Author Picture

ভাল আছি ভাল থেকো

শামসুদ্দিন তৌহিদ

ঘুমাতে যাবার আগে রিং টোন সাইলেন্স মুডে দিয়ে ঘরের বাতিটা নেভাতেই বিছানার ওপর রাখা সেল ফোনের আলো জ্বলে উঠলে শফিক তাকিয়ে দেখে দেশের বাইরের কল। এখন ক’টা বাজে? টেবিল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত এগারোটা বেজে গেছে। শফিক ভাবে ওদের ওখানে এখন নিশ্চয়ই দুপুর একটা বাজে। আয়শা কল করেছে। বেচারী ছেলের কনভোকেশন প্রোগ্রামে হাজির থাকবে বলে নিউইয়র্কে গিয়ে আটকা পড়ে আছে। আয়শা নিউইয়র্ক পৌঁছানোর এক সপ্তাহ পরেই ওখানে লকডাউন শুরু। আয়শা ছেলেকে নিয়ে নিউইয়র্ক সিটি থেকে প্রায় দেড়’শ কিলোমিটার দূরে নিউ পলস্ সিটিতে থাকে। ঢাকা থেকে ফেনী যতটুকু দূর, নিউ পলস্ নিউইয়র্ক সিটি থেকে আনুমানিক ততটুকুই দূরে। মে মাসের ২৫তারিখ ছেলের কনভোকেশন প্রোগ্রাম হওয়ার কথা থাকলেও ছেলের সঙ্গে বেশকিছু দিন কাটাবে বলে ফেব্রুয়ারীর শেষ সপ্তাহেই চলে গিয়েছিল আয়শা। শফিক মেয়েকে নিয়ে মে’র ১৫ তারিখে ইউএসএ যাবে বলে বিমানের টিকেটও কেটে রেখেছিল। কিন্তু করোনাভাইরাস যেন সবকিছু পাল্টে দিয়েছে। ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ কনভোকেশন প্রোগ্রামও কেনসেল করেছে। এই পরিস্থিতিতে শফিক এবং আয়শা সন্তানদের নিয়ে পৃথিবীর দু’মেরুতে আটকা পড়ে গেছে।

শফিকদের সংসারে ওরা চারজন। এক মেয়ে ও এক ছেলে। মেয়েটি বড়, নাম কথা। ছেলে ছোট, ওর নাম বার্তা। আয়শা প্রথম যেদিন তার কনসিভের কথা শফিককে জানিয়েছিল, শফিক তখন অনেকক্ষণ আয়শার দিকে তাকিয়ে থেকে কাছে টেনে নেয়। তারপর আয়শার কানের কাছে মাথা ঝুঁকে খুব নীচু স্বরে বলে, মেয়ে হলে আমি কিন্তু ওর নাম ‘কথা’ রাখবো! কথা নামটা উচ্চারণ করতেই আয়শা মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে দেয়। আয়শা জানে, শফিক সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া পর তার আগের জীবনের অনেক স্বাদ-আহ্লাদই পূরণ করতে পারেনি। ভার্সিটিতে পড়ার সময় শফিক সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি ‘কথা’ নামে একটি ত্রৈমাসিক সাহিত্য সাময়িকী’র সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত ছিল। কিন্তু সামরিক জীবনে প্রবেশ করার পর নানা সীমাবদ্ধতার কারণে তার সাহিত্য প্রতিভা বিকাশের পথটি রুদ্ধ হয়ে যায়। আয়শার বুঝতে পারে শফিক এখন তার সেই পুরোনো স্মৃতিকে ধরে রাখতেই মেয়ের নাম কথা রাখতে চাইছে। এ জন্যেই আয়শা শফিকের এক কথায় রাজি হয়ে যায়। শফিকের ভাগ্য সুপ্রসন্ন; যথাসময়ে তাদের প্রথম সন্তান মেয়ে হয়। এর ঠিক তিন বছর পর, আয়শার কোল জুড়ে আসে ছেলে। কথা’র নামের সঙ্গে মিলিয়ে ছেলের নাম রাখে বার্তা। এরপর থেকে বন্ধুমহল এবং আত্মীয়স্বজনদের কাছে ওরা কথাবার্তার মা-বাবা হয়েই পরিচিত হতে থাকে।

