Author Picture

চীনের অর্থনৈতিক রাজনীতি

ইমরুল কায়েস

নব্বই দশকের গোড়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয় ঠান্ডাযুদ্ধ। তারপর থেকে কয়েক দশক জুড়ে বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্য বিরাজ করছে। অতি সম্প্রতি মার্কিনী এই আধিপত্যে ভাগ বসাতে শুরু করেছে এশিয়ার দেশ চীন। অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে দেশটি। চীন বর্তমানে দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক পরাশক্তি। যেভাবে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে তাতে ২০৩০ সাল নাগাদ দেশটি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, তা হল চীন ‘নিউ নরমাল ইকোনমি’ বা ‘নতুন অর্থনৈতিক অ্যাপ্রোচ’ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এর রূপকার চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং। এর মোদ্দা কথা হল ব্যবসা ও বিনিয়োগের মাধ্যমে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অর্থনীতির সাথে টেকসই সম্পর্ক গড়া। শি চিনপিংয়ের নেতৃত্বে ভূ-কৌশলগত এবং ভূ-অর্থনৈতিকভাবে চায়না তার আধিপত্য ইতিবাচকভাবে বিশ্বে সম্প্রসারণ করতে উদ্যোগী হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ আন্তঃযোগাযোগ বৃদ্ধি করে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে ২০১৩ সালে চীনের ঐতিহাসিক ‘এক অঞ্চল এক পথ’ কর্মসূচি ঘোষণা করেন প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং।
এই কর্মসূচি চীনাদের কাছে এই মুহূর্তে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। চীন সরকারের আমন্ত্রণে ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে পরপর তিন বছর গণমাধ্যম প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে দেশটি সফর করার সময় আমার এই উপলব্ধি হয়। সেসময় চীনা নীতি-নির্ধারক, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন মহলের সাথে মতবিনিময়ে চীনের এই নয়া কর্মসূচির গুরুত্বের বিষয়টি উঠে আসে। রাজনৈতিক পর্যায়ে যেসকল নেতাদের সাথে মতবিনিময় হয়েছে তাদের সবাই এ কর্মসূচির কথা দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করেন। তাদের কথায় উঠে আসে, চীন কোন দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে চায় না। বরং ‘এক অঞ্চল এক পথ’ কর্মসূচির মাধ্যমে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ অঞ্চলের সাথে দৃঢ় যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করে সমতা ভিত্তিক সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়নে আগ্রহী।

খ্রিস্টপূর্বকাল থেকেই চীন থেকে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকাতে পণ্য রপ্তানি হতো। রপ্তানি পণ্যের মধ্যে সিল্ক বা রেশম ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি। মধ্য এশিয়ার স্থল পথের পাশাপাশি সমুদ্র পথে জাহাজ প্রচলনের পর নৌ পথেও শুরু হয় পণ্য পরিবহন। চীনের এই পণ্য রপ্তানির পথ ‘সিল্করোড’ বা ‘রেশম পথ’ নামে খ্যাতি লাভ করে

২০১৩ সালে শি চিনপিং এই কর্মসূচি ঘোষণার পরই বিশ্ব রাজনীতির আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে বিষয়টি। শুরু হয় এর পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনা। যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পরাশক্তিও বিষয়টি নিয়ে বিশদ গবেষণা শুরু করে। ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ কর্মসূচি ঘোষণার সময়ই প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং জোর দিয়ে বলেন, ‘‘এক অঞ্চল এক পথ’ চীনের উত্থাপিত উদ্যোগ, কিন্তু উদ্যোগটির ফলাফল ও সুযোগ বিশ্বের সম্পদ। এ উদ্যোগ একটি নতুন উদ্যোগ, সহযোগিতার ক্ষেত্রে মতভেদ থাকা একটি সাধারণ প্রপঞ্চ । অভিন্ন আলোচনা, অভিন্ন নির্মাণ ও অভিন্ন ভাগাভাগির নীতি মেনে নিয়ে অবশ্যই সবাই সহযোগিতা করবে, মতভেদ মোকাবিলা করবে। যাতে উদ্যোগটি একটি ব্যাপক আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়। বিভিন্ন দেশের জনগণের কল্যাণ বয়ে আনে।’’ এরই মধ্যে বিশ্বের ১৩৬ টি দেশ ও ৩০ টি আন্তর্জাতিক সংস্থা বেল্ট এন্ড রোড বা বিআরআই কো-অপারেশন ডকুমেন্ট সই করেছে। এসব দেশে এরই মধ্যে ৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে চীন।

যেহেতু চীনের বৈশ্বিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম ‘এক অঞ্চল এক পথ’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত সেহেতু প্রথমেই জেনে নেয়া দরকার এই কর্মসূচি সম্পর্কে।

