Author Picture

প্রেমহীন প্রেম কাহিনির উপক্রমণিকা

হাইকেল হাশমী

আজ ওই হলুদ পাখিটি আবার এলো। বর্ষায় প্রত্যেকদিন সে সময়ে অসময়ে চলে আসে আর গাছের ডালে বসে ভিজে অথবা তার ভেজা পাখা শুকায় আর সুরেলা কন্ঠে ডাকে। কোন সংস্কৃত শ্লোকের বাণী, পরিষ্কার, অবিকল… কিন্তু না জানি কি বলে। এই জায়গার লোকেরা এই পাখির নাম জানেনা শুনে পবিত্রা অনেক আশ্চর্য হল। জিজ্ঞাসা করলে মুখ বাঁকা করে বলে, কি জানি বাপু!
‘হলদে পাখি’ নামটি পবিত্রা নিজেই দিয়েছে।

এই একটি পাখি যেটা ওর দেশে নেই আর যদি থেকেও থাকে, পবিত্রা সেটা কোন দিন দেখেনি। সত্যি বলতে কি এই দেশে এমন কোন জিনিষ নেই যেটা ওর দেশে ছিল না। গাছ, ফল, ফুল, ফসল, জন্তু, পাখি… শুধু এই হলদে পাখিটি ছাড়া। মাছরাঙাকে এখানে লোকেরা বলে ‘মাছলোকনি’। পবিত্রা এখানে এসে জানলো যে ওর গ্রাম অর্থাৎ পূর্ববাংলা’র পেঁচা এখানে উল্লুক। সে উল্লুককে ভাল্লুকের মত কোন জন্তু মনে করত। মানুষের নামের পিছনে লাল, প্রসাদ, ঝা, আর নরায়ন লাগিয়ে দিলে তাতে কি? মানুষের চেহারা তো আর বদলায় না। কিন্তু এই বস্তি (নবীনগর)’র নিরানব্বই ভাগ লোক পবিত্রার কথার সাথে একমত না। তাঁরা বলবে, কি মুশকিল দিদি ঠাকুর, প্রসাদ উপাধি আমাদের গাঁয়ের কোন লোকের নামের সাথে জুড়ে দাও, দেখবে মানাবে না। নামের মত চেহারাও হতে হয়ে দিদি।’ কি মুশকিল!

গ্রাম স্থাপনের পর একদিন পবিত্রা গ্রামের লোকদের বুঝাচ্ছিল, আমাদের ভাগ্য ভাল যে আমাদের এই জেলায় থাকতে দেয়া হয়েছে। এখানে ধান আর পাট চাষ করা হয়। আমরাও আমাদের দেশে ধান আর পাটের চাষ করতাম। এখানেও লোকজন মাছ ভাত খায়। গ্রাম, ঘর-বাড়ী, বাগান-বাগিচা, পুকুর আর নদী, সব আমাদের দেশের মত।
শুকনো হরিলাল সাহা তীক্ষ্ণ কন্ঠে বিরোধিতা করল, সে হোতি পারে না! এমন হওয়াটা অসম্ভব। কোথায় নিজের দেশ এবং দেশের মাটি, কোথায় নিজের দেশের চাল আর কোথায় এই আজব দেশের আজব জিনিষগুলো। জানি না তুমি কি দেখলে দিদি ঠাকুর! এখানকার মাছে কি তুমি ওই স্বাদ পাও যেটা পদ্মা’র ইলিশে আছে?’
হরিলাল সাহা’র কথায় সবাই এমন ভাবে মুচকি হাসল যেন সে সবার মনের কথা বলছে।
গাঁয়ে টিউব-ওয়েল বসানোর জন্য সরকারী লোক এসেছে। সে বাংলা থেকে আসা শরণার্থীদের জন্য কয়েকটি গ্রামে আগেও কাজ করেছে, মানে সে ওইসব গ্রামে টিউব-ওয়েল বসিয়েছে। তাই সে একটু একটু পূর্ববাংলার ভাষা বুঝার দাবী করে। ওকে দেখে হরিলাল সাহা তার চোখ টিপে কথা বন্ধ করে দিল আর অন্য সবাই চুপ হয়ে গেল।
কিন্তু সেই সরকারী লোক চুপ থাকলো না, সে হেসে পবিত্রাকে জিজ্ঞাসা করল, আপনারা এই আপন দেশ, আপন দেশ কি বলেন? দেশের অর্থ কি? মানে কি?
—দেশের অর্থ আর কি হবে। দেশের অর্থ দেশ।
হরিধণ মন্ডল এই নিম্নপদস্থ সরকারী কর্মচারীকে দুই চোখে দেখতে পারে না। মেয়ে দেখলেই তার জিহ্বায় কথা বলার জন্য সুরসুরি হয়। ব্যাটা প্রত্যেকটি কথার অর্থ খোঁজে।
দেশ অর্থ যদি দেশ হয় তাহলে ভারত কি নিজেদের দেশ নয়? আপনাদের দেশ নয়?
—ভারত কেমনে আমাদের দেশ হবে?
কালাচাঁদ ঘোষ চালাক ছেলে সে কথাটা হালকা করার জন্য তার মোটা গলায় হেসে বলল, বাবু আপনি যে অর্থে দেশ বুঝেন আসলে আমরা দেশ ওভাবে বুঝি না। দেশের অর্থ? যেমন বাংলাদেশ, বিহার দেশ, উড়িষ্যা দেশ এই আরকি।
তাহলে প্রদেশ বলেন, জেলা বলেন।