আয়শার কানের কাছে মাথা ঝুঁকে খুব নীচু স্বরে বলে, মেয়ে হলে আমি কিন্তু ওর নাম ‘কথা’ রাখবো! কথা নামটা উচ্চারণ করতেই আয়শা মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে দেয়। আয়শা জানে, শফিক সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া পর তার আগের জীবনের অনেক স্বাদ-আহ্লাদই পূরণ করতে পারেনি। ভার্সিটিতে পড়ার সময় শফিক সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি ‘কথা’ নামে একটি ত্রৈমাসিক সাহিত্য সাময়িকী’র সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত ছিল। কিন্তু সামরিক জীবনে প্রবেশ করার পর নানা সীমাবদ্ধতার কারণে তার সাহিত্য প্রতিভা বিকাশের পথটি রুদ্ধ হয়ে যায়। আয়শার বুঝতে পারে শফিক এখন তার সেই পুরোনো স্মৃতিকে ধরে রাখতেই মেয়ের নাম কথা রাখতে চাইছে

শফিক ও আয়শা সন্তানের পিতামাতা হয়েছে আজ প্রায় ২৬বছর। দেখতে দেখতে ছেলে মেয়ে দুটো অনেক বড় হয়ে গেছে। মেয়ে আর্কিটেক্সচার বিষয়ে গ্রেজুয়েশন শেষ করে বর্তমানে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস্ এ এমবিএ পড়ছে। আর ছেলে, যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল ইন্জিনিয়ারিং এ গ্রেজুয়েশন শেষ করল মাত্র। আয়শা এখন ছেলের গ্রেজুয়েশন উত্তর কনভোকেশন প্রোগ্রামে হাজির দিতে গিয়ে প্রায় তিনমাস যাবত নিউইয়র্কে গৃহবন্দি।

এদিকে মেয়েকে নিয়ে শফিক ঢাকার মীরপুর ডিওএইচএস এর বাসায় করোনার এই মহাদূর্যোগকাল অতিক্রম করছে। দুজন দু’মেরুতে পড়ে থাকলেও প্রায় প্রতিদিনই ওদের যোগাযোগ হয় মেসেঞ্জারে। আয়শা ফোন করে সংসারের খোঁজখবর নেয়। বিদেশে আটকে পড়লেও আয়শার মন কিন্তু পড়ে থাকে ডিওএইচএস এর বাসায়। করোনার কারণে কাজের বুয়া আসতে পারে না বলে শফিক নিজেই প্রতিদিনের খাওয়ার ব্যবস্থা করে নেয়। এ নিয়ে আয়শার আফসোসের অন্ত নেই। ভাবে, আহা শফিক বেচারা সারা জীবন সরকারি চাকুরি করে এখন অবসর জীবনে একটু শান্তিতে দিন কাটাবে, তা না করে এখন তাকেই রান্না করে খেতে হচ্ছে। করোনা অনেক কিছুই পাল্টে দিয়েছে। শফিক যেন তা হারে হারে টের পাচ্ছে। মাঝে মধ্যে তার মেয়ে কথা তাকে রান্নায় সাহায্য করে। তবে নুডুলস্ আর পাস্তা ছাড়া অন্য কিছু রান্না করতে জানে না ও। নুডুলস্ এবং পাস্তায় শফিকের কোনো আগ্রহ নেই। ওই খাবারে সে অভ্যস্তও নয়। মাছ-ভাত অথবা দেশী যে কোনো খাবার ওর পছন্দ। আয়শা বুঝতে পারে এসময় ওকে ছাড়া শফিকের খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু উপায় কি? না সে ছুটে আসতে পারছে, না কিছু করতে পারছে শফিকের জন্য।

মেসেঞ্জারের কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আয়শা বলে ওঠে,
-কেমন আছো তুমি?
-ভাল আছি, শফিক উত্তর দেয়।
-আমাকে ছাড়া তুমি ভাল থাক কি করে! আয়শার পাল্টা প্রশ্ন শুনে শফিক কিছুটা থতমত খেয়ে যায়। কি বলবে জবাব খুঁজে পায় না। পর মূহুর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
-না মানে, এখন পর্যন্ত আমি সুস্থ্য আছি। তুমি কেমন আছো?
-তোমাকে ছাড়া আমি কেমন থাকতে পারি তুমি বুঝো না!!

