Author Picture

ঈশ্বর, মানুষ, ছায়া কণিকা, এবং প্রতিসমতা

খন্দকার রেজাউল করিম

আমার বাড়ির পাশে আরশি নগর, সেথায় এক পড়শী বসত করে,
আমি একদিনও হায়, না দেখিলাম তারে।
পড়শী যদি আমায় ছুঁতো, আমার জম-যাতনা যেত দূরে,
সে আর লালন একখানে রয়, তবু লক্ষ যোজন ফাঁক রে।
লালন (Lalon Fakir, ১৭৭২-১৮৯০)


কেপলার: ‘যুদ্ধের দেবতারা খেঁকী কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করছে, দামামা বাজছে, চারদিকে হ্রেষাধ্বনি। এই বিভিৎস চিৎকারকে ছাপিয়ে আমার কানে ভেসে আসে মহাবিশ্বের গোপন তান, আমার তৃষিত আঁখি খোঁজে প্রকৃতির প্রতিসমতা (symmetry)।’

ফ্যাবিওলা (Fabiola Gianotti, ১৯৬০): আমি একজন মহিলা পদার্থবিদ, বর্তমানে CERN এর মহাপরিচালক। ‘লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে আমরা এখন খুঁজছি ছায়া পদার্থ (dark matter), প্রতিপদার্থ (antimatter), এবং পদার্থ-সমতা।’

এমি (Amy Poehler, ১৯৭১) : আমি একজন মার্কিন অভিনেত্রী এবং লেখক। আমার ধারণা, ‘প্রতিসমতা প্রীতিকর কিন্তু সেক্সি নয়। আইনস্টাইন দারুন, কিন্তু পিকাসো আমার মনের কথা জানে।’

লেখক : ‘সুন্দর’ এবং ‘সেক্সি’ দুটোই প্রতিসমতার সাথে জড়িত, পিকাসোর ছবিতে আমি দুটোই দেখেছি। সৌন্দর্য হলো প্রতিসমতা, সেক্সি হলো ভাঙা-সমতা (broken-symmetry), প্রকৃতিতে দুটোই খুঁজে পাওয়া যায়। ভাঙা-সমতা পিকাসোর ‘গুয়েরনিকা’ ছবির মতো যন্ত্রনাময় হতে পারে, যেন নিঃশব্দ চিৎকারে কেউ তার কষ্টের কথা জানাচ্ছে। আবার ভাঙা-সমতা সেক্সি হতে পারে, দৃষ্টি-কাড়া হতে পারে, যেমন এক আধুনিকার কালো চুলের মাঝে ভিন্ন কিছু রঙের মিশ্রণ, যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে তিনি আমাদের কিছু দেখাতে চান!

ফ্যাবিওলা: ছায়া পদার্থের হদিশ পেতে আইনস্টাইন এবং পিকাসো দুজনেরই প্রয়োজন হতে পারে। মাটির তলে, পাতালপুরীতে, আকাশের কোনে খোঁজ চলেছে আজ ষাট বছর হলো। ওরা সবখানেই আছে, কিন্তু দেখা মিলছে না।

রবীন্দ্রনাথ: ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে।’

লেখক : নয়ন দিয়ে কাজ হবে না। একদল বিজ্ঞানী পাতালপুরীতে বসে আছে বিশাল তরল জিনন গ্যাসের ট্যাঙ্ক নিয়ে, আরেকদল টেলিস্কোপ নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু কি খোঁজা হচ্ছে তা কেউ জানে না। ধরুন সমুদ্রে এক অচেনা মাছ ধরতে গেছেন, ও তিমি মাছ না পুটি মাছ জানা নেই, কি ধরণের জাল, কি ধরণের টোপ বা কি ধরণের বড়শি ব্যবহার করবেন? হয়তোবা মাছ নয়, ও হয়তো পাখি, বা বৃক্ষ, বা পশু। হয়তো ছায়া কণিকা আমাদের মহাবিশ্বের অধিবাসী নয়, হয়তো ওরা থাকে অন্য এক সমান্তরাল মহাবিশ্বে! আঁধার ঘরে এক কালো বিড়াল খোঁজার মতো, যে বিড়াল ঘরের বাইরে বসে আছে!