ছদামদাস তো সব সময় সরকারী লোকদের সাথে কথা বলার জন্য ব্যতিব্যস্ত থাকে। সে দাঁত বের করে বলল, ওভারসিয়ার বাবু, এবার দেশ বলেন, প্রদেশ বলেন বা জেলা বলেন, এখন আমাদের যা আছে সেটা তো শুধুই এই নবীনগর গ্রাম।
সরকারী কর্মচারী জানি না কেন জোরে হেসে দিল। ছদামদাশের বুদ্ধিমত্তা দেখে পবিত্রা মুচকি হাসল। টিউব ওয়েল ফিটার বাবুর দৃষ্টি সারাক্ষণ পবিত্রা’র উপরই ছিল। ফিটার বাবু নিজের পকেট থেকে বিড়ি বের করে সবাইকে দিল আর তার নিজ লাইটার দিয়ে সবার বিড়ি জ্বালিয়ে দিল

ছদামদাস তো সব সময় সরকারী লোকদের সাথে কথা বলার জন্য ব্যতিব্যস্ত থাকে। সে দাঁত বের করে বলল, ওভারসিয়ার বাবু, এবার দেশ বলেন, প্রদেশ বলেন বা জেলা বলেন, এখন আমাদের যা আছে সেটা তো শুধুই এই নবীনগর গ্রাম।
সরকারী কর্মচারী জানি না কেন জোরে হেসে দিল। ছদামদাশের বুদ্ধিমত্তা দেখে পবিত্রা মুচকি হাসল। টিউব ওয়েল ফিটার বাবুর দৃষ্টি সারাক্ষণ পবিত্রা’র উপরই ছিল। ফিটার বাবু নিজের পকেট থেকে বিড়ি বের করে সবাইকে দিল আর তার নিজ লাইটার দিয়ে সবার বিড়ি জ্বালিয়ে দিল।
তারপর সে নিজের কাজে চলে গেল। ছদামদাশ বলল, দেখলে, ফিটারকে ওভারসিয়ার বলাতে কত খুশী হল।
সবাই একসাথে মিলে মন খুলে নিজের দেশের হাসি হাসল। কিন্তু পবিত্রা বলল, তোমরা যাই বল, সে ঠিকই বলেছে। দেশ অর্থ হিন্দুস্থান, মানে ভারত।
—দিদি ঠাকুর, দেশ কেমন করে হিন্দুস্থানকে বলি? আমাদের এই গ্রামের নাম হল নবীনগর কিন্তু এখানকার স্থানীয় লোকেরা বলে ‘পাকিস্তানি টোলা’!
কালাচাঁদের মা সব সময় উচিৎ কথাই বলে।
মধ্যবয়সী গোপাল দা খুব মিতভাষী ব্যক্তি। ম্যট্রিক পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে আর এই গাঁয়ে যে স্কুল স্থাপিত হতে যাচ্ছে তার একজন সম্ভাব্য মাষ্টার। সে বলল, কালা’র মা, নতুন স্কুল চালু হোক, সাইন বোর্ড লাগুক তারপর দেখি তাঁরা কেমনে আমাদের গ্রাম নবীনগরকে পাকিস্তানীটোলা বলে।
ছাদামদাশ তার পড়া গেঞ্জি পেটের উপর টেনে তার পেটে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, আসল সমস্যা হল এই শালা পেট। এই ব্যাটা পেটের জন্য যে যা বলে, যে যা কয় সবই সহ্য করতে হয়।
হলদে পাখি আবার ডাকলো…
নবীনগর নয় এটা হল নাবীন নগর!
না এটা নাবী নগরও না, নবীন নগরও না। এই প্রদেশের গৃহ মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রি মোহম্মাদ ইসমাইল নবী এই গ্রামের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সময় একটি জলসায় বলে ছিলেন, এটা শুধুই বাপুর দয়া যে আমার মত দলের একজন ছোট কর্মীর নামে এই বস্তির নামকরণ করা হচ্ছে নবীনগর।
তারপর মন্ত্রী সাহেব নতুন বস্তি স্থাপন করা আর আবাস বস্তি পরিত্যক্ত হওয়ার উপর একটি “শের” পড়লেন যেটা গ্রামের বেশীর ভাগ লোকই বুঝতে পারেলো না কিন্তু সবাই অনেক জোড়ে হাততালি দিল।
আবাস বস্তি পরিত্যক্ত হয়ে যাওয়া?
পবিত্রা এই নতুন স্থাপিত গ্রাম নবীনগরের একটি বাসায় শুয়ে তার পরিত্যক্ত গ্রামে পৌঁছে গেল। জেলা ময়মনসিংহ’র জুম্মাপুর গ্রামে।
পবিত্রা’র বাবা, জুম্মাপুরের একমাত্র হিন্দু জমিদার ছিলেন, একা ব্রাহ্মন পরিবার, একমাত্র উঁচু জাতের হিন্দু পরিবার। গ্রামে আরও তিনজন জমিদার ছিলেন, তিনজনই মুসলমান। মুসলমানদের তেরটা পাড়া ছিল আর হিন্দুদের আড়াইটা মহল্লা। হিন্দু মুসলমান সবাই পবিত্রার বাবাকে “পিতা ঠাকুর” বলে সম্বোধন করতেন আর তাদের বাড়ীকে বলা হত ঠাকুর বাড়ী।
কাশিনাথ চট্টোপাধ্যায়, পবিত্রা’র পিতা, তিনি শুধু বাংলা আর সংস্কৃতের পন্ডিত ছিলেন না বরং উর্দু আর ফার্সিও তার আয়ত্তে ছিল। জুম্মাপুরের “মজলিস”-এ দূর দুরান্ত থেকে আলেম আর মোল্লারা আসতেন আর “পিতা ঠাকুর” তাদের সাথে ঘন্টার পর ঘণ্টা ইসলামের সুক্ষ্ণ বিষয়ে নিয়ে তর্ক করতেন। বাসায় কোন কথায় যদি উনি মুগ্ধ হতেন, তখন ফার্সির কোন “শের” বলতেন আর বাসার সবাই হাসাহাসি করলে শুদ্ধ বাংলায় তার অনুবাদ করতেন। মা রেগে বলতেন, “তুমি তো শুধু কলমা বলে সব কথায় জিততে চাও”।
কলমা। কাদের। কাশেম। না কাশেম না, কাশেম দাদা। কাশেম দাদা না কসাই!
কাদের বাবা’র বাসায় প্রত্যেক বছর ঠাকুর বাড়ী থেকে দুইবার উপহার পাঠানো হত– ঈদ আর দুর্গা পুজার সময়। পবিত্রা ছোট বেলা থেকে ঈদের সময় কাদের বাবা’র বাসায় যেত। কাশেম, শামিম, শবনম, কাদের বাবার সব ছেলে-মেয়ে দুর্গা পুজার সময় ঠাকুর বাড়ীতে আসত।
কিন্তু গতবার ঈদের দিন পবিত্রা তাদের বাসায় যায়নি, কাশেম দাদা নিজেই এল। পবিত্রা হেসে তাকে বলল, ঈদ মুবারক কাশেম দাদা।
কাশেম দাদা এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, ঈদের চাঁদ তো আমি এই মাত্র দেখলাম।
—কাশেম দাদা, কি বকছ?
তুমি আমার চাঁদ।
—কিন্তু কাশেম দাদা, চাঁদ তো আকাশে থাকে।
তখনই পবিত্রা তার পিতাকে জানিয়ে দিল যে এই কাশেম একদম ফাজিল হয়ে গেছে, মানে পুরা বদমাইশ হয়ে গেছে।
তার পিতা সেইসময় গান্ধীজ্বির পথ অনুসরণ করে সপ্তাহে একদিন মৌনব্রত পালন করতেন। তিনি কাগজের টুকরায় লিখে উত্তর দিলেন, বদমাইশ হোক বা শয়তান, প্রেম দ্বারা সবাইকে জয় করা যায়। প্রেমের সব সময় জয় হয়! গান্ধীজ্বি বলেছেন।
তারপর হঠাৎ এক রাতে ধ্বংসের এক মহালিলা শুরু হল। আগুন দাঙ্গা। মার কাট। বন্দুকের শব্দ। ঈদের উৎসব। ফুলঝরি। বন্দে মাতারম। গান্ধীজ্বির জয়। পবিত্রা’র বাবা’র কন্ঠ ঠাকুর বাড়ীর পরিবেশে ঝুলে থাকল। আগুনের শিখার মাঝে পবিত্রা কাশেমকে দেখল, সে খুঁজছে, কোথায়? সে কোথায়?

