Author Picture

প্রথম ধাক্কা

খন্দকার রেজাউল করিম

(একটি কাল্পনিক বিতর্ক। যাঁরা অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি : দেকার্ত (Rene Descartes, ১৫৯৬-১৬৫০): ফরাসি দার্শনিক, বিজ্ঞানী, এবং গণিতবিদ। আল হেথাম (Ibn al-Haytham, ৯৬৫-১০৪০): গণিতবিদ, দার্শনিক, জ্যোর্তিবিদ। সে আমলের প্রখ্যাত মুসলিম পন্ডিত। তাঁর লেখা বইগুলো ইউরোপিয়ান দার্শনিকদের উপরে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিলো। গ্যালিলিও (Galileo Galilei, ১৫৬৪-১৬৪২): ইতালির বিজ্ঞানী এবং জ্যোতিবিজ্ঞানী। তিনি প্রথম দূরবীন দিয়ে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান এবং গতি পর্যবেক্ষণ করেন, বৃহস্পতি গ্রহের চারটি বড় বড় উপগ্রহের সন্ধান পান। তিনি আবিষ্কার করেন পড়ন্ত বস্তুর সূত্র, সরল দোলকের সূত্র, দোলক-ঘড়ি, এবং বায়ু-থার্মোমিটার। ‘পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে,’ এই ঘোষণার জন্যে রোমের ধর্মযাজক পোপের নির্দেশে তাঁকে জীবনের শেষ দশটি বছর গৃহবন্দী অবস্থায় কাটাতে হয়। নিউটন (Isaac Newton, ১৬৪৩-১৭২৭): ব্রিটিশ বিজ্ঞানী এবং গণিতবিদ। মহাকর্ষ, বল-গতির সূত্র, আলোর বর্ণালী, প্রতিফলিত আলোর দূরবীন, এবং ক্যালকুলাসের আবিষ্কারক।)


দেকার্ত : আমাকে আধুনিক দর্শনশাস্ত্রের পিতা বলে ডাকা হয়। কিন্তু গতিবিদ্যা, আলো, এবং গণিত শাস্ত্রে আমার অনেক অবদান আছে। আমার “cogito ergo sum,” (I think, therefore I am) কথাটির জন্য দার্শনিক-মহলে সবাই আমাকে চেনে। আমি চিন্তা করি, এই আমার প্রধান পরিচয়, এই আমার অস্তিত্বের প্রমান।
লেখক : হায়, দেকার্ত সাহেব, আমি শুধুই দুঃশ্চিন্তা করি। আমি খাই, আমি পরচর্চা করি, এরাই আমার অস্তিত্বের নির্যাস। শুনেছি গ্যালিলিও এবং মুসলমান বিজ্ঞানী ইবনে আল হেথাম তোমার চিন্তার উপরে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে। সে সম্পর্কে কিছু জানতে ইচ্ছে করে।
দেকার্ত: বুড়ো বয়েসে গ্যালিলিও যখন ধর্মযাজকদের আদালতে অপদস্থ হচ্ছেন, আমি তখন নবীন যুবক। গ্যালিলিওর বিচারের খুঁটিনাটি আমি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। যৌবন বয়েসে গ্যালিলিও কাউকে তেমন পরোয়া করতেন না, অনেকটা সক্রেটিসের মতো! তাই শাস্তি দুজনকেই পেতে হয়েছে। গ্যালিলিওর কাছে শিখেছি বল এবং গতির তত্ত্ব, একটি বস্তুর গতিকে কেমন করে দুটি গতির সমষ্টি হিসেবে প্রকাশ করা যায়। আর আলো নিয়ে আমার যে সব আবিষ্কার, তা বিজ্ঞানী আল হেথাম পাঁচশো বছর আগে শুরু করেছিলেন মিশরের গবেষণাগারে। বিজ্ঞান এবং দর্শনের বিশ্লেষণ প্রণালী আমি তাঁর বই পড়ে শিখেছি। ভাগ্যিস, তাঁর বইগুলো ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল! আল হেথাম ল্যাটিন ভাষায় আলহাজেন বলে পরিচিত। শ’তিনেক বই লিখেছিলেন তিনি, অপটিক্স, গতিবিদ্যা, সংখ্যাবিদ্যা, ক্যালকুলাস, আলজেব্রা, জ্যামিতি, ত্রিকোনোমেট্রি, ধর্মশাস্ত্র, কিছুই বাদ নেই! শুধু আমি কেন, কেপলার, গ্যালিলিও, নিউটন, সবাই তাঁর কাছে ঋণী। ভাবতে অবাক লাগে, বিজ্ঞান এবং দর্শনের জগতে রোমের রাজা এবং খ্রিস্টান ধর্মযাজকের দল শুধুই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওদিকে মুসলমান খলিফা আল মানসুর, আল মামুন, হারুনুর রশিদ, কি প্রচন্ড আবেগে জ্ঞানের আলো প্রচারে হাত বাড়ালেন, একটি নতুন সভ্যতা কেমন দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে।