এক অঞ্চল এক পথ কি ?
খ্রিস্টপূর্বকাল থেকেই চীন থেকে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকাতে পণ্য রপ্তানি হতো। রপ্তানি পণ্যের মধ্যে সিল্ক বা রেশম ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি। মধ্য এশিয়ার স্থল পথের পাশাপাশি সমুদ্র পথে জাহাজ প্রচলনের পর নৌ পথেও শুরু হয় পণ্য পরিবহন। চীনের এই পণ্য রপ্তানির পথ ‘সিল্করোড’ বা ‘রেশম পথ’ নামে খ্যাতি লাভ করে। বর্তমানে চীন পণ্য পরিবহনের অতীতের এই দুই পথকে সম্প্রসারণ করে অর্থনৈতিক যোগাযোগকে সমৃদ্ধ করতে চাচ্ছে। ‘এক অঞ্চল এক পথ’ মানে এই রেশম পথের পুনরুজ্জীবন। হাজার হাজার ডলারের এই প্রকল্পটি দুই ধাপে বিভক্ত। প্রথম ভাগে রয়েছে ‘রেশমপথ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ বা সড়ক পথ এবং দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে ‘সামুদ্রিক রেশমপথ’ বা সমুদ্র পথ। পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশ হয়ে অবশেষে ইউরোপীয় অর্থনৈতিক বৃত্ত পর্যন্ত ‘এক অঞ্চল এক পথ’ ধারণার অন্তর্গত। এর মধ্যে ‘রেশমপথ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ বা ‘সড়ক পথে’ র গুরুত্বপূর্ণ রুট হচ্ছে চীন থেকে মধ্য এশিয়া, রাশিয়ার মধ্য দিয়ে ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়ার মধ্য দিয়ে পারস্য উপসাগর ও ভূমধ্য সাগর এবং চীন থেকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরে যাওয়ার রুট। অন্যদিকে, ‘সামুদ্রিক রেশমপথে’র গুরুত্বপূর্ণ রুট হচ্ছে চীনের বিভিন্ন বন্দর থেকে দক্ষিণ চীন সাগর হয়ে ভারত মহাসাগর, ইউরোপ ও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে যাওয়ার রুট। এই রুট বা পথ অঞ্চলের দেশগুলোর মোট লোকসংখ্যা ৪৪০ কোটি, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৬৩ শতাংশ এবং অর্থনীতির মোট পরিমাণ ২১ ট্রিলিয়ন ডলার, যা বিশ্বের মোট অর্থনীতির ২৯ শতাংশ।

প্রকল্পের উদ্দেশ্য

মূলত চীনের বিশাল অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখা এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলেও চীনকে ইউরোপ, এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার সাথে সংযুক্ত করাও এর প্রধান উদ্দেশ্য। অর্থনৈতিক বন্ধনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বন্ধন দৃঢ় করা, পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, উন্নতমানের অবকাঠামো বাস্তবায়ন ও পরিকল্পনায় যুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোর মাধ্যমে সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করাই এর অন্যতম উদ্দেশ্য। যেসব দেশে উন্নতমানের অবকাঠামো নাই সেসব দেশে অবকাঠামো তৈরিতে সহায়তার ঘোষণাও দিয়েছে চীন। বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতৃত্বের আসনে সমাসীন হওয়ার লক্ষ্যকে সামনে রেখেই অগ্রসর হচ্ছে দেশটি।

কিভাবে তৈরি হবে

বৃহৎ এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য এরইমধ্যে কাজ শুরু করেছে চীন সরকার। প্রাথমিক ধাপ হিসেবে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর এবং বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার বা বিসিআইএম ইকোনোমিক করিডোর তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে দেশটি। প্রকল্প বাস্তবায়নে বেল্ট এন্ড রোড বা বিআরআই উদ্যোগের দেশগুলোতে চীন প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। এ উদ্যোগে বিভিন্ন বিষয়ে জোর দেওয়া হবে। এর মধ্যে রয়েছে অবকাঠামোর উন্নয়ন, বিশাল মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল, বাণিজ্য বাধা দূরীকরণ, ই-কমার্স সার্ভিসেস ইত্যাদি। পাকিস্তানে ৪৫, ভারতে ৩৫ ও বাংলাদেশে ২৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে দেশটি। সড়ক ও সমুদ্র উভয় পথেই এই কর্মসূচি বাস্তবায়িত হবে। সড়ক পথে চীন বিভিন্ন দেশের সাথে গত দশক বা তার আগে থেকেই রেল যোগাযোগ স্থাপন করেছে এবং এখনো করছে। চীন থেকে জার্মানি, স্পেন ও ইরানে সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপনের চিন্তা করছে। সড়ক পথে যে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে তা হলো, যে দেশগুলোর কোন সমুদ্র বন্দর নেই সে দেশগুলোকে একত্রে সংযুক্ত করা। এর মধ্যে মধ্য এশিয়ার দেশগুলো উল্লেখযোগ্য। এছাড়া আফ্রিকার দেশগুলোকেও এর আওতায় আনা হবে। সড়ক প্রকল্পটিকে ‘রেশম পথ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ বলে অভিহিত করা হয়।

