Author Picture

আসাদ উল্লাহ’র একগুচ্ছ কবিতা

আসাদ উল্লাহ

বুকপকেটে নীল পাহাড়
.
বুকপকেট উপচানো বিশাল এক নীল পাহাড়
সাধারণত মানুষ পাহাড় কেটে কেটে বসতি গড়ে।
এ এক উদ্ভুত পাহাড়, উল্টো আমাকেই কাটে
কেটে কেটে ফতুর করে ঘন গুল্ম সবুজ
পাহাড় থেকে কতো কী গড়ায়, কতো কী ওড়ে, ঝরে।
গ্রামের হালটে জমে থাকা পায়ের চিহৃ দেখে হুহু করে উঠে মন
একটি হলুদ বিকাল মাঝে মাঝে কী সুন্দর-
দোয়েল পাখি ঘুঙুর পায়ে নাচে।

ভাঁপ ওঠা ভাতের থালায় মা দিতেন নতুন আলুর ভর্তা
শীতে নিজেদেরই গাভী ধুয়ানো দুধ থেকে খুশবু ছড়ানো ঘি,
কখনো কিশোরগঞ্জের চেপায় কুমরো পাতার পুলি
আহা! সেইসব এখন পড়ে আছে দূর বিষন্ন পাহাড়ে
যেমন আমার মা শান্ত বেদনার্ত শিশু বসে আছেন আমারই বুকে।

পাহাড়ে কতো কী ফোটে, কতো কী ফোটে
লোকালয় পেলো না বলে সেইসব বন্যফুলের সাথে
আজো খেলা করে মাধবীর বুকে যতনে ফোটা আহত গোলাপ।

পাহাড় থেকে উড়ে এসে একদল পুণ্যাত্মা আবাবিল পাখি
পালকে তুলে নেয় পৃথিবীর সব ঘুম আর
রাতের কাফনে পড়ে থাকে মৃতদের খোলস,
তবুও মানুষ দূর পাহাড়ে তাকিয়ে থাকে
থেকে থেকে দেখে ফেণা ওঠা সময়, কাঁদে হাসে।

স্মৃতিমগ্নতাই বোধ করি মানুষের আমৃত্য প্রেম
খুঁড়ে খুঁড়ে হাঁটে, হেরার গুহার আলো কতোদূর কতোদূর
মাথা থেকে গড়ায় মাথা থেকে গড়ায় ক্রুশবিদ্ধ রক্তাক্ত নগর।


যে ভালোবাসার কথা বলে
.
যে ভালোবাসার কথা বলে
সে রমনী উর্বর শস্যশীলা মাটির কথা বলে
ডাকবাক্সো ঠোঁটে ধরা লাজুক বিকেলে কবুতরের চঞ্চল পালকে
এবাড়ি ওবাড়ি চোখের সবুজ নৃত্য দেখে।

যে ভালোবাসার কথা বলে
সে ক্ষুধার্ত শিশুর রুটি অথবা ভাতের কথা বলে
ট্রেনের হুইসেলে যাত্রীদের জাগরণ দেখে
মুক্তির আসন্ন লড়াইয়ে প্রস্তুতির কথা বলে।

যে ভালোবাসার কথা বলে
সে প্যালেস্টাইন, সিরিয়া, ইথিওপিয়ার
কান্নার কথা বলে-
বাঁধাকপির খামারের মতো তাদের হাসির স্বপ্ন দেখে।

যে ভালোবাসার কথা বলে
সে একটি পুষ্পিত পৃথিবীর মানচিত্র আঁকে
মোহাম্মদ, জেসাস, বৌদ্ধ, কৃষ্ণের পতাকার কথা বলে।

যে ভালোবাসার কথা বলে
সে দীর্ঘ মানব অথবা মানবী-
হতে পারে বিতাড়িত গন্ধম দোষে।


আমি অথবা মা ডাকলে
.
অমি যখন মাকে ডাকি অথবা মা আমাকে ডাকেন
তখন, তখন পৃথিবী জেগে উঠে এবং
আন্তনগর ট্রেনের শীতোতাপ নিয়ন্ত্রিত কামরায়
একদল ভ্রমণপিয়াসী কফি আর প্রিয় জার্নালে পর্যটনে বেরিয়ে পড়ে।
আমি যখন মাকে ডাকি অথবা মা আমাকে, তখন-
পাড়ায় পাড়ায় নেমে আসে পহেলা বৈশাখ
চাল ধোয়া হাতের মতো সজিব ফুল, মাধবীলতা
হেসে উঠে বাগানে বাগানে;
জলকলো গানে নাচে অর্ধমৃত নদী
চরে পড়ে থাকা নিষ্প্রাণ ডিঙি মাছরাঙা হয়ে যায়।
আমি যখন মাকে ডাকি অথবা মা আমাকে, তখন-
বিবাহ প্রস্তাবে চঞ্চল কিশোরীর মতো হাওয়া দোল খায় শস্যময় মাঠে
কয়েকটি চাঁদ এসে গোল হয়ে বসে যায় উঠোনে,
খুচরো কয়েন জমা আনন্দে লাফায় জামা ও পেন্টের পকেটে বিলগেটস্-
মোড়ের দোকানে এতো বিক্রিবাট্টা শুরু হয়
যেনো কতোকাল পর দুর্ভিক্ষে রুক্ষ দিনের অবসান
যেনো কতোকাল পর বিদায় নিলো সভ্যতা খেকো লকডাউন।

