
এক.
শোর উঠেছে রক মিউজিক নাকি বিলুপ্ত হবার পথে। গত শতকের নব্বই দশকের পর থেকেই রক মিউজিকের উন্মাদনা পড়তির দিকে। তার নানান কারণও অবশ্য রয়েছে। মূল কারণ সম্ভবত কম্পিউটার প্রযুক্তির বিকাশ ও বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেটের বিপ্লব ঘটে যাওয়া। কেননা এই দু’টি বিষয় আসলে মানুষের বিনোদিত হবার ধরণকেই পাল্টে দিয়েছে। অবশ্য রক মিউজিকের এই ক্ষয়ের পেছনে তার নিজস্ব কিছু চারিত্র্যও কম-বেশি কাজ করেছে। ক্লাসিফিকেশনের আধিক্য, অর্থাৎ অসংখ্য সাব-জনরা (Sub-Genre) তৈরী হওয়ার বিষয়টিও রক মিউজিকের এই ক্ষয়িষ্ণুতার পেছনে প্রভাবকের কাজ করেছে বলে ধারণা করা যায়। তথ্যটি প্রায় অবিশ্বাস্য যে, খুঁজতে গেলে রক মিউজিকের অন্তত তিরিশটি বা তারও বেশী সাব-জনরা বের করা যাবে। এত-এত উপ-ঘরানা তৈরী হবার মত সাঙ্গীতিক বাস্তবতাই আসলে রক মিউজিকের ছিল কী না, সেটিই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হতে পারে এখানে। তাছাড়া সিন্থ-মিউজিক; যা সিন্থেসাইজার-পপ বা টেকনো-পপ নামেও অধিক পরিচিত— সেটি মানুষের শোনার কান, মানে সঙ্গীত রুচিকেই ততোদিনে বদলে দিতে শুরু করেছিল।
মানুষ যেহেতু উদ্ভাবনপ্রিয়, ফলে সে তার প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনকে প্রাত্যাহিক জীবনে ফলিত অবস্থায় দেখতে ও প্রয়োগ করতে আগ্রহী হবে, সেটিই স্বাভাবিক। কম্পিউটারের এই বাইনারি নম্বরের যুগে প্রবেশ করবার পর যখন দেখা গেল, কেবলমাত্র একটি বায়বীয় সফটওয়্যার ব্যবহার করেই রক মিউজিকে যে কোন ধরণের গিটার, ড্রামস বা সমগোত্রীয় সঙ্গীত যন্ত্রের অবিকল সুর ও শব্দ সৃষ্টি করা সম্ভব হচ্ছে, তখন মিউজিশিয়ান প্রকৃত বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা ও ঝোঁক হারিয়ে ফেললেন। পরিব্রাজনে গেলে পাহাড়ে-জঙ্গলে হুট করে সন্ধ্যা নামলে যেমন বিপদে পড়ে লোকে, তেমনই রক মিউজিকও এমন আকস্মিক পরিবর্তনে বড় রকমের বিপদে পড়ে গেল। কেননা, রক মিউজিকের সাঙ্গীতিক অনুভব সৃষ্টির প্রথম ও প্রধান শর্তই হল ‘প্রকৃত’ বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার। রক সঙ্গীতের যে কোন শ্রোতা মাত্রই বিষয়টি জানবেন। আর সেটি যেহেতু হচ্ছে না, তাই স্বাভাবিকভাবেই রক মিউজিকের গ্রাফটিও পড়তির দিকে থাকবে, এ বিচিত্র কী আর! যে কারণে সঙ্গীতের অন্যান্য জনরার সাথে টিকে থাকাই রক মিউজিকের জন্য এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াল। বোঝার সুবিধার্থে একটা বরং উদাহরণ দেয়া যাক। রক মিউজিককে যদি ‘অরগ্যানিক মিউজিক’ বলা যায়, মানে— আমাদের শোনার কানে রক মিউজিকের যেই প্রকৃত অনুভব, সেটি যথাযথভাবে সৃষ্টি করতে হলে একজন মিউজিশিয়ানকে প্রকৃত বাদ্যযন্ত্রটিই ব্যবহার করতে হবে। কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত সফটওয়্যারের কোনো বায়বীয় বা ইথারীয় ইফেক্ট নয়। রক-সঙ্গীতে এ’রকমের প্রযুক্তিমুখীনতা ওই ‘অরগ্যানিক মিউজিক’ থেকে ক্রমেই বিযুক্ত করে ফেলল শ্রোতাদের।