এই রুট বা পথ অঞ্চলের দেশগুলোর মোট লোকসংখ্যা ৪৪০ কোটি, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৬৩ শতাংশ এবং অর্থনীতির মোট পরিমাণ ২১ ট্রিলিয়ন ডলার, যা বিশ্বের মোট অর্থনীতির ২৯ শতাংশ

নৌ রুটটি হবে চীনের দক্ষিণ অঞ্চল থেকে। এরই মধ্যে দেশটি বিভিন্ন দেশের সমুদ্র বন্দরকে ভাড়া নিচ্ছে বা ব্যবহারের জন্য চুক্তি করছে। যেমন শ্রীলঙ্কার কাছ থেকে হাম্বানটোটা সমুদ্র বন্দরটি ৯৯ বছরের জন্য লিজ নিয়েছে তারা। এছাড়াও বাংলাদেশের চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর, মিয়ানমারের সিটওয়ে, পাকিস্তানের করাচি, মালদ্বীপের মালে ইত্যাদি বন্দর নিচ্ছে বা নেয়ার চেষ্টা করছে। দক্ষিণ চীন সাগর থেকে শুরু করে বঙ্গোপসাগর, ভারত মহাসাগর, লোহিত সাগর বেষ্টিত বিশাল অর্থনৈতিক অঞ্চলকে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রকল্পটি কতদিনে বাস্তবায়ন হবে সে সম্পর্কে সঠিক কোন ধারণা দেয়নি চীন সরকার। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, সম্পূর্ণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হতে ৪০-৭০ বছর বা তারও বেশি সময় লেগে যেতে পারে।

‘এক অঞ্চল এক পথ’ ও বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক:

চীনের ‘এক পথ এক অঞ্চল’ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে সংযুক্ত সব দেশই লাভবান হবে। এক্ষেত্রে চীনের প্রতিবেশি দেশ বাংলাদেশও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে ধারনা করা যাচ্ছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চীন সরকার বৃহৎ অংকের অর্থ বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে। নয়া প্রকল্পের অংশ হিসেবেই ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং বাংলাদেশ সফরে আসেন। ওই সফরে দুই দেশের মধ্যে ২৬টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়। চীনা প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দেন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পাশে থাকবে চীন। কর্মকর্তাদের সুত্রে জানা যায় বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অবকাঠামো উন্নয়নসহ নানা খাতে প্রায় ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে দেশটি। প্রেসিডেন্ট শি চট্টগ্রাম ও খুলনায় তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণসহ ছ’টি প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। গভীর সমুদ্রে একটি বন্দরও নির্মাণের আগ্রহ দেখায় চীন। কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশের আপত্তির কারণে শেষমুহূর্তে এই প্রস্তাব থেকে সরে যায় বাংলাদেশ। এরপর ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফর করেন। সেসময় বাংলাদেশে জ্বালানী, প্রযুক্তি, অবকাঠামোসহ বিভিন্ন খাতে চীনা সহায়তার বিষয়ে ৯ চুক্তি ও সমঝোতা সই হয়। বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক স্ট্র্যাটেজিক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে বলে অহরহ উল্লেখ করছে দেশ দুটির নেতারা। বাংলাদেশের শেখ মুজিব শিল্প নগরীতে চায়না অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলার জন্য সম্প্রতি চীনের ইয়াবাং গ্রুপ ও বাংলাদেশ ইকোনমিক জোনস অথরিটি-বেজা’র মধ্যে চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে। এর আলোকে ইয়াবাং গ্রুপ প্রাথমিকভাবে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে বলে জানা গেছে। এটা বাস্তবায়িত হলে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

দক্ষিণ চীন সাগর থেকে শুরু করে বঙ্গোপসাগর, ভারত মহাসাগর, লোহিত সাগর বেষ্টিত বিশাল অর্থনৈতিক অঞ্চলকে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রকল্পটি কতদিনে বাস্তবায়ন হবে সে সম্পর্কে সঠিক কোন ধারণা দেয়নি চীন সরকার। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, সম্পূর্ণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হতে ৪০-৭০ বছর বা তারও বেশি সময় লেগে যেতে পারে