পবিত্রা ঠাকুর বাড়ী থেকে বের হয়ে বাগদিপাড়া পৌঁছে গেল, সে জানে না। তার জ্ঞান যখন ফিরল তখন সে নিজেকে ভারতের একটি শরণার্থী ক্যাম্পে পেল, কাঠিয়ার ষ্টেশনের কাছে। তার জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে সে জিজ্ঞাসা করল, বাবা কোথায়? মা কোথায়? আর সবাই কোথায়? কেউ কোন উত্তর দিল না। তারপর সে আর কোন প্রশ্ন করেনি। সে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে চুপ হয়ে গেল। তখন থেকেই সে চুপ। সবাই নিজের গ্রাম আর গ্রামের লোক, যারা হারিয়ে গেছে, তাদের গল্প করে আর সে মুখ বাঁকা করে হাসে, চিন্তা করে— এরা কি বোকার মত কথা বলে

তারপর কেমন করে পবিত্রা ঠাকুর বাড়ী থেকে বের হয়ে বাগদিপাড়া পৌঁছে গেল, সে জানে না। তার জ্ঞান যখন ফিরল তখন সে নিজেকে ভারতের একটি শরণার্থী ক্যাম্পে পেল, কাঠিয়ার ষ্টেশনের কাছে। তার জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে সে জিজ্ঞাসা করল, বাবা কোথায়? মা কোথায়? আর সবাই কোথায়? কেউ কোন উত্তর দিল না। তারপর সে আর কোন প্রশ্ন করেনি। সে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে চুপ হয়ে গেল। তখন থেকেই সে চুপ। সবাই নিজের গ্রাম আর গ্রামের লোক, যারা হারিয়ে গেছে, তাদের গল্প করে আর সে মুখ বাঁকা করে হাসে, চিন্তা করে— এরা কি বোকার মত কথা বলে।
জেলা ময়মনসিংহে জুম্মাপুর গ্রাম!
নবীনগর কলোনীতে এক’শ জনের ভিতর পাচাত্তর জন একই জেলার বাসিন্দা। পবিত্রা ছাড়া সবাই নিচুজাতের লোকজন। জোগেশ দাশ বরিশাল থেকে এসেছে, শারদা বর্মণ আর মাখন ত্রিপুরার বাসিন্দা, বিথিয়া শরণার্থী ক্যাম্পে জুম্মাপুর গ্রামের লোকদের সাথে এসে মিশে গেছে।
তিন-চারটা শরণার্থী ক্যাম্পে কয়েক বছর তাঁরা পবিত্রা’র কারণে টিকে ছিল। জুম্মাপুরের একটা বাচ্চাও নিজেদের দল থেকে বেরিয়ে কোথাও যেতে চায় না। আর পবিত্রার কারণে তাদের কোন দুর্ভোগ সইতে হয় না। যে কোন জায়গায় জুম্মাপুরের লোকদের সব অভিযোগ আগে ভাগেই শুনা হয়। দিদি ঠাকুরের অনুমতি ছাড়া কেউ সরকারী রেশন অথবা তহবিলের এক পয়সাও নিতে পারে না। তাঁরা বলে, এইসব ব্যপার দিদি ঠাকুর জানে।
আর সব জায়গায় পবিত্রাকে এক জোড়া চোখ তাড়া করত। ওই চোখ থেকে কাশেম উঁকি দিয়ে বলত, তুমি আমার চাঁদ! পবিত্রা শুনত কাশেম বলছে, তুমি যা বলবে আমি করার জন্য তৈরী। আগুনে ঝাঁপ দিতে বল বা পানিতে ডুবতে বল।
পবিত্রা আদেশ দিত, চাল, দুধ, বিস্কুট, ওষুধ, কাপড় তাড়াতাড়ি পাঠাও!
ক্যাম্প সুপারভাইজারকে বদলি কর!
রিলিফ ক্লার্ককে বরখাস্ত কর। কাশেম বলত, যা আদেশ! যেমন তোমার ইচ্ছে! কিন্তু কিন্তু আমারও একটি প্রার্থনা? আমি কি একটা চুম্বনও পাবো না?

এমন প্রশ্নে পবিত্রা মুখ বাঁকা করে হেসে দিত আর বলত, ননসেন্স। কিন্তু বিথিয়া ক্যাম্পের ইন্সপেক্টারের চোখ থেকে উঁকি দেয়া কাশেম উচ্ছৃঙ্খল হয়ে চাঁদকে ধরার জন্য অগ্রসর হত।
পবিত্রা মুখ বাঁকিয়ে হাসতে থাকল আর দশ বার জন জুম্মাপুরি শরণার্থী ইন্সপেক্টারের মাথা ন্যাড়া করে, মুখে চুন-কালি মেখে ক্যাম্প থেকে বের করে দিল, ঢোল-বাজনার সাথে।
তারপর সব চেয়ে বড় অফিসরের চোখে কাশেমকে উঁকি মারতে দেখে পবিত্রা হুকুম দিল, জুম্মাপুরের সব শরণার্থীদের এমন জায়গায় পাঠাও যেখানে তাঁরা পেট ভরে ভাত-মাছ খেতে পারে, ধান বুনতে পারে আর পাটের চাষ করতে পারে।
সব চেয়ে বড় অফিসার বলল, যা হুকুম! সব জুম্মাপুরিরা পুরনিয়া যাবে। চোখের জানালা দিয়ে কাশেম উঁকি মেরে বলল, কিন্তু তোমাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে। আমার মনে একটি নির্জন জায়গা আছে, তুমি ওখানে নিজের ঘর বাঁধ। পবিত্রা মুখ বাঁকা করে হাসলো। গাড়ী পুরনিয়ার দিকে চলল সব জুম্মাপুরি শরণার্থীদের সঙ্গে নিয়ে।
আর পুরনিয়া পৌঁছে দেখল যে আর-ও সাহেবের পি-এ অর্থাৎ “রিহাব্লিটেশন অফিসার”এর “পারসোনাল এসিস্টেন্ট”এর চোখে আগে থেকেই কাশেম আস্তানা গেড়ে বসে আছে।
তাই সব চেয়ে ভাল জায়গায় আর সব চেয়ে উৎকৃষ্ট স্থানে জুম্মাপুরের লোকদের জন্য কলোনী স্থাপন করা হলো। যে জায়গার মাটি অনেক উর্বর, যে জায়গার নদীতে সব ধরণের প্রচুর মাছ আছে। গোডিয়ার গ্রামের দক্ষিনে খালি জমিতে জুম্মাপুর কলোনীর ভিত স্থাপন করলেন “আর-ও” সাহেব নিজে। সে দিন কাশেম “আর-ও” সাহেবের চোখে ছিল তাই “পি-এ” চোখ তুলে তাকানোর সাহস পায়নি ।