লেখক : তুমি শুনলে খুশি হবে যে ২০১৫ সালে UNESCO ইবনে হেথামকে অপটিক্সের পিতা বলে ঘোষণা করেছে। ১০০১ টি আবিষ্কারের জনক বলে ২০১৫ সালে তাঁকে সম্মানিত করা হয়। বিখ্যাত অভিনেতা ওমর শরীফ হেথামের চরিত্রে তাঁর জীবনের শেষ অভিনয় করে গেছেন! তবে তোমার সাথে ইবনে হেথামের একটা পার্থক্য খেয়াল করেছি, তুমি জ্ঞানের পথে যাত্রা শুরু করো ঈশ্বরের উপরে ভরসা করে, হেথাম শুরু করে সব কিছুর উপরে অবিশ্বাস থেকে। অথচ দুজনেই শেষমেশ পৌঁছে যাও একই স্থানে!

আল হেথাম : যে বই-কিতাব পড়ে, কিন্তু তার সত্যমিথ্যা যাঁচাই করে না, সে সত্য-সন্ধানী নয়। যে সত্য-সন্ধানী সে সন্দেহ করে, প্রশ্ন করে। যদি জ্ঞানের সন্ধান করতে চাও তবে প্রথমেই তুমি যা পড়ো তার সাথে শত্রুতা ঘোষণা করো। বুঝতে চেষ্টা করো, চারদিক থেকে ওকে আক্রমণ করো। সেই সাথে নিজেকেও সন্দেহ করো, তোমার নিজের মন নিরপেক্ষ তো?

নিউটন : আমি যদি আরো অনেকের চেয়ে বেশি দূরে দেখে থাকি, তার কারণ এই যে আমি কয়েকটি জ্ঞান-বৃক্ষের উপরে দাঁড়িয়েছিলাম। আল হেথাম ছিলেন এমন একজন জ্ঞান-বৃক্ষ।

গ্যালিলিও : আবার গতিবিদ্যার কথায় আসা যাক। ধরো একটা মার্বেল বাড়ির ছাদের উপরে জোরে গড়িয়ে দিলে। মার্বেলটি বাড়ির ভিতর থেকে কত দূরে এসে পড়বে? ছাদ থেকে পড়ার সময় মার্বেলটি বাঁকানো পথে নিচে নামতে থাকবে। ও একই সাথে নিচে পড়ছে এবং মাটির সমান্তরালে এগুচ্ছে, ওর গতি এই দুটি গতির সমষ্টি (superposition)। আমি পরীক্ষা করে দেখেছি, যে মুহূর্তে মার্বেলটি ছাদচ্যুত হলো সেই মুহূর্তে ওখান থেকে একটি পাথর ফেলে দিলে পাথর এবং মার্বেলটি একই সাথে মাটিতে এসে পড়বে। কি অদ্ভুত ব্যাপার! একটি দুর্গের চূড়া থেকে মাটির সমান্তরালে একটি কামানের গোলা ছুড়লে এবং একটি পাথর ফেলে দিলে, দুটোই এক সাথে মাটিতে এসে পড়বে, যদিও পাথরটি দুর্গের ভিত্তির পাশেই পড়েছে, আর কামানের গোলা পড়েছে ভিত্তি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে! আমার মনে হয় ছাদ থেকে গড়ে পড়া মার্বেলটির সাথে চাঁদের বাঁকা পথের গতির একটা সম্পর্ক আছে। মার্বেলের মতো চাঁদটিও হয়তো পৃথিবীর দিকে পড়ছে, কিন্তু ওর সমান্তরাল গতি পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে ওকে দূরে রেখে দিচ্ছে। বেচারা চাঁদ সেই কবে থেকে তাই ঘুরে মরছে পৃথিবীর চারদিকে। সবসময় মাটির দিকে পড়ছে, অথচ মাটিতে পড়া ওর আর হলো না!