চীন বাংলাদেশের সাথে বাণিজ্য করে দীর্ঘকাল ধরে। কিন্তু পারস্পরিক বাণিজ্যক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এখানে বড় রকমের বাণিজ্যঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতি কমাতে সম্প্রতি বাংলাদেশকে ৫ হাজার ১৬১টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে চীন। এর আগের সংখ্যা মিলিয়ে মোট ৮ হাজার ২৫৬টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিল দেশটি। অর্থনৈতিক কূটনীতির অংশ হিসেবে চীন এ সুবিধা দিল বাংলাদেশকে। এর মধ্য দিয়ে দু’দেশের বাণিজ্যে কিছুটা ঘাটতি কমবে বলে আশা ব্যবসায়ীদের।

অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে বর্তমানে বাংলাদেশের সাথে চীনের নিবিড় ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিরাজ করছে যা দুই দেশের সাম্প্রতিক কর্মকান্ডে প্রকাশ পাচ্ছে। এই মুহূর্তে পদ্মাসেতু, কর্ণফুলি টানেলসহ বড় বড় বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চীন। সুতরাং একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ অনেকটাই চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। নিঃসন্দেহে এর একটা কূটনৈতিক প্রভাবও আছে।

মাওয়ের মৃতদেহ যেখানে সংরক্ষন করে রাখা হয়েছে সেই ভবনের সামনে কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন ও লেখক ইমরুল কায়েস।

চীন বড় অংকের অর্থ বিনিয়োগ করলে এবং বাংলাদেশের অবকাঠামো প্রস্তুত হলে বাণিজ্যের সুযোগ আরও বাড়বে। চীনের এখন বিশাল রিজার্ভ, এ ছাড়া উন্নত প্রযুক্তি ও ব্যাপক বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। অভ্যন্তরীণভাবে এর সবটুকু ব্যবহার করা সম্ভব নয়। এ জন্য তাদের দেশের বাইরে বাজার প্রয়োজন। এ ধারণা থেকেই হয়তো চীনের ‘এক পথ এক অঞ্চল’ উদ্যোগ নেয়া। বাংলাদেশের আছে বিশাল কর্মক্ষম জনসংখ্যা। চীনের বিনিয়োগ হলে এই জনসংখ্যার জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। ভৌগলিক অবস্থানের সুবিধার কারণেও বাংলাদেশের জন্য খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্প। চীনের নয়া প্রকল্পের সুবিধা নিয়ে সমুদ্রপথে যোগাযোগ স্থাপন হলে বাংলাদেশ সহজেই নৌপথে বাণিজ্য করতে পারবে। তাছাড়া এ প্রকল্পের আল্টিমেট লক্ষ্য হিসেবে আঞ্চলিক দেশগুলোর সাথে স্থলপথে বাংলাদেশের যোগাযোগ স্থাপিত হবে। যার সুফল বাংলাদেশ ভোগ করতে পারবে। বাংলাদেশের প্রধান পণ্য তৈরি পোশাক রপ্তানিতে এই প্রকল্প সহায়ক হবে বলে আশা করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী সমাজ। এ প্রকল্পের সাথে সংযুক্ত হলে দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি সমুদ্র বন্দরগুলোর আধুনিকায়নে কাজ করবে চীনা বিনিয়োগ। ফলে সমুদ্রপথে ব্যবসার দ্বার উন্মুক্ত হবে। তবে বাংলাদেশ এসব সুবিধা কতটুকু আদায় করতে পারবে তা অবশ্য এখনি বলা কঠিন। এজন্য ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বাংলাদেশের নিজস্ব সক্ষমতা বাড়ানোর বিকল্প নাই। বাংলাদেশের সাথে শুধু অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কই বাড়াতে আগ্রহী নয় চীন, বরং এর পাশাপাশি সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও শিক্ষাক্ষেত্রেও সম্পর্ক এগিয়ে নিতে খুব জোরেশোরে কাজ করছে দেশটি। ‘এক পথ এক অঞ্চল’ উদ্যোগ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবেই যে চীন বাংলাদেশকে তার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার বানিয়েছে বা বানানোর চেষ্টায় রত বিভিন্ন কর্মমান্ডে তা স্পষ্ট।

