Author Picture

প্রদীপের গল্প

কাউসার মাহমুদ

আজাদ খেজুরের খোঁজে একবার আমি বাগদাদে গিয়েছিলাম। লোকেরা তখন এক দুর্ভিক্ষের ব্যাপারে বলাবলি করছিল। ঈশ্বর জানেন, তা ছিল অনাবৃষ্টি, ক্ষুধা এবং মৃত্যুর একটি বছর (প্রার্থনা করি, প্রভু আমাদের সকলকে বাঁচিয়ে রাখুন)। কঠিন সে দুর্ভিক্ষ বজ্রের মত মরক্কোর প্রাচীনতম শহর; কায়রূয়ান, ফেস, গাফসা, সিজিলমসা ও মাহদিয়ার কোন একটিতে নেমে এসেছিল।

ভয়ানক সে দুর্ভিক্ষে ক্রমশ সমস্ত খাদ্য ফুরিয়ে যায়। ক্ষুধার যাতনা লাঘবে—ঘাস, পাতা ও নানাধরণের ছোট কাঁটাগাছের খোঁজে লোকেরা মরুভূমিতে নেমে আসে। কিন্তু তাও যখন শেষ হয় এবং একই সাথে তাদের সমস্ত আশা নিঃশেষ হয়ে যায়, তখন তারা মৃত্যুকেই জীবনের ওপর কামনা করে। (ঈশ্বর আমাদের ক্ষুধার প্রেতাত্মার নির্যাতন থেকে রক্ষা করুন) এই খরা ও অনাবৃষ্টি লাগাতার সাত বছর স্থায়ী হয়। এতে, দুর্বল, ক্ষীণকায় উটগুলো নতজানু হয়ে পড়ে। এতোটাই দুর্বল যে, পশুগুলো নিজের পিঠে নিজের কুঁজ বহন করতেই অক্ষম ছিল। হ্যাঁ, প্রভু বিশ্বাসীদের প্রতি দয়ালু! যদিও লোকেরা সবসময় সেই ভয়ানক তিমিরান্তিক বছরগুলোর কথা স্মরণ করতো; যা এক ধারাবাহিকতার ক্রম হিসেবে তাদের ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছিল। সেখান থেকেই তারা তাদের সমস্ত পালাপার্বণ, উৎসব ও ভোজপর্বের গণনা করতো।

তখন, সেখানের প্রাচীনতম শহরের একটিতে ভীষণ চতুর এক লোক বাস করতো। সুখ, সমৃদ্ধি ও নিরাপদ-নিশ্চিন্ত, আনন্দিত সময়ে তার জীবনযাপন। সে বিশ্বাস করে ‘চিত্তপ্রসাদ এক অনন্ত সম্পদ।’ আর গল্পটি এখান থেকেই শুরু হচ্ছে যে, লোকটি সেসময় দিনে আবু ইনায়া স্কুলের পাশে তার সুন্দর দোকানটিতে জুতো মেরামতের কাজ করতেন। আর রাতে স্ত্রী, পুত্র ও কন্যাদের সঙ্গে খোশগল্পে ব্যস্ত থাকতেন। যদিও কিছু লোকের দাবী, ‘না! তার দোকানটি বরং সায়্যীদ আল সাহিব প্রাসাদের নিকটে ছিল। এমনকি এখনও কারো কারো দাবী যে, ‘আসলে ওই দু’জায়গার কোথাও না। আসলে, দোকানটি ছিল আমীরুল মুমিনীন খলীফা ইসমাইল আল মানসুল আলশায়ী নির্মিত কালো ছাদের বিশাল প্রাসাদটির পাশে। (এ ব্যাপারে ঈশ্বরই ভালো জানেন)

সীমাহীন দুর্বলতায় উটগুলো নতজানু হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ছে তখন তার আত্মতৃপ্তির অনন্ত সম্পদের সে দৃঢ়মূল বিশ্বাস কোথায় যেন উড়ে যায়! তার সমস্ত প্রত্যয় তরঙ্গের মতো দুলতে থাকে এবং ধীরে ধীরে তা ম্লান হয়ে পড়ে। কিছু একটা আঁকড়ে থাকার সামান্য বস্তুও অবশিষ্ট থাকে না আর

যাহোক, সে এবং শহরের অন্যান্যদের জীবন এমন প্রাচুর্য ও তৃপ্তিতে পরিপূর্ণ ছিল— যা কখনোই মলিন হবার নয়। এমনকি গ্রীষ্মের কালো মেঘও তা সামান্য বিবর্ণ করতে পারে না। কিন্তু যখনই এই বিপর্যয়ের ডামাডোলে সে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যায় এবং চারপাশ থেকে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ ও সঙ্কট মুখ তেড়ে আসে, তখন তার আত্মতৃপ্ত হৃদয় ও চতুর মস্তিষ্ক তাকে পরিত্যগ করে। যখন সে দেখে, সীমাহীন দুর্বলতায় উটগুলো নতজানু হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ছে তখন তার আত্মতৃপ্তির অনন্ত সম্পদের সে দৃঢ়মূল বিশ্বাস কোথায় যেন উড়ে যায়! তার সমস্ত প্রত্যয় তরঙ্গের মতো দুলতে থাকে এবং ধীরে ধীরে তা ম্লান হয়ে পড়ে। কিছু একটা আঁকড়ে থাকার সামান্য বস্তুও অবশিষ্ট থাকে না আর। এতে, প্রবল ক্রোধ এবং জিঘাংসায় পতিত হয় সে।