আইনস্টাইন: সবকিছু যখন আঁধারে ঢাকা দেখি তখন দিশেহারা না হয়ে আমি তাকাই নিজের অন্তরের পানে, সেখানকার সত্যই আমাকে পথ দেখায়। এই মহাবিশ্ব যে মহাশিল্পীর ছবি তিনি পিকাসোকেও গড়েছেন, তাঁর ছবিতে আমি পরিপূর্ণ প্রতিসমতা আশা করি। কোনোখানে ভাঙা সমতা দেখলে তার কারণটা সবার আগে খুঁজে বের করতে হবে। হয়তো ঈশ্বর চোখে আঙ্গুল দিয়ে কিছু দেখাতে চাচ্ছেন।

ফাইনম্যান (Richard Feynman, ১৯১৮-১৯৮৮): আইনস্টাইন ভাগ্যবান ঈশ্বর-বিশ্বাসী লোক, আমি এক দুর্ভাগা অজ্ঞাবাদী, আমাকে আবার খুঁজে বের করতে হবে প্রতিসমতা কোথা থেকে আসে! ‘প্রকৃতি কেন প্রতিসমতা পছন্দ করে? উত্তরটা আমার জানা নেই!’

লেখক : তুমি সোজা ভাষায় কথা বলো, ‘জানি না’, বলতে তোমাকে কখনো সংকোচ করতে দেখি নি, তাই তো তোমাকে আমার এতো ভালো লাগে। আরেক দল পন্ডিতের কথা জানি যারা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এই সব প্রশ্নের জবাব দিতে চায়। এ ধরণের প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই, বা যে উত্তরগুলি আছে (anthropic argument), সে সব বিশ্বাস করার চেয়ে ঈশ্বরে বিশ্বাস করা অনেক সহজ। আমার ঈশ্বর-বিশ্বাসের প্রধান কারণ তো ওটাই। মহাবিশ্বের রীতিনীতি ফুলের মতই সুন্দর, সূক্ষ্ম, পরিমিত, মধুময়!

রবীন্দ্রনাথ: ‘ফুল বলে, ধন্য আমি মাটির কোলে।’ স্রষ্ঠার হাতে অঢেল সময়। কত যুগ ধরে তিনি একটি ফুলকে সুন্দর করেছেন, ওর রঙিন পাপড়িগুলো মনের মতো করে সাজিয়েছেন, পরাগগুলি সুগন্ধে ভরে দিয়েছেন, ওকে দিয়েছেন গোলাকার প্রতিসমতা, ওর বুকে ঢেলেছেন মধু। শুনেছি, ‘প্রতিসমতার স্বাদ মিষ্টি।’

লেখক : বঙ্কিমচন্দ্রের সাবধানবাণী মনে রাখা দরকার, ‘পুষ্পে কীট আছে, লতাগুল্মে কণ্টক আছে, মনুষ্যহৃদয়ে শঠতা আছে। ফুল সুন্দর কিন্তু মানুষ এতো নোংরা কেন? দুটোই তো ঈশ্বরের সৃষ্টি! ফেরেশতারা সর্বদা আল্লাহর প্রশংসায় মশগুল, আল্লাহর কোনো ইচ্ছার বিরোধিতা করা ওদের স্বভাব নয়। কোরান শরীফে পড়েছি যে মানুষ সৃষ্টির সময় ফেরেশতারা প্রশ্ন করেছিল। মানুষের মতো এমন নোংরা জীব সৃষ্টি করার কি প্রয়োজন যারা পৃথিবীর বুকে দুর্নীতি, অত্যাচার, রক্ত, এবং অশ্রু-জলের প্লাবন বইয়ে দিবে? উত্তরে আল্লাহ বলেছিলেন, ‘আমি যা জানি, তোমরা তা জানো না (কোরান, ২:৩০)। সেই না-জানা কথাটি জানার আশায় কোরানের প্রতিটি পাতা ব্যাকুল আগ্রহে আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি।

রবীন্দ্রনাথ: দয়াময় ঈশ্বরের গড়া মানুষ কেন এমন দয়াহীন তা নিয়ে আমিও অনেক ভেবেছি। তবে মানুষের অপকর্মের দায়ভার মানুষের না ঈশ্বরের? মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আছে, ফুলের নেই! ফুল ধূলিতে জন্ম নিয়েছে, কিন্তু ওর অন্তরে তো ধূলি লাগেনি! মানুষ মায়ের কোলে জন্মেছে ধূলিশূন্য অবস্থায়, তারপরে স্বেচ্ছায় সারাজীবন ধূলি কুড়িয়ে বেড়িয়েছে।

অস্কার ওয়াইল্ড (Oscar Wilde, ১৮৫৪-১৯০০) : ‘I think God, in creating man, somewhat overestimated his ability.’