চীনের নয়া প্রকল্প ও আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার

নয়া এই প্রকল্প বাস্তাবায়ন করতেই চীন শুধু বাংলাদেশ নয়, এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশের সাথে সম্পর্ক বাড়ানোর জোরদার চেষ্টা করছে। এরইমধ্যে পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, আফগানিস্তানের মত দেশগুলোর সাথে দৃঢ় সম্পর্ক গড়তে সমর্থ হয়েছে চীনারা। পাকিস্তান হল চীনের একমাত্র বিশ্বস্ত বন্ধু। আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভারতকে কোনঠাসা করতে চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানে চীনের নানা প্রকল্প রয়েছে। ‘এক পথ এক অঞ্চল’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ২০১৫ সালে ৪৬ মিলিয়ন ডলারের চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর প্রকল্প চালু করেন প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং। ২০১৭ সাল নাগাদ এই প্রকল্পের মূল্য দাঁড়ায় ৬২ মিলিয়ন ডলার। দুই হাজার কিলোমিটারের এই প্রকল্পটি চীনের শিনজিয়াং প্রদেশের কাশগড় থেকে পাকিস্তানের গদর শহরের গদর বন্দর পর্যন্ত হবে। লাহোর এবং করাচীর মধ্যে ১১০০ কিলোমিটারে হাইওয়ে নির্মিত হবে। চীনের শিনজিয়াং রেলওয়েকে পাকিস্তানের রেলওয়ের সাথে সংযুক্ত করা হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পাকিস্তানের বন্দর ব্যবহার করে চায়না ও এশিয়ার মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি পশ্চিম ইউরোপ, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের সাথে চীনের সংযোগ স্থাপনে পুরাতন সিল্করোডের পুনর্জাগরণ ঘটবে। ফলে এসব অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব হ্রাস পাবে।

রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকেই দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়ন নতুন মাত্রা লাভ করেছে। সীমান্তবর্তী লিপুলেখ, কালাপানি ও লিম্পিয়াধুরা উত্তরাখন্ড রাজ্যের পিথোরাগড় জেলার অংশ হিসেবে ভারত দাবি করলেও সম্প্রতি নেপাল উল্লিখিত ভূখন্ডগুলো নিজ দেশের অবিচ্ছিন্ন অংশ হিসেবে দেখিয়ে একটি মানচিত্র তৈরি করে তা সংসদে পাস করে নিয়েছে

চীনের সাথে আঞ্চলিক সম্পর্কের দিক দিয়ে পাকিস্তানের পরেই আছে মিয়ানমারের অবস্থান। মিয়ানমারের আরাকানে জ্বালানী তেলের টার্মিনাল স্থাপনও কার্যকর করেছে চীন। জ্বালানী তেলের সমান্তরালে প্রাকৃতিক গ্যাসের পাইপলাইনও স্থাপন করেছে দেশটি। এটি আকিয়াবের কাছে ‘শয়ে’ গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস টার্মিনাল হয়ে চীনের কুনমিং পার করে গোঞ্জেহ প্রদেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গ্যাস পাইপলাইন দিয়ে বছরে ১২ বিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস সঞ্চারিত হচ্ছে, যার ২০ শতাংশ মিয়ানমার ব্যবহার করবে। শুধু এই প্রকল্পেই ব্যয় হয়েছে ২৫০ কোটি মার্কিন ডলার। আরাকানে সব মিলিয়ে এক হাজার ৮০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে চীন। আরাকানে তেল-গ্যাসক্ষেত্রসহ নানা প্রকল্পের মাধ্যমে চীন আসলে দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর এলাকায় একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

‘এক পথ এক অঞ্চল’ কর্মসূচির আওতায় ১৫০ কোটি ডলারে শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর তৈরি করেছে চীন। ১১২ কোটি ডলারে এই বন্দর লিজ নিয়েছে চীনের ‘মার্চেন্টস পোর্ট’। চীনের দাবি এই বন্দরের প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরে লজিস্টিক হাব তৈরি করতে চাইছে তারা। কিন্তু আমেরিকা, ভারত ও জাপান মনে করছে ভারত মহাসাগরে নজরদারি বাড়িয়ে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে চাইছে চীন। এশিয়া ও ইউরোপের মূল শিপিং রুটের কাছেই এই বন্দরের অবস্থান।

