Author Picture

মনে হতো বাইরে গেলে হারিয়ে যাব অথবা বাইরে থেকে এলে দরজাটা বন্ধ পাব

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রাবন্ধিক হিসেবে বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও তার কথাসাহিত্য সম্পর্কে সাধারণ পাঠকের খুব বেশি জানা আছে বলে মনে হয়না। মুক্তবুদ্ধি ও প্রগতিশীল সাহিত্য-সংস্কৃতির ধারক এই মহান লেখক অভিনব ভঙ্গি ও চিন্তার প্রাতিস্বিক বৈশিষ্ট্যের গুণে অগণিত পাঠকের মনে স্থায়ী আসন তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। তার বৈচিত্র্যধর্মী সৃষ্টিকর্মের মধ্যে প্রবন্ধ ও গবেষণা ছাড়াও রয়েছে প্রচুর অনুবাদগ্রন্থ। প্রগতিশীল মনোভঙ্গি তার বক্তব্যকে দিয়েছে অনন্য মহিমা। দেশের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত থাকায় এসব ক্ষেত্রের সমস্যা যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর রচনা সহজ-সরল ও হৃদয়গ্রাহী। ‘বাবুলের বেড়ে ওঠা’, ‘কণার অনিশ্চিত যাত্রা’, ‘শেষ নেই’ তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। গল্প ‘ভালোমানুষের জগৎ’, ‘দরজাটা খোলো’। অনুবাদ গ্রন্থের মধ্যে ‘অ্যারিস্টটলের কাব্যতত্ত্ব’, ‘ইবসেনের বুনো হাঁস’, ‘হাউসহোলের কাব্যের সভা’। প্রবন্ধ ও গবেষণা সাহিত্যের মধ্যে, ‘অন্বেষণ’, ‘দ্বিতীয় ভুবন’, ‘নিরাশ্রয় গৃহী’, ‘আরণ্যক দৃশ্যাবলি’, ‘অনতিক্রান্ত বৃত্ত’, ‘স্বাধীনতা ও সংস্কৃতি’, ‘একই সমতলে’, ‘ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা গদ্যের সামাজিক ব্যাকরণ’ ছাড়াও উল্লেখ করার মতো আরো অনেক গবেষণাকর্ম। মনস্বী এই লেখকের সঙ্গে তাঁর কথাসাহিত্য এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা বলেন কথাসাহিত্যিক মনি হায়দার।


মনি হায়দার : আপনাকে এদেশের মানুষ শিক্ষাবিদ হিসেবেই ভালো চেনে, এর বাইরেও আপনার একটা পরিচয় আছে, আপনি গল্প দিয়ে শুরু করেছিলেন, গল্পটা কেন বাদ দিলেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : গল্প লেখার ক্ষেত্রে আমার আগ্রহটা ছিল, এই আগ্রহটা তৈরি হয়েছে কিশোর বয়সে ‘মুকুলের মহফিলের পাতা’ পড়ে। আমাদের আজাদ পত্রিকাতে এটা থাকত। সাহিত্যের শিক্ষকতার আরেকটা অসুবিধা আছে। সাহিত্যের অধ্যাপকরা যা করেন সেটা বিশ্লেষণ করেন, একটা রচনাকে বিশ্লেষণ করছেন, তার মধ্যে কী কী উপাদান আছে তা দেখছেন। পড়াতে হচ্ছে, আবার তাকে এটা অনুধাবনও করতে হচ্ছে। আর গল্প বা উপন্যস তারা কিন্তু সংশ্লেষণ করেন, নিয়ে আসেন। নানান জায়গা থেকে উপাদানগুলোকে সংগ্রহ করে এক জায়গায় নিয়ে এসে একটা পরিপূর্ণ রূপ দেন। দুটো দুই রকমের। একটা বিশ্লেষণ আরেকটা সংশ্লেষণ। এই পার্থক্যের মধ্যেই আমি পড়ে গেছি। আমার চিন্তাধারাগুলো বিশ্লেষণমুখী হয়ে গেছে। এটা অধ্যাপনার একটা অসুবিধা, যারা সাহিত্যচর্চা করেন। সেজন্য যারা সাহিত্যচর্চা করেন, তাদের মধ্যে অধ্যাপনা করলে এই অসুবিধাটা দেখা দেয় বলে আমার ধারণা এবং তারা ভালো করতে পারেন, সুবিধাজনক হলো সাহিত্যচর্চা করা। তাই প্রবন্ধ লেখার দিকেই আমি চলে গেলাম।

হায়দার : আমি ‘শেষ নেই’ উপন্যাসটা নিয়ে আপনার সঙ্গে কথার সূত্রপাত করি। ‘শেষ নেই’ মুক্তিযুদ্ধের আখ্যান, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী যে রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং নায়ক আফতাব মুক্তিযুদ্ধ করেছিল মুক্ত সমাজ গঠন করার যে আকাঙ্খা নিয়ে, মুক্তিযুদ্ধের পর সে পরিবর্তিত হয়ে গেল, আপনার দেখা চরিত্রই হয়তো।
চৌধুরী : আমি এই উপন্যাস লিখেছি ঈদসংখ্যার জন্য। ঈদসংখ্যার জন্য একটা চাপ থাকে, দ্রুত দিতে হবে। একটা সীমাও থাকে। পরে আমি একটু বাড়িয়েছি কিন্তু এটাকে আরো অনেক বড় করা দরকার ছিল।

হায়দার : হ্যাঁ, সুযোগ ছিল। এই উপন্যাসের একটা চরিত্র সুমন। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। ও যখন বড় হয়ে উঠছিল, ও যখন দেখছিল মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী এই সময়ে স্বাধীনতাবিরোধীরা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, ও প্রতিবাদ করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু ওকে আপনি মেরে ফেললেন, কেন মেরে ফেললেন?
চৌধুরী : এটা হল যে পারা গেল না। হারিয়ে গেল, আমরা ওই জিনিসটাকে ধরে রাখতে পারলাম না।

