
(একটি কাল্পনিক বিতর্ক। যাঁরা অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:
এরিস্টটল (খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৪-৩২২): গ্রিক দার্শনিক এবং বিজ্ঞানী, প্লেটোর প্রিয় ছাত্র। গ্যালিলিও (Galileo Galilei, ১৫৬৪-১৬৪২): ইতালির বিজ্ঞানী এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তিনি প্রথম দূরবীন দিয়ে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান এবং গতি পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি আবিষ্কার করেন পড়ন্ত বস্তুর সূত্র, সরল দোলকের সূত্র, দোলক-ঘড়ি, এবং বায়ু-থার্মোমিটার), নিউটন (Isaac Newton, ১৬৪৩-১৭২৭): ব্রিটিশ বিজ্ঞানী এবং গণিতবিদ। মহাকর্ষ, বল-গতির সূত্র, আলোর বর্ণালী, প্রতিফলিত আলোর দূরবীন, এবং ক্যালকুলাসের আবিষ্কারক।)
এরিস্টটল : আমি চেয়ারে বসে গতি নিয়ে অনেক ভেবেছি। উপর থেকে ছেড়ে দিলে সব কিছু পৃথিবীর বুকে এসে পড়ে। এটাই হলো বস্তুর স্বাভাবিক গতি। তেমনি চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র সব পৃথিবীকে ঘুরে পাক খায়, ওটাই ওদের স্বাভাবিক গতি। কোনো বস্তুকে চলতে দেখলেই বুঝতে হবে যে আরেকটা বস্তু ওকে টানছে বা ঠেলছে। ঠেলাঠেলি টানাটানি ছাড়া গতি সম্ভব নয়। স্বাভাবিক গতির কথা আলাদা।
গ্যালিলিও : একেবারেই ভুল ধারণা। সরল পথে সমবেগে চলার জন্যে কোনো বলের (Force) প্রয়োজন হয় না, টানাটানি বা ঠেলাঠেলির দরকার নেই। একে পদার্থের গতি জড়তা বলে। ঠেলাঠেলি করতে গেলে ওর গতিবেগের অথবা দিকের পরিবর্তন ঘটবে। ধরো, একটা মার্বেলের উপরে বল প্রয়োগ করে মেঝের উপরে ছুড়ে দিলে। ও কিছুক্ষন পরে থেমে যায়। কিন্তু যদি বাতাস এবং মেঝের সাথে ঘর্ষণ না থাকতো তবে ও থামতো না, মার্বেলটি অনন্ত কাল ধরে সরলপথে চলতো। অনেক পরীক্ষা এবং ভেবেচিন্তে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। প্রথমে মার্বেলটি ছুঁড়েছি একটু অমসৃণ সমতলে। কিছুদূর গিয়ে ও থেমে গেছে। মসৃণতা যতই বেড়েছে, বলটি ততই বেশি দূর গেছে। শীতকালে বরফের উপরে মার্বেলটি তো আর থামতেই চায় না!
নিউটন : আমি গতির তিনটে সূত্র আবিষ্কার করেছি। গরুগাড়ি থেকে এরোপ্লেন, ফুটবল থেকে কামানের গোলা, বাগানের দোলনা থেকে আকাশের গ্রহ তারকা সবাই আমার এই তিনটে সূত্র অনুসারে চলে! আমার প্রথম সূত্রটি স্থিতি এবং গতি জড়তা নিয়ে। এ ব্যাপারে আমি গ্যালিলিওর সাথে একমত। গতি নিয়ে আমার প্রথম সূত্র হলো, “যদি বাইরে থেকে বল প্রয়োগ না করা হয়, তবে যে বসে আছে সে বসেই থাকবে, আর যে ছুটে চলেছে সে সরলপথে সমবেগে চিরদিন ছুটেই চলবে।”
গরু: আমি গরু। পন্ডিতদের বিবাদে আমার কথা বলা শোভা পায় না। তবে গরুর মতো বুদ্ধি নিয়ে কতলোক তো সারাক্ষন কথা বলে যায়! গ্যালিলিও বলেছিলেন, যে তিনি জীবনে এমন কোনো মূর্খ লোক খুঁজে পান নি, যার কাছ থেকে কিছু শিখতে পারেন নি! এই গরুর কাছে হয়তো তোমাদের শেখার কিছু আছে। এক হাট থেকে আরেক হাটে গরুগাড়ি টেনে জীবনটা কাটিয়েছি। গতি সম্পর্কে আমার কিছু বলার আছে। তোমার প্রথম সূত্রের দ্বিতীয় অংশ আমার কাছে অসম্ভব বলে মনে হয়।