বিড়বিড় করে বলে, যেভাবেই হোক, আমার পরিবারের জন্য খাবার সংগ্রহ করতে হবে। এর জন্য— চুরি, ডাকাতি, খুন যা করতে হয়; তাই করবো আমি। এই ভেবে, এক ভোরে একটি ছুরি নিয়ে সে তার ঘর ছেড়ে বেরোয় এবং বাড়ির নিকটবর্তী স্থানসমূহে হাঁটতে হাঁটতে গভীর মনোযোগে চারপাশ দেখতে থাকে। সেখানে শুধু কেবল একটি দৃশ্যই দেখতে পায় সে। তাহলো, রাস্তার ওপর ক্ষুধার্ত মানুষের মরদেহের স্তুপ। চারপাশে শকুনের দল উড়ছে। ওপরে গমগমে লাল সূর্যটি নীল আকাশ ছাপিয়ে আগুনের এক শিখা ধরে আছে—এর মাঝে হঠাৎই তীব্র লু-হাওয়ার ঝাপটা। কি বীভৎস দৃশ্য নিরন্ন দুর্বল মনুষ্যজাতের। দুঃখী মানুষ কাঁদে আর অশ্রুবর্ষণ করে।…

তাহলে! এই দৃশ্য দেখে লোকটি কি নিয়ে ঘরে ফিরেছিল? মোম? সে কি তার সন্তানদের জন্য মোম নিয়ে ঘরে ফিরেছিল? তাদের কি তা আপন মুখের ভেতর নিষ্পেষিত হয়ে নিঃশেষ হওয়া পর্যন্ত চিবানোর কথা ছিল? এই নির্যাতিত যুগের ওপর আল্লার অভিশাপ!

অগত্যা হতভাগ্য লোকটি সেই মক্ষিমল নিয়েই ঘরে ফেরে। এবং আশ্চর্য! নিক্ষেপ করার সাথে সাথেই বুভুক্ষু জিহ্বাগুলো দ্বারা তা ধৃত হয়। এরপর বিষন্ন মনে সে তার দোকানে যায়। একটি থলের ভেতর নিজের সমস্ত জিনিস পুরে নেয়। তা সমস্ত বলতে, ওই সামান্য
সুই-সুতো, ছুরি, কিছু পেরেক, একটি হাতুড়, এবং দেয়ালে ঝুলে থাকা ছোট্ট বাতিটা। সাকুল্যে এই সম্পদ নিয়ে সে তার দোকানের দরোজায় তালা মারে। পুনরায় এটিকে দেখে নিশ্চিন্ত হয়। আপনমনে বলে, ‘আমাকে এই জায়গা থেকে বেরুতে হবে এবং সুবিশাল এই পৃথিবী আবিষ্কার করতে হবে।’ যেমন কবি বলেছেন, ‘যেখানেই থাকি যেই পথে, যদি থাকতে পারি। আলেকজেন্দ্রিয়াও হতে পারে আমার বাড়ি।’

এরপর লোকটি তার মাতৃভূমি এবং পরিচিত প্রতিটি মানুষকে পরিত্যাগ করে তার অনির্ণেয় গন্তব্যে রওয়ানা হয়। গন্তব্যহীন এই ভ্রমণে কোন বিরাম নেই তার। রাতদিন লাগাতার চলছে তো চলছেই; এ যেন অনন্তকালের পথ! সপ্তাহর পর সপ্তাহ চলে যায়, মাসের পর মাস। কিন্তু নিজেই জানেনা কোথায় যাচ্ছে সে! কোথায় গিয়েই বা থামবে! অগুনতি গাছপালা, নানাজাতের ফুল-শস্য,গবাদি পশু, বিস্তৃত মরুভূমি, পতিত জমি ও অসংখ্য মরুদ্যান পেছনে ফেলে সে ছুটছে আর ছুটছে—এবং এভাবে সে নাকি একসময় অদৃশ্যই হয়ে যায়! তবে কতক গল্পকারের মতে, ‘লোকটি অবশ্য তার পেছনে গাদামিস শহরের দেয়াল দেখেছিল। যেখানে অন্যরা বলছে, ‘না! সে বরং স্বর্ণসড়কের ওপর তার ভ্রমণ অব্যাহত রেখেছিল।’ অথচ,গল্পকার আবু শুয়াইব মুহাম্মদ বিন সুলাইমান একরকম নিশ্চিত করেই বলছেন যে, ‘ক্ষুধা ও তৃষ্ণার যন্ত্রণায় মরুভূমিতেই মারা গিয়েছিল লোকটি।’ এদিকে আবার সাহিব আল তায়ের আল-বারাকাত বর্ণনা করেন যে,’ উপরিউক্ত বর্ণনার কোনটিই যথার্থ নয়, লোকটি বরং টিম্বুক্টু শহরের প্রধান দেয়ালের সদর দরোজায় একটা অজ্ঞাত পায়রা দ্বারা পরিলক্ষিত হয়েছিল। যাহোক, এই বিবিধ মত ও একটি দ্বিধামিশ্রিত ভ্রমের ভেতর এখনি আমরা গল্পের সমাপ্ত চাই না। আমরা অবশ্য অনুমান করতে পারি, ‘তীব্র ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও অবসাদ সত্ত্বেও লোকটি তার ভ্রমণ অব্যাহত রেখেছিল।’