হায়দার : ও তো মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। মেরে ফেলে আপনি কি এটা বোঝাতে চেয়েছিলেন যে মুক্তিযুদ্ধে আমরা যা চেয়েছি সেটা সম্পূর্ণ পাইনি।
চৌধুরী : লেখক এটা যে অনেক সময় সচেতনভাবে করে তা না, এটা এসে যায়। তখন তার মনে হয় তার উপলব্ধিটা এখানে মূর্ত হয়েছে। সে পারছে না, এ জায়গাটা তার জন্য অনুকূল না। সে যে স্বপ্নটা লালন করছিল, সে চরিতার্থ করা যাবে না।

হায়দার : এই উপন্যাসের একটা চরিত্র ছিল পারুল, প্রথম দিকে ছিল। সে শহর থেকে গ্রামে গিয়েছিল বেঁচে থাকার জন্য, রাজনৈতিক কর্মী আফতাবের সঙ্গে তার বিয়ে হল। ’৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা তাকে তুলে নিয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত পারুলকে আর পাওয়া যায়নি। কিন্তু গোটা উপন্যাসে পারুল একটি প্রতীক হয়ে উঠেছিল, একটা নারীর, একটা লড়াইয়ের। পারুলকে কি অন্যভাবে ফিরিয়ে আনা যেত?
চৌধুরী : হয়তো যেত, কিন্তু সে যে হারিয়ে গেল, ওটা বাংলাদেশের যেন মূর্তি এক অর্থে আপনি বলতে পারেন। বিচ্ছিন্নভাবে ধর্ষণ হয়েছে, নারী নির্যাতন হয়েছে, গোটা বাংলাদেশই তো ধর্ষিত ছিল। একটা বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে। সে হারিয়েই যাবে। তার হারিয়ে যাওয়াটা তবুও বাঁচোয়া যে, সে ওদের অধীনে থাকেনি। তাকে বশ্যতা স্বীকার করতে হয়নি। সে অপমানিত হয়নি। এটা বোঝাতে চেয়েছি। মনে হয় এটা বোঝাতে চেয়েছি।

হায়দার : ‘কণার অনিশ্চিত যাত্রা’ উপন্যাসে কণা প্রধান চরিত্র হয়ে উঠেছে। সম্পূর্ণ উপন্যাস ওকে নিয়ে আবর্তিত হয়েছে। কিন্তু শেষে গিয়ে মনে হয়েছে কণার যাত্রা তো অনিশ্চিত নয় বরং নিশ্চিত। সে হাসপাতাল তৈরি করবে, বাবার স্বপ্ন পূরণ করবে। আপনি অনিশ্চিত যাত্রা নাম দিলেন কেন?
চৌধুরী : অনিশ্চিত যাত্রা মানে সে জানত না কিন্তু। এটা ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে। যখন সে শুরু করেছিল, তখন সে জানত না। অনিশ্চিত ছিল যাত্রাটা। যাত্রার ধারণাটা আমার এখানে প্রধান ছিল।

হায়দার : তাহলে উপন্যাসটার নাম হতে পারত ‘কণার যাত্রা’।
চৌধুরী : আপনি তো জানেন, সাহিত্যে একটু আড়াল তৈরি করতে হয়। ‘কণার যাত্রা’ বললে মনে হয় যেন সাংবাদিকতা। অনিশ্চয়তাটা না থাকলে মনে হয় যেন একজন সাংবাদিক প্রতিবেদন তৈরি করছে।

হায়দার : আপনার যে দুটো উপন্যাস, এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। বিশেষ করে ‘শেষ নেই’টায় এবং ‘কণার অনিশ্চিত যাত্রা’র মধ্যেও মুক্তিযুদ্ধ আছে। মুক্তিযুদ্ধকে আপনি কীভাবে অনুধাবন করেন।
চৌধুরী : আমার মনে হয় জাতিসমস্যার সমাধানটা হওয়া দরকার ছিল। আমাদের দেশে দুটো সমস্যা ছিল, একটা সমস্যা হলো শ্রেণির, অন্যটা জাতির। জাতিসমস্যার সমাধানটা আমরা করতে পারিনি। আমার একটা আত্মজৈবনিক লেখা আছে, দুই খন্ডে বের হয়েছে, ছোট্ট, তার মধ্যে আমি তার নাম দিয়েছি ‘দুই যাত্রায় এক যাত্রী’, অর্থাৎ দু’বার আমরা স্বাধীন হলাম, যাত্রা হলো, আমি যাত্রী, আমার দেশও যাত্রী। প্রথম যাত্রায় তো আমরা মুক্ত হতে পারলাম না। আবার দ্বিতীয় একটা যাত্রা করতে হচ্ছে কেননা, জাতিসমস্যার সমাধানটা প্রথম যাত্রায় হলো না। পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ কোনো জাতীয়তাবাদ না। এই উপমহাদেশে কমপক্ষে ১৭টা জাতি ছিল ভাষাভিত্তিক। পাকিস্তানেও আমরা হিসাব করতে পারি যে ছয়টা জাতি ছিল। এই যে জাতিসমস্যার সমাধান হচ্ছে না, সেই সমস্যা সমাধান করার জন্যই মুক্তিযুদ্ধটা অনেক দরকার ছিল।

