
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:
‘তোমরা দেখিয়া চুপি চুপি কথা কও,
সখীতে সখীতে হাসিয়া অধীর হও,
বসন-আঁচল বুকেতে টানিয়া লয়ে,
হেসে চলে যাও আশার অতীত হয়ে।
তোমরা কোথায় আমরা কোথায় আছি,
কোনো সুলগনে হবো না কি কাছাকাছি।’
লেখক : মেয়ে যদি হয় ঢেউ, পুরুষ হবে কণা! রবি ঠাকুর, তুমি কোয়ান্টাম রাজ্যে চলে এসো। এখানে অদ্ভুত সব কান্ড ঘটে। ঢেউ হয়ে যায় কণা, আর কণা হয়ে যায় ঢেউ! পদার্থ ঢেউয়ের মতো চলে, ধরতে গেলেই আবার পদার্থে পরিণত হয়। বলতে পারো কোয়ান্টাম রাজ্যে ছেলেরা আঁধার ঘরে মেয়ে হয়ে ঘুরে বেড়ায়, আলো জ্বালালেই আবার ছেলেতে পরিণত হয়! এই ঢেউ-কণার ধাঁধা থেকেই কোয়ান্টাম তত্ত্বের জন্ম।
ইয়াং: (Thomas Young, ১৭৭৩-১৮২৯): আলো যে ঢেউ তা আমি প্রথম নিশ্চিত ভাবে প্রমান করি। নিউটন আলোকে কণা হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন, তিনি বলেছিলেন, ‘জ্বলজ্বলে বস্তু থেকে ছড়িয়ে পড়া ছোট্ট ছোট্ট কণারা-ই কি আলো নয়?’ নিউটন, তুমি মহাবিজ্ঞানী, কিন্তু তুমি তো জানোই যে এসব মিষ্টি কথায় পদার্থবিদ্যার চিড়া ভেজে না, প্রমান দেখাতে হয়! তুমি কোনো প্রমান দিতে পারো নি। কণা এবং ঢেউ দুটোই এক স্থান থেকে আরেক স্থানে শক্তি বয়ে নিয়ে যায়। এটুকুই এদের মিল, বাঁকিটা শুধুই গরমিল। একটি মার্বেল কণার মতো, ওর ভর আছে, একটি নির্দিষ্ট আয়তন আছে। চলন্ত মার্বেলের ভরবেগ আছে, গতিশক্তি আছে। একদল মার্বেলের প্রতিটিকে আলাদা করে চেনা যায়। দুটি মার্বেলের সাথে আরো দুটি মার্বেল যোগ করলে চারটি মার্বেল পাওয়া যাবে। ওদের যোগফল কখনো শূন্য হবে না, তিনটে, একটি, বা সাতটি হবে না। খোলা জানলা তাগ করে মার্বেল ছুড়লে হয় সে জানলা দিয়ে বেরিয়ে যাবে, না হয় জানালার পাশের দেয়ালে লেগে ফিরে আসবে। বাঁধাকে পাশ কাটিয়ে, এড়িয়ে ওপারে চলে যাওয়ার কৌশল মার্বেল জানে না। ধরা যাক এই মার্বেলকে ভাঙা যায় না। তাহলে একটি মার্বেলের দলে দশটি বা এক’শ মার্বেল থাকতে পারে, কখনোই সাড়ে দশটি মার্বেল থাকতে পারে না।
এবারে ঢেউয়ের কথা বলা যাক। পুকুরের পানিতে ঢেউ উঠলে পানির অণুগুলো ওঠানামা করে, পানির ঢেউ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এক সেকেন্ডে অণুগুলো যতবার ওঠানামা করবে তাকে বলা হবে ঢেউয়ের কম্পাঙ্ক। পানির স্তর যে দূরত্বে ওঠানামা করে তাকে বলা হয় বিস্তার বা প্রসার (amplitude)। ঢেউয়ের পাশাপাশি দুটি উঁচু স্থানের মাঝের দূরত্বকে বলা হয় তরঙ্গদৈর্ঘ (wavelength)। তরঙ্গদৈর্ঘকে কম্পাঙ্ক দিয়ে গুন করলে