
সত্যেন্দ্রনাথ বসু (১৮৯৪-১৯৭৪) : আমি কোলকাতার ছেলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছি দীর্ঘদিন। ওখানকার পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে আমার সম্মানে বসু-কেদারা (Bose-chair) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ভারত সরকার আমাকে দিয়েছে পদ্মবিভূষণ সন্মান।
লেখক : তোমাকে নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ নেই। মহাবিশ্বের কণাদের দুই ভাগে ভাগ করা হয় : বোসন এবং ফার্মিয়ন। পদার্থবিদ ডিরাক এই বোসন নামটি তোমার সম্মানে জুড়ে দিয়েছিলেন। তাপমাত্রা শূন্য কেলভিনের কাছে গেলে এক দল বোসন কণা কেমন মোহিনী রুপ ধারণ করতে পারে তুমি তার ভবিষ্যৎবাণী করেছিলে ১৯২৫ সালে। কোটি কোটি পরমাণু শুধু একটি কোয়ান্টাম ঘরে ঢুকে পড়বে, ওদের পরিচয় যাবে মুছে, ওরা ঢেউ হয়ে একে অপরের মাঝে হারিয়ে যাবে! পদার্থের এই নতুন রূপের নাম বোস-আইনস্টাইন ঘনায়ন (Bose-Einstein condensate)।
লর্ড কেলভিন (Lord Kelvin, ১৮২৪-১৯০৭): আমিই প্রথম অংক কষে সবচেয়ে কম তাপমাত্রা -২৭৩.১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কথা বলি। আমার সম্মানে এই তাপমাত্রাকে শূন্য কেলভিন (০ ক) বলা হয়ে থাকে। আদর্শ বায়ুর সূত্র অনুসারে আয়তন সমান রেখে তাপমাত্রা কমাতে থাকলে বায়ুর চাপ কমতে থাকে। এ থেকে গ্রাফ এঁকে শূন্য কেলভিন তাপমাত্রার খোঁজ মেলে। শূন্য কেলভিন তাপমাত্রায় চাপ শূন্য হয়ে যাওয়ার কথা! তবে শূন্য কেলভিনে পৌঁছানোর অনেক আগেই সব গ্যাস তরল হয়ে যায়, শুধু হীলিয়াম্ চার কেলভিন পর্যন্ত গ্যাস হিসেবে টিকে থাকে। নক্ষত্রগুলো বাদ দিলে মহাবিশ্বের আর সব স্থান বেজায় ঠান্ডা, প্রায় -২৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৩ ক)। সূর্য নামে এক নক্ষত্রের প্রতিবেশী বলে পৃথিবীর তাপমাত্রা অনেক সহনীয়। বিষুবরেখার আশেপাশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৫৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ওদিকে মেরু অঞ্চলের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা -৯০ ডিগ্রি। এই পরিমিত তামাত্রার কারণে প্রাণের বিকাশ হয়েছে এখানে।
লেখক : এক ফোঁটা পানির কথা ধরা যাক। ওর আকৃতি শুরুতে হবে প্রায় গোলাকার। পানির অণুগুলো ক্রমাগত ঝাঁকাঝাঁকি, নড়াচড়া করছে। এই গতিকেই আমরা তাপমাত্রা বলি। আগে মনে করা হতো যে শূন্য কেলভিন তাপমাত্রায় সব নড়াচড়ার অবসান হবে। কোয়ান্টাম অনিশ্চয়তা তত্ত্বের মতে নড়াচড়া না করে অস্তিত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয়, তাই শূন্য কেলভিনও কিছু ঝাঁকাঝাঁকি চলতেই থাকবে! পানির অণুগুলি একে অপরকে আকর্ষণ করে, কেউ একা থাকতে চায় না। যে অণুগুলো পানির ফোঁটার পৃষ্টদেশে আছে তারা চাচ্ছে আর সব অনুর ভিড় ঢেলে ফোঁটার কেন্দ্রের দিকে যেতে, ওখানেই সবচেয়ে বেশি “গুষ্টি-সুখ” পাওয়া যাবে! ভেতরে অণুগুলো যায়গা ছাড়তে চায় না। এই সব টানাটানির ফলে পানির ফোঁটাটা অনেকটা গোলাকার আকার ধারণ করে আছে। তবে খুব বেশি ক্ষণের জন্যে নয়। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ফোঁটার সব অনুকে পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে টানছে। অনেক অনু আবার ঝাঁকাঝাঁকির কারণে ফোঁটা থেকে বাতাসে লাফ দিচ্ছে। বাতাসের অণুগুলোও বসে নেই, ওরা এসে ধাক্কা খাচ্ছে পানির ফোঁটার সাথে। বেজায় গোলমেলে সব ব্যাপার চলছে এই এক ফোঁটা পানিকে ঘিরে।
লর্ড কেলভিন: তাপমাত্রা কমালে অণুগুলোর ঝাঁকাঝাঁকি কমতে থাকবে। শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস (২৭৩ ক) তাপমাত্রায় তরল পানি কঠিন বস্তুতে (বরফ) পরিণত হবে। তাপমাত্রা ক্রমাগত কমাতে থাকলে বস্তু গ্যাস থেকে তরল হয়, তারপরে হয়ে যায় কঠিন। বোস-আইনস্টাইন ঘনায়ন রূপে যাওয়ার অনেক আগেই পদার্থের এই কঠিন রূপে আত্মপ্রকাশ ঘনায়ন তৈরির কাজে অন্যতম বাধা।