হায়দার : সেই মুক্তিযুদ্ধের আপনি একজন প্রত্যক্ষদর্শী, হয়তো সরাসরি অংশ নেননি। সেই মুক্তিযুদ্ধকে এখন এখানে এসে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
চৌধুরী : মুক্তিযুদ্ধকে আমি মূল্যায়ন করি যে, এটা অনিবার্য ছিল জাতিসমস্যা সমাধানের জন্য। কেননা পাকিস্তান টিকত না। পাকিস্তান যদি ’৭১ সালে না ভাঙত, তাহলে ১০ বছর পর হলেও ভাঙত। এটা টিকে থাকার কোনো কারণ ছিল না। শুধু এটা নয় দূরত্ব ছিল, আরেকটা কারণ হচ্ছে বৈষম্য। এই বৈষম্যটা জাতিগত রূপ নিয়েছিল। পাকিস্তানে যারা ছিল পাঞ্জাবি, পাঞ্জাবিরা শাসন করে এ যোগ্যতায় তারা সামরিক বাহিনী। পাকিস্তানের লম্বা ইতিহাস সামরিক শাসনেরই ইতিহাস। ওই সামরিক পাঞ্জাবির যে আধিপত্য তারা কখনো চায়নি যে অন্য জাতিসত্তাগুলো বিকশিত হোক। যেহেতু বাঙালিরা সংখ্যায় বেশি, শতকরা ৫৬ জন, তারা মেনে নেবে না, মেনে নিচ্ছিলও না, কিন্তু তাদেরকে ঠান্ডা করার জন্য একেবারে সশস্ত্র জায়গাটাতে চলে গেল। ওরাও কিন্তু জাতীয়তাবাদের দ্বারা পরিচালিত, পাঞ্জাবি জাতীয়তাবাদ। ওরা মনে করছে, আমাদের কর্তৃত্ব চলে যাবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে কেবল যে বাংলাদেশ স্বাধীন হবে তা না, পাঞ্জাবি শাসন মানবে না, সিন্ধিরা মানবে না, বেলুচরা মানবে না, পাঠানরা মানবে না, এমনকি মহাজির যারা উর্দুভাষী তারাও মানবে না। ওই ভীতিটাও ছিল তাদের। মূলত পাঞ্জাবিভীতি এবং এর সঙ্গে যে ভুট্টো জড়িত হয়েছিল তার নিজের লোভে। ক্ষমতায় আসার জন্য। তাকে আবার পাঞ্জাবির সঙ্গে, সেনাবাহিনীর সঙ্গে আঁতাত করতে হচ্ছে। ভুট্টোর যে প্রতিনিধিত্ব তা কিন্তু দুর্বল, সে কিন্তু বেলুচিস্তানে একটাও আসন পায়নি, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে খুব সামান্য পেয়েছে, সিন্ধুতে কিছু পেয়েছে, পাঞ্জাবেই বেশি পেয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানে আসন সংখ্যা ১৩৮টা। তার মধ্যে ভুট্টো পেয়েছে ৮১টা। তার প্রাধান্য নেই, কিন্তু সে মনে করছে তার ক্ষমতায় যেতে হবে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সে সামরিক বাহিনীর লোকগুলোর সঙ্গে আঁতাত করেছে।

হায়দার : ছোটগল্প, বাচ্চাদের জন্য মোটামুটি আপনার একটা ভালো লেখা আছে। কিশোর গল্প, ‘দরজাটা খোলো’ রিংকু, শুরুটা হলো ও দরজা খুলছে না, ওর মা দরজা ধাক্কাচ্ছে, কিন্তু ও দরজা খুলছে না। গল্পের শেষে গিয়ে দেখলাম যে ওর দরজাটা খুলে গেছে, মনোজগতের, অন্তরের, বহির্জগতেরও। এই গল্পটার প্রতীকটা কী?
চৌধুরী : এখানে দু’রকম প্রতীক, একটা হলো আমার ব্যক্তিগত, আমার মনে হতো আমি বাইরে গেলে হারিয়ে যাব অথবা বাইরে থেকে এলে দরজাটা বন্ধ পাব। শৈশব-কৈশোরের অনুভূতি ছিল। দরজাটা ধাক্কা দিচ্ছে, দেখছে দরজাটা বন্ধ। সে মুক্তিটা কোথায় পাবে? ভেতরে কিন্তু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের কথা আছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে মুক্তির একটা জায়গা দেখাচ্ছে। প্রতীকটা আমি খুব স্থুলভাবে আনার চেষ্টা করিনি। দরজাটা খুলতে হবে, খুলতে না পারলে আমরা আটকা পড়ে আছি। আমরা বিকশিত হতে পারছি না। কিশোরও বিকশিত হতে পারছে না, আমরা সমষ্টিগতভাবে বিকশিত হতে পারছি না।

হায়দার : আরেকটা উপন্যাস ‘বাবুলের বেড়ে ওঠা’ এই বাবুল কি সিরাজুল ইসলামের কৈশোরের বাবুল?
চৌধুরী : ঠিক আমি না। এই সমস্যাগুলো আমাদের কৈশোরের কালে ছিল, আমরা যখন বড় হচ্ছি, তখন যে রকম পরিবেশটা পাচ্ছি, সেই পরিবেশে যে নিষ্ঠুরতা আছে, সেখানে প্রতিযোগিতা আছে, সেখানে সন্তোষ আছে এবং যে জায়গাটা আমি ধরার চেষ্টা করেছি সেটা হলো মধ্যবর্তী মধ্যবিত্ত, তাদের আকাঙ্ক্ষাগুলো, বস্তুগত আকাঙ্ক্ষা বস্তুগত সাফল্যের, বাবা যখন এই জায়গায় চলে যায় তখন সন্তানকে তারা যে উপেক্ষা করছে সে সন্তানটা কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে। একাকী হয়ে যাচ্ছে। এই যে একাকিত্ব, যাকে আমরা বিচ্ছিন্নতা বলি। আমার প্রবন্ধে আমি বার বার বলি বিচ্ছিন্নতা তৈরি হচ্ছে। বাবা-মার মধ্যেও একটা বিচ্ছিন্নতা তৈরি হচ্ছে। যখন তারা কম বিত্তবান ছিল বা স্বাচ্ছন্দ্য ছিল না পরিবারে তখন তাদের মধ্যে একাত্মতা ছিল। তখন তাদের সুখ-দুঃখগুলো পরস্পর ভাগ করে নিচ্ছে। এই বাবা যখন জাহাজ কোম্পানিতে বড় চাকরিতে গেল তখন যে সমৃদ্ধিটা এলো তার দাম দিতে হচ্ছে কিশোরদের। তার উন্নতির যে বোঝা তা কিশোরদের বহন করতে হচ্ছে। এটা আমি সচেতনভাবে সাজিয়ে করিনি।