শফিক চুপ হয়ে যায়। কি বলা উচিত বুঝে উঠতে পারে না সে। ওর মনে হয় ওরা যেন সেই তিরিশ বছর আগে ফিরে গেছে। দু’বছর চুটিয়ে প্রেম করে সবে মাত্র বিয়ে করেছে ওরা। বিয়ের পর পরই শফিককে কাজে যোগ দিতে চলে যেতে হয়েছিল সেই সুদূর রাঙ্গামাটিতে। মাত্র ছয়মাস হল শফিকের সেখানে পোষ্টিং হয়েছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীদের রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকান্ড তখন বেশ তুঙ্গে। সমস্ত পাহাড়ী অঞ্চল জুড়ে অস্ত্রের ঝনঝনানি। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর ইশারা। এমন উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে শফিকের পোষ্টিং ছিল রাঙ্গামাটির এক রিমোট এলাকা জুড়াছড়ি আর্মি ক্যাম্পে। মাত্র সাতদিনের ছুটি পেয়েছিল সে। শফিক তখন সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন। বিয়ের অনুষ্ঠিকতা শেষ হতে না হতেই ওর ছুটি শেষ হয়ে যায়। শফিক নিজের মনে আফসোস করে ওঠে, ‘ইশ্…আরও ক’টা দিন যদি থেকে যাওয়া যেত।‘ ছুটিতে আসার সময় সে অবশ্য ব্যাটালিয়ান অধিনায়ককে অনুরোধ করেছিল যেন আরও তিনটি দিন ছুটি বাড়িয়ে দেন। কিন্তু কাজ হয়নি। অধিনায়ক তার অনুরোধ রাখতে পারেননি। কারণ, দশদিন বাদেই তাঁর একটা গুরুত্বপূর্ণ সম্মিলিত অভিযানের পরিকল্পনা আছে; সে অভিযানে ক্যাপ্টেন শফিককে একটি টহল দলের অধিনায়ক নির্বাচিত করা হয়েছে। এ কারণেই ছুটি বাড়িয়ে দেয়া সম্ভব ছিল না। অতএব, ছয়দিনের মাথায় শফিককে আয়শার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যেতে হয়েছিল। শফিক জানে ওই অভিযানে যোগ দিলে তার কী পরিনতি হতে পারে। পাহাড়ের ওই পরিস্থিতিতে অভিযানে বেরিয়ে গিয়ে কেউ জীবিত ফিরে আসবে তার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না তখন। এ জন্য অভিযানে বের হবার সময় সৃষ্টিকর্তার ওপর নিজেদের ভাগ্য ছেড়ে দিয়ে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে যেতে হতো। শফিক জানে সদ্য বিয়ে করা নতুন বউকে এসব কথা বলা ঠিক হবে না। মন না চাইলেও দেশের প্রয়োজনে তাকে রাঙ্গামাটি যেতেই হবে।

রাঙ্গামাটি পৌঁছে শফিকের মন খুব খারাপ হয়ে গেল। বিয়ে করার পর হানিমুন তো দূরে থাক এতটুকু বেশী সময়ও সে দিতে পারেনি আয়শাকে। আয়শার জন্য ওর কষ্ট হয়। খুব মিস করছে সে ওকে। ক্যাম্পে ফিরে যাবার আগে রাঙ্গামাটি শহর থেকেই আয়শার সঙ্গে কথা বলে যেতে হবে। ক্যাম্পে চলে গেলে আর কথা হবে না। আর্মি ক্যাম্পে টেলিফোন সংযোগ নেই। সময় নষ্ট না করে স্থানীয় টেলিফোন এ্যাক্সচেঞ্জে চলে যায় শফিক।

শফিক কল দিতেই অপর প্রান্তে আয়শার মা টেলিফোন রিসিভ করেন। কুশোল বিনিময়ের পর তিনি বললেন, একটু অপেক্ষা করো আমি আয়শাকে ডেকে দিচ্ছি। কিছুক্ষণ পর টেলিফোনের রিসিভার হাতে নিয়ে আয়শা হ্যালো বলতেই শফিক জিজ্ঞেস করে,
-কেমন আছো?
খুব নীচু গলায় আয়শা উত্তর দেয়,
-তোমাকে ছাড়া আমি কেমন থাকতে পারি তুমি বুঝো না?
আয়শার কথা শুনে শফিক চুপ হয়ে যায়। মুখে সে কিছুই বলতে পারছে না। কেবল মনে হচ্ছিল ওই মুহূর্তে যদি সে আয়শার কাছে ফিরে যেতে পারত। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে শফিক বলে- তুমিও কি বুঝো না, তোমাকে ছাড়া আমিই বা ভাল থাকি কি করে?