অথচ, একইসাথে এ বড় আশ্চর্য ও বিপদসংকুল ঘটনা যে, অবশেষে কোন এক উজ্জ্বল স্বচ্ছ রাতে লোকটি হঠাৎই বিশাদঘেরা, আশ্রয়হীন মরুভূমি মাঝে লাল কাদামাটি নির্মিত একটি শহুরে দেয়ালের কাছে এসে পৌঁছে। দীর্ঘদিন অনুদ্দেশ যাত্রার পথ, খাঁ-খাঁ মরুভূমি মাঝে আচমকা এমন অস্বাভাবিক শহরের সাক্ষাৎ তাকে বেশ তাজ্জবই করে। সে আনন্দে উত্তেজিত হয়, কিন্ত একইসাথে এ ঘটনা আবার ভয়েরও ছিল। তবুও ভেবেচিন্তে অনিশ্চিত এক দ্বন্দ্বের ভেতর অজ্ঞাত শহরের দরোজায় কড়া নাড়ে সে। আর ভারি অবাক কাণ্ড হলো, এর কিছুক্ষণ পরেই একজন দারোয়ান বেরিয়ে এসে তাকে বলে, ‘টিম্বুক্টু শহরে তোমায় অভিবাদন। তুমি আমাদের সম্মানিত ভাইদের একজন।’

অজ্ঞাত শহর, বেশভূষা মলিন, ভিখিরির মত বিপর্যস্ত কোন পর্যটকের প্রতি এমন অভিবাদন—ভয়কে কিছুটা প্রশমিত করলেও তার সন্দেহ থেকে যায়। তবুও সন্দেহের এই দোলাচলেই—মলিন, শুষ্ক মুখাবয়ব ভেজানোর জন্য
দারোয়ানের কাছে সামান্য জল প্রার্থনা করে সে। জবাবে দারোয়ান বলে, ‘ও জল! আচ্ছা, শোনো তবে, ‘এই শহরে প্রবেশের একটি শর্ত হচ্ছে, আজ গোটা রাত তুমি এই দেয়ালের বাইরে কাটাবে। এবং ভোর নাগাদ, আমাদের মহামহিম সুলতানের উপহার নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করবে।’

এটুকু বলেই দারোয়ান অদৃশ্য হয়ে যায়। আর হতভাগ্য আগন্তুক পর্যটক রাতভর সেখানে একা বসে ভাবতে থাকে, ‘রাজাকে কি উপহার দেবে? তার থলেতে তো দেবার মতো কিছুই নেই।’ অভিসম্পাত এই নিষ্ঠুর, জালেম কালের ওপর!
এই দুর্ভাবনা ও হীনতর আসন্ন বিপর্যয়ের দৃশ্য চিন্তা করতে করতে কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়ে নিজেই টের পায়নি। অবশেষে, মুয়াজ্জিনের আজান যখন বিশ্বাসীদের ভোরের প্রার্থনার দিকে ডাকে, রাতের সেই দারোয়ান সদর দরোজার বাইরে এসে দ্রুত লোকটাকে জাগায়।(যদিও কিছুটা ইচ্ছে করেই সে খুব ধীরে জেগে ওঠে) তারপর প্রথম তাকে মসজিদে নিয়ে যায়। সেখানে সে অজুর মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করে এবং পর্যাপ্ত সময় ধরে রুকু-সেজদা পালনের মধ্য দিয়ে তার নামাজ আদায় করে। ওদিকে পাগলের মতো তার হৃৎস্পন্দন কাঁপছে এবং সমস্ত অস্থি ভারি হয়ে, প্রতিটি নাড়ি ড্রামের শব্দের মত ভেতরে নিনাদ করছে।

তাকে মসজিদে নিয়ে যায়। সেখানে সে অজুর মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করে এবং পর্যাপ্ত সময় ধরে রুকু-সেজদা পালনের মধ্য দিয়ে তার নামাজ আদায় করে। ওদিকে পাগলের মতো তার হৃৎস্পন্দন কাঁপছে এবং সমস্ত অস্থি ভারি হয়ে, প্রতিটি নাড়ি ড্রামের শব্দের মত ভেতরে নিনাদ করছে

নামাজ শেষে, দারোয়ান তাকে কিছু খেজুর ও সামান্য দুধ প্রদান করে। এগুলো খাওয়ার পর সে রাজপ্রাসাদের দিকে যাওয়ার অনুমতি পায়। তখন, এই ধীর অগ্রসরময়তা, দয়া, একধরনের ভদ্রতা ও নির্দয় আতিথিয়েতার ভেতর লোকটি নিজেকে একজন বন্দি অনুভব করে।

আর মনে মনে ভাবে, কিইবা উপঢৌকন দেবে সে সুলতানকে? এই হাতুড়ি? যেটা তিনি তার মাথায় মারবে। এই ছুড়ি? যা দিয়ে তিনি তাকে জবাই করবে। না, এই সেলাইয়ের সুই ! যেটা দিয়ে সে তার চোখের পাতা আর ঠোঁট সেলাই করে দেবে! নাকি এই সুতো দেবে? যা দিয়ে সে তাকে বাঁধবে! আর বলবে, ‘নচ্ছার কুকুর তুই! কি করে আমাকে এই তুচ্ছ দড়ি উপঢৌকন দেবার সাহস হলো তোর? যেখানে আমরা তোর সাথে একজন পরম অতিথির আচরণ করেছি এবং সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনে আমাদের মাথার ওপরে স্থান দিয়েছি। হতচ্ছাড়া, নরাধম কুকুর!’