সম্প্রতি নেপালের সাথে চীনের গভীর ঘনিষ্ঠতা লক্ষণীয়। দীর্ঘদিনের রাজতন্ত্রের অবসানের পর নেপালে মাওবাদীদের রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকেই দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়ন নতুন মাত্রা লাভ করেছে। সীমান্তবর্তী লিপুলেখ, কালাপানি ও লিম্পিয়াধুরা উত্তরাখ- রাজ্যের পিথোরাগড় জেলার অংশ হিসেবে ভারত দাবি করলেও সম্প্রতি নেপাল উল্লিখিত ভূখন্ডগুলো নিজ দেশের অবিচ্ছিন্ন অংশ হিসেবে দেখিয়ে একটি মানচিত্র তৈরি করে তা সংসদে পাস করে নিয়েছে। এই জায়গাগুলো বর্তমানে ভারতের দখলে রয়েছে। নেপালের এই পদক্ষেপের পেছনে চীনের ইন্ধন আছে বলে মনে করে ভারত। চীন-ভারত দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের পুরোনো। লাদাখ, অরুণাচলসহ সীমান্তের বিভিন্ন এলাকা নিয়ে দু’দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব বিরাজমান। এমনকি সীমান্ত বিরোধ নিয়ে ১৯৬৫ সালে চীন-ভারত যুদ্ধে জড়ায়। সেই কারণে শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ, ভুটানের মত দেশগুলোর সাথে চীনের ক্রমবর্ধমান সম্পর্ককে ভাল চোখে দেখছে না ভারত-মার্কিন জোট। ওপরের আলোচনায় একটি বিষয় পরিষ্কার, ভূ-কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে অর্থনৈতিক সহায়তাসহ নানাভাবে নিয়ন্ত্রণে এনে নিজের প্রভাব বৃদ্ধি করছে চীন। আর এতে ক্রমেই এই অঞ্চলের দেশগুলোর ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে আঞ্চলিক পরাশক্তির দৌড়ে থাকা ভারত। ‘এক অঞ্চল এক পথ’ আদতে অর্থনৈতিক প্রকল্প হলেও এই প্রকল্পের মাধ্যমে সামরিক দিক দিয়েও সুবিধা পাবে চীন। যে কারণে ভারত এই প্রকল্পের ঘোর বিরোধিতা করে আসছে। দেশটি সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন তুলে এ প্রকল্প থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে। তবে কারণ যাই দেখাক ভারত আসলে দীর্ঘদিনের দ্বন্দের কারণেই চীনের এই প্রকল্পে যোগ দিতে চায় না। ভারত প্রশ্ন তুলেছে, বঙ্গোপসাগরসহ ভারত মহাসাগরের দখল নিতেই চীন এ উদ্যোগ নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। চীন যেভাবে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করছে তাতে অচিরেই আরব সাগর, ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরে সামরিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠবে দেশটি। এসব এলাকায় নজরদারির মাধ্যমে এ অঞ্চলে মার্কিন প্রভাবকে হ্রাস করা এবং ভারতকে কোণঠাসা করার প্রচেষ্টায় চীন কতটুকু সফল হবে তা অবশ্য সময়ই বলে দেবে।

এছাড়া দক্ষিণ চীন সাগরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে জাপান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, ব্রুনাই ইত্যাদি দেশের সাথে চীনের সম্পর্কে কিছুটা শীতলতা রয়েছে। এ দেশগুলোও চীনের এই মহাউদ্যোগে যোগদানে বিরত থাকতে বা অনাগ্রহ দেখাতে পারে। এসব বিষয়ে চীনের অবস্থান কি হবে তা এখনই বোঝা যাচ্ছেনা। তবেই এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব যে দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই হবে নানা কর্মমান্ডে তা আন্দাজ করা যাচ্ছে।

চীন-ইরান চুক্তি ও বৈশ্বিক রাজনীতি

বর্তমানে চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বের কথা সবারই জানা। দেশ দুটির মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধের ছদ্মাবরণে চলছে ঠান্ডা লড়াই। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনের বিভিন্ন পণ্য প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। বিরোধের জেরে সম্প্রতি দুই দেশই একে অপর থেকে নিজেদের কনস্যুলেট পর্যন্ত গুটিয়ে নিয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনে অবস্থিত চীনা কনস্যুলেট বন্ধের নির্দেশ দিলে পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে চেংদুতে থাকা মার্কিন কনস্যুলেট বন্ধ করে দেয় চীন। হংকং ইস্যু এবং করোনার উৎসের দোষারোপ নিয়ে বিরজমান চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বের মধ্যেই এই ঘটনা ঘটলো, যা দুদেশের সম্পর্ককে আরও তিক্ত করে তুলবে। ট্রাম্প এবং তার পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাইক পম্পেও যেভাবে হুংকার ছাড়ছেন তাতে পরবর্তী মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও ক্ষমতায় আসলে দুদেশের মধ্যে যুদ্ধ হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

এতে ক্রমেই এই অঞ্চলের দেশগুলোর উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে আঞ্চলিক পরাশক্তির দৌড়ে থাকা ভারত। ‘এক অঞ্চল এক পথ’ আদতে অর্থনৈতিক প্রকল্প হলেও এই প্রকল্পের মাধ্যমে সামরিক দিক দিয়েও সুবিধা পাবে চীন। যে কারণে ভারত এই প্রকল্পের ঘোর বিরোধীতা করে আসছে