এই সমস্যাগুলো আমাদের কৈশোরের কালে ছিল, আমরা যখন বড় হচ্ছি, তখন যে রকম পরিবেশটা পাচ্ছি, সেই পরিবেশে যে নিষ্ঠুরতা আছে, সেখানে প্রতিযোগিতা আছে, সেখানে সন্তোষ আছে এবং যে জায়গাটা আমি ধরার চেষ্টা করেছি সেটা হলো মধ্যবর্তী মধ্যবিত্ত, তাদের আকাঙ্ক্ষাগুলো, বস্তুগত আকাঙ্ক্ষা বস্তুগত সাফল্যের, বাবা যখন এই জায়গায় চলে যায় তখন সন্তানকে তারা যে উপেক্ষা করছে সে সন্তানটা কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে। একাকী হয়ে যাচ্ছে। এই যে একাকিত্ব, যাকে আমরা বিচ্ছিন্নতা বলি। আমার প্রবন্ধে আমি বার বার বলি বিচ্ছিন্নতা তৈরি হচ্ছে।

হায়দার : আপনার একটা গল্প আছে, ‘ভালো মানুষের জগৎ’ নামে, আমি জানি না আপনার মনে আছে কিনা। আহমদ আলী, তার জগৎটা তার স্ত্রীকে নিয়ে, তার স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে পারছে না। সে সৎ থাকতে চায়, আহমদ আলী সৎ থাকতে চায়, ভালো মানুষের জগৎ, সে সৎ থাকে না, নানা জায়গায় পরাজিত, ভালো মানুষরা কেন পরাজিত হচ্ছে? আহমদ আলী কেন ভালো মানুষের জগৎটা পেল না? কেন তার জগৎটা অন্ধকারে পরিপূর্ণ, কেন সে বারবার পরাজিত হচ্ছে?
চৌধুরী : দুটো বিষয় আমার অনুভূতির মধ্যে ছিল, একটা হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক জগৎটা এমনই। কে কাকে জব্দ করতে পারবে। কে কার চামড়া ছিলতে পারে। একই সঙ্গে চাকরিতে ঢুকে ওপরে চলে গেছে, সে অন্যদের সঙ্গে কী ব্যবহার করে, এটা এক নম্বর।
দ্বিতীয় হলো, এই যে আমলাতান্ত্রিকতা, এটা কিন্তু আমলাদের জগৎ, এরা কিন্তু আবার স্বাধীন না। এরা একটা ব্যবস্থার মধ্যে আছে। এই ব্যবস্থাটা হলো পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। আমি কিন্তু পুঁজিবাদকে ভালোভাবে চিনতে পারি যতই বয়স বাড়ছে, ততই আমার কাছে পুঁজিবাদ প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে। আমি দেখতে পাই পুঁজিবাদ হচ্ছে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা। সবল কেবল নিপীড়ন করবে তা না, দুর্বলের যা আছে তা কেড়েও নেবে, শোষণ করবে। শোষণের যে প্রক্রিয়া তা বন্ধুত্বের মধ্যেও চলে আসে। ওর বন্ধু পাকিস্তানে চলে গিয়েছিল, চাকরি করত, ফেরত এসেছে। শেষে আবার এখানে হাজির হয়েছে।

হায়দার : আহমদ আলীর স্ত্রী ওর প্রাক্তন প্রেমিকাও বটে।
চৌধুরী : সে তখন বিয়ে করেনি, পাকিস্তানে আরো ভালো পরিবারে বিয়ে করবে তাই। একথা সত্যি নিন্ম মধ্যবিত্তের মধ্যে একটা হীনম্মন্যতা জেগে ওঠে, কারণ দুই বন্ধু দুই অবস্থানে কাজ করছে একই অফিসে। তার মধ্যে হীনম্মন্যতার বোধটা তৈরি হয়। এই বোধটা ভেতরে ভেতরে মানুষটাকে খুব দুর্বল করে। তার জীবনটাকে মনে করে কীরকম সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। সমাজে সে ভালো মানুষ বলে পরিচিত না, কারণ সে কিছু করতে পারছে না। পরিবারে তার বাবা-মাও তার ওপর সন্তুষ্ট না। কারণ সবাই ক্ষমতা দেখতে চায়। ক্ষমতাই সমাজের প্রধান সত্য।

হায়দার : আপনার আরেকটা গল্প ‘সীমান্তে’। ‘সীমান্তে’ যে গল্পটা, একটি মেয়ে ১০ বছর পর দেশে ফিরবে, বিদেশি জামাই নিয়ে আসবে, ওর বাবার নাম আজমল আলী। আজমল আলীর একটি ভাই আছে আকবর, একটু প্রতিবন্ধী টাইপের। যখন বিদেশি জামাই আসবে, বাড়িটা প্রস্তুত হচ্ছে, তখন ওর চাচাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হলো, এই জন্য যে, বিদেশি জামাই এসে এ রকম একটা প্রতিবন্ধী মানুষকে দেখবে? নির্মম একটি ঘটনা। সব যখন প্রস্তুত, মেয়েটি এলো না, কারণ বাংলাদেশে বন্যা হচ্ছে, বিদেশি জামাই এসে বাংলাদেশে বন্যা দেখবে? পুরো ঘটনা গল্পটাকে একটা অন্য জায়গায় নিয়ে গেছেন।
চৌধুরী : আমি এটা কিন্তু প্রতীক হিসেবে দাঁড় করাইনি, কিন্তু প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। লেখক যান্ত্রিকভাবে সাজান না, প্রতীক হিসেবে যদি ধরি যে, মেয়েটা জার্মানিতে গিয়ে একটা জার্মান ছেলেকে বিয়ে করেছে, ছেলেটা ভালো, কিন্তু মেয়েটির মধ্যে একটা বোধ আছে যে আমার দেশ তো এত দরিদ্র, তাই মেয়েটা জামাইকে এদেশে আনতে চায়নি, জামাই জোর করে আসছে। জামাইটার অন্যরকম দৃষ্টিভঙ্গি, সে ভাবছে একটা গণতান্ত্রিক দেশে যাবে। সে এখানে আসতে চেয়েছে, কিন্তু ভয়ংকর রকম বন্যার জন্য সবকিছু নোংরা হয়ে যাবে। মেয়েটা ভীষণ লজ্জা পাবে, কারণ দেশের অবস্থা এতটা খারাপ যে, মেয়েটার স্বামী হয়তো কল্পনা করতে পারে না। তাতে করে মেয়েটা অজুহাত পেয়ে গেল দেশে না যাওয়ার। মেয়েটা একলা আসতে চাচ্ছিল। এটাও একটা প্রতীকের মতো দাঁড়িয়ে যায়। আসলে আমাদের উন্নয়নের জায়গাতে অনেক রকম মাসুল দিতে হচ্ছে। ভাইকে ত্যাগ করতে হচ্ছে, আমার সন্তান আসতে পারছে না, যেহেতু সন্তান অন্য ধরনের জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।