এমন সব দুর্ভাবনার ভেতর লোকটি অনবরত মনেমনে জপতে থাকে, ‘আওযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম: (অভিশপ্ত শয়তান থেকে আমি আমার প্রতিপালকের আশ্রয় প্রার্থনা করি)। শেষাবধি প্রবল এক ভয় ও তীব্র আতঙ্ক নিয়ে নিজেকে সে সুলতানের সামনে আবিষ্কার করে। সে দেখে, অনুচর ও রাজ সভাসদবৃন্দ দ্বারা সুলতান পরিবেষ্টিত। তাকে দেখামাত্রই সুলতান তার আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। মেহমানকে অভর্থ্যনা জানাতে বেদী থেকে নেমে আসে। দু’হাত প্রশস্ত করে বলে, ‘স্বাগত! আমাদের সম্মানিত অতিথি।’ এই বলে সে তাকে হার্দিক আলিঙ্গন ও তার কপালে চুমু খেয়ে এমন মনোভাব প্রকাশ করে, যেন সে তার প্রিয় বন্ধু। বহুদিন যার সাথে দেখা নেই। এমনকি এরপর কুশল বিনিময় ও আলাপন পর্বে সে লোকটিকে তার সিংহাসনের পাশে বসায়। কিন্তু এদিকে তো তার অবস্থা বড় বেগতিক। ভয়, দ্বিধায় জড়োসড়ো সে শুধু কেবল শক্ত করে তার বুকের সাথে একমাত্র থলেটা চেপে আছে। যা অবশ্যই সুলতানের চোখ এড়ায়নি। ফলে, কথোপকথন মাঝে হঠাৎই বাদশাহ জিজ্ঞেস করে, ‘এটাই কি মহামূল্যবান সে উপঢৌকন যা তুমি তোমার ঝুলিতে নিয়ে এসেছো?’ সুলতানের আচমকা এ প্রশ্নের সাথে সাথেই তার সভাসদ ও পরিপার্শ্বের সমস্ত অনুচরবৃন্দ মুহূর্তে প্রবল নীরবতায় চলে যায়। এবং তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সুলতানের জন্য আনীত সে উপহার দেখতে ব্যাকুল হয়ে পড়ে।
লোকটি তখন বিড়বিড় করে বলে, ‘হ্যাঁ! প্রভু!
তার এই ক্ষীণ উত্তরে সুলতান আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। এবং ভীতসন্ত্রস্ত লোকটি তার মুণ্ডুখানা করাত-কলের তলে কল্পনা করতে করতে ধীরে থলের ভেতর থেকে বাতিটি বের করে সুলতানের হাতে দেয়।
সুলতান ভীষণ আশ্চর্য হয়ে ওটার দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ পর গম্ভীরস্বরে জিজ্ঞেস করে,’এটা কী?
এটা একটা বাতি—লোকটি কাচুমাচু করে জানায়।
সুলতান কিছুই বুঝতে পারে না। নির্বাক রাজামহাশয় তখন চুপচাপ ওটার দিকে একদৃষ্টে থাকিয়ে থাকে। যখন উপস্থিত সকলেই তাদের এই ক্ষুদ্র বস্তটিকে একনজর ভালোভাবে দেখার জন্য তাদের গলা বাড়িয়ে ধরে। অল্পক্ষণ পর সুলতান তার আশ্চর্য দ্বিগুণ করে পুনরায় বলে, ‘একটি বাতি?’
লোকটি ভীতস্বরে জবাব দেয়ে, ‘হ্যাঁ প্রভু! পিপা-নির্মাতা তৈরী একটি বাতি!’
এবার কিছুটা শীতল স্বরে সুলতান জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা! বাতি মানে কী?
অগত্যা লোকটি তখন মিনমিন করে সুলতানকে বুঝিয়ে বলে, ‘এটা তাম্র নির্মিত একটি বস্তু। সামান্য তৈল ও ক্ষুদ্র সলতের মাধ্যমে জ্বালানো হয়।’
‘কি কাজ হয় এতে?’—সুলতান জিজ্ঞেস করে।
‘এটি আলো দেয়, প্রভূ’—লোকটি মৃদুস্বরে জানায়।
এই শুনে সুলতান তার বিস্ময় বাড়িয়ে বলে, ‘সত্যিই এটি চাঁদ,সূর্যের মতো আলো দেয়?’
‘আজ্ঞে হ্যা, প্রভু! যখন সূর্য অদৃশ্য হয়ে যায় তখন এটি পৃথিবীকে আলো দেয়, এবং নিজে আঁধারের ভেতর লুকিয়ে থাকে।’
লোকটির এমন অদ্ভুত কথায় সুলতান যেন ভিরমি খায়! আশ্চর্য হয়ে কয়েক কদম পিছু হটে। কণ্ঠে রাজ্যের বিস্ময় ধরে বলে,’ তাহলে তো সূর্যের পক্ষ থেকে এ এক জীবন্ত কয়লা!’
লোকটি বিনীতভাবে বলে, ‘আপনি যা বলেন, প্রভূ!’
অতএব, পুনরায় সুলতান সেই বাতিটার ওপর তার গভীর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এবং চারপাশ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দীর্ঘক্ষণ দেখতে থাকে। এরপর কিছুটা অপ্রকৃতস্থের মতোই সে জিজ্ঞেস করে, ‘এটা কী এই মুহূর্তে আলো দিতে পারবে?’
নিজের জীবনের জন্য এ এক সুযোগ মনে করে, সুলতান বলা মাত্রই কি এক আশ্চর্য কুশলতায় যেন লোকটি তৎক্ষণাৎ সেটি প্রজ্বলিত করে! আর মুহূর্তের মধ্যেই ওটার আলোকরশ্মি হলঘরের বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। জাদুর মত এই অপ্রাকৃত দৃশ্যে সুলতান কেঁপে ওঠে। আনন্দে সে প্রায় মূর্ছা যায়। এদিকে তার সভাসদরাও উল্লাসে করতালি দেয় এবং হ্রেষাধ্বনি শুরু করে। এই অত্যাশ্চর্য বদান্যতার কারণে, তারা তাদের মহান প্রতিপালকের প্রশংসা করে।