আগেই বলেছি, ‘এক অঞ্চল এক পথ’ কর্মসূচির মাধ্যমে চীন বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছে বলে সর্বদাই অভিযোগ করে আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র সর্বতোভাবে বিরোধিতা করছে এই কর্মসূচির, যার প্রতিফলনই দুদেশের সাম্প্রতিক কর্মকান্ডে আমরা লক্ষ করছি। মার্কিনীরা নিজেদের দেশে চীনের বিভিন্ন পণ্যের পাশাপাশি চায়না প্রযুক্তিকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করছে। এসব পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে দুই দেশ ক্রমেই সামরিক বৈরিতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া দক্ষিণ চীন সাগর, কোরিয়া ইস্যুসহ নানা ইস্যুতে দুদেশের মধ্যে একে অপরের বিরোধিতা পুরোনো।

নয়া মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে রাশিয়ার মত পুরোনো মিত্রদের পাশাপাশি নতুন নতুন মিত্রদেশের সাথে গাঁটছাড়া বাঁধছে দেশটি। ২০১৩ সালে ‘এক অঞ্চল এক পথ’ কর্মসূচির মত মহাপরিকল্পনা মধ্য এশিয়ার দেশ কাজাখস্তান সফরে গিয়ে ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং। কথা হল, এত দেশ থাকতে কাজাখস্তানে গিয়ে কেন তিনি এই কর্মসূচি ঘোষণা করলেন? বিশেষজ্ঞদের মতে, অতীতের রেশম পথের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল কাজাখস্তান তথা মধ্য এশিয়া। এই পথ দিয়েই পশ্চিম এশিয়া এবং ইউরোপে বাণিজ্য করতো চীন। তাছাড়া মধ্য এশিয়ার সবচেয়ে বড় দেশ কাজাখস্তান। এর একদিকে রাশিয়া এবং আশপাশে কিরগিজস্থান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তানসহ অন্যান্য দেশ। এই দেশকে ‘এক অঞ্চল এক পথ’ কর্মসূচির আওতায় আনলে স্থলপথে এশিয়া ও ইউরোপের সাথে বাণিজ্য করা চীনের জন্য সহজ হয়ে যাবে। সুতরাং ভূ-কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ মধ্য এশিয়ার সাথে চীনের সম্পর্ক পুনর্জাগরণ করে দৃঢ় বন্ধন তৈরির জন্যই মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে কাজাখস্তানকে বেছে নিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং।

বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর নেতৃত্বে আছে সৌদি আরব। কিন্তু সৌদি আরব চীনের চিরশত্রু যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র। একারণে চীন পাকিস্তানকে কাজে লাগিয়ে তুরস্ককে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের আসনে সমাসীন করতে কাজ করছে। ক্রমেই জোরদার হচ্ছে চীন-তুরস্ক সম্পর্ক। ২০১৮ সালে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স এইরেসে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনের সাইড লাইন বৈঠকে অংশ নেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। পরে অবশ্য দুই নেতাই বলেন, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে দুই দেশই সম্পর্ক জোরদার করতে প্রস্তুত রয়েছে। এর দুদিন পরই চীন সফরে যান তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালী ইলদিরিম। তাঁর সাথে বৈঠকে চীনা প্রধানমন্ত্রী লে কেকিয়াং ‘এক অঞ্চল এক পথ’ কর্মসূচির গুরুত্ব তুলে ধরে তাতে জোরালোভাবে যোগ দেয়ার জন্য তুরস্কের প্রতি আহ্বান জানান। গত ছয়-সাত বছরে চীন ও তুরস্কের শীর্ষনেতারা ছয়বার বৈঠকে বসেছেন।

হংকং ইস্যু এবং করোনার উৎসের দোষারোপ নিয়ে বিরজামান চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বের মধ্যেই এই ঘটনা ঘটলো যা দুদেশের সম্পর্ককে আরও তিক্ত করে তুলবে। ট্রাম্প এবং তার পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাইক পম্পেও যেভাবে হুংকার ছাড়ছেন তাতে পরবর্তী মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও ক্ষমতায় আসলে দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধ হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না