আজ আবার আয়শার মুখে সেদিনের সেই কথার পুনরাবৃত্তি শুনে শফিক কিছুটা আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ে। চোখ কেমন ঝাপসা হয়ে আসে। আয়শার কথাগুলো যেন বার বার তার কানে বাজতে থাকে।
শফিক কিছু বলছে না দেখে আয়শা পুনরায় বলে- কথা বলছো না যে? আমার কথা কি শুনতে পাওনি?
আয়শার কথায় শফিক বাস্তবে ফিরে আসে। সরাসরি উত্তর না দিয়ে সে আয়শাকে জিজ্ঞেস করে,
-আচ্ছা আয়শা, বিয়ের পর সেই যে আমি রাঙ্গামাটি চলে গিয়েছিলাম, কতদিন পর তোমার কাছে আমি ফিরে এসেছিলাম?
শফিকের কথা শুনে আয়শা কিছুটা অবাক হয়। নিজেকে প্রশ্ন করে- হটাৎ করে শফিক কেন পুরোনো প্রসঙ্গ টেনে কথা বলছে? আপাতত প্রশ্নের কোনো উত্তর না পেয়ে শফিকের কথার জবাব দেয়,
-বিয়ে করে চলে যাবার পর প্রায় তিন মাস তুমি আমার কাছে ফিরে আসনি। সেই যে গেলে, আর আসার নাম নেই তোমার। ওই পরিস্থিতিতে নতুন বিয়ে করা বউ হয়ে কিভাবে যে সময় কাটিয়েছি তা কেবল আমিই বলতে পারবো। নাই টেলিফোন, নাই অন্য কোনো যোগাযোগের সুযোগ। পনেরদিন পর পর একটা করে চিঠি তোমার খবর পাওয়ার একমাত্র মাধ্যম ছিল। মাঝেমধ্যে খবরের কাগজে পার্বত্য চট্রগ্রামের কিছু কিছু দু:সংবাদ ছাপা হতো। তোমাকে নিয়ে তখন খুব টেনশনে থাকতাম।
একটানা কথাগুলো বলে আয়শা শফিককে পাল্টা জিজ্ঞেস করে, হটাৎ করে তুমি সেদিনের প্রসঙ্গ তুললে যে?
-নাহ্ এমনি। বিয়ের ছয়দিনের মাথায় তোমাকে ছেড়ে যেতে আমার খুব কষ্ট হয়েছিল। তবুও না যেয়ে উপায় ছিল না। তোমাকে ছেড়ে রাঙ্গামাটির সেই বিক্ষুব্ধ এলাকায় আমার দিন-রাত্রি যে কিভাবে কেটেছে ভাবলে এখনও আমি বুকের ভেতর কষ্ট অনুভব করি। এবছর ফেব্রুয়ারিতে তুমি যখন আমাকে ছেড়ে ছেলের কাছে চলে গেলে, তারপর থেকে আমার মনে হয়েছে আমি তোমাকে অনেক মিস করছি। প্রায় তিন মাস হলো তুমি ছেলের কাছে গেছো। টেলিভিশনে নিউইয়র্কের করোনা সংক্রান্ত ভয়াবহ সংবাদ শুনে শুনে এই কয়টা মাস এক অজানা আশঙ্কায় দিন কাটিয়েছি। প্রতিদিন তোমার সঙ্গে কথা হলেও তা বুঝতে দেইনি। বিয়ের পর যখন তোমাকে ছেড়ে রাঙ্গামাটি চলে যাই তখন তো আপন বলতে আমার পাশে কেউ ছিল না। ক্যাম্প থেকে এক একটা অভিযানে বেরিয়ে গেলেও ভয় পাইনি। কারণ সে সময় আমার জীবনের ঝুঁকি থাকলেও তুমি ছিলে নিরাপদে। কিন্তু এখন! তুমি, আমি আমাদের সন্তানেরা এক অনিশ্চিত জীবনের মুখোমুখি। আয়শা আজ আমার মেয়ে পাশে থাকলেও আমি তোমাকে ছাড়া ভীষণ একা ফিল করছি….