ঢেউয়ের গতিবেগ পাওয়া যায়, কম্পাঙ্ক যত বেশি হবে ঢেউয়ের তরঙ্গদৈর্ঘ ততই ছোট হবে। কণাদের মতো ঢেউও শক্তি বয়ে নিয়ে যায়। ঢেউ যত উঁচুনিচু হবে, বিস্তার ততই বেশি হবে, ওর শক্তি হবে ততই বেশি। ঢেউয়ের শক্তি বিস্তারের বর্গের উপরে নির্ভর করে, কম্পনাংকের উপরে নয়! দুটি ঢেউ এক সাথে যোগ দিয়ে কোনো জায়গায় একটা বড় ঢেউ তৈরী করতে পারে, আবার কাটাকুটি করে কোনো জায়গায় শূন্য ঢেউ সৃষ্টি করতে পারে।
লেখক : ঢেউ বাধাকে পাশ কাটিয়ে চলতে পারে। শব্দ একধরণের ঢেউ। পাশের ঘরে কেউ ফিসফিসিয়ে কথা বললেও এ ঘর থেকে শোনা যায়। দরজার ফাঁক দিয়ে ঘুরেফিরে শব্দের ঢেউ এ ঘরে পৌঁছে যায়। পাশের ঘরে হাজারটা মার্বেল ছড়ালেও কোনো মার্বেল এ ঘরের নাগাল পাবে না। ঘুরে দাঁড়িয়ে বাধার ওপারে চলে যাওয়ার ক্ষমতাকে ঢেউয়ের অপবর্তন (diffration) বলে। সূর্যের আলোয় আপনার ছায়া পড়েছে। একটু ভালো করে ছায়ার কিনারা পরীক্ষা করে দেখুন। ছায়ার প্রান্তভাগ তীক্ষ্ণ (sharp) নয়। আলো একটু ঘুরে যেয়ে ছায়ার সীমানা অস্পষ্ট করে তুলেছে। বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমান বেশি হলে আকাশের সূর্য এবং পূর্ণ চাঁদের চারিদিকে গোলাকার ছায়া দেখা যেতে পারে। গ্রামের কৃষকের ভাষায় ‘চাঁদের সভা বসেছে!’ এসব কান্ড ঘটেছে আলোর অপবর্তনের কারণে।
পুকুরের মাঝে একসাথে দুই জায়গায় ঢিল ছোড়া যাক। দুটি স্থান থেকেই ঢেউ বৃত্তাকারে চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। একটু পরেই ওরা মিলেমিশে যাবে, একে ওপরের উপরে চড়াও হয়ে এক জটিল ঢেউয়ের সৃষ্টি করবে। এই ঢেউয়ের কোনো কোনো স্থানে আদি ঢেউ দুটো একসঙ্গে মিলে একটি বড় ঢেউ সৃষ্টি করেছে, কোনো স্থানে ওরা একে অপরকে ধ্বংস করে ফেলেছে। পানির ঢেউ না হয়ে আলোর ঢেউ হলে দেখা যেত এক স্থানে আলো, আরেক স্থানে আঁধার। পরপর আলো আঁধার দিয়ে সাজানো এই রূপটিকে ব্যতিচার (interference) প্যাটার্ন বলে।
ইয়াং: দুটো কণা একসাথে মিলে যেমন শূন্য কণা সৃষ্টি করতে পারে না, তেমনি একদল কণা একসাথে মিলে ব্যতিচার প্যাটার্ন তৈরী করতে পারে না। ১৮০১ সালে আলোর ব্যতিচার প্যাটার্ন তৈরী করে আমি প্রমান করেছিলাম যে আলো ঢেউ, কণা নয়। আরো একটি মজার ব্যাপার। দুটো আলোর শক্তির যোগফল সাধারণ গণিতের নিয়ম মানে না। এক আর এক যোগ করলে কখনো হয় চার, কখনো বা শূন্য, দুই হচ্ছে ওদের গড় যোগফলের পরিমান। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই : দুটো আলোর ঢেউ এক সাথে মিশলে ওদের বিস্তার যোগ হয়, কিন্তু শক্তি হলো বিস্তারের বর্গ।