একটি সরকারী খাম হাতে নিয়ে গোপাল’দা চেঁচাচ্ছে, সকল ভাই-বোন শুনেন, মঞ্জুর হয়ে গেছে! মঞ্জুর হয়ে গেছে! স্কুল স্থাপন হচ্ছে।
পবিত্রা অনেক অবাক হল, যে লোকটি খুব অল্প কথা বলে, যে কম কথা শোনে, আর খুব অল্প ঘুমায়, সেই গোপাল’দা এত চেঁচাচ্ছে কেন? স্কুল তো হবেই তাহলে এত চেঁচানোর কি দরকার?
সে গোপাল দাদা’র সমস্ত উৎসাহে পানি ঢেলে দিল একটি কথা বলে, গোপাল’দা স্কুলের মঞ্জুরি পেয়েছেন কিন্তু আপনার স্কুলের পাকা সাইন বোর্ডের কি হলো? কর্তৃপক্ষ স্কুলের নাম পাকিস্তানী স্কুল বলে তো নামকরণ করে নি?
এই কথা শুনার পর গোপাল’দা মনযোগ দিয়ে অক্ষরে অক্ষরে চিঠিটি পড়লেন, গোডিয়ার গ্রামে পাকিস্তানী টোলাতে স্কুল স্থাপনের প্রস্তাব মঞ্জুর।
এরপর সে আর পড়তে পারলো না, তার গলা কান্নায় ভেঙ্গে গেল, সত্যি সত্যি এই পাকিস্তানী টোলার নাম আর কোন দিন মুছবে না? গোডিয়ার, গোডিয়ার, চুল্লায় যাক এই গোডিয়ার গ্রাম!
—না গোপাল’দা এভাবে বলতে নেই। সব গ্রামই উন্নতি করুক, পবিত্রা তাকে বুঝালো। গোডিয়ার গ্রামের সাথে আপনার নবীন নগরও চুলায় চলে যাবে।
কালাচাঁদ ঘোষ এখন পর্যন্ত চুপ ছিল। স্কুল স্থাপিত হোক বা গ্রামের নাম বদলে যাক এইসব নিয়ে তার কোন মাথা ব্যথা নেই, সে শুধুই তার কীর্তন পার্টি নিয়ে ব্যস্ত। সে গোপাল’দার দিকে তাকিয়ে গাইতে শুরু করে দিল –
নবীন নগর নয় রে বাবা
নবী নগর বল
পাকিস্তানী টোলার নামে
স্কুলের রেজিস্টার খুল
বল সবাই হরি হরি বল!
সবাই হেসে দিল আর গোপাল’দা অঝোরে কাঁদতে লাগলো। পবিত্রা চোখে চোখে কালাচাঁদকে বকা দিল।
গোডিয়ার গ্রাম –
এই গ্রামে, পনরোটি পরিবার মৈথিলী ব্রাহ্মিন, চারটি পরিবার রাজপুত– এই নিয়ে হল গোডিয়ার গ্রামের বাবু টোলা। বিশটি পরিবার গোয়ালা, আটটি পরিবার চামার, তের পরিবার গোড়হী (জেলে)। গোডিয়ার গ্রামের উৎপতি এই গোড়হী টোলা থেকে যেখানে এই গোড়হীরা বসবাস করত। গোড়হীবার থেকে হল গোডিয়ার। গোডিয়ার গ্রামে সব চেয়ে স্বচ্ছল আর সুখী পরিবার হচ্ছে এই গোড়হী। তালওয়ার গোড়হীর বাসার টাকা থেকে গন্ধ বের হয় অর্থাৎ সুটকি মাছের মত জমে থাকা টাকাগুলো থেকে গন্ধ বের হয়।
ব্রাহ্মন টোলাতে চৌধুরী পরিবার আর রাজপুতদের মধ্যে মাত্র একটা পরিবারের কাছে কিছু জমি আছে। অন্যরা ক্ষেতে কাজ করে, গরুগাড়ী চালায়, দোকানদারি করে, চাকুরী করে, মজুরী করে আর কিছু লোক চুরি করে।
জুম্মাপুরি কলোনীতে স্কুল খুলবে এই খবর গোডিয়ার গ্রামের সব মহল্লায় পৌঁছে গেল। তালওয়ার গোড়হী’র কাচারি ঘরে চামচা আর তোষামদিদের ভিড় লেগে থাকে। ধনকটুলির মোহনা দপ্তরি, যেহেতু সে একজন সরকারী কর্মচারী তাই সে নিয়মের বাইরে কথা বলে না। সে বলল, গ্রামের লোকেরা গত দশ বছর ধরে চিৎকার করছে, স্কুল, স্কুল, স্কুল কিন্তু কিছুই হল না। আর এই দেখ ওই পাকিস্তানীদের এখানে আসার মাত্র ছয় মাসও হয়নি, তাদের জন্য স্কুল খোলার অর্ডার পাস হয়ে গেলো।