নয়া মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে চীন। এরই অংশ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী দেশ ইরানের সাথে মিত্রতা গড়ছে দেশটি। চাউর হয়েছে ইরানের সাথে চীনের দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি সম্পাদনের কথা। চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বে আগুনে ঘি ঢালার মত কাজ করছে দেশ দুটির সহযোগিতা চুক্তির খবর। ২০১৬ সালে ইরান সফরে গিয়ে প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং ২৫ বছরের কৌশলগত সহযোগিতা চুক্তি করার প্রস্তাব করেন। খবর বেরিয়েছে মার্কিন রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে চীন ও ইরান এই চুক্তির বোঝাপড়া চূড়ান্ত করে ফেলেছে। চুক্তির খসড়া অনুমোদন করেছে ইরানের মন্ত্রিসভা। দুই দেশের পার্লামেন্ট অনুমোদন দিলে এবং প্রেসিডেন্টরা সই করলেই চুক্তি পাকাপাকিভাবে সম্পাদিত হবে। চীন ও ইরান এই চুক্তির বিষয়ে পরিষ্কার করে কিছু না বললেও নিউইয়র্ক টাইমস এবং হংকং ভিত্তিক এশিয়া টাইমসের দাবি ১৮ পাতার খসড়া চুক্তি দেখেছে তারা। এতে বলা হয়েছে, ইরানের তেল-গ্যাস, ব্যাংকিং, টেলিকম, বন্দর উন্নয়ন, রেলওয়ে উন্নয়ন এবং আরও কয়েক ডজন গুরুত্বপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করবে চীন। আগামী ২৫ বছরে এই বিনিয়োগের পরিমাণ ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ হবে। প্রস্তাবিত চুক্তিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল এতে সামরিক ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যৌথ প্রশিক্ষণ, মহড়া, গবেষণা, যুদ্ধাস্ত্র তৈরি এবং গোয়েন্দা তথ্য আদান প্রদানের কথা রয়েছে। মিডল-ইস্ট আই নিউজ ওয়েবসাইটে একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, চুক্তির আওতায় চীন ইরানে পাঁচ হাজার পর্যন্ত সৈন্য মোতায়েন করতে পারবে। সুতরাং চুক্তি চুড়ান্ত হলে প্রথমবারের মতো মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশে সেনা মোতায়েনের সুযোগ পাবে চীন। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র হল ইসরাইল। আর ইহুদিবাদী ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শত্রু হল ইরান। সেকারণে চীনের সাথে ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্রতা হলে তা অবশ্যই ইসরাইলের মাথা ব্যথার কারণ। চীনের সহায়তায় ইরানের শক্তিবর্ধণ নিশ্চিতভাবেই ইসরাইলের জন্য একটি বড় রকমের হুমকি। তাইতো যুক্তরাষ্ট্রের ডজনখানেক মিডিয়ার দাবি চীন-ইরান কৌশলগত চুক্তি মধ্যপ্রাচ্য তথা এশিয়ার বিরাট একটি অংশের ভূ-রাজনৈতিক চালচিত্র বদলে দিতে পারে। তবে সেটা সত্য হবে কিনা তা সময় হলেই বলা যাবে। তবে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় ‘এক অঞ্চল এক পথ’ এর মত মহাপরিকল্পনা নিয়ে ধীরে ধীরে বিশ্ব রাজনীতি, সামরিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে গণচীন।

আরো পড়তে পারেন

বাঙালি মনীষীদের চা প্রীতি-অপ্রীতি

প্রাথমিক পর্যায়ে ভারতবর্ষে চায়ের বিপণন ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং। ক্রেতাদের চামুখী করার জন্য কোম্পানিগুলোর নানামুখী তৎপরতা ছিল উল্লেখ করার মতো। তারা এ কাজে বাহারি বিজ্ঞাপন ছাড়াও নানাবিধ বিনিয়োগের মাধ্যমে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের মানুষদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করত। তবে শুরুতে চরম প্রতিকূল পরিবেশের সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাদের। বৈরী এ পরিবেশ তৈরিতে সর্বতো সহযোগিতা ছিল যার, তিনি হলেন প্রখ্যাত….

ইয়ে থেকে বিয়ে

জগতের বেশিরভাগ বিয়ে প্রথমে হয় দুটো পরিবারের মধ্যে। তারপর সর্ম্পক হয় দুটো মানুষে। এটাকেই লোকে এখন বলে এরেঞ্জড ম্যারেজ। আদি কাল থেকেই এটা হয়ে আসছিল, এখনও বেশিরভাগ বিয়েগুলো পারিবারিক সম্মতি ও সর্ম্পকে হয়। বিয়েতে সর্ম্পক হয় না, সর্ম্পক গড়ে। প্রেমে সর্ম্পক গড়ে ওঠে। আধুনিক প্রেমের বিয়ে যতটা সিনেমা গল্পে হয়, বাস্তবে ঠিক ততটা নয়।  বিয়ের….

আর্কটিক থেকে উপসাগর পর্যন্ত: কানাডা ও বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিপূর্ণ হুমকি

এটি শুধু একটি ভৌগলিক বা স্থানিক ব্যাপ্তির  বর্ণনা নয় , যা আর্কটিক অঞ্চল থেকে উপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ভ্রমণ বা পরিসরের পরামর্শ দেয়। আর্কটিক বলতে পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তরের অংশকে বোঝায়, যা আর্কটিক মহাসাগর এবং আশেপাশের ল্যান্ডস্ক্যাপ জুড়ে রয়েছে। অন্যদিকে উপসাগর জলের শুধু একটি অংশ নয় যা ভূমি দ্বারা আংশিকভাবে ঘেরা ও একটি প্রশস্ত মুখ দিয়ে সামনে….

error: Content is protected !!