
ভ্যান গ (Vincent Van Gogh, ১৮৫৩-১৮৯০): আমি একজন পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট (post-impressionist) শিল্পী। আমার আঁকা ‘নক্ষত্র-খচিত রাত্রি (Starry Night)’ পৃথিবীর শিল্পানুরাগীদের ঘরে ঘরে টাঙানো থাকে। আমার তোলপাড় মনের দশা প্রকাশ করেছি রঙের বেহিসেবি ছড়াছড়িতে। আমার সবচেয়ে প্রিয় রং ছিল হলুদ। আমি এঁকেছি ‘ফুলদানিতে হলুদ সূর্যমুখী ফুল,’ কখনো বারোটা ফুল, কখনো বা চোদ্দটা। আমার তুলিতে ভোরের এবং সাঁঝের সূর্য হয়ে গেছে হলুদ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:
‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
হাসিকান্না হীরাপান্না দোলে ভালে,
কাঁপে ছন্দে ভালোমন্দ তালে তালে,
কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ
দিবারাত্রি নাচে মুক্তি নাচে বন্ধ…’
লেখক : তোমার এই গানটি আমার খুব প্রিয়, কিন্তু শরীরের কোন অংশ যে চিত্ত তা কারো জানা নেই। তবে সেখানকার নর্তকীরা যে ইলেক্ট্রনের দল সে নিয়ে বিজ্ঞানীদের এতটুকু সন্দেহ নেই। আলো, হাসি, রং, সুখ, দুঃখ, ভালোবাসা- আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সব অনুভূতির উৎস হলো বিদ্যুৎ। আর বিদ্যুৎ হলো ইলেক্ট্রনের চলাফেরা। আমাদের মগজ বাস করে মাথার এক দরজা-জানালাহীন অন্ধকার গুহায়, পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের সব অনুভূতি ওখানে ঢোকে বৈদ্যুতিক সংকেত হিসেবে। এই সংকেত মগজের ইলেক্ট্রনদের নাচায়, কোনো নাচ আনন্দের, কোনোটা বা দুঃখের, কোনো নাচের অনুভূতি হলুদ রং, কোনো নাচের অনুভূতি নীল। আরো অনেক নাচ আছে যা থেকে কোনো অনুভূতির সৃষ্টি হয় না। আমাদের মগজ ভেবে নিয়েছে যে বেঁচে থাকার জন্যে ওই অনুভুতিগুলোর প্রয়োজন নেই! বিজ্ঞানীরা অবশ্য ওই সব অজানা নাচের অনেক খবর জেনে ফেলেছে। ওদের নাম দেয়া হয়েছে ইনফ্রা রেড, মাইক্রো ওয়েভ, রেডিও ওয়েভ, আলট্রা ভায়োলেট, এক্সরে, গামা রে, ইত্যাদি। ভাগ্যিস মগজটা মাইক্রো নাচ শেখে নি! তাহলে দিন রাত্রি বলে কিছু থাকতো না। যে কোনো সময়ে মহাবিশ্বের যে কোনো স্থানে যে কোনো দিকে তাকালেই দেখা যেত “মাইক্রো” আলো। ঘুমাবো কখন? তেরো দশমিক সাত বিলিয়ন বছর আগে যে মহাবিস্ফোরণ (Big Bang) থেকে এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি, “মাইক্রো আলো” তার অবশিষ্ট জ্যোতি। বিজ্ঞানীরা একে বলে ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশান (Background radiation)। এরা সর্বক্ষণ আমাদের ঘিরে থাকে। ওদিকে হলুদ হলো দৃশ্যমান রংগুলোর মধ্যমনি। শিল্পী ভ্যান গ একটুও ভুল করেননি। সূর্যমুখী সূর্যের দিকে চেয়ে থাকে কারণ সূর্য আর সব রঙের চেয়ে সবুজ রং সবচেয়ে বেশি ছড়ালেও বায়ুর স্তর ভেঙে আসতে আসতে হলুদটাই প্রাধান্য পায়।
রিটার (Johann Ritter, ১৭৭৬-১৮১০): সূর্যের আলো প্রিজম দিয়ে ছড়িয়ে নিউটন বর্ণালী সৃষ্টি করেন, গানের সাতটি তানের সাথে মিল রেখে রংগুলোর সাতটি নাম দেন, বেগুনি, ঘন নীল, নীল, সবুজ, হলুদ, কমলা, এবং লাল। এর বাইরে যে আরো না-দেখা রং আছে তা বিজ্ঞানী হার্শেল (Wiliam Herchel) প্রথম টের পান। বর্ণালীর রংগুলো তাপমাত্রায় কোনো ভেদাভেদ আছে কি না তা তিনি থার্মোমিটার দিয়ে মাপছিলেন। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন যে লাল আলোর পাশে রংহীন জায়গাটি সবচেয়ে বেশি তাপ ছড়াচ্ছে। ওখানে তাহলে এক ধরণের আলো আছে যা আমাদের চোখ দেখতে পায় না। হার্শেল সেই না-দেখা রঙের নাম দেন ইনফ্রা রেড। বেগুনি রঙের ওপারেও হয়তো কোনো অদৃশ্য রং আছে! এই নিয়ে অনেক গবেষণা করে আমি আলট্রা ভায়োলেট রঙের সন্ধান পাই। আমরা দেখতে না পেলেও, প্রজাপতি, পাখি, পোকামাকড় কিন্তু ইনফ্রা রেড এবং আলট্রা ভায়োলেট রং দেখতে পায়। আমাদের চোখে মাত্র তিনটি রং নির্ধারক সেন্সর আছে- লাল, সবুজ, এবং নীল। এদের (primary colour) মিশ্রণ থেকেই আমরা আর সব রঙের অনুভূতি পাই।
লেখক : বেগুনি থেকে লাল রং সব একসাথে মেশালে তা দেখাবে সাদা। সূর্যের সাদা আলো গাছের পাতায় পড়ে, সবুজ বাদে আর সব আলো পাতার ইলেক্ট্রনগুলোকে নাচায়, সেখানে তাপ সৃষ্টি হয়, সেই শক্তি দিয়ে কার্বন ডাই অক্সাইড এবং পানি থেকে পাতা তৈরী করে খাদ্য এবং অক্সিজেন। সবুজ আলোটি কোনো কাজে লাগে না, পাতা ওকে আবার চারদিকে ছড়িয়ে দেয়। তাই তো পাতার রং সবুজ আলো হলো বিদ্যুৎ এবং চুম্বুকের ঢেউ, আমরা যে আলো চোখে দেখতে পাই তার মধ্যে লাল আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ সবচেয়ে বড়, বেগুনি আলোর দৈর্ঘ সবচেয়ে কম। তরঙ্গ দৈর্ঘের দিক থেকে লাল আলোর পরে আছে ইনফ্রা রেড, মাইক্রো, এবং রেডিও ঢেউ। ওদিকে আলট্রা ভায়োলেটের চেয়ে ছোট তরঙ্গ দৈর্ঘের ঢেউয়ের নাম এক্সরে এবং গামা রে।
আইনস্টাইন: রেডিওর মতো বড় তরঙ্গ থেকে ক্রমাগত ছোট তরঙ্গ দৈর্ঘের ঢেউয়ের দিকে যাত্রা শুরু করলে এক অদ্ভুত কান্ড ঘটে! আলট্রা ভায়োলেটের কাছে এসে আলো হটাৎ ঢেউ থেকে কণা হয়ে যায়। এই কণাগুলোকে ফোটন বলে। এমন আলো ধাতব পদার্থের উপরে পড়লে, ইলেক্ট্রন আর নাচে না, নাচের বদলে লাফ দিয়ে বস্তুর বাইরে চলে আসে। একে বলে ফটোইলেক্ট্রিক এফেক্ট। এর ব্যাখ্যা দিয়েই আমি নোবেল পুরস্কার পাই। ফোটন হলো আলোর কোয়ান্টাম রূপ। কোয়ান্টাম তত্ত্বকে আমি কখনোই ভালোবাসতে পারি নি, কিন্তু আলোর কোয়ান্টাম রূপের সন্ধান দিয়ে আমি কোয়ান্টাম তত্ত্বের গোড়াপত্তন করি। আমি আমার জীবনের পঞ্চাশ বছর কাটিয়েছি আলো কি তা ভেবে। আলোর বেগে চললে সময় এবং স্পেস অদৃশ্য হয়ে যায়, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ আলাদা করে চেনা যায় না, সীমা-অসীমের মাঝের বেড়াটি লোপ পায়! আলো নিয়ে একের পরে এক তত্ত্ব দিয়েছি- বিশেষ আপেক্ষিকতা, মহাকর্ষ, কোয়ান্টাম- তবুও আলোকে জানতে পারিনি। ‘আজকাল অনেক গর্দভ মনে করে যে ওরা আলোকে বোঝে, কিন্তু ওরা শুধুই নিজেদের সাথে ছলনা করছে।’