শেষে, উল্লাসধ্বনি ও আনন্দের ফোয়ারা কিছুটা কমে আসলে, সুলতান লোকটিকে তার পাশে বসায় এবং বাতিটা তার প্রাসাদের প্রধান জানালা বরাবর স্থাপন করে। যে জানালা দিয়ে সোজা শহরের রাস্তা দেখা যায়। রাজ্যের লোকেরা তখন বাদশহার জানালায় আনোখা, প্রজ্বলিত এই বস্তুটি দেখে রাজার মহামূল্য উপহার সম্বন্ধে জানতে আগ্রহী হয়। তাদের ঔৎসুক্য দ্বিগুণ করতে সুলতান চিৎকার করে বলে, ‘এটি একটি বাতি।’
উৎসুক জনতা তখন আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। তাদের চোখ যেন অনন্তকাল সেই বাতির ওপরই সেঁটে থাকে। তারা আনমনেই ক্ষণেক্ষণে চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘বাতি দীর্ঘজীবী হোক, সুলতান দীর্ঘজীবী হোক। বাতি দীর্ঘজীবী হোক,সুলতান দীর্ঘজীবী হোক।’
এমন আনন্দঘন, অভূতপূর্ব পরিবেশে সুলতান তার অতিথির কপালে চুম্বন করে বলে, ‘আমরা বাতি সম্বন্ধে জানতাম না। তেমাকে ধন্যবাদ, হে আমাদের সম্মানিত অতিথি। আমরা এমন কিছু জানলাম যা আমাদের অজ্ঞাত ছিল। আসলে তুমি আমাদের অন্ধকারের ওপর আলো জ্বেলছ। তুমিই সূর্যকে আমাদের পৃথিবীতে নিয়ে এসেছ। তাই, এই অসামান্য অবদান ও অপার্থিব উপহারের কারণে আমি তোমাক মন্ত্রী বানাবো বলে স্থির করেছি।’

রাজার এমন অপ্রত্যাশিত প্রস্তুাবে লোকটি তখন বিহ্বলের মতো ঠায় বসে থাকে। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বড়ো আজ্ঞাবাহীর মতো নীচুস্বরে বলে, ‘প্রভূ! আমি নিতান্তই প্রভুভক্ত এক সাধারণ মানুষ। আমি শান্তি ও আনন্দ উপভোগ করি এবং সত্যিই জানি না কি করে একজন মহামান্য বাদশাহকে পরামর্শ দেব!’
না, ওতে কিচ্ছু হবে না। আমি যা বলেছি তাই। বাদশাহ দৃঢ়কণ্ঠে তার হুকুমের কথা জানায়।
এতে লোকটি পুনরায় আর্জি করে, ‘প্রভূ! আমি আপনার কাছে এই গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে মুক্তির সনির্বন্দ অনুরোধ জানাচ্ছি। আমি আপনার বিশ্বস্ত বন্ধু এবং অনুগত ভৃত্য হবো।’
বাদশাহ সোল্লাসে তার খুশি প্রকাশ করে বলে, ‘কি অদ্ভুত আনুগত্যপ্রবণ! সাবাশ!’ এই বলে, সে খাজাঞ্চিকে আসার নির্দেশ করে। যখন সে আসে তখন তারা তিনজন রাজভাণ্ডারে যায়। রাজা তার সুবিশাল ভাণ্ডার উন্মুক্ত করে লোকটিকে বলে, ‘তোমার যা ইচ্ছে এখান থেকে নাও এবং অবস্থার উন্নতি কর।’
লোকটি তখন দু’হাত ভরে বিবিধ রত্নমনি, হিরা, মুক্তা এবং প্রবলসদৃশ বহু মূল্যবান জিনিস যত পারা যায় তার থলেতে ভরে নেয়। রাজভাণ্ডার থেকে ফেরার পর, সবাইকে আশ্চর্য করে বাদশাহ টিম্বুকতু শহরের রাজ কাজিকে ডেকে আনার নির্দেশ দেয়। কাজি আসে। বাদশাহ তাকে বলে, আমি আমার মেয়ে জুবেইদার সঙ্গে আমার এই মহান অতিথি, অজ্ঞাত পর্যটকের বিবাহের মনস্থ করেছি। আমি চাই আপনি অতিদ্রুত এই বিবাহের কাজ সম্পন্ন করুন।’
নির্দেশ অনুযায়ী তড়িৎ বিবাহের কাজ সম্পন্ন হয়। বিবাহ উপলক্ষে বাদশাহ পর্যটককে স্বর্ণখচিত রেশম সুতোর জামা উপহার দেয় এবং তাকে সমস্ত সভাসদ ও অনুচরবৃন্দের উপস্থিতিতে রাজকন্যার কাছে নিয়ে যায়। কিন্তু যখনই লোকটি তার নববধুকে দেখে, সে ভাবে তার চোখ কোন ভ্রমে পড়ে গেছে। সে তার অতীত জীবনের সমস্ত স্মৃতি হাতড়িয়ে এই বিশ্বাসে উপনীত হয় যে, তার চোখ ইতঃপূর্বে এরচেয়ে রূপবতী কোন নারী দেখেনি। তখন সে মনেমনে এই প্রাচীন কবিতার পঙক্তিটি স্মরণ করে, ‘বর্ণিল সে রাত। জানজের সবচেয়ে রূপবতী নববধু আমার। হীরক দ্যুতি মেলে চোখের কোণে, গলায় জড়ানো আছে মুক্তোর হার।’