ডিজিটাল কমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে এ’রকম গাণিতিক কোড ব্যবহার করে কোন কিছু সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে বলে কোয়ান্টাইজেশন। টার্ম হিসেবে পদার্থবিজ্ঞানের ফেনোমেনার ক্ষেত্রে কোয়ান্টাইজেশনের আরও পরিব্যাপ্ত ও ভিন্নার্থক সংজ্ঞা থেকে থাকবে, কিন্তু সেটি আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু নয়। একজন রকস্টার গিটার-প্লে আর ফোর-ফোর বিটের ড্রামসের ঝংকারের সাথে কন্ঠের উচ্চ নিনাদে যেই মুর্চ্ছনা ও সাঙ্গীতিক আবহের সৃষ্টি করেন, সেটিই বিশুদ্ধ রক মিউজিক সৃষ্টির স্বীকৃত, স্বাভাবিক ও অনুসৃত প্রক্রিয়া। এমন একটি প্রক্রিয়ার সাথে একজন রকস্টার শারীরিক ও মানসিকভাবেও ভীষণ সম্পৃক্ত ও অভ্যস্ত থাকেন। ফলে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত এই কোয়ান্টাইজেশন যখন রক মিউজিককে গিলে খেতে উদ্যত হল, তখন একজন রকস্টারের জীবনাচারেও আমূল পরিবর্তন সূচিত হল। কালের পরিক্রমায় ও যুগের চাহিদার বিপরীতে এটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ও নবতর বাস্তবতা হিসেবে দেখা দিল। রকস্টার/মিউজিশিয়ানরাও এমন পরিবর্তিত বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে পরিবর্তিত ঘরানার রক মিউজিক সৃষ্টি ও চর্চা করতে লাগলেন। ফলে রক মিউজিক সৃষ্টির ক্লাসিক্যাল ও স্বীকৃত ধারাটিতে একটি বড় ধরণের ছেদ পড়ল। আমরা জানি, রক মিউজিক নিজেই একটি ক্লাসিক ব্যাপার। ফলে আজকের এই সফটওয়্যার ও অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপগুলো এসে যখন প্রায় বিদায়-ঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছে গিটার ও ড্রামবিট নির্ভর প্রকৃত রক মিউজিকের, তখন রক মিউজিকের শ্রোতা ও সঙ্গীতকার উভয়কেই রক মিউজিকের এই পড়ন্ত বাস্তবতাকে মেনে নিতে হচ্ছে। এমনকি আজকের এই ‘ফিঙ্গারটিপ সল্যুশন’ এর দুনিয়াতেও রক মিউজিকের পুনরুত্থানের বিষয়ে আমাদের দৃশ্যত কোনো ‘সল্যুশন’ চোখে পড়ছে না। যুগের সাথে তাল না মিলিয়ে রক মিউজিক কি তবে পেছন দিকে হাঁটবে? এ’কিছুটা অদ্ভুতুড়ে ব্যাপার বটে।
এই বাইনারি নম্বরের যুগে প্রবেশ করবার পর যখন দেখা গেল, কেবলমাত্র একটি বায়বীয় সফটওয়্যার ব্যবহার করেই রক মিউজিকে যে কোন ধরণের গিটার, ড্রামস বা সমগোত্রীয় সঙ্গীত যন্ত্রের অবিকল সুর ও শব্দ সৃষ্টি করা সম্ভব হচ্ছে, তখন মিউজিশিয়ান প্রকৃত বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা ও ঝোঁক হারিয়ে ফেললেন। পরিব্রাজনে গেলে পাহাড়ে-জঙ্গলে হুট করে সন্ধ্যা নামলে যেমন বিপদে পড়ে লোকে, তেমনই রক মিউজিকও এমন আকস্মিক পরিবর্তনে বড় রকমের বিপদে পড়ে গেল। কেননা, রক মিউজিকের সাঙ্গীতিক অনুভব সৃষ্টির প্রথম ও প্রধান শর্তই হল ‘প্রকৃত’ বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার
দুই.