হায়দার : আপনার আরেকটা গল্প আছে, ‘হারাবার কিছু নেই’। নিজাম ওর বন্ধু, নিজাম হলো রাজাকারের পুত্র, ব্যবসা করে অনেক টাকার মালিক হয়েছে। কিন্তু বন্ধুটি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ওর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এ কারণে, এখানে থাকলে তার অনেক ক্ষমতা হবে, অনেক টাকা হবে। টাকার কাছে মুক্তিযুদ্ধ কি এভাবে বিলীন হয়ে গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে?
চৌধুরী : যদি এটা কেউ বিশ্লেষণ করতে চায়, তাহলে এখানেও প্রতীক পাবে। যারা মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন দেখেছিল, যারা যুদ্ধ করেছিল, যারা আত্মত্যাগ করেছিল, তারা কী করে আত্মসমর্পণে বাধ্য হলো, কী করে তারা নিগৃহীত হলো তাদের হাতে, এই মুক্তিযুদ্ধই সুযোগ এনে দিয়েছে সম্পদ আহরণের এবং এই সম্পদ তারা দ্রুত আহরণ করেছে, অনৈতিকভাবে আহরণ করেছে। করুণ জায়গাটা এখানেই যে, যারা আত্মত্যাগ করেছে তারাই অধীনে চলে গেছে। যারা আত্মত্যাগ করেইনি শুধু না, যারা রাজাকারতন্ত্রকে সহযোগিতা করেছিল, সমঝোতা করে টিকে ছিল, তাদের হাতে ক্ষমতা চলে যায়।

আমার মনে হলো গল্পটাকে কিশোরদের উপযোগী করে ধারাবাহিকভাবে বলা যায়। এটা আমি ধারাবাহিকভাবেই লিখেছি। কিন্তু আরেকটা গল্প আছে, এই গল্পের উল্টো গল্প হোমারেরই গল্প ‘ইলিয়ড’, যুদ্ধের গল্প, সেটা আমাকে আকর্ষণ করেনি। এটা আকর্ষণ করল কেননা এটায় যাত্রা আছে, দীর্ঘযাত্রা, লড়াই আছে, অনিশ্চিত যাত্রা, আবার আনুগত্য আছে, দেশে ফিরতে হবে। নানারকম বিপদের মধ্যেও দেশে ফেরার কথা ভাবছে। যখন প্রাচুর্য পেয়েছে, সমাদর পেয়েছে, তখনও ভাবছে স্ত্রী, সন্তান, দেশ

হায়দার : আপনার একটা অনুবাদ, হোমারের ‘ওডিসি’, কিশোরদের জন্য, খুবই চমৎকার। এই যে ‘ওডিয়ুস’, কিসের প্রতীক?
চৌধুরী : সে তো একজন যাত্রী, সে যাত্রা করছে। আমার ভেতরে কোথাও যাত্রার ব্যাপারটা আছে। সেজন্য এই গল্পটা আমাকে আকৃষ্ট করেছে। এটারও একটা কাহিনী আছে, কিশোর বাংলা বলে একটা পত্রিকা বের হতো, রফিকুল হক দাদুভাই সম্পাদিত, তাতে লেখার জন্য খুব তাগিদ দিচ্ছিল, তারা ধারাবাহিক চাচ্ছিল। তখন আমার মনে হলো গল্পটাকে কিশোরদের উপযোগী করে ধারাবাহিকভাবে বলা যায়। এটা আমি ধারাবাহিকভাবেই লিখেছি। কিন্তু আরেকটা গল্প আছে, এই গল্পের উল্টো গল্প হোমারেরই গল্প ‘ইলিয়ড’, যুদ্ধের গল্প, সেটা আমাকে আকর্ষণ করেনি। এটা আকর্ষণ করল কেননা এটায় যাত্রা আছে, দীর্ঘযাত্রা, লড়াই আছে, অনিশ্চিত যাত্রা, আবার আনুগত্য আছে, দেশে ফিরতে হবে। নানারকম বিপদের মধ্যেও দেশে ফেরার কথা ভাবছে। যখন প্রাচুর্য পেয়েছে, সমাদর পেয়েছে, তখনও ভাবছে স্ত্রী, সন্তান, দেশ।