এদিকে বিবাহ চুক্তির সময়, তার এই বিশ্বাসকে আরো দৃঢ় করে কাজি তার স্বীকারোক্তি জানায়,’আল্লাহর কসম! যোবেইদার চেয়ে রূপসী, কোমল, সুগন্ধিময়, সূক্ষ্ম এবং একহারা কোন নারী আমি আমার জীবনে দেখিনি। সে যেন ঠিক মেস্ক-আম্বর। রেশম ও মখমল। যেন একটি ফুল ও জুঁই। ‘

বাদশাহর অনুমতি কামনা করে সে তার আপন মাতৃভূমিতে সফরের মনস্থ করেছিল। এতে বাদশাহও সায় দিয়েছিল। তখন সে তার এই যাত্রা উপলক্ষে উট, ঘোড়া, গাধা ও খচ্চর সমৃদ্ধ একটি ক্যারাভান প্রস্তত করে। এবং কাইরুয়ান থেকে উৎকৃষ্ট কম্বল,ইয়েমেন থেকে আঠা। নাইজেরিয়া থেকে সেগুন কাঠ। সুদান থেকে আম্বার

এরপর, লোকটি—বাদশাহ, তার সভাসদ ও সাধারণ মানুষের জন্য হাজার হাজার বাতি তৈরি করে। সেসব বাতি প্রাসাদ, মসজিদ, স্কুল, রাস্তা, চত্বর ও বাড়িসমূহে ঝুলিয়ে দেয়। এছাড়াও একহাজার কৃষ্ণাঙ্গকে শহরের সমস্ত বাসিন্দাদের রাতদিন স্নান করা পর্যন্ত বাতি প্রজ্বলনের কাজে নিযুক্ত করে। মোটকথা, সব মিলিয়ে আমাদের এই পর্যটক বেশ ক’বছর আরাম ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনকে উপভোগ করছিল(যদিও শুধুমাত্র ঈশ্বরই জানেন তা ঠিক কয় বছর ছিল)। তবে, যতদিন পর্যন্ত… হ্যাঁ, ঠিক যতদিন পর্যন্ত তার হৃদয় স্বদেশে ফেরার আকুল আকাঙ্ক্ষায় ব্যাথিত হয়ে উঠেছিল এবং তার সন্তান ও অন্যান্য পরিচিতদের দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল—ততদিন সে ভীষণ আনন্দেই দিনাতিপাত করছিল। এছাড়াও যখন সে অনুভব করেছিল, ইতোমধ্যে হয়তো সেই বীভৎস দুর্ভিক্ষের বছরগুলো কেটে গেছে। নিশ্চয় ভাগ্য ও প্রসন্নের বৎসর শুরু হয়ে গিয়েছে। তখন এসবের সম্ভাবনা ও আশীর্বাদ সঙ্গে নিয়ে বাদশাহর অনুমতি কামনা করে সে তার আপন মাতৃভূমিতে সফরের মনস্থ করেছিল। এতে বাদশাহও সায় দিয়েছিল। তখন সে তার এই যাত্রা উপলক্ষে উট, ঘোড়া, গাধা ও খচ্চর সমৃদ্ধ একটি ক্যারাভান প্রস্তত করে। এবং কাইরুয়ান থেকে উৎকৃষ্ট কম্বল, ইয়েমেন থেকে আঠা। নাইজেরিয়া থেকে সেগুন কাঠ। সুদান থেকে আম্বার। ঘানা থেকে গজদন্ত (হাতির দাত) ও অন্যান্য জাঁকাল অলঙ্কার সংগ্রহ করে। এরপর এসব সমেত টিম্বকতুর উজ্জ্বল আলোকরশ্মি পেছনে ফেলে, সর্বশক্তিমান মহান প্রভুর আশ্রয়ে সে তার মাতৃভূমির দিকে রওয়ানা করে। এবং খুব দ্রুতই ভ্রমণকারী মরুযাত্রীদলসহ আপন শহরে এসে পৌঁছে। কিন্তু অদ্ভুত কাণ্ড হলো, সে আসার সাথেসাথেই লোকেরা তার চারপাশে এসে তার সমস্ত সম্পদ দখলের জন্য ভিড় করতে থাকে। এবং মুহূর্তের মধ্যেই নিজেদের মাঝে বিবাদ ও দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। এমনকি তারা একে অপরকে হত্যা পর্যন্তও করতে থাকে। উচ্ছৃঙ্খল জনতা— উট, ঘোড়া গাধা ও খচ্চরের ওপর তাদের ছোঁড়া নিয়ে হামলে পড়ে এবং চোখের পলকেই এসব প্রাণি খেয়ে ফেলে। এমন অস্বাভাবিক অবস্থা দেখে, লোকটি
আশ্চর্য হয়ে এর কারণ অনুসন্ধান করে। এতে সে জানতে পারে, এই শহরের মানুষ বিগত প্রায় বিশ বছর যাবত কিছুই খেতে পায়নি।’
সব শুনে সে তার বিখ্যাত বাণী ও পুরনো ধিক্কার মনে করে, ‘এই নিষ্ঠুর অবিচার সময়ের ওপর অভিসম্পাত।’