বিয়ের ছয়দিনের মাথায় তোমাকে ছেড়ে যেতে আমার খুব কষ্ট হয়েছিল। তবুও না যেয়ে উপায় ছিল না। তোমাকে ছেড়ে রাঙ্গামাটির সেই বিক্ষুব্ধ এলাকায় আমার দিন-রাত্রি যে কিভাবে কেটেছে ভাবলে এখনও আমি বুকের ভেতর কষ্ট অনুভব করি। এবছর ফেব্রুয়ারিতে তুমি যখন আমাকে ছেড়ে ছেলের কাছে চলে গেলে, তারপর থেকে আমার মনে হয়েছে আমি তোমাকে অনেক মিস করছি। প্রায় তিন মাস হলো তুমি ছেলের কাছে গেছো। টেলিভিশনে নিউইয়র্কের করোনা সংক্রান্ত ভয়াবহ সংবাদ শুনে শুনে এই কয়টা মাস এক অজানা আশঙ্কায় দিন কাটিয়েছি। প্রতিদিন তোমার সঙ্গে কথা হলেও তা বুঝতে দেইনি। বিয়ের পর যখন তোমাকে ছেড়ে রাঙ্গামাটি চলে যাই তখন তো আপন বলতে আমার পাশে কেউ ছিল না। ক্যাম্প থেকে এক একটা অভিযানে বেরিয়ে গেলেও ভয় পাইনি। কারণ সে সময় আমার জীবনের ঝুঁকি থাকলেও তুমি ছিলে নিরাপদে

আয়শা শফিকের কথার কোনো জবাব দেয় না। চুপ করে থাকে। বেশ কয়েক সেকেন্ড এভাবেই কেটে যায়। শফিক অপেক্ষা করে। কিছুক্ষণ পর সেল ফোনের ওপাশ থেকে যেন আয়শার দীর্ঘশ্বাস ভেসে আসে। চোখ বন্ধ করে শফিক যেন দেখতে পায়, আয়শার চোখের জল দু’গাল বেয়ে নীরবেই নীচে গড়িয়ে পড়ে।
-আয়শা তুমি কাঁদছো? শফিক জিজ্ঞেস করে। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে ভারী গলায় আয়শা উত্তর দেয়, কই না তো! তুমি হয়তো ভুল শুনেছো। আয়শা নিজেকে সামলে নেয়।
-শফিক আমিও তোমাকে খুব মিস্ করছি। আয়শার কথা শুনে শফিকের চোখ ভিজে যায়। সে যেন আয়শার কথা স্পষ্ট শুনতে পায়নি। আবারও শুনবে বলে জিজ্ঞেস করে,
-আয়শা… তুমি কি সত্যিই আমাকে মিস্ করো?
শফিকের পাল্টা প্রশ্নে আয়শা এবার নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। আবেগ তাড়িত কন্ঠে বলে ওঠে- তুমি ওভাবে বলো না। আমার কষ্ট হচ্ছে। এভাবে কথা বললে কষ্ট হয়তো আরও বেড়ে যাবে। দেশে যে ফিরে আসবো সে উপায়ও নেই। যদি সুযোগ হতো তাহলে আমি ছেলেকে নিয়ে এ মুহূর্তে তোমার কাছে চলে আসতাম শফিক।
-আয়শা, করোনাভাইরাস শুধু আমাদেরই দূরে সরিয়ে দেয়নি; বিশ্বের সবাইকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। আমরা সকলেই যেন এখন এক একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মানুষ।
-আমরা কবে আবার এক হবো বলতে পারো?
-জানি না। তিন মাস, ছয় মাস অথবা বছর! এইভাবেই হয়তো চলে যাবে আমাদের দিন-রাত্রি। শফিকের মুখে হতাশার সুর।
-আজ টিভিতে দেখলাম ঢাকার করোনা পরিস্থিতি খুব খারাপ। সাবধানে থেকো। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে বাইরে বের হওয়ার দরকার নেই। আয়শা শফিককে বারণ করে দেয়।
-নিউইয়র্কে মৃত্যুর সংখ্যা কমলেও সেকেন্ড ওয়েবে আক্রান্তের হার আরও বৃদ্ধি পাবে বলে শোনা যাচ্ছে। তোমাদের নিয়ে আমার চিন্তা হয়। এতদিন ঘরবন্দি হয়ে পড়ে আছো, বাইরে বের হবারও কোনো উপায় নেই।
-তুমি ঠিকই বলেছো। গ্রোসারী আইটেম কেনার জন্য বেরুতে হয়, তাও খুব অল্প সময়ের জন্য। তাছাড়া বাইরে যাবার প্রয়োজন পড়ে না।
-না বেরুনোই ভাল।
-ক’টা বাজে দেখেছো। ঢাকায় এখন রাত একটা বেজে গেছে তাই না? ঘুমাবে কখন?