অনুমিতভাবেই আধুনিক রক মিউজিকের জন্মস্থান মার্কিন-মুলুকে। পাশ্চাত্য-সভ্যতা গড়ার কাজে সাত-সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সুদূর আফ্রিকা থেকে দাস হিসেবে যাদেরকে আনা হয়েছিল, তাদের মাধ্যমেই বিভিন্ন ঘরানার সঙ্গীত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল উত্তর আমেরিকায়। মূলত আফ্রো-আমেরিকান ব্লুজ, জ্যাজ, বুগি-উগি ও গসপেল-মিউজিকের সাথে আমেরিকার স্থানীয় ফোক ঘরানার সঙ্গীতের সম্মিলনের ফলে ভীষণ অপ্রচল ও শ্রুতিগতভাবে ‘নতুন’ এক ধরণের সঙ্গীতের সূচনা হয়, যাকে মানুষ পরবর্তীতে রকেন’রোল নামে চিনেছিল। ওই রকেন’রোল থেকেই পরবর্তী এক দশকের মধ্যে স্বতন্ত্র জনরা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল আদি ও প্রাথমিক পর্যায়ের রক সঙ্গীত। ততোদিনে ইলেকট্রিক গিটার চলে এসেছে মিউজিশিয়ানদের হাতে। মূলত ইলেকট্রিক গিটার ও ড্রামসের ব্যবহার এবং উচ্চস্বরের গায়কী-সহ রক গানের বাণীগত তেজস্বীতা, সর্বোপরি মেলোডি নির্ভর সুরেলা কম্পোজিশন রক মিউজিককে এক পৃথক আবহ ও নিজস্বতা দান করেছিল, রকেন’রোল থেকে।

প্রাথমিক অবস্থার, মানে ৬০ দশকের রক গানগুলো আজ ক্লাসিক-রকের মর্যাদা পেয়েছে। পরবর্তীতে ব্লুজ-রক, জ্যাজ-রক, ফোক-রক, সাইকেডেলিক-রক, প্রগ্রেসিভ-রক, হার্ড-রক, গ্ল্যাম-রক, সফট-রক, পাংক-রক (পরে পাংক-রক থেকে সাব-জনরা হিসেবে নিউ ওয়েভ, পোস্ট-পাংক, হার্ডকোর-পাংক ইত্যাদি বিকশিত হয়), অল্টারনেটিভ-রক (পরে অল্টারনেটিভ-রক থেকে সাব-জনরা হিসেবে বিকশিত হয় গ্রাঞ্জ-রক, ইন্ডি-রক) নামক সাব-জনরা সৃষ্টি ও তার চর্চা হতে আমরা দেখেছি। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, ৭০ দশকের প্রথমার্ধেই রক মিউজিক থেকে একটি ধারা অত্যন্ত শক্তিশালীভাবে তার নিজস্ব তেজ নিয়ে রক মিউজিকের পাশাপাশি বিকশিত হতে থাকে, যা সবার কাছে হেভি-মেটাল বা মেটাল নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। রক মিউজিকের প্রচল বৈশিষ্ট্যগুলোকে ছাপিয়ে আরও উচ্চগ্রামের গগণবিদারী, অপেক্ষাকৃত কর্কশ ধরণের গায়কী এবং ঘনসন্নিভ গিটার ও ড্রামস বাদন হেভি-মেটালকে পৃথক এক ধরণের উন্মত্ততা দান করেছিল। আজকের হেড-ব্যাঙ্গিং শব্দটিকে আমরা এখানে এই ঘরানার সাথেসাথেই জনপ্রিয় হতে দেখব। রকের মত সাব-জনরা হিসেবে এখানেও আছে থ্র্যাশ-মেটাল, ডেথ-মেটাল, প্রগ্রেসিভ-মেটাল, গ্রুভ-মেটাল, ব্ল্যাক-মেটাল, ইন্ডাস্ট্রিয়াল-মেটাল, অল্টারনেটিভ-মেটাল ইত্যাদি। ফলে আজকের নানা ঘরানা ও উপ-ঘরানার রক ও হেভিমেটাল মিউজিকের উৎপত্তির জায়গা খুঁজতে গেলে আদি রক মিউজিকের কাছেই ফিরে আসতে হবে আমাদের বারবার।