লেখক : সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা হবে যখন বস্তুর কণাগুলো প্রায় আলোর বেগে ছোটাছুটি করে। এমনটি ছিল মহাবিশ্বের জন্মলগ্নে। কোটি কোটি কোটি কোটি কোটি ডিগ্রি তাপমাত্রায় মহাবিশ্ব শুরুতে ছিল কোয়ার্ক-গ্লুওন প্লাাসমা দশায়। তিন হাজার ডিগ্রিতে ইলেক্ট্রন, নিউট্রন, এবং প্রোটন মিলে শুরু হয় পরমাণুর ঘর-সংসার। পঞ্চাশ ডিগ্রি সেলসিয়াসে মানুষ দরদর করে ঘামতে থাকবে, শূন্য সেলসিয়াসে সে থরথর করে কাঁপবে। আমাদের রেফ্রিজারেটরে মাছ-মাংস হিমায়িত করে রাখি -৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে (২৬৮.১৫ ক), -২৬৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে (৪ ক) হীলিয়াম্ গ্যাস তরল হয়ে যায়, -২৭২ সেলসিয়াসে (০.৬ ক) সব রাসায়নিক বিক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়, বস্তু ঘর্ষণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, -২৭৩.১৪৯৯৯৯ সেলসিয়াসে (০.০০০০০১ ক) বস্তু বোস-আইনস্টাইন ঘনায়নে পরিণত হতে পারে।
সত্যেন্দ্রনাথ বসু: ১৯২৫ সালে আইনস্টাইন এবং আমি অংকের মাঝে পদার্থের যে নতুন রূপের খোঁজ পেয়েছিলাম ৭০ বছর পরে, ১৯৯৫ সালে ল্যাবে তার দেখা মেলে। যা ভেবেছিলাম তাই হয়েছে। প্রচন্ড ঠান্ডায় পরমাণু তার নিজের পরিচয় হারিয়ে ফেলেছে। প্রতিটি পরমাণু বলছে, “আমি জানিনা আমি কে! আপন পরের প্রভেদ একেবারেই ঘুঁচে গেছে। আমি একই সাথে সব জায়গায় আছি! আমরা, কোটি কোটি পরমাণু, একে অপরের মাঝে হারিয়ে গেছি !”
আইনস্টাইন: শূন্যে আলোর গতি এক সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার, কিন্তু বোস-আইনস্টাইন ঘনায়নে ঢুকে আলো ধমকে যায়, হামাগুড়ি দিয়ে চলতে শুরু করে। মহাশুন্যে আলোই রাজা, ওর চেয়ে বেশি গতিতে কেউ চলতে পারে না। আলোর এই গতি বজায় রাখার জন্যে স্পেস বেঁকে যায়, সময় ধীরে চলে। কিন্তু বোস-আইনস্টাইন ঘনায়ন কোন অলৌকিক মন্ত্রবলে এই দুরন্ত আলোকে বশ করে ফেলে। এখন বোস-আইনস্টাইন ঘনায়ন দিয়ে কোয়ান্টাম কম্পিউটার বানানোর চেষ্টা চলছে। শুনেছি মেয়েদের মনের খবর উপরওয়ালাও জানে না। কোয়ান্টাম কম্পিউটার মনের খবর কম্পিউটার নিজেও ঠিক জানবে না! গোপনীয়তা বজায় রেখে দ্রুত অংক করতে এমন কম্পিউটারের জুড়ি থাকবে না।
লেখক : বস্তুর এ কি মায়াবী রূপের সন্ধান দিয়েছো তোমরা! এই রূপের খোঁজে বিজ্ঞানীরা শূন্য কেলভিন তাপমাত্রার একশ কোটি ভাগের এক ভাগে পৌঁছে গেছে। সেই তাপমাত্রায় এখন হরেক পদার্থকে নতুন করে দেখার চেষ্টা চলছে। কোলে ছোট্ট শিশু এলে মা যে কি করবে তা ভেবে পায় না। কত সাজে সাজিয়ে ওকে দেখতে ইচ্ছে করে! ওর কত রূপ, ও যখন হাসে, কাঁদে, খেলা করে, কথা বলে, দুষ্টুমি করে। বিজ্ঞানীদের এখন সেই দশা হয়েছে! এই দুষ্টু ছেলেটি বড় হয়ে একদিন মানুষের জন্যে অনেক কল্যাণ বয়ে আনবে। তবে বিজ্ঞানীরা সে সব কাজের কথা ভুলে আপাতত বোস-আইনস্টাইন ঘনায়ন নিয়ে খেলতে ব্যস্ত। কত যে নতুন রূপের সন্ধান মিলছে!
“পঞ্চশরে দগ্ধ করে করেছ একি সন্ন্যাসী,
বিশ্বময় দিয়েছ তারে ছড়ায়ে!
ব্যাকুলতর বেদনা তার বাতাসে উঠে নিশ্বাসি,
অশ্রু তার আকাশে পড়ে গড়ায়ে।”
সুন্দরী রমণীর সাজে এক সন্যাসীর ধ্যানভঙ্গ করতে যেয়ে কামনার দেবতা পঞ্চশর নিজেই পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিলেন! সেই ছাই সারা পৃথিবী জুড়ে কামনা হয়ে ঝরেছিল। সত্যেন্দ্র নাথ বসুর একই দশা হয়েছে। তাঁর আবিষ্কার এখন বিজ্ঞানীদের কামনা হয়ে ঝরছে।