সেই দাঙ্গা ও খুনোখুনির ভেতর নির্জীব, নিথর ব্যতিক্রম এক লোক বসে ছিল। নিষ্পলক সে এই ভয়াবহ চিত্রাবলি দেখছিল। কিছুক্ষণ পর সে পর্যটকের দিকে তাকায়। এবং তার অক্ষিপলক দ্রুতই এই ভয়াবহ দৃশ্য ও পর্যটকের মাঝে পরিবর্তিত হতে থাকে। পর্যটক তখনও তার উটের ওপরই ঠায় বসা ছিল এবং হতবিহ্বল হয়ে দেখছিল যে, পঙ্গপালের মতো কি করে চারপাশে মানবতা শক্ত জাঁতায় চূর্ণ হচ্ছে। যাহোক, অবশেষে নিশ্চল সে লোকটি দাঁড়ায় এবং পর্যটককে অভিবাদন জানায়। সে বলে, ‘আমি তোমাকে চিনি। তুমি মুচির কাজ করতে। এবং মৌলভি মুহাম্মদ আল দাখিল মঠের পাশেই তোমার দোকান। তার উল্টো পাশেই আমার দোকান ছিল। আমিও জুতো মেরামত করতাম। আমার দোকান মৌলভী মুহাম্মদ আল খারিজ মঠের পাশে ছিল। নিশ্চয়, এখন তুমি আমায় চিনতে পারছো! তা ভাই সত্যি করে বলো তো, কীভাবে তুমি এই অগাধ সম্পদ অর্জন করলে? কি করে তুমি এর মালিক হলে? অথচ, যেদিন থেকে বাজারে তোমার প্রতিবেশী হলাম, সেদিন থেকে আমরা একই ব্যবসাই করতাম। তাছাড়া তোমার ওই পেশার শুরু দিন থেকেই তোমার সহচর বা প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম! তাহলে, তুমি এসব অর্জন করলে কিভাবে? প্রকৃত, এসব অমূল্য জিনিস অন্বেষণ ও লাভের জন্য কোন দেশ সফর করেছো তুমি? আমাকে বলো ভাই! বিশ্বাস করো, রুটি ও গোশতের জন্য ব্যগ্র হয়ে আছি আমি। রেশম, নারী, সোনা, প্রশান্তি ও সুন্দর সুখস্বপ্নের জন্য বিভোর হয়ে আছি। এই দুঃখ, বিষাদ, হতাশা ও নিষ্ঠুর অবিচারের কাল থেকে আমায় রক্ষা করো।’

তার এমন কাকুতি শুনে, পর্যটক লোকটি তাকে দেশ ত্যাগের পরামর্শ দেয়। সে বলে, ‘এই দেশ পরিত্যাগ করো বন্ধু! এবং এ পথের শেষতক অনুসরণ করো। পথের শেষে, সেখানে তুমি একটি শহর খুঁজে পাবে। সে শহরের সুলতানের জন্য যেকোনো একটি উপহারের শর্তে শহরের ভেতর প্রবেশ করতে পারবে। আর আশ্চর্য হলো, তারা এর জন্য তোমাকে পুরস্কৃত করবে।’

পরামর্শ মতে, সে-ও সুন্দর জীবন, রুটি, মাংস, রেশম, নারী, শান্তি ও সুখস্বপ্নের বাসনায় তার দেশ ত্যাগ করে। এবং একাধারে ভ্রমণ করে যায়। বহু উপত্যকা পাড়ি দিয়ে অবশেষে এক উজ্জ্বল রাতে লাল মাটি নির্মিত সে শহরে এসে উপস্থিত হয়। যা হঠাৎই পূর্বের মতোই মরুভূমি মাঝে ফুটে উঠেছে। সে তার প্রধান দরোজায় কড়া নাড়লে, একজন দারোয়ান এসে তাকে অভিবাদন জানায়। এবং রাতটি দরোজার বাইরে কাটাতে বলে অদৃশ্য হয়ে যায়। পরবর্তী সকালে এসে তাকে জাগিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আমাদের মহামান্য সুলতানের জন্য কোনো উপহার এনেছো কী?
লোকটি তৎক্ষণাৎ উত্তর দেয়, ‘হ্যাঁ! এই ব্যাগের ভেতর আমি একটি উপহার নিয়ে এসেছি।

এরপর সামান্য কথোপকথন শেষে, লোকটি দ্রুত পবিত্র হয়ে তার নামাজ শেষ করে এবং তড়িৎ প্রাসাদের অভিমুখী হয়। বাদশাহ ও তার অনুচরদের সাক্ষাতে তাড়াহুড়ো করতে থাকে। যখন সে সুলতানের সামনে আসে, দ্রুত নতজানু হয়ে নিজেকে ভূপতিত করে বাদশাহর সামনের জমিনে চুম্বন করে। কিন্তু সে তার চোখ উঠিয়ে বাদশাহর খালি পা দেখতে পায়। একইসাথে সমস্ত সভাসদবৃন্দেরও। এমনকি দারোয়ানটি পর্যন্ত যে তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। অগত্যা, মৃদু এক দ্বিধা নিয়ে সে জমিন থেকে উঠে দাঁড়ায় এবং থলে থেকে অতীব চমৎকার ও সর্বোৎকৃষ্ট একজোড়া চপ্পল বের করে। যা ‘ফাস’ শহর সৃষ্টির পর থেকে আজ পর্যন্ত সর্বোৎকৃষ্ট, সুন্দর ও উন্নত করে তৈরি করা হয়েছে।