হায়দার : আপনার একটা প্রবন্ধের বই আছে ‘দুই বাঙালির লাহোর যাত্রা’। শেরেবাংলা, ’৪০ সালে গিয়েছিলেন লাহোর প্রস্তাব নিয়ে, পাকিস্তানের পক্ষে, আরেক বাঙালি, শেখ মুজিবুর রহমান, ’৬৬ সালে গিয়েছিলেন ছয় দফা দাবি নিয়ে। যে পাকিস্তান ’৪০ সালের এক প্রস্তাবে তৈরি হয়েছিল, ’৬৬ সালে আরেক প্রস্তাব সে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, ভাঙা এবং গড়া, অদ্ভুত একটা ব্যাপার।
চৌধুরী : সেই লাহোরেই, পাঞ্জাবেই, পাকিস্তানের প্রথম অক্ষর হচ্ছে ‘পি’, জিন্নাহ সাহেব সবসময় বলতেন যে ‘Punjab is the heart of Pakistan’. এই জায়গাতে এক বাঙালি গিয়ে লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করলেন। কিন্তু প্রস্তাবটা তারা তৈরি করে রেখেছিল, সেটা শেরেবাংলা বুঝতে পারেননি, এবং তাকে শেরেবাংলা উপাধিটা তারাই দিয়েছিল। ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে উনি প্রধানমন্ত্রী হলেন। লক্ষ্নৌতে গিয়েছিলেন মুসলিম লীগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে, তারপর ওনার হাতে তুলে দিয়েছে প্রস্তাবটা। উনি শুধু পড়ে দিয়েছিলেন। উনি বোঝেনও নাই প্রস্তাব এত গুরুত্বপূর্ণ হবে। কেউ বোঝেনি। পরে ’৬৬ সালেরটা বুঝেশুনেই হয়েছিল, বোঝা গেল ওই পাকিস্তান প্রস্তাব ভুল ছিল। ওটা আমাদের মুক্তি আনতে পারেনি। আরেক বাঙালিকে যেতে হয়েছিল লাহোর প্রস্তাবকে নাকচ করার জন্য। কিন্তু এর মধ্যে একটা বক্রাঘাত আছে, সেটা হলো, যে প্রস্তাব সেদিন উত্থাপন করা হয়েছিল, লাহোর প্রস্তাব যেটা আমরা বলি, সেখানে কিন্তু এক পাকিস্তান না, স্টেটস কথাটা ছিল। আর ছয় দফা দাবি নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান যখন গেলেন, তখন তিনি লাহোর প্রস্তাবের আলোকেই স্বায়ত্তশাসনের কথা বলেছিলেন। অর্থাৎ বাংলাদেশ একটা স্টেট হবে, পশ্চিম পাকিস্তান একটা স্টেট হবে। লাহোর প্রস্তাব কিন্তু ছয় দফার মধ্যেও আছে। ছয় দফার মধ্যে বলা আছে, স্বায়ত্তশাসন হবে লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী। লাহোর প্রস্তাবের যে ধারণা ছিল, সেই ধারণা অনুযায়ী। বক্রাঘাত হচ্ছে ওই পাঞ্জাবিরা স্বায়ত্তশাসন প্রস্তাব মানতে পারছে না। তাদের লাহোর প্রস্তাবকে তারা গ্রহণ করতে পারছে না। ইতিহাসের এই বক্রাঘাতগুলো খুব তাৎপর্যপূর্ণ।

হায়দার : আপনার লেখার অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে জাতীয়তাবাদ। একটি দেশে কি দুটি জাতীয়তাবাদ থাকতে পারে, নাকি থাকা উচিত? বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। বাঙালি জাতীয়তাবাদ হচ্ছে বৈশ্বিক, সমগ্র পৃথিবীর বাঙালিকে নিয়ে একটি নিরঙ্কুশ জাতীয়তাবাদ। সেটায় ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হলো। সেই জাতীয়তাবাদকে ভেঙে যখন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ করা হয় এবং কিছু মানুষ মেনে নেয়, এই যে দ্বন্দ্ব, সেটা কীভাবে সম্ভব?
চৌধুরী : জাতীয়তাবাদের মূল উপাদান আমি মনে করি ভাষা, এটা স্বীকৃতও বটে। আরো উপাদান আছে, ধর্ম আছে, ইতিহাস আছে, সংস্কৃতি আছে, অর্থনীতি আছে, স্থান আছে, আচার-আচরণ আছে। প্রধান উপাদান আমি মনে করি ভাষা। বাঙালি একটা জাতি, কেননা তারা বাংলাভাষী। এই বাঙালি অনেক জায়গায় ছড়িয়ে আছে, কিন্তু একটা রাষ্ট্রের মধ্যে যে একটা জাতি থাকবে এটা সত্য না। রাষ্ট্র একধরনের গঠন, তার মধ্যে একাধিক জাতি থাকতে পারে।
আমাদের এখানে, এই বাংলাদেশেও এক জাতি রাষ্ট্র নয় কিন্তু। আমাদের এখানে ক্ষুদ্র হলেও নৃগোষ্ঠী আছে, আদিবাসী আছে, এমনকি বিহারিরাও আছে। এখানে বাঙালি প্রধান, অন্য জাতি থাকবে। তাদের জাতীয়তা আলাদা, বাঙালিদের জাতীয়তাও আলাদা। তাদের বাঙালি হওয়ার দরকার নেই, তারা তাদের মতো থাকবে। এমনকি আমেরিকাতেও দেখবেন, একটা বিরাট চৌবাচ্চার মধ্যে ঢুকিয়ে সব একসঙ্গে করে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু সেটা তো টিকছে না এখন। প্রত্যেকেই নিজেদের জাতিসত্তা নিয়ে বেঁচে আছে। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদটা আনা হয়েছিল ইচ্ছাকৃতভাবে। এটার মধ্যে বাঙালিত্বকে কমিয়ে দেয়ার জন্য।

হায়দার : বৈশ্বিক যে দৃষ্টিভঙ্গি সেটাকে খাটো করার জন্য, সীমিত জায়গাতে সীমাবদ্ধ করার জন্য বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদটা আমদানি করা হয়েছে?
চৌধুরী : আমরা পশ্চিমবঙ্গ থেকে আলাদা একথা বলার জন্যও। লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে যে পাকিস্তান হয়েছে আমরা লাহোর প্রস্তাবের বাস্তবায়ন করেছি। পশ্চিমবঙ্গের লোকদের বলা হয় ভারতীয়। তাদেরও ভয়টা ছিল, যে দুই বাঙালি না আবার এক হয়ে যায়। মনে করেন ভাষাগতভাবে দুই জার্মানি এক হয়ে গেছে। দুই কোরিয়া এক হতে পারছে না বলে খুব কষ্টের মধ্যে আছে। তেমনই তাদের মধ্যে একটা ভয় ছিল, দুই বাঙালি এক হয়ে গেলে তাদের মধ্যে এক জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠলে তারা আবার বিচ্ছিন্নতা দাবি করবে। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদকে খাটো করে আমরা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ গ্রহণ করেছি। এর সমাধান হচ্ছে আমরা নাগরিক বাংলাদেশের, জাতীয়তা বাঙালি।