ফ্যাবিওলা: মানুষের পাপ-পুণ্যের রহস্য নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় আমার নেই। আমিও ঈশ্বরে বিশ্বাস করি, তবে আমার মতে ধর্ম এবং বিজ্ঞান দুটি আলাদা প্রশ্নের উত্তর। ধর্ম এবং বিজ্ঞানকে আলাদা করে রাখাই ভালো। মানুষের কথা থাক, আমার এখনকার দায়িত্ব লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে শক্তি থেকে ছায়া কণিকা বানানো, তারপরে কোটি কোটি কণার ভিড়ে ওদেরকে চিনে নেয়া। আইনস্টাইন, সবাই তোমাকে জিনিয়াস বলে, আমাকে একটা উপায় বাতলে দাও।

আইনস্টাইন: বাংলার লালন ফকির এবং কেপলারের কথাগুলো একটু মন দিয়ে শোনো। একটা শিশু ছবিতে কি খোঁজে ? প্রতিসমতা! আমরাও তাই করি। ‘বিশৃঙ্খলতার মাঝে আমি সহজ কিছু দেখতে চাই, হট্টগোলের মাঝে সুর খুঁজে পেতে চাই। আমি জিনিয়াস নই, আমি শুধুই একজন কৌতূহলী লোক। আমি অনেক প্রশ্ন করি। যখন উত্তরটা খুব সহজ মনে হয় তখন বুঝি ঈশ্বর নিজেই আমার প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন।’

আরো পড়তে পারেন

বাঙালি মনীষীদের চা প্রীতি-অপ্রীতি

প্রাথমিক পর্যায়ে ভারতবর্ষে চায়ের বিপণন ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং। ক্রেতাদের চামুখী করার জন্য কোম্পানিগুলোর নানামুখী তৎপরতা ছিল উল্লেখ করার মতো। তারা এ কাজে বাহারি বিজ্ঞাপন ছাড়াও নানাবিধ বিনিয়োগের মাধ্যমে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের মানুষদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করত। তবে শুরুতে চরম প্রতিকূল পরিবেশের সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাদের। বৈরী এ পরিবেশ তৈরিতে সর্বতো সহযোগিতা ছিল যার, তিনি হলেন প্রখ্যাত….

ইয়ে থেকে বিয়ে

জগতের বেশিরভাগ বিয়ে প্রথমে হয় দুটো পরিবারের মধ্যে। তারপর সর্ম্পক হয় দুটো মানুষে। এটাকেই লোকে এখন বলে এরেঞ্জড ম্যারেজ। আদি কাল থেকেই এটা হয়ে আসছিল, এখনও বেশিরভাগ বিয়েগুলো পারিবারিক সম্মতি ও সর্ম্পকে হয়। বিয়েতে সর্ম্পক হয় না, সর্ম্পক গড়ে। প্রেমে সর্ম্পক গড়ে ওঠে। আধুনিক প্রেমের বিয়ে যতটা সিনেমা গল্পে হয়, বাস্তবে ঠিক ততটা নয়।  বিয়ের….

আর্কটিক থেকে উপসাগর পর্যন্ত: কানাডা ও বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিপূর্ণ হুমকি

এটি শুধু একটি ভৌগলিক বা স্থানিক ব্যাপ্তির  বর্ণনা নয় , যা আর্কটিক অঞ্চল থেকে উপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ভ্রমণ বা পরিসরের পরামর্শ দেয়। আর্কটিক বলতে পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তরের অংশকে বোঝায়, যা আর্কটিক মহাসাগর এবং আশেপাশের ল্যান্ডস্ক্যাপ জুড়ে রয়েছে। অন্যদিকে উপসাগর জলের শুধু একটি অংশ নয় যা ভূমি দ্বারা আংশিকভাবে ঘেরা ও একটি প্রশস্ত মুখ দিয়ে সামনে….

error: Content is protected !!