ফোন রাখতে মন না চাইলেও শফিক বলে,
ওহ্…হা, অনেক রাত হয়ে গেছে।
রাখবো ?
-হা ফোন রেখে ঘুমিয়ে পড়ো। ভাল থেকো।
-তোমরাও ভাল থেকো। এখন তাহলে রাখি।

সেল ফোনের লাইন কেটে দেয় শফিক। কথায় কথায় অনেক রাত হয়ে গেছে। ঘুমাতে চেষ্টা করে সে। বিছানার এপাশ ওপাশ করলেও চোখে ঘুম নেই। আয়শাকে আজ যেন একটু বেশীই মিস করছে সে। শফিক বুকের ভেতর যেন শূন্যতা অনুভব করে।
বিয়ের পর সেই বয়সে আয়শার কাছ থেকে দূরে থেকে যত না খারাপ লেগেছিল; এই পরিণত বয়সে এসে দূরে থাকার এই দু:খ-বেদনা যেন শতগুনে বুকের ভেতর আঘাত করছে। ঘরের দেওয়ালে টানানো আয়শা সাথে ওর যুগলবন্দী ছবিটার দিকে তাকিয়ে শফিক ভাবে, বিয়ের পর পর নবপরিণীতা বউকে রেখে যেদিন সে রাঙ্গামাটি চলে গিয়েছিল; তখন শান্তি বাহিনীর মতো চিহ্নিত শত্রুকে চোখে দেখে মোকাবেলা করার সম্ভব ছিল। শত্রু কোন দিক থেকে আঘাত হানতে পারে তা অনুমান করায় সমস্যা ছিল না।
প্রয়োজনে হাতিয়ার ব্যবহার করে শত্রুকে ঘায়েল করার সুযোগও ছিল। সেদিন আয়শার জীবন নাশের কোনো শঙ্কা ছিল না। কিন্তু আজ! এক অদৃশ্য শত্রু আমাদের ঘিরে ধরেছে। ঘরের পাশেই যেন শত্রুর আনাগোনা। আয়শা, ছেলেকে নিয়ে যোজন যোজন দূরে থাকলেও জীবন নাশের আশঙ্কা এখন দু’জনেরই।

আরো পড়তে পারেন

শেষ বিকেলের অতিথি

আজ চন্দ্রার কথা মনে পড়তেই ছল ছল চোখে অশ্রুবিন্দু ঝড়ছে। তার অভিমানের শেষ আকুতি মনের মধ্যে বারবার ধাক্কা দেয়। তার প্রস্থান শেষ পর্যন্ত এতো কঠিন হবে বুঝতে পারিনি। আগেও চন্দ্রার সাথে হয়েছে অভিমানের খুনসুটি। নিজেকে মেঘের আড়ালে ঢাকতে চেয়েছে, কিন্তু সে মানাভিমান ক্ষণিকেই ইতি ঘটে গেছে। জোছনা হয়ে সে ধরা দিয়েছে। খুব ছোট্ট বিষয় নিয়ে….

স্মৃতি এখন কী করবে

জেলখানা থেকে বেরিয়ে স্মৃতি বাসে চড়ে বসে। সঙ্গে ওর মেয়ে ফাতেমা। বেশিক্ষণ কথা বলতে পারেনি হায়দারের সঙ্গে। শুধুই চোখ বেয়ে পানি পড়েছে। ফাতেমাও ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে। আর হয়তো দেখা হবে না বাবার সঙ্গে। হায়দারের চোখও ভেজা ছিল। আজই হয়তো ওদের শেষ দেখা। হায়দার বারবার স্মৃতির হাত ধরে অনুরোধ করেছে ওকে ক্ষমা করে দিতে।….

ইন্টারভিউ

কত দিন পর দেখা হলো রূপার সঙ্গে। তা মনে করতে পারছি না। চোখে চোখ পড়তেই কিছুটা থমকে গেলাম। চিন চিন করে উঠল বুকের ভেতর। ভেতর-বাইর শুরু হলো জ্বলন-পোড়ন। কথা বলব কি-না তা বুঝে ওঠার আগেই সে এলো এগিয়ে। আমাকে বলল, সায়েম তুমি এখানে? আমার ইন্টারভিউ আজ। তোমারও কি তাই? হ্যাঁ। আমারও তাই। কেমন আছ তুমি?….

error: Content is protected !!