হায়দার : আরব জাতি কিন্তু কতগুলো রাষ্ট্র। অনেকগুলো জাতি আরব দেশে থাকে। বাঙালিত্ব যে রকম আছে, সে রকম একটা জাতীয়তা আছে।
চৌধুরী : বাঙালি শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নেই, সারা পৃথিবীতে আছে।

হায়দার : ভারতের নানা জায়গাতে আছে।
চৌধুরী : বাঙালি যারা আমেরিকায় আছে ওখানেই রয়ে যাবে, ইউরোপে যারা আছে ওখানেই রয়ে যাবে। তারা ওই রাষ্ট্রেরই নাগরিক থাকবে।

হায়দার : আপনি ‘লিও তলস্টয়’-এর ওপর একটি বই লিখেছিলেন, বিশ্বসাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে টলস্টয়কে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
চৌধুরী : শেক্সপিয়র যেমন নাটকের ক্ষেত্রে টলস্টয় তেমন উপন্যাসের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ। শেক্সপিয়রকে যেমন আপনি পৃথিবীর পরিপ্রেক্ষিতে মনে করেন নাটকে শ্রেষ্ঠ, তেমনি তলস্টয় উপন্যাসে শ্রেষ্ঠ।

আমরা বলি সার্বজনীনতা আছে, সময়কে অতিক্রম করা আছে, এই লেখা স্থায়ী হয়ে যায়। তিনি সময়কে অতিক্রম করেন, যে শ্রেণির মধ্যে থাকেন সেই শ্রেণিকেও অতিক্রম করে যান। কিন্তু আবার শ্রেণির মধ্যে থেকে লিখছেন, সময়ের মধ্যে থেকেও লিখছেন। শেক্সপিয়রের জীবনীতে দেখবেন, তার সমাজে নারীর অধীনস্ততা স্বীকৃত ছিল এবং অসামান্য নারী আছে কিন্তু, তারা পুরুষতান্ত্রিক ছায়ার নিচে চাপা পড়ে আছে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ তাদের অধস্তন করে রাখছে। শেক্সপিয়র এই সত্যটাকে উন্মোচিত করেছেন

হায়দার : আপনার আরেকটা বই আছে, ‘শেক্সপিয়রের মেয়েরা’। তার নাটক অসামান্য, আপনি শুরুতেই বলেছেন। তার নাটকগুলো অসাধারণ, কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু তার নাটকের নারী চরিত্রগুলো সুবিধাবাদী নারী। সংগ্রামী নারী নেই। এটা কি তার শ্রেণিকে প্রতিনিধিত্ব করেছে তার নারী চরিত্র?
চৌধুরী : সময়কে ও শ্রেণিকেও প্রতিনিধিত্ব করেছে। কোনো লেখক তার সময়কে অতিক্রম করে যান, কারণ তিনি তার সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন না। তখন আমরা বলি সার্বজনীনতা আছে, সময়কে অতিক্রম করা আছে, এই লেখা স্থায়ী হয়ে যায়। তিনি সময়কে অতিক্রম করেন, যে শ্রেণির মধ্যে থাকেন সেই শ্রেণিকেও অতিক্রম করে যান। কিন্তু আবার শ্রেণির মধ্যে থেকে লিখছেন, সময়ের মধ্যে থেকেও লিখছেন। শেক্সপিয়রের জীবনীতে দেখবেন, তার সমাজে নারীর অধীনস্ততা স্বীকৃত ছিল এবং অসামান্য নারী আছে কিন্তু, তারা পুরুষতান্ত্রিক ছায়ার নিচে চাপা পড়ে আছে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ তাদের অধস্তন করে রাখছে। শেক্সপিয়র এই সত্যটাকে উন্মোচিত করেছেন।

হায়দার : ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলার সময়, ‘বুচার’ টিক্কা খানের লিস্টে তো আপনার নাম ছিল, আপনি যে বেঁচে আছেন, এটা তো আপনার বোনাস লাইভ।
চৌধুরী : পাকিস্তানিরা তো কাউকে চেনে না, ওদের কাছে একটা লিস্ট দিয়েছে এখানকার লোকেরা। কিন্তু লোকগুলো কোথায় থাকে তার ঠিকানা তারা জানে না, আমাদের পুলিশ বাহিনীর স্পেশাল ব্রাঞ্চে তারা তালিকাটা পাঠিয়েছিল, ওই ব্রাঞ্চেই আমার এক আত্মীয় চাকরি করতেন। তিনি দেখলেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন শিক্ষকের তালিকায় আমার নাম তিন নম্বর বা চার নম্বরে আছে। তিনি আমাকে বললেন, ‘তোমার নাম আছে’। ইনি এতটা রিস্ক নিলেন যে, অফিসে নিয়ে আমাকে দেখালেন নামের তালিকাটা। আমি অফিসে গেলাম বিকেলে, তখন ওনার কামরার চাবি ছিল ওনার কাছে, উনি দেখালেন। ওরা ঠিকানা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির সময় দরখাস্তে যে ঠিকানা ছিল সেটা। আমি বুঝে গেলাম আমি এখানে নিরাপদ নই, সেখানে আর থাকিনি। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় থাকিনি। তারপর দুটো ঘটনায় প্রমাণ পাওয়া গেল, টিক্কা খান যখন গভর্নর হিসেবে চলে যান, মালেক যখন গভর্নর হলো তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য যে ফাইল ছিল, তা সে শেষ করে দিয়ে গেছে। আমাদের ছয়জন শিক্ষককে চিঠি দিয়ে গেছে সে যাওয়ার সময়। তখন যিনি ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন, তিনি ডেকে আমাদের দিলেন। চিঠির মধ্যে আমাদের সতর্ক করে দেয়া হলো। বুঝলাম যে ফাইলটা শেষ করল।
দ্বিতীয়টা হলো আলবদরদের তালিকার মধ্যে, পরে যে তালিকা পাওয়া গেল আলবদরের ডাইরির মধ্যে অনেকের নাম পাওয়া গেছে। যে তালিকা রাওফরমান আলীর তৈরি। তাতে যাদের নামের পাশে ঠিকানা আছে, তাদের ধরে নিয়ে গেছে। সেটা পরে প্রকাশিত হয়েছে পেপারে, সেখানে আমার নাম আছে কিন্তু নামের পাশে ঠিকানা নেই। তখন আমি আগের ঠিকানায় থাকি না। আমি নানান জায়গায় থাকি তখন। আমার তখন স্থায়ী ঠিকানা ছিল না।