বাদশাহ জিজ্ঞেস করে, ‘আশ্চর্য! কি এটা?’
আপনার জন্য আনীত উপহার ‘একজোড়া চপ্পল’—প্রভূ!
কি হয় এ দিয়ে—বাদশাহ পুনরায় প্রশ্ন করে।
পায়ে দেয়া হয়—লোকটি উত্তর দেয়। এবং চপ্পলখানা পরিধান করে কয়েক কদম হেঁটে সামনে এগোয়। এতে বাদশাহ ভীষণ আনন্দিত হয় এবং সমস্ত সভাসদ তার বিস্তর প্রশংসা করে। তারা সমস্বরে বলে ওঠে, ‘চপ্পল দীর্ঘজীবী হোক। বাদশাহ দীর্ঘজীবী হোক। চপ্পল দীর্ঘজীবী হোক। বাদশাহ দীর্ঘজীবী হোক।’
তাদের হ্রেষাধ্বনি থামলে, বাদশাহ তার সিংহাসন ছেড়ে এসে লোকটিকে বলেন, ‘সত্যিই খুব চমৎকার একটি উপঢৌকন উপহার দিয়েছো। এবং শ্রেষ্ঠ কোন পুরস্কারের যোগ্য এটি।’
এই বলে, বাদশাহ তার খাজাঞ্চিকে ডাকে। সে আসলে, বাদশাহ তাকে বলে, ‘যেখান থেকে এসেছো ফিরে যাও।’
এতে সভাসদবৃন্দ যারপরনাই আশ্চর্য হন। বাদশাহ তখন তাদের আশ্চর্যধরা মুখের ওপর বলেন, ‘এই অজ্ঞাত পর্যটক অর্থের চেয়ে প্রকৃত কোন মূল্যবান পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য।’
এরপর সে আগন্তক লোকটির দিকে ফিরে বলেন, ‘হে আমার সম্মানিত অতিথি! দয়া করে আপনি আপনার অক্ষিযুগল এই ছাদের দিকে উঁচু করুন।
লোকটি নম্রভাবে তার মাথা উত্তোলন করে।
বাদশাহ জিজ্ঞেস করে, কি দেখতে পাচ্ছেন?
একটি বাতি—লোকটি দ্বিধামিশ্রিত কন্ঠে জানায়।
‘আপনার উপহারের বিনিময় দেখুন।’


প্রদীপের গল্প
মূল: ইয্-আল দ্বীন আল-মাদানী ।। রূপান্তর : কাউসার মাহমুদ

লেখক পরিচিতি: ১৯৩৮ সালে তিউনিসিয়ায় জন্ম নেয়া ইয্-আল দ্বীন আল- মাদানী আধুনিক আরব সাহিত্যে এক উজ্জ্বলতম ব্যক্তিত্ব। সাহিত্যের বিবিধ শাখায় বহুপ্রজ এই গুণী লেখক তিউনিসিয়ার শিল্পসাহিত্যের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য নাম। সাহিত্যের নানা ক্ষেত্রে যিনি তার ভ্রমণ অব্যাহত রেখেছেন। উপন্যাস, ছোটগল্প ও নাট্য রচনার পাশাপাশি একজন সাহিত্য সমালোচক হিসেবে সর্বদাই অগ্রগণ্য আছেন মাদানী। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এ লেখক একসময় তিউনিসিয়ার সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের বিশেষ উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন। এছাড়াও দেশটির বেশ কিছু জাতীয় দৈনিক ও ম্যাগাজিনের প্রধান সম্পাদক হিসেবে তিনি তার চিন্তা ও সুসংগঠিত কাজের জ্যোতির্ময় প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তিনি ২০০৬ সালে দোহায় আয়োজিত কাতার কালচারাল ফেস্টিভ্যালে তার সমৃদ্ধ নাট্যসমগ্রের জন্য ‘থিয়েটার প্রাইজ’ লাভ করেন।

আল মাদানীর বিখ্যাত ‘হেকায়াতুল কিন্দিল’ বা প্রদীপের গল্পটি—রোনাক হুসনি ও ড্যানিয়েল নিউম্যান সম্পাদিত ‘আধুনিক আরবী গল্পসমগ্র’ থেকে নেয়া হয়েছে। বইটি ২০০৮ সালে প্রকাশিত হয়।

আরো পড়তে পারেন

শেষ বিকেলের অতিথি

আজ চন্দ্রার কথা মনে পড়তেই ছল ছল চোখে অশ্রুবিন্দু ঝড়ছে। তার অভিমানের শেষ আকুতি মনের মধ্যে বারবার ধাক্কা দেয়। তার প্রস্থান শেষ পর্যন্ত এতো কঠিন হবে বুঝতে পারিনি। আগেও চন্দ্রার সাথে হয়েছে অভিমানের খুনসুটি। নিজেকে মেঘের আড়ালে ঢাকতে চেয়েছে, কিন্তু সে মানাভিমান ক্ষণিকেই ইতি ঘটে গেছে। জোছনা হয়ে সে ধরা দিয়েছে। খুব ছোট্ট বিষয় নিয়ে….

স্মৃতি এখন কী করবে

জেলখানা থেকে বেরিয়ে স্মৃতি বাসে চড়ে বসে। সঙ্গে ওর মেয়ে ফাতেমা। বেশিক্ষণ কথা বলতে পারেনি হায়দারের সঙ্গে। শুধুই চোখ বেয়ে পানি পড়েছে। ফাতেমাও ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে। আর হয়তো দেখা হবে না বাবার সঙ্গে। হায়দারের চোখও ভেজা ছিল। আজই হয়তো ওদের শেষ দেখা। হায়দার বারবার স্মৃতির হাত ধরে অনুরোধ করেছে ওকে ক্ষমা করে দিতে।….

ইন্টারভিউ

কত দিন পর দেখা হলো রূপার সঙ্গে। তা মনে করতে পারছি না। চোখে চোখ পড়তেই কিছুটা থমকে গেলাম। চিন চিন করে উঠল বুকের ভেতর। ভেতর-বাইর শুরু হলো জ্বলন-পোড়ন। কথা বলব কি-না তা বুঝে ওঠার আগেই সে এলো এগিয়ে। আমাকে বলল, সায়েম তুমি এখানে? আমার ইন্টারভিউ আজ। তোমারও কি তাই? হ্যাঁ। আমারও তাই। কেমন আছ তুমি?….

error: Content is protected !!