তবে এত সাব-জনরা, এত বৈভিন্ন্য-সূচক সাঙ্গীতিক আবহের পরও মাত্র ছয় দশকেই রক মিউজিক আজ পতনোন্মুখ ও ক্ষয়িষ্ণু! কম্পিউটার প্রযুক্তির উন্মেষ, কোয়ান্টাইজেশন এবং উপরে বলা কারণগুলো ছাড়া রক মিউজিকের আধিপত্য ক্ষুণ্ণ হবার অন্য কিছু ‘আমেরিকান’ কারণও ছিল। তাতে দৃকপাত করা গেলে আমরা দেখব, পাশ্চাত্যে রক মিউজিকের এমন একটি সমালোচনা ইদানিং চালু হয়েছে যে, Rock music probably became too white and too male। অর্থাৎ একদিকে সাদা ও অন্যদিকে ভীষণরকম পুরুষ প্রভাবিত হয়ে পড়েছে আজকের রক মিউজিক। কিছু চিত্রের দিকে তাকালে এর সত্যতাও পাওয়া যায়। কালোদের মাধ্যমে আমেরিকায় রক মিউজিকের সূচনা হলেও এখনকার সময়ে আমেরিকান রক মিউজিকের বেশি শ্রোতা আর কালোতে অবশিষ্ট নেই, শ্রোতাদের অর্ধেকের বেশি আজ শেতাঙ্গ। তাছাড়া রকেন’রোল পর্ব থেকে আদি রক মিউজিকের শ্রোতাদের একটা বড় অংশের শ্রোতাই ছিল নারী।

রকেন’রোল যুগের এলভিস প্রিসলি থেকে পরবর্তীতে রক মিউজিকের কিংবদন্তী ব্যান্ড বিটলস, রোলিং স্টোনস, দ্য হু বা ক্রিম এর মত শিল্পী ও ব্যান্ডের ফ্যান বেজ প্রায় অর্ধেকই ছিল নারী শ্রোতা। যেটি হালের কোনো রকস্টার বা রক ব্যান্ডগুলোর ক্ষেত্রে তেমন দেখা যায় না। খুব জোরালো না হলেও এই কারণটি ফেলে দেয়ার মতও নয়। ফলে অবনত স্বরে এটিরও একটি উল্লেখ থাকল।
তিন.
গত শতকের ৬০ ও ৭০ দশকে রক মিউজিক ছিল তারুণ্যের স্ফূরণ ও চর্চার প্রধানতম মাধ্যম। ৮০ দশকের পর প্রযুক্তির নানামুখী বিকাশ ঘটায় এবং তারুণ্যের স্ফূরণ ঘটার নানান মাধ্যম তৈরির ফলে সৃজনশীলতার প্রকাশও বিবিধমুখী হয়ে পড়ে। ৮০ দশকে পাশ্চাত্যে শুরু হয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও গেম সংস্কৃতি ও নতুন সহস্রাব্দ শুরু হবার পর ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ অপরাপর বিনোদন-অনুষঙ্গের বিকাশ ঘটায় সামগ্রিকভাবে তারুণ্যের প্রধান আকর্ষণ আর রক মিউজিককে কেন্দ্র করে থাকেনি। অর্থাৎ তারুণ্যের আকর্ষণের বিষয় হিসেবে রক মিউজিক তার অবিসংবাদিত জায়গাটি ক্রমেই হারিয়ে ফেলে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে যায়, বিগত ছয় দশকে রক মিউজিকের যেই জগৎজোড়া খ্যাতি ও প্রতাপ গড়ে উঠেছিল, তার পুনরাধিষ্ঠান কি প্রকৃতপক্ষেই আর সম্ভব হবে? একজন শ্রোতা ও ভক্ত হিসেবে সেই সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে দেবারও উপায় নেই। বিষয়টি নির্ভর করছে আমাদের এই চলমান স্ক্রিন-যুগ (মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, এমপিথ্রি প্লেয়ার, ডিজিটাল স্টুডিও এইসবের স্ক্রিন নির্ভরতার কথা ভেবে বলা) শেষ হবার পর পৃথিবীতে কী ধরণের সাংস্কৃতিক হাওয়া প্রবাহিত হয়, তার উপর। কেননা বর্তমানের নানা বাস্তবতা ও ঘটমানতায় রক মিউজিকের আধিপত্য ক্ষুণ্ণ হলেও শিল্পের শ্বাশত নিয়মানুযায়ী সংগীতের এই ধারাটি বিলীন হবার নয়। ফলে যারা ভাবছেন রক মিউজিক দ্রুতই ডাইনোসরের অনুগামী হবে, তারা সম্ভবত ভুল ভাবছেন। জগতের কোথাও না কোথাও তাদের জন্য অনাগত ও অশ্রুত রকস্টারের গিটার তৈরি হচ্ছে।