হায়দার : পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন?
চৌধুরী : এখানে-ওখানে, আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতেই ছিলাম। আত্মীয়-স্বজনরাও একধরনের বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ত, তা বুঝতে পারতাম। তারা নিজেরাই বিপদে আছে আর উটকো একটা ঝামেলা এসে ভর করেছে। তখন এমন ছিল যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তারা মারবেই।
আমরা আলবদরদের হাত থেকেও বেঁচেছি, আবার টিক্কা খান যে আত্মসমর্পণ করল সে জন্যও বেঁচেছি।

হায়দার : দীর্ঘদিন ধরে আপনার জীবনের শুরু থেকে বা যখন থেকে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত হলেন তখন থেকে সমাজমুক্তির, মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই করছেন, কথা বলছেন, লিখছেন, আসলে মানুষের মুক্তি কোথায়, কতদূর? আদৌ কি আসবে মুক্তি?
চৌধুরী : মুক্তির সংগ্রামটা তো চলবেই। মুক্তির সংগ্রাম আছে বলেই তো আমি পুঁজিবাদকে ভালোভাবে বুঝতে পারি, অনুধাবন করতে পারি। পুঁজিবাদের সম্পর্কটা একটা জায়গায় এসে পড়েছে, যখন সে ফ্যাসিবাদের রূপ নেয়। এখন পৃথিবীময় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটা ভেঙে পড়ছে। এমন সব লোক নির্বাচিত হয়ে আসছে, যারা ওই সমাজের নিকৃষ্ট প্রতিনিধি। গৃহযুদ্ধের জায়গা আসছে, আগে যেমন বিশ্বযুদ্ধ ছিল, এখন দেশের ভেতরেই যুদ্ধটা হচ্ছে। এটা ভাঙবে, নতুন একটা সম্পর্ক তৈরি হবে, মানবিক সম্পর্ক, যে সম্পর্কটা প্রভু এবং ভৃত্যের না, মানুষের সাম্যের সম্পর্ক। অধিকারের এবং সুযোগের সাম্য থাকবে। সে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার জন্য এখন বিশ্বব্যাপী সংগ্রাম চলছে। সব দেশের মানুষ জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে লড়ছে সেজন্য। এই ব্যবস্থাটা পৃথিবীতে আসতে হবে, কিন্তু সেখানে যেটা প্রধান সমস্যা সেটা হলো যে সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানা নাকি সামাজিক মালিকানা? এই ব্যক্তিগত মালিকানাতে পুঁজিবাদ বিশ্বাস করে, কিন্তু ব্যক্তিগত মালিকানার জায়গাতে এখন আর থাকতে পারছে না। অল্প কয়েকজন লোকের হাতে এত সম্পত্তি, বাকি সব লোক বঞ্চিত, এটা টিকবে না। কাজেই সামাজিক মালিকানার দিকে যাবে, আমরাও যাব। ওই জায়গা না হলে আমাদের কোনো মুক্তি নেই।

আরো পড়তে পারেন

বিস্তৃত পাঠ সবচেয়ে আনন্দের : ইমান মিরসাল

ইমান মিরসাল ১৯৬৫ সালে মিসরে জন্মগ্রহণ করেন। একজন আধুনিক আরব কবি, প্রবন্ধকার, অনুবাদক, সাহিত্য গবেষক এবং কানাডার আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ভাষা ও সাহিত্যের সহযোগী অধ্যাপক। নব্বই দশকের উজ্জ্বল তরুণ লেখকদের একজন। সমসাময়িক আরবি কবিতার অন্যতম আকর্ষণীয় কণ্ঠ ইমান মিরসালের বহু কবিতাই এক ডজনেরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিখ্যাত লিটারারি জার্নালগুলোয় নিয়মিত লেখাপত্র প্রকাশের পাশাপাশি পৃথিবীর….

‘পেশাদার খুনিরা, তোমরা সৈনিক নও।’ এটা ছিল কবিতাটির শেষ লাইন -আহমাদ ফারাজ

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উর্দু কবি আহমাদ ফারাজ। ১৯৩১ সালের ১৪ জানুয়ারী পাকিস্তানের কোহাতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পুরোদস্তুর কবিতা লেখার সূচনা তাঁর কলেজে থাকতেই। যেগুলো পাঠ করলে দেখা যায়, তিনি তাঁর স্বতন্ত্র নিয়েই আবির্ভূত হয়েছিলেন। আধুনিক উর্দু গযলেও রয়েছে তাঁর অসামান্য প্রভাব। শিক্ষা জীবনে পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্সি ও উর্দু সাহিত্য অধ্যয়ন করেন। পরে এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই….

আমি চেয়েছি কল্পনার ডানায় ভর করে বিজ্ঞানের আনন্দ সবার কাছে পৌঁছে দিতে

খন্দকার রেজাউল করিম শিক্ষক, গবেষক, লেখক। তাঁর শিক্ষকতা জীবনের শুরু ১৯৭৫ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭৮ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকা যান। ১৯৮৩ সালে ইউনিভার্সিটি অব অরিগন থেকে পদার্থবিদ্যায় ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপরে ৩০ বছর কাটিয়েছেন আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষনা ও শিক্ষকতার কাজে। বর্তমানে তিনি আমেরিকার ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ইমিরেটাস প্রফেসর। ড. করিম গবেষনার কাজে জড়িত….

error: Content is protected !!