সবাই একসাথে অবাক হয়ে বলল, কি? স্কুল? পাকিস্তানী টুলিতে? তারপর কিছুক্ষণের নীরবতা। সবার চোখ বৃদ্ধ তালওয়ার গোড়হীর উপর স্থির আছে। তিনি হাত থেকে সমিরন (তসবিহ) থলিতে রেখে খুব পরিষ্কার ভাবে বললেন, যারা নিজেদের সন্তানকে শিক্ষিত করতে চায় তাদের জন্য তো সরকার স্কুল খুলবেই, এটাতে অবাক হবার কি হল?
—ঠিক বলেছেন, ঠিক বলেছেন।
তার কথা শুনে সবাই হতাশ। মনে হয় বুড়ো আজ রেগে আছে। আজ আর কিছু হবে না।
তিনি আবার তাদের হতাশাগ্রস্ত চেহারার উপর খুশীর আবরণ মেখে দিলেন এই কথা বলে, ভাই তোমরা কোথায় থাকো? পাকিস্তানীরা কোথাও কি বসবাস স্থাপন করবে? বসবাস করার ইচ্ছা থাকলে যেখানে ছিল সেখান থেকে কেন পালাল?
—ঠিক বলেছেন, ঠিক বলেছেন।
দুই সৎভাই, জয়রাম সিংহ আর রামজয় সিংহ ইদানীং তালওয়ার গোড়হীর বিনা পয়সায় লাঠিয়ালের দায়িত্ব নিয়েছে। জয়রাম সিংহ বলল, যেখানে যেখানে এই শালাদের বস্তি বানানো হয়েছে ওই জায়গায় গিয়ে দেখেন। এই বাঙ্গালিরা, দেখলে মনে হয় কথাও বলতে জানে না কিন্তু ভিতরে ভিতরে বড় ওস্তাদ হয়।
এক রাতে সিমেন্ট, লোহা, কাঠ সব বিক্রি করে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়, সেহেসওয়া গ্রামে, মহিচাঁদ গ্রামে, সব জায়গায় একই অবস্থা।
—শালারা সব কাজকে ফাঁকি দেয়, একদম কামচোর।
ফ্যাশন দেখেছেন?
—শালা মহিলারাও স্যান্ডেল পড়ে হাঁটে, মাটির উপর পা রাখতে নারাজ।
মাটির উপর পা রাখবে কেন? সরকারের টাকা তো ঘরের মুরগী, ডাল বানও…
পন্ডিত রামচন্দ্র চৌধুরী এতক্ষন চুপচাপ সব শুনছিলেন। মুখ থেকে খাইনি (তামক) ফেলে বললেন, এই পাকিস্তানীরা যদি স্কুলের টাকা হজম করে না পালায় আমার নাম বদলে দিও, আমার নাম রামচন্দ্র চৌধুরীর জায়গায় কুক্কার(মোরগ)চন্দ্র চৌধুরী রেখে দিও। যত অকর্মা, অযোগ্য সবাই “রিফিউজি” হয়ে গেছে। কিন্তু পাঞ্জাবী “রিফিউজিরা” এমন নয়। পাটনা শহরে এক্সিবিশন রোডের পাশে, লালিসেনের সামনে একজন পাঞ্জাবী রিফিউজীর পাকোড়ার দোকান ছিল। আমরা যখন হাইকোর্টে আপিল করার জন্য ওখানে গেলাম তখন দেখেছিলাম দুই বুড়া-বুড়ি দিন রাত পাকোড়া আর ঘুগনি বেচতো। আর যখন কেসের রায় শুনতে গেলাম তখন দোকানও নেই, বুড়া-বুড়িও নেই…!
কোথায় চলে গেল? সরকারী টাকা খেয়ে উধাও হয়ে গেল?
—না ভাই, ওরা কেন পালাবে? পালায় তো এই বাঙালী “রিফিউজিরা”। আর কি বলবো? কোথায় টিনের একটা ভাঙ্গা বাসা ছিল আর সেই জায়গায় দেখলাম একটি তিন তালা বিল্ডিং…!
বিল্ডিং কি?
মোহনা দপ্তরি, যে বিল্ডিঙের অর্থ জানতে চেয়ে ছিল তাকে বুঝিয়ে দিল, আর কথা বলার সুযোগ নিজে নিয়ে নিল, চৌধুরী জ্বী একদম খাঁটি কথা বলেছেন। পরিশ্রমের নাম শুনলে তারা দূরে পালায়। সারা দিন কোন জায়গায় সবাই মিলে আড্ডায় বসবে, বিড়ি খাবে আর শুধু তর্ক করবে। সবাইকে “শালার ব্যাটা শালা” ডাকবে।
চৌধুরী রামচন্দ্র মোটেও মোহনা দপ্তরির এই অভ্যাস পছন্দ করে না। কথার মাঝখানে নিজের কথা বলার দুঃসাহসিকতা। তিনি রেগে বললেন, শালার ব্যাটা শালা বললে এমন কি হলো? শালা যেমন বিহারে বলে তেমনি বাংগালে বলে। কলোনীর ছোট ছোট বাচ্চারাও আমাদের বাচ্চাকে বলে, অসভ্য, জংলী, খোট্টা…।
অসভ্য মানে কি?
মোহনা দপ্তরি নিজেই অসভ্যর অর্থ জানে না সে আর কি উত্তর দিবে প্রশ্নকারীকে?
রামজয় সিংহ বলল, পুরা কলোনীতে একটাই মেয়ে লোক যাকে দেখে মানুষ আর চোখ ফেরাতে পারে না।
এবার মোহনা দপ্তরি আবার এক সরকারী তথ্য দিল, হ্যাঁ ওই মেয়েটা মেয়ে না, একদম চাবির মতো! সব অফিসারদের সাথে তার খাতির, সবার সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে, সবাইকে নিজের বসে করে রাখে। দারোগা সাহেব বলছিলেন, ওর উপর একটু নজর রাখতে, বোধহয় কমিন্স (কমিউনিস্ট) হবে।
কমিন্স অর্থ কি?
তালওয়ার গোড়হী বলল, কমিন্স’এর মানে জানো না? ওই যে যাকে হিন্দিতে কামসিন (যুবতী) বলে তাকে উর্দুতে কমিন্স বলে।
মোহনা কথা থামানোর চেষ্টা করল, “না, না, না”।
এবার পন্ডিত রামচন্দ্র চৌধুরী রেগে গিয়ে বললেন, মোহনা তুমি এক বছরের দপ্তরির অভিজ্ঞতায় তালওয়ার ভাইয়ের কথা উড়িয়ে দিতে পার না। এই গ্রামে তুমি কী একমাত্র যে সব কথা বুঝে?
মোহনা বলল, কমিন্স’এর অর্থ কামসিন (যুবতি) কিন্তু এমম কামসিন…।
মোহনাকে কেউ কথা বলতে দেয় না।
সামনে সড়ক দিয়ে নবী নগরের এক দল ছেলে, যারা গলায় আর কোমড়ে টিনের বাক্স ঝুলিয় বিভিন্ন প্রকারের সামগ্রীর যেমন, বিস্কুট, লেমন চুস, গামছা ইত্যাদীর ফেরী করে বাসে আর ট্রেনে। তাঁরা বাসে আর ট্রেনে করে দূরে দূরে চলে যায় আর রাত দশ এগারোটা সময় ফিরে আসে।