মা মারা যাওয়ার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে বারবার দেখছিলেন আমায়
যেনো তার প্রিয় পৃথিবী দেখছেন,
ভাঙাচোরা ভবঘুরে প্রিয় পৃথিবী-
অযত্নে জঙ্গলাকীর্ণ
এখানে সেখানে এতো খুঁড়খুড়ি, ক্ষত ও ক্ষতি
স্নেহ ও ভালোবাসার বদলে দাহের দাগ!
সূর্যালোকে রৌদ্র নেই-
তবু পুড়ে যায় কিছু কিছু গাছের রঙ,
এক ফালি চাঁদ ডুবে যাচ্ছে দূর বনে
অথচ পথিক তখনো পায়নি বাড়ির পথ
মা দেখছেন তার পৃথিবী ইস্টিশনের মলিন চায়ের দোকানে
এক কাপ লিকারে কী সুন্দর নিরুদ্বিগ্ন বসে আছে
নিজ গৃহে নিলাজ সন্ন্যাসী।

আমি যখন মাকে ডাকতাম অথবা মা আমাকে ডাকতেন
তখন, তখন পৃথিবী জেগে উঠতো পৃথিবীর মতো
আহা! কতোকাল হয়ে গেলো মাকে ডাকি না
কতোকাল হয়ে গেলো মা আমাকে ডাকেন না!


পৃথিবী হয়ে গেছে ঘর
.
মহামারী অসুখে পৃথিবী হয়ে গেছে এক ঘর
তবু চলে গেছে মানুষ বহুদূর পরস্পর,
হৃদয় ছুঁয়ে না দাঁড়ালে ভালো লাগে কার
কে চায়, কে চায় এমন বিবর্ণ পৃথিবী আর?

পথে কাঁদে ক্ষুধার্ত কুকুর, পাখিটির জল ছলছল চোখ
বুকের ভেতর ঝরাপাতা মাধবীর করুণ ক্লান্ত মুখ।

মৃত মানুষের জনপদে ছিলো স্বজনের নরম মিছিল
কান্নাভেজা মাটি গড়াগড়ি জোছনার ভাঙা আলো,
মহামারীর কালে মানুষ হয়েছে ভুত, ভুল পুষ্প-প্রেম
পথে-ঘাটে-মাঠে গ্রীবা উপচানো গা ছমছম কালো!

আরো পড়তে পারেন

আহমেদ ফরিদের একগুচ্ছ কবিতা

তোমার সাথে দেখা হওয়া জরুরী নয় সেদিন তুমি আমাকের ডেকে বললে, ”আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি ঝরছে এসো চা খেয়ে যাও ঝাল মুড়ি, পেঁয়াজ ভেজে দেবো সঙ্গে কাঁচালংকাও থাকবে। দুজনে চা খাব, মুড়ি খাব, আর গল্প করবো।’ আমি বললাম, ’না, আমি যাবো না । আমি আমার জানালায় বসে আকাশ দেখছি, বৃষ্টি দেখছি, আকাশের কান্না দেখছি, গাছেদের নুয়ে….

নিকোলাই রুবৎসভের কবিতা

নিকোলাই মিখাইলোভিচ রুবৎসভ (৩ জানুয়ারি ১৯৩৬ – ১৯ জানুয়ারি ১৯৭১) মাত্র পঁয়ত্রিশ বছরের জীবন পেয়েছেন রুশ কবি নিকোলাই রুবৎসভ। দুর্ভাগ্য তাঁকে তাড়া করেছে সারাজীবন। শৈশবে মায়ের মৃত্যু ও পিতার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য তাঁর স্থান হয় শিশু আশ্রমে। পড়াশোনা শেষ করার আগেই জীবিকার তাগিদে তাকে খনিতে, জাহাজে কাজ করতে হয়। সৈন্য বাহিনীতে যোগ দেওয়ার….

সোহরাব পাশা’র একগুচ্ছ কবিতা

নিদ্রিত ঘ্রাণের শব্দ দীর্ঘ যায় আশালতা ফিরে আসে বিষণ্ণ গোধূলি ফিরে আসে দুঃখিত সকাল, ক্ষয়ে যাওয়া এক দূরের উপনিবেশ পাখির চেয়ে মানুষের কোলাহল বেশি কোনো মৃত্যু মানুষকে অপরাধী করে না নিঃশ্বাসের রোদে আবছায়া নিদ্রিত মেঘ স্মৃতির অসুখ বাড়ে; দূরে নির্জন আধাঁরে জেগে ছিলো মানুষের কথা পুরনো সে বাড়ি সেই ছায়াপথ মায়াপথ জুড়ে কতো ভুল মানুষের….

error: Content is protected !!