
একটি কাল্পনিক বিতর্ক। যাঁরা অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:
নিউটন (Isaac Newton, ১৬৪৩-১৭২৭): ব্রিটিশ বিজ্ঞানী এবং গণিতবিদ। মহাকর্ষ, বল-গতির সূত্র, আলোর বর্ণালী, প্রতিফলিত আলোর দূরবীন, এবং ক্যালকুলাসের আবিষ্কারক। শেক্সপীয়ার (William Shakespeare, ১৫৬৪-১৬১৬): ব্রিটিশ কবি এবং নাট্যকার। গ্যালিলিও (Galileo Galilei, ১৫৬৪-১৬৪২): ইতালির বিজ্ঞানী এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তিনি প্রথম দূরবীন দিয়ে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান এবং গতি পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি আবিষ্কার করেন পড়ন্ত বস্তুর সূত্র, সরল দোলকের সূত্র, দোলক-ঘড়ি, এবং বায়ু-থার্মোমিটার। কেপলার (Johannes Kepler, ১৫৭১-১৬৩০): জার্মান গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী। পৃথিবী এবং আর সব গ্রহের সূর্যের চারদিকে ঘোরার নিয়ম অংক কষে বের করেছিলেন। আলেকজান্ডার (Alexander Pope, (১৬৮৮-১৭৪৪) ব্রিটিশ কবি।
নিউটন : অনেকে বলেন বিজ্ঞানের জগতে আমার দৃষ্টি ছিল সুদূরপ্রসারী। কারণটা খুব সোজা। কপালগুনে আমার আগেই পৃথিবীতে জন্মেছিল কয়েকটি বিশাল জ্ঞানবৃক্ষ। গ্যালিলিও ছিলেন এমন একজন। হাজার বছরের ধর্মন্ধতা, মূর্খতা, এবং গোড়ামির ঝড় এদের উপর দিয়ে বয়ে গেছে। আমি যে বছর জন্মাই তার আগের বছর গ্যালিলিও মারা যান।
শেক্সপীয়ার : আমি এবং গ্যালিলিও একই বছরে জন্মেছিলাম। সে বছরই মাইকেলএঞ্জেলো মারা গেলেন। লিওনার্দো ডা ভিনসি জন্মেছিলেন আরো একশ বছর আগে। সেটা ছিল ইউরোপের অন্ধকার যুগ। রাজা-রানী, পোপ, বিশপ, পাদ্রী, এবং সম্ভ্রান্ত বংশীয়দের হাতে ছিল সব ক্ষমতার কলকাঠি। মাখন, পনির, মাংস, বিনাকাজে ওদের পাতেই পড়তো, সাধারণ মানুষ দিনে বারো ঘন্টা খেটেও দুবেলার রুটি জোটাতে পারতো না। গ্যালিলিওর মতো আমার মনে হয়েছে, “মূর্খতা বিধাতার অভিশাপ, জ্ঞানের পাখা মেলে স্বর্গে পৌঁছানো যায়।” আমার নাটকে ছিল রাজা-রানীর কাহিনী, ডা ভিনসি এবং মাইকেলএঞ্জেলোর শিল্পকর্মে থাকতো বাইবেলের বীরদের গল্প। তাই আমরা বেশ সুখেই ছিলাম। কিন্তু বেচারা গ্যালিলিওর কথা ভেবে দুঃখ হয়, জীবনের শেষ দশটা বছর কাটলো গৃহবন্দী হয়ে। মিথ্যে গল্প ফাঁদিয়ে কাউকে খুশি করার উপায় বিজ্ঞানীদের হাতে একেবারেই নেই!
গ্যালিলিও : বুড়ো বয়েসে গৃহবন্দী হয়ে আছি। আমার টেলিস্কোপ কেড়ে নিয়েছে ওরা, আকাশের দিকে তাকানো বারণ। ঘরের ভিতরে মাটির দিকে তাকিয়ে কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করার অনুমতি পেয়েছি। ইদানিং তাই নিয়ে ভাবছি। মনে পড়ছে অনেক দিন আগে এক রবিবারে গির্জায় গিয়েছিলাম। আমি তখন পাডুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। পাদ্রী সাহেব ভাষণ দিচ্ছিলেন, স্বর্গে যাবার উপায় বাতলে দিচ্ছিলেন, খুব ভালো ভালো সব কথা। সেটাই তো ভালো, “The Bible shows the way to go to heaven, not the way the heavens go.” ধর্মের চাঁইরা দ্বিতীয় দায়িত্ব ঘাড়ে নিলেই যত সব গন্ডগোল বাধে! “আমি খেপে যাই যখন ধর্মপুস্তকের দোহাই দিয়ে ওরা বিজ্ঞানের গলায় ফাঁস লাগাতে চায়, অথচ নিজেরা সব যুক্তি-তর্কের উর্ধে বসে থাকে।”
পাডুয়া গির্জার পাদ্রী: আজ আমি মানুষের পাপ এবং ঈশ্বরের ক্ষমার কথা বলবো। মানুষের প্রথম অপরাধ কি ছিল? বাইবেলের সেই প্রশ্ন, “Where are you, Adam” কি আমাদের সব সময় মনে থাকে? ঈশ্বর যদি আজ আপনাকে এই প্রশ্ন করে, তবে কি জবাব দিবেন? সেদিন শয়তান এবং বিবি হাওয়ার প্ররোচনায় জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেয়ে আদম বড় বিপাকে পড়েছিলেন, নিজের নগ্নতা বুঝতে পেরে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন। সারা জীবনের দুস্কর্মের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে আজ আপনি কোথায় লুকাবেন?
