৈচৈ দেখে আমি এবং আমার ক্লাসমেট উহলেনবেক (Uhlenbeck) একদিন তর্ক করছিলাম। একটা অতি সহজ সমাধান মাথায় এলো। ইলেক্ট্রন যদি চক্কর খেতে খেতে ঘোরে! চুম্বুক হলো বৈদ্যুতিক চার্জের ঘোরাঘুরি। চক্কর খাওয়া ইলেক্ট্রনকে একটি খুদে চুম্বুক হিসেবে ধরা যেতে পারে। ওদিকে ইলেক্ট্রনের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রোটোনটা ওর চারদিকে ঘুরছে এবং তা থেকে চুম্বকীয় ফিল্ড তৈরী হচ্ছে। এই দুই বলের সংঘাত থেকে বাড়তি কিছু শক্তি তৈরী হবে। সমাধানটা এতো সহজ অথচ কেন আইনস্টাইন, বোর, শ্রোডিঙ্গারের মতো সব নামকরা বিজ্ঞানীদের মাথায় আসছে না তাই নিয়ে মাথা ঘামানো শুরু করলাম। আমাদের যুক্তিতে নিশ্চয় কোনো গলদ আছে! পরামর্শ নেয়ার জন্যে আমরা প্রফেসর এর্নফেস্টের সরণাপন্ন হলাম। ভদ্রলোক খুব ভালো, বোকার মতো প্রশ্ন করলে বকাবকি করেন না! তিনি বললেন, হয়তো তোমাদের ধারণা বেজায় মূল্যবান, নয়তোবা একেবারেই ফালতু। আমি ব্যাপারটা আরেকটু তলিয়ে দেখছি। তোমরা এ নিয়ে ছোট্ট একটা গবেষণা পেপার লিখে ফেলো, আমি সেটা একটা বিজ্ঞান পত্রিকায় পাঠিয়ে দিবো।
বেশ কিছুদিন পরে আমরা দুই ছাত্র আবার প্রফেসরের ঘরে হাজির। প্রফেসর এর্নফেস্ট বললেন, আমি তোমাদের কথা গণিতবিশারদ লোরেন্জকে বলেছিলাম। তিনি অংক কষে দেখেছেন যে তোমাদের তত্ত্ব যদি সত্যি হয় তবে ইলেক্ট্রনকে পরমাণুর চেয়ে বড় হতে হবে, এবং আলোর চেয়ে বেশি বেগে ঘুরতে হবে। ব্যাপারটা অসম্ভব। আমরা আমাদের পেপারটা ফেরত চাইলে এর্নফেস্ট বললেন, ওটাতো আমি সেই কবেই পত্রিকায় পাঠিয়ে দিয়েছি। তবে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। তোমরা এখনো ছাত্র। কিছু বোকামি করার অধিকার সব ছাত্রের আছে।
লেখক : ভাগ্যিস, পেপারটা ফেরত নেয়া হয় নি। ইলেক্ট্রনের চক্করের আবিষ্কারের সন্মান এই দুই ছাত্রের কপালেই জুটেছিল। তবে লোরেন্টজের অংকে কোনো ভুল ছিল না। ইলেক্ট্রনের চক্কর আসলে চক্কর নয়! ওটা যে কি তা কেউ জানে না। বলা যেতে পারে ওটা চক্কর নয় বরং চক্কর দেয়ার স্বাধীনতা! এই স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে ইলেক্ট্রন দুই দিকে চক্কর খেতে পারে।
ডিরাক (Paul Dirac, ১৯০২-১৯৮৪): শ্রোডিঙ্গারের তত্ত্বে ইলেক্ট্রন চক্কর খায় না। তাঁর সমীকরণে সময় এবং স্থান সমান মর্যদা পায় নি, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের শর্ত মানা হয় নি। যেখানে আইনস্টাইনের এমন অসম্মান সেখানে অংকের ইলেক্ট্রন চক্কর খাবে কি করে? ১৯২৮ সালে আমি এক সমীকরণ বের করি যেখানে কোয়ান্টাম এবং আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মিলন ঘটেছে। এই সমীকরণে ইলেক্ট্রনের চক্কর যেন হাওয়া থেকে এসে অংকের মধ্যে ঢুকে পড়ে। এই ইলেক্ট্রন দুই দিকে চক্কর খেতে পারে। আমার সমীকরণ থেকে যে ওয়েভ ফাঙ্কশন পাওয়া গেল তার আছে চারটি অংশ (component), শ্রোডিঙ্গারের একটি কোয়ান্টাম ঘর যেন চারটি হয়ে গেল। এই ঘরগুলিতে কে বা কারা বাস করবে? প্রথম ঘরে ইলেক্ট্রন একদিকে চক্কর খাচ্ছে, দ্বিতীয় ঘরে ইলেক্ট্রন আরেকদিকে চক্কর খাচ্ছে, কিন্তু বাঁকি ঘরদুটিতে কে থাকবে? কি ভৌতিক ব্যাপার! ইলেক্ট্রনের যেন না দেখা এক দোসর কণা আছে, সেও চক্কর খায়।
লেখক : এই দোসর কণার গল্প তখন গাঁজাখুরি মনে হয়েছিল। এখন আমরা এদেরকে প্রতিকণা (anti-matter) বলে জানি। মহাবিশ্বের প্রতিটি কণার আছে এমন প্রতিকণা। ইলেক্ট্রনের প্রতিকণার নাম পজিট্রন। প্রতিকণার অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করার জন্যে ডিরাক-সমুদ্রের কথা বলা হয়। এই সমুদ্রের প্রতিটি কোয়ান্টাম ঘরে কেউ না কেউ বসে আছে। তবে শক্তি প্রয়োগ করে কাউকে যদি ঘরছাড়া করা যায় তবে সে কণাতে পরিণত হয় এবং ফাঁকা ঘরটি হয়ে পড়ে প্রতিকণা। যদি কণা এবং প্রতিকণার মিলন ঘটে তবে আলোর ঝলক পিছনে ফেলে রেখে ওরা দুজনেই অদৃশ্য হয়ে যায়, ডিরাক সমুদ্রে আবার শান্তি ফিরে আসে!
১৯৩৬ সালে প্রতিকণা আবিষ্কারের জন্যে কার্ল অ্যান্ডার্সন নোবেল পুরস্কার পান। ডিরাকের তত্ত্বমতে প্রতিকণা সৃষ্টি না করে কণা সৃষ্টি করা যায় না। মহাবিশ্বে কণা এবং প্রতিকণার সংখ্যা সমান হতে হবে। কিন্তু এই মহাবিশ্বে প্রতিকণার খোঁজ পাওয়া ভার, চারিদিকে শুধুই কণা! ওরা কোথায় গেল? এই সমস্যার সমাধান আজও হয় নি।