পবিত্রা অফিস কক্ষের দক্ষিন পাশে ছোট কাঠাল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। জানি না কোন দিকে দেখছে, না জানি কি দেখছে।
গোপাল’দা পবিত্রা’র মনযোগ সরানোর জন্য তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কি দেখছেন? স্কুলের জায়গা দেখছেন? আর দেখতে হবে না, আমাদের নবীন নগর স্কুলের জায়গা একদম ফার্স্ট ক্লাস।
—না গোপাল’দা, আমি অন্য কিছু দেখছি। আপনাকেও এখন দেখাব। সব জুম্মাপুর বাসীকে ডেকে দেখাতে হবে।
কি দেখাবেন?
পবিত্রা হেসে বলল, এদিকে আসেন! এই জায়গায় দাঁড়ান। এখন দেখেন, ওই দিকে, না ওদিকে না সামনে দেখেন, দূর ওই বাঁকা গাছটা, দেখতে পারছেন তো? এখন আরো দূরে ওই যে সবুজ জঙ্গল দেখা যাচ্ছে আর টালি দেয়া বাসাগুলো— দুটি খেজুর গাছের মাঝ দিয়ে, দেখলেন? আচ্ছা এখন বলেন তো গোপাল’দা— এটা আমাদের জুম্মাপুর গাঁ থেকে মদিনপুর হাটের মতন লাগে কি না? ধরে নেন আপনি ঠাকুর পুকুরের পাশে পূব দিকে মুখ করে দাঁড়িয় আছেন আর দূরে দেখা যাচ্ছে মদিনপুরের সবুজ জঙ্গল। ওই গাছ, এমনি বাঁকা গাছ ওই রাস্তার উপরেও ছিল। আর খেজুরের জোড়া গাছও ছিল। আপনার মনে পড়ে কি? দেখন না? কিছু বলেন?
গোপাল’দা চোখের উপর কপালে হাতের তালু রেখে দূরে দেখল তারপর হাত দিয়ে চোখ ডললো। সে ওদিকে তাকিয়েই রইলো আর বলল, এ কি ভগবানের লিলা?
—আমি গতকাল থেকে দেখে অবাক হয়ে আছি।
গোপাল’দা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখল তারপর কেমন করে জানি সব কিছু ভুলে গেল। তার মনে হলো যে সে জুম্মাপুর গ্রামে ঠাকুর পুকুরের সামনে দাঁড়িয় মদিনপুর হাটের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। পিছনে ঠাকুর বাড়ী। কাশিনাথ চট্টোপাধ্যায়’র বাসা। গোপাল’দা এই মাত্র পাঠশালা থেকে ফিরেছে কিছু জরুরী কথা বলতে হবে সেক্রেটারি (পিতা ঠাকুর)’এর সাথে। বাগদিপাড়াতে পাঠশালা খোলার কথা চলছে আর কাদের জমিদারের ছেলে কাশেম বিরোধিতা করছে। লোকজনকে উস্কানি দিচ্ছে। পিতা ঠাকুর গরুর গাড়ীতে করে মদিনপুর গেছেন। বাঁকা গাছের পাশে তার গরুর গাড়ী দেখে তার হৃদ কম্পন বেড়ে গেল। জানি না কমিটিতে কার বিজয় হলো? পিতা ঠাকুরের কোন প্রস্তাব কোন দিন প্রত্যাখান হয় নাই। এবার দেখা যাক কি হয়? ঠাকুর বাড়ীর সামনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে পবিত্রা ডাকছে, গোপাল মাষ্টার, বাবা এখনই চলে আসবে। আপনি এখানে এসে বসেন।
গোপাল মাষ্টার কি হলো?
—পাঠ শালা খুলতে দিবে না, আমি অনশন করব।
কিন্তু স্কুল খোলার অনুমতি তো হয়ে গেছে। আগামীকাল দালান করার জন্য ঠিকাদার আসছে।
— কোথায়? ওই শালার ব্যাটা শালা কাদেরের পোলা, শালা অত্যাচারী, অত্যাচারী, আমি অনশন।
কি বকছো মাষ্টার?
—আমি বকছি?
হঠাৎ কেউ গোপাল মাষ্টারকে নবীন নগর কলোনীর অফিসে এনে আছড়ে ফেলল। তার চোখ দিয়ে অশ্রু পড়ছে।
এ কি দেখালে দিদি ঠাকুর? এটা তুমি কি দেখালে? এটা কি করে হলো?
—চিন্তা করছি গ্রামের দিক এই দিকে ঘুরিয়ে দিই, যেমনটা জুম্মাপুরে ছিল।