দেকার্ত: পদার্থবিদ্যার ভরবেগ এবং শক্তির conservation laws আমি প্রথম চালু করি। ফ্রান্সে এক প্রবাদ বাক্য আছে, “the more things change, the more they remain the same.” এই আইনদুটি অনেকটা সেরকম। বস্তুর গতির কথা বলতে গেলে দূরত্ব, সময়, গতিবেগ, ত্বরণ ইত্যাদির কথা এসে পড়ে। তেমনি ভরবেগ এবং গতিশক্তির ধারণা থেকেও অনেক কিছু জানা যেতে পারে। ভরবেগ হলো বস্তুর ভর এবং বেগের গুনফল, বলতে পারো একটা চলন্ত বস্তুর ভরবেগ হলো ওর চলার আবেগ। যখন কয়েকটি বস্তুর মাঝে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয় তখন একজনের ভরবেগ আরেকজনের মাঝে সঞ্চারিত হতে পারে, কিন্তু সবার ভরবেগের সমষ্টি অপরিবর্তিত থাকবে। চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র এই যে সারাক্ষন ছুটে চলেছে, ওদের এই চলার আবেগ কোথা থেকে এলো? কে দিয়েছিলো প্রথম ধাক্কা? তিনি যে ঈশ্বর তাতে আমার সন্দেহ নেই!

লেখক: তোমার সূত্র মতে কাউকে ধাক্কা দিলে উল্টো দিকে ধাক্কা খেতে হয়। সেই “unmoved mover” সমস্যার সমাধান আজ পর্যন্ত হয় নি।


লেখক: পদার্থবিদ ও ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ইমিরিটাস প্রফেসর।

আরো পড়তে পারেন

বাঙালি মনীষীদের চা প্রীতি-অপ্রীতি

প্রাথমিক পর্যায়ে ভারতবর্ষে চায়ের বিপণন ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং। ক্রেতাদের চামুখী করার জন্য কোম্পানিগুলোর নানামুখী তৎপরতা ছিল উল্লেখ করার মতো। তারা এ কাজে বাহারি বিজ্ঞাপন ছাড়াও নানাবিধ বিনিয়োগের মাধ্যমে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের মানুষদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করত। তবে শুরুতে চরম প্রতিকূল পরিবেশের সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাদের। বৈরী এ পরিবেশ তৈরিতে সর্বতো সহযোগিতা ছিল যার, তিনি হলেন প্রখ্যাত….

ইয়ে থেকে বিয়ে

জগতের বেশিরভাগ বিয়ে প্রথমে হয় দুটো পরিবারের মধ্যে। তারপর সর্ম্পক হয় দুটো মানুষে। এটাকেই লোকে এখন বলে এরেঞ্জড ম্যারেজ। আদি কাল থেকেই এটা হয়ে আসছিল, এখনও বেশিরভাগ বিয়েগুলো পারিবারিক সম্মতি ও সর্ম্পকে হয়। বিয়েতে সর্ম্পক হয় না, সর্ম্পক গড়ে। প্রেমে সর্ম্পক গড়ে ওঠে। আধুনিক প্রেমের বিয়ে যতটা সিনেমা গল্পে হয়, বাস্তবে ঠিক ততটা নয়।  বিয়ের….

আর্কটিক থেকে উপসাগর পর্যন্ত: কানাডা ও বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিপূর্ণ হুমকি

এটি শুধু একটি ভৌগলিক বা স্থানিক ব্যাপ্তির  বর্ণনা নয় , যা আর্কটিক অঞ্চল থেকে উপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ভ্রমণ বা পরিসরের পরামর্শ দেয়। আর্কটিক বলতে পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তরের অংশকে বোঝায়, যা আর্কটিক মহাসাগর এবং আশেপাশের ল্যান্ডস্ক্যাপ জুড়ে রয়েছে। অন্যদিকে উপসাগর জলের শুধু একটি অংশ নয় যা ভূমি দ্বারা আংশিকভাবে ঘেরা ও একটি প্রশস্ত মুখ দিয়ে সামনে….

error: Content is protected !!