
(একটি কাল্পনিক বিতর্ক। যাঁরা অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি :
আইনস্টাইন (Albert Einstein, ১৮৭৯-১৯৫৫): পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী। আপেক্ষিকতা তত্ত্বের জনক। যদি পৃথিবীর বাইরে কোনো গ্রহে মানুষের চেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণীদের উদ্ভব হয় তবে ওরা বলবে, পৃথিবীটা সেই গ্রহ যেখানে আইনস্টাইন জন্মেছেন। গ্যালিলিও (Galileo Galilei, ১৫৬৪-১৬৪২): ইতালির বিজ্ঞানী এবং জ্যোতিবিজ্ঞানী। তিনি প্রথম দূরবীন দিয়ে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান এবং গতি পর্যবেক্ষণ করেন, বৃহস্পতি গ্রহের চারটি বড় বড় উপগ্রহের সন্ধান পান। তিনি আবিষ্কার করেন পড়ন্ত বস্তুর সূত্র, সরল দোলকের সূত্র, দোলক-ঘড়ি, এবং বায়ু-থার্মোমিটার। নিউটন (Isaac Newton, ১৬৪৩-১৭২৭): ব্রিটিশ বিজ্ঞানী এবং গণিতবিদ। মহাকর্ষ, বল-গতির সূত্র, আলোর বর্ণালী, প্রতিফলিত আলোর দূরবীন, এবং ক্যালকুলাসের আবিষ্কারক।)
আইনস্টাইন: পদার্থবিদ্যায় একধরণের কাল্পনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা (thought experiment) আছে। কল্পনা এবং যুক্তি দিয়ে সাজানো এই পরীক্ষা থেকে অনেক সময় একটা তত্ত্বের সত্য-মিথ্যা যাচাই করা সম্ভব। আমি জীবনে এরকম অনেক কাল্পনিক পরীক্ষা করে অনেক তত্ত্বকে ঝামেলায় ফেলেছি। আমার সবচেয়ে মজার কাল্পনিক পরীক্ষাটি ছিল কোয়ান্টাম জড়াজড়ি (quantum entanglement) নিয়ে। কোয়ান্টাম-ঢেউ তত্ত্বের জনক শ্রোডিংগার একটি কাল্পনিক বিড়াল নিয়ে একটি মজার কাল্পনিক পরীক্ষা করেছিলেন। তবে গ্যালিলিওকে গুরু বলতে আমাদের কারো আপত্তি নেই। পড়ন্ত বস্তু নিয়ে গ্যালিলিওর কাল্পনিক পরীক্ষার প্রশংসা করতেই হয়!
গ্যালিলিও: সে আমলে সবাই বিশ্বাস করতো যে ভারী বস্তু হালকা বস্তুর চেয়ে দ্রুতবেগে পড়ে। মহাপন্ডিত এরিস্টটল দেড় হাজার বছর আগে বলেছেন, সবাই এখনো তা বিশ্বাস করে বসে আছে! এমন সব গাধা, তোর হাতের পেন্সিল এবং ভারী বইটি একসঙ্গে ফেলেই দেখ না, কে আগে মাটিতে পড়ে। একটা পাথর এবং একটা বালিশ একসাথে ফেললে অবশ্য পাথরটি আগে মাটিতে পড়বে, কারণ বাতাসের বাধা বালিশের উপরে অনেক বেশি হবে। তবে কল্পনায় আমি চলে যেতে পারি এমন এক দেশে যেখানে বায়ু নেই, যেখানে পাথর এবং বালিশ একসাথে পড়ে। গ্রিক দার্শনিকদের নিয়ে এক সমস্যা, ওরা বেজায় আলসে। বাড়িতে বসে চিন্তা করেই সব সমস্যার সমাধান করতে চায়। যারা মাঠেঘাটে খেটে খায়, তাদের প্রতি এক ধরণের অবজ্ঞা! পিসার বাঁকানো মানমন্দিরের (leaning tower of Pisa) উপর থেকে বিভিন্ন ওজনের পাথর ফেলে দেখেছি, ওদের মাটিতে পড়তে একই সময় লাগে। কিন্তু এসব হাতে-কলমে পরীক্ষার কথা কি আর এরিস্টটলের কানে ঢুকবে? দর্শনের যুক্তি ছাড়া কিছুই যে ওদের পছন্দ হয় না।
চিন্তার জাল ফেলে এরিস্টোটলকে কাবু করা যাক। ধরো দুর্গের উপর থেকে দুই কেজি ওজনের একটা পাথর ফেললাম, ওর মাটিতে পড়তে এক মিনিট লাগলো। সবই কল্পনায় করছি, এরিস্টটল সাহেবের খুব পছন্দ হবে। এবার এক কেজি ওজনের একটা পাথর ফেললাম, হালকা বলে ওর মাটিতে পৌঁছাতে লাগলো দুই মিনিট। এবার পাথর দুটিকে একটি ছোট্ট দড়ি দিয়ে বেঁধে এক সাথে দুর্গ থেকে ফেললাম। এবার কে আগে মাটিতে পড়বে, এবং পড়তে কত সময় লাগবে? যদি হালকা বস্তু ধীরে পড়ে তাহলে এক কেজি পাথরটি ধীরে পড়বে এবং উপর থেকে দড়িতে টান দিয়ে দুই কেজি পাথরের গতিবেগ কমাতে চাইবে। ওদিকে এক কেজি পাথরকে দুই কেজি পাথর দড়ি দিয়ে নিচে টেনে ওর গতিবেগ বাড়াতে চাইবে। আবার দুটি পাথরকে একসঙ্গে যদি একটা পাথর ভাবি যার ওজন হবে তিন কেজি, তবে ওটা তো সবার আগে মাটিতে পড়ার কথা। তাহলে কে আগে মাটিতে পড়বে? সমস্যাটা বুঝতে পারছেন, এরিস্টটল সাহেব?
নিউটন: ভাগ্যিস গ্যালিলিও আমার আগে জন্মেছিলেন। আমার গতিতত্ত্বের প্রথম আইনটি তাঁর কাছ থেকে ধার করা। বস্তুর গতি নিয়ে গ্যালিলিও যেমন হাতেকলমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, তেমনি করেছেন কল্পনায়। পৃথিবী যে সূর্যের চারদিকে প্রচন্ড বেগে ছুটে চলেছে, সে কথা সে আমলের পাদ্রী, পন্ডিত, মূর্খ সবার কাছেই অসম্ভব মনে হয়েছিল। বারে বারে গল্প বলে একটু একটু করে গ্যালিলিও ওদের আজন্ম পালিত বিশ্বাসে ঘুন ধরাতে চেয়েছেন। এমন একটা গল্প শোনা যাক।
গ্যালিলিও: ধরো তুমি একটা বড় জাহাজে করে মামার বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছ। জাহাজটা এখনো নোঙ্গর করে আছে। জাহাজের একটি ঘরে তোমার স্থান মিলেছে, ঘরের জানালা-দরজা সব বন্ধ করে দিয়েছো। তোমার মামা একজন সৌখিন জীববিজ্ঞানী। তুমি তার জন্যে একটি বড় কাঁচের পাত্রে নিয়েছো কয়েকটি রঙিন পুটি মাছ, একটি খাঁচায় বন্দি করে রেখেছো কয়েকটি প্রজাপতি। হঠাৎ ভুল করে খাঁচার দরজাটা খুলে দিলে, প্রজাপতি গুলো সারা ঘরময় পাখা মেলে উড়ে বেড়াতে লাগলো। ওদিকে পাত্রের মাছগুলো চারিদিকে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে। ধরা যাক তুমি একজন পাগলাটে লোক। ঘরের মেঝে থেকে ঠিক উপরের দিকে দিলে এক লাফ। কোথায় পড়লে? ঠিক যেখান থেকে লাফ দিয়েছো, সেখানেই। অনেক ধকল গেছে, একটু ঘুমানো যাক, তুমি ঘুমিয়ে পড়লে। যখন ঘুম ভাঙলো তখন জাহাজটি নোঙ্গর খুলে সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছে, জলের বুক চিরে দ্রুতবেগে ছুটে চলেছে। তুমি চারিদিকে ভালো করে সবকিছু পরীক্ষা করলে: প্রজাপতি গুলো সেই আগের মতোই ঘরময় উড়ে বেড়াচ্ছে, মাছগুলো সাঁতার কাটছে। তুমি আগের মতোই উপরে লাফ দিলে, যেখান থেকে লাফ দিয়েছো সেখানে এসেই পড়লে। জাহাজটি যে ছুটে চলেছে তা বোঝার কোনো উপায় নেই।
লেখক: পড়ন্ত বস্তুর পরীক্ষাটা এতো মজার যে ওটা চাঁদের বুকেও করা হয়েছে। অ্যাপোলো ১৫ চন্দ্রযানের নভোচারী এক হাতে একটি হাতুড়ি এবং অন্য হাতে ঈগল পাখির পালক নিয়ে চাঁদের মাটিতে দাঁড়িয়ে দুটোই একসাথে ফেলে দিয়েছিলেন। চাঁদে বায়ু নেই, পালক এবং হাতুড়ি এক সাথে চাঁদের মাটিতে পড়েছিল। গ্যালিলিওর কথাই ঠিক। নভোচারীদের আগেই গ্যালিলিও মনে মনে চাঁদে গিয়ে কল্পনায় পরীক্ষাটি করেছিলেন। এরিস্টটল চিন্তা করতে ভালোবাসতেন। গ্যালিলিও চিন্তা, কল্পনা, এবং হাতে-কলমে পরীক্ষা করার কাজ, সবই ভালোবাসতেন। আইনস্টাইন ভালোবাসতেন কল্পনার জগতে ঘুরে বেড়াতে। চিন্তা এবং কল্পনার মধ্যে কোনো তফাৎ আছে কি? আইনস্টাইন বলেছেন, “লজিক তোমাকে এক বিন্দু থেকে আরেক বিন্দুতে নিয়ে যাবে। কিন্তু কল্পনা তোমাকে নিয়ে যাবে সবখানে।” তফাৎটা ওখানেই।
লেখক: পদার্থবিদ ও ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ইমিরিটাস প্রফেসর।