অবশ্যই বদলিয়ে দেন।
গোপাল মাষ্টার এত বড় একটা ব্যপার জানবে আর চুপ থাকবে তা তো হয় না। সে জুম্মাপুরের এক একজন বাসিন্দার নাম ধরে ডাকতে থাকল, এসো এসে দেখো, নিজের জননী জন্মভূমির এক ঝলক দেখে যাও।
ছাদাম দাশ, কালাচাঁদ ঘোষ, হারে রামা হরিধন, রাখাল বিশ্বাস, লক্ষীকান্ত সরকার সবাই দৌড়িয়ে আসলো। ভূত টুত তো দেখে নাই?
ক্ষেত থেকে আর হাট বাজার থেকে ফিরতি লোকদের গোপাল’দা রাস্তায় ধরে বলতে লাগল, দিদি ঠাকুর একটি অদ্ভুত জিনিষ, একটি মজার জিনিষ দেখাবে, চল চল!
পবিত্রা কালাচাঁদকেও ওভাবে দাঁড়াতে বলল, হ্যাঁ একবার চোখ বন্ধ করে ভাব তুমি জুম্মাপুরের ঠাকুর বাড়ীর পুকুরের সামনে দাঁড়িয়ে আছ আর মদিনপুর হাটের দিকে তাকিয়ে রয়েছ। সোজা পূব দিকে। তারপর চোখ খুল। চল, এবার চোখ বন্ধ কর।
কালাচাঁদ হেসে বলল, চোখ বন্ধ করলে কি হবে? পা তো অপরিচিত বিদেশী মাটির উপর আছে।
তুমি চোখ বন্ধ কর, আর যা বলেছি কর।
কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ রেখে কালাচাঁদ চোখ খুলে পূব দিকে তাকাল এবং তার চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। এই জোড়া খেজুর গাছের উপর থেকে সে দুটি টিয়া পাখির বাচ্চা নামিয়ে ছিল। রাম লক্ষনের জোড়া। মদিনপুর হাটে সে আলু চপ খাওয়ার জন্য বাসা থেকে পয়সা চুরি করে দৌড় দিত। ওই যে যেখানে সাদা বক উড়ে বেড়াচ্ছে সেইটা হল বিবি দীঘি, মাছ দিয়ে ভরা ছোট একটি পুকুর। ওটার তীরে মহাররামের মেলা বসত। জঙ্গল পার হলেই মদিনপুর গ্রাম। জঙ্গলের কাছে একটি দরগাহ আছে। ওই জঙ্গল থেকে একদিন হাজার লোকের মিছিল বের হয়, স্লোগান তুলতে তুলতে— বন্দে মাতারাম, বন্দে মাতারাম! মহাত্মা গান্ধীর জয় হোক।
পবিত্রা হেসে জিজ্ঞাসা করলো, স্লোগান দিচ্ছ কেন?
কালাচাঁদ কান্নাভরা কন্ঠে বলল, দিদি ঠাকুর, পরদেশে।
পবিত্রা বকা দিল, আবার পর-দেশ বল?
—না দিদি ঠাকুর! এটা তো মনে হচ্ছে আমরা সত্যি সত্যি জুম্মাপুর গ্রামে আছি। যুগি’দা আপনি বুঝবেন না, বরিশালের না যারা জুম্মাপুরের চিত্র দেখতে চাও তাঁরা দেখে যাও।
পচিশ বছর আর তার বেশী বয়েসে যারা ছিল তাঁরা সবাই সেই জুম্মাপুর গ্রামের ছবি দেখল, নিজের দেশের ছবি!
লক্ষ্মীকান্ত সরকার, মনসুর সাহেবের দোকানে কাজ করত। রোজ সকালে সে হাটে যাবার আগে পূব দিকে ভাল করে দেখে নিত যেন ঠাকুর ষাঁড় নেই তো। ঠাকুর ষাঁড়, লক্ষ্মীকান্তকে দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠত। লাল রঙের কোন কাপড় না। মুসলিম লীগের পতাকা বানানোর জন্য মনসুর সাহেবের দোকানে থানের পর থান কাপড় এনে ছিল। ওই কাপড় দিয়ে মনসুর সাহেব তার দোকানের সব কর্মচারীর জন্য কুর্তা বানিয়ে দিয়ে ছিলেন। প্রথম যে দিন লক্ষ্মীকান্ত সেই জামা পড়ে বের হল, তাকে দেখে, সর্বদা শান্ত, ঠাকুর ষাঁড়ের মত তার উপর চড়াও হল। সে কোন উপায়ে ডান দিকে খেজুর গাছের উপর উঠে দুই ঘন্টা ঝুলে থাকল।
পনরো বছরের ছেলে মেয়েরা কিছুই বুঝতে পারছে না!