নিউটন: পন্ডিত, মূর্খ, গরু, সবার কাছেই “সরল পথে অন্তহীন চলার” কথাটা অসম্ভব মনে হয়। চলন্ত বস্তু থেমে যায়, আমরা প্রতিদিন চোখের সামনে দেখছি, তাই এই অবিশ্বাস। কিন্তু যদি ঘর্ষণ এবং বাতাসের বাধা না থাকতো তাহলে একটি চলন্ত বস্তু অনন্তকাল ধরে সমবেগে সরল পথে চলতো। এবারে বলি আমার দ্বিতীয় সূত্র, “বলকে ভর (mass) দিয়ে ভাগ করলে পাওয়া যাবে ত্বরণ (acceleration), ত্বরণ = বল/ভর।”
গরু: বল, ভর, ত্বরণ আমার চির-চেনা সব শব্দ। গরুগাড়ি চলে কার বলে? বাঁকা পথে ঘানি টানে কে? পিঠে গাড়িয়ালের লাঠি পড়লে ত্বরান্বিত বেগে কে চলে? এই সুত্রটি আমার পছন্দ হয়েছে। ত্বরণ মানে তো গতিবেগের পরিবর্তন। যত বেশি বল খাটাবে গাড়ির ত্বরণ ততই বেশি হবে। গরুগাড়িতে যত মাল বোঝাই হবে ওর ত্বরণ ততই কম হবে, একেবারেই সহজ কথা। তবে এর জন্যে আবার সমীকরণের কি দরকার? সমীকরণ জিনিষটা আমার একেবারেই পছন্দ নয়।
নিউটন: আমার তৃতীয় সূত্র, “অ্যাকশন = রিঅ্যাকশন, তুমি যদি কারো উপর বল প্রয়োগ কর, সে তোমার উপরে উল্টো দিকে সমপরিমাণ বল প্রয়োগ করবে।”
গরু: তা কি করে সম্ভব? আমি যদি বল প্রয়োগ করে গরুগাড়ি সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই তবে গরুগাড়ি পেছন থেকে আমাকে সমান বেগে টানবে। তাহলে আমি সামনে যাব কি করে? তোমার এই সূত্র সত্যি হলে কেউ ঠেলে বা টেনে কোনো কিছু নড়াতে পারতো না। টারজান এবং একটি ছোট্ট শিশু দড়ি টানাটানি করছে। টারজানের গায়ে বেজায় জোর। কিন্তু তাতে লাভ কি? টারজান যত জোরে দড়িতে টান দিচ্ছে, দড়িটি সমান জোরে টার্জানকে উল্টো দিকে টান দিচ্ছে। দড়ি টানাটানির খেলায় তাহলে কখনো হারজিত হতো না!
নিউটন: ধরা যাক তোমার গায়ের জোর টারজানের চেয়ে দশগুন বেশি, গরুগাড়িতে কোনো মাল নেই, কিন্তু চাকাগুলো কাদায় আটকে গেছে। তুমি টানছো প্রচন্ড বেগে, চাকাগুলো বনবন করে ঘুরছে, কিন্তু গাড়িটি একটুও সামনে এগুচ্ছে না! কেন?
গরু: এমন অভিজ্ঞতা আমার অনেক হয়েছে। নির্দয় গাড়িয়াল এসময় খামোখা আমাকে মারধর করে। আমি প্রাণপন চেষ্টা করি, কিন্তু গাড়ি তো নড়ে না।
নিউটন: গাড়িয়ালকে আমার এই তিন নম্বর গতিসূত্র বোঝালে হয়তো কাজ হতো। আপাততঃ তোমাকে বোঝাই। তুমি টানাটানি করে গরুগাড়ির চাকা ঘোরাতে পারো, এই পযন্তই তোমার ক্ষমতা। চাকাটি ঘোরার সময় মাটিতে ধাক্কা দেয়, মাটি চাকাকে উল্টো দিকে ধাক্কা দেয়, সেই ধাক্কাতেই গাড়ি সামনে এগিয়ে চলে। নরম কাদামাটির ধাক্কা দেয়ার ক্ষমতা খুব কম, তাই চাকাটি ঘুরছে কিন্তু গাড়িটি সামনে যাচ্ছে না। আমি হাঁটাহাঁটি করি কি করে? পা দিয়ে মাটিতে গুতো দিই, মাটি আমাকে উল্টো দিকে গুতো দেয়। বর্ষার পিছল পথে হাঁটা এতো কঠিন কেন? পিছল পথে ঘর্ষণ কম, তাই আমি পথকে ভালোকরে গুতো দিতে পারি না, পথও আমাকে ভালোকরে গুতো দিতে পারে না!
গরু: বেশ। কিন্তু টারজান-শিশুর দড়ি টানাটানি? ওখানে তো কোনো চাকা নেই!
নিউটন: টারজান এবং শিশু দুজনেই দাঁড়িয়ে শুধু দড়ি টানছে না, সেই সাথে পা দিয়ে মাটিকে ঠেলছে। মাটিও ওদের উল্টোদিকে ঠেলছে, সেই সাথে আছে দড়ির টান। নিজেই একটু ভেবে দেখো!
গরু: মাটির মতো জড় পদার্থ কেমন করে বল প্রয়োগ করে তা ভেবে আমার অবাক লাগে!
নিউটন: তুমি যদি ইটের শক্ত দেয়ালে বেজায় জোরে এক লাথি মারো তবে তোমার পা ভেঙে যাবে। তোমার পা ভাঙলো কে?