গ্যালিলিও: এসব কথা অনেকবার শুনেছি, তবুও এই মর্তলোকে অধর্মের কমতি নেই কোনো। হিতোপদেশ ছেড়ে আমি ভাবছি অন্য এক কথা। গির্জার ছাদ থেকে একটা লম্বা শেকল ঝুলছে, তার শেষে লাগানো আছে একটি ঝাড়বাতি। বাইরের দমকা বাতাস ঝাড়লন্ঠকে মাঝে মাঝে দুলিয়ে দিচ্ছে। আমার দৃষ্টি গেছে ওই লণ্ঠনের দোলাদুলির দিকে। ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে বামহাতের নাড়ি চেপে ধরে হৃদয়ের স্পন্দন গুনতে লাগলাম, এক, দুই, তিন, চার! দোলনের পরিমান যত বড়োই হোক, চার গুনতে গুনতেই ঝাড়লণ্ঠনটি ঠিক আগের জায়গায় ফিরে আসছে! আজব ব্যাপার!
নিউটন: তুমি দোলক নিয়ে অনেক পরীক্ষা করেছিলে, দোলক ঘড়ি (pedulum clock) বানানোর কৌশল বলে দিয়েছিলে। তুমি দোলকের তিনটে সূত্র আবিষ্কার করেছিলে, (১) দোলকের দোলাদুলি গোলকের (bob) ভরের উপরে নির্ভর করে না, (২) দোলনের সময়কাল (time period) দোলনের পরিমানের (amplitude) উপরে নির্ভর করে না, (৩) দোলনের সময়কাল দোলকের সুতার দৈর্ঘ্যের বর্গমূলের সাথে বাড়ে। দোলকের সময়কাল পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ জনিত ত্বরণের উপরেও নির্ভর করে, তুমি সেটা জানতে না, আমি তো তখনো মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব আবিষ্কার করি নি!
কেপলার : সৌরজগতের গ্রহগুলির ঘোরাঘুরি নিয়ে আমিও আবিষ্কার করেছিলাম তিনটি আইন: (১) গ্রহের কক্ষপথ একটি উপবৃত্ত (ellipse), (২) সূর্য থেকে একটি গ্রহ পর্যন্ত যদি একটি বিশাল কাল্পনিক ঝাড়ুর কথা ভাবতে পারেন, তবে সেটা একই সময়ে একই আয়তন ঝাড় দেবে, এবং (৩) সূর্যের চারদিক একবার ঘুরে আসতে একটি গ্রহের যে সময় লাগে তার বর্গফল, সূর্য থেকে গ্রহটির দূরত্বের কিউবের সমান। অবশ্য এখানে গ্রহের দূরত্বকে সূর্য-পৃথিবীর দূরত্বের মাপে মাপতে হবে, এবং সময় মাপতে হবে বছরে।
গ্যালিলিও: এই পৃথিবীর দোলনার দোল এবং আকাশের গ্রহের চলাফেরার মাঝে কোনো মিল আছে কি! আমার মনে হয় দোলনা এবং গ্রহের সূত্রগুলোর উৎস একই! দুঃখ এই যে প্রকৃতির সেই গোপন কথাটি না জেনেই আমাকে মরতে হবে।
আলেকজান্ডার:
“Nature and Nature’s laws hid in night :
God said, Let Newton be! And all was light.”
লেখক: নিউটন এসে মর্তলোক এবং স্বর্গলোক একই আইনের সুতো দিয়ে বেঁধে ফেলবেন। গ্যালিলিও, দুঃখ করো না। জানাজানির পালা কখনো শেষ হবার নয়! আজ পর্যন্ত সবাই ওই দুঃখ বুকে নিয়েই মারা গেছেন।
লেখক: পদার্থবিদ ও ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ইমিরিটাস প্রফেসর