বেশী ভাগ ছেলে মেয়েদের জন্ম পালানোর সময় বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে হয়ে ছিল– মালদা, কাঠিয়ার, পাটনা, বিথিয়া’র শরণার্থী শিবিরে। তবুও তাঁরা খোলা ক্ষেত, খেজুরের গাছ, সবুজ বন, ছাদে লাল টালি দেয়া বাসাগুলো এক নাগাড়ে তাকিয়ে দেখেছে। ওটা মদিনপুর হতে যাবে কেন? ওটা তো পুরবাহা গ্রাম, গতকাল তো ইন্দু ওখানে বিস্কুট বিক্রি করে এসেছে।
জুম্মাপুরের শরণার্থীরা সারা রাত আর ঘুমাতে পারল না। এটা কি দেখিয়ে দিল দিদি ঠাকুর? রাতের অন্ধকারেও একই দৃশ্য। অবিকল মদিনপুর হাটের আলো, ওই রকম ঝলমল করা আলো

তাদের ভিতরে বেশী ভাগ ছেলে মেয়েদের জন্ম পালানোর সময় বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে হয়ে ছিল– মালদা, কাঠিয়ার, পাটনা, বিথিয়া’র শরণার্থী শিবিরে। তবুও তাঁরা খোলা ক্ষেত, খেজুরের গাