
ইউরি গ্যাগারিন (Yuri Gagarin, ১৯৩৪-১৯৬৮) : আমি পৃথিবীর প্রথম মহাশূন্যচারী পথিক। ভস্টক রকেটে চড়ে ১৯৬১ সালে মহাকাশ থেকে পৃথিবীর চারদিকে পাক খেয়েছি। প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দূর থেকে পৃথিবীর চারদিকে একবার ঘুরে আসতে লেগেছিলো দেড় ঘন্টা। মহাকাশ থেকে এই সময়টুকুর মধ্যে একবার দেখলাম রাতের পৃথিবী, তারপরে আবার পেলাম দিন। মেঘের পরে মেঘ, সমুদ্র, বন, ওদের আড়ালে আমার চেনা পৃথিবীটা ঢাকা পড়ে আছে। “দূর মহাকাশ থেকে আমার সারা জীবনের সুখদুঃখকে একটি উজ্জ্বল বিন্দু বলে মনে হচ্ছিলো।”
আর্মস্ট্রং (Neil Armstrong, ১৯৩০-২০১২): এপোলো ১১ রকেটে চড়ে ১৯৬৯ সালে আরো দুজন মহাকাশচারীর সাথে আমি চাঁদের দিকে যাত্রা করি। চাঁদের মাটিতে আড়াই ঘন্টা সময় কাটাই। লুনার মডিউল যখন চাঁদের বুকে নামছিলো, তখন ব্যাকুল চোখে খুঁজছিলাম একটি নিরাপদ স্থান, মাত্র পনেরো সেকেন্ডের জ্বালানি বাকি ছিল। চাঁদের মাটিতে পা দিয়ে বললাম, “চাঁদের বুকে মানুষের পায়ের একটি ছোট্ট ছাপ, সমগ্র মানবজাতির জন্যে এক বিরাট অগ্রগতি।”
লেখক : গ্যাগারিনের রকেট পৃথিবীকে একবার পাক দিয়েই ফিরে এসেছিলো। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে দুই হাজার দুই শত একাত্তরটি কৃত্তিম উপগ্রহ (satellite) পৃথিবীকে পাক দিচ্ছে। প্রতিদিন নুতন নুতন উপগ্রহ যোগ দিচ্ছে এই দলে। চাঁদের মতো এরাও পৃথিবীর চারদিকে অনিদৃষ্টকাল ধরে ঘুরে মরে। কেমন করে? প্রাচীন আমলে মনে করা হতো দেবতারা চাঁদকে পাশ থেকে ঠেলছেন!
নিউটন: ধরো তুমি ছাদের উপরে দাঁড়িয়ে মাটির সমান্তরালে গুলি করলে। বুলেট এক কিলোমিটার দূরে গিয়ে মাটিতে পড়লো। যদি আরো জোরে গুলি করো, তবে বুলেট আরো বেশি দূরে যাবে। যদি পাহাড়ের উপর থেকে গুলি করো তবে বুলেট আরো অনেক দূরে যাবে। কখনো কি ভেবে দেখেছো যে বুলেটটি পৃথিবীটাকে পাক দিয়ে তোমার পিঠে এসে আঘাত করতে পারে!
গ্যালিলিও: আমি গতি নিয়ে অনেক কিছু ভেবেছি, কিন্তু এমনটা কখনো ভাবি নি। তাহলে পাহাড় থেকে মাটির সমান্তরালে গুলি করা বিপদজনক। নিজের পিঠেই গুলি এসে লাগতে পারে! একেই বলে গাছের যে ডালে বসে আছি তাকেই করাত দিয়ে কাটা!
নিউটন: সে ভয় নেই, এমন কোনো বন্দুক নেই যা থেকে এতো বেগে গুলি ছোড়া যায়। তাছাড়া আছে বাতাসের বাধা। তাই তো রকেটের মাথায় বসিয়ে একটি কৃত্তিম উপগ্রহকে প্রথমে কয়েক শত থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার উপরে উঠানো হয়, যেখানে বাতাস নেই। তারপরে মাটির সমান্তরালে ছোড়া হয়। পৃথিবীটা চক্কর দিয়ে আবার ও সেখানেই ফিরে আসে। সেই যে ঘোরাঘুরি শুরু হলো তার যেন আর শেষ নেই!
গ্যালিলিও: জ্বালানি ছাড়া যুগযুগ ধরে একটি কৃত্রিম উপগ্রহ বা চাঁদ কেমন করে ঘোরে?
নিউটন: আমার মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব মতে মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু এক অপরকে টানাটানি করে। বস্তু দুটির ভর যত বেশি, টানাটানির বলও তত বেশি। এই বলের পরিমান বস্তু দুটির দূরত্বের বর্গের সাথে কমে আসে। মাধ্যাকর্ষণের বল কৃত্তিম উপগ্রহ বা চাঁদকে পৃথিবীর চারদিকে ঘোরায়। ছেলেবেলায় একটা দড়ির আগায় পাথর বেঁধে মাথার উপরে ঘুরিয়েছি। এখানে চাঁদ এবং পৃথিবী এক অদৃশ্য দড়ি দিয়ে বাঁধা, মাধ্যাকর্ষণের বল সেই অদৃশ্য দড়ি ধরে টান দিচ্ছে। চক্রাকার পথে পাথরকে ঘোরাতে হলে দড়িকে বৃত্তের কেন্দ্রের দিকে টানতে হয়, পাশ থেকে নয়। চাঁদকে পৃথিবীর চারদিকে চক্রাকারে ঘোরাতে হলে তেমনি চাঁদকে পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে টানতে হবে। মাধ্যাকর্ষণ যতদিন এই কাজটি করবে ততদিন চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে ঘুরতেই থাকবে।
গ্যালিলিও: একটি বস্তু চক্রাকারে সমবেগে ঘুরলেও তার ত্বরণ আছে, কারণ সে ক্রমাগত দিক পরিবর্তন করছে। এই ত্বরণের হিসাব আমার পক্ষে করা সম্ভব ছিল না।
নিউটন: আমার নবআবিষ্কৃত ক্যালকুলাস থেকে এর হিসাব খুবই সোজা। এই ত্বরণের পরিমান হবে গতির বর্গকে চক্রের ব্যাসার্ধ দিয়ে ভাগ করলে যা হয় তার সমান, ধ=(া)(া)/জ, এখানে া হলো গতিবেগ এবং জ হলো ব্যাসার্ধ। এই ত্বরণের দিক চক্রের কেন্দ্রের দিকে, তাই একে কেন্দ্রাভিমুখী ত্বরণ বলে। এই সমীকরণ থেকে হিসাব করে দেখেছি যে চাঁদ পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে ত্বরান্বিত বেগে পড়ছে যার পরিমান ০.০০২৭ মিটার/সেকেন্ড/সেকেন্ড। একই হিসাবমতে গাছ থেকে পৃথিবীর ক্রেন্দ্রের দিকে একটি বৃন্তচ্যুত আপেলের ত্বরণ ৯.৮০ মিটার/সেকেন্ড/সেকেন্ড। একটি আপেল পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে যত দূরে, চাঁদ তার চেয়ে ৬০গুন দূরে। মাধ্যাকর্ষণের বল দূরত্বের বর্গের সাথে কমে। ৯.৮০ কে ষাটের বর্গ ৩৬০০ দিয়ে ভাগ করলে হয় ০.০০২৭। সব কিছু কেমন মিলে যাচ্ছে। পৃথিবীর আপেল এবং আকাশের চাঁদ একই আইন মেনে চলে।
গ্যালিলিও: চাঁদ পৃথিবীর দিকে পড়ছে সেই কবে থেকে, কিন্তু আপেলের মতো মাটিতে এসে পড়ছে না কেন?
নিউটন: সে বিদ্যা তো তোমার কাছেই শিখেছি। ধরে নিতে পারো চাঁদের দুটো গতি আছে। একটি পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে, আরেকটি পৃথিবীর সমান্তরালে। এই সমান্তরাল গতি চাঁদকে পৃথিবী থেকে দূরে রেখে দিয়েছে। বলতে পারো এই দুই গতির যোগফল চক্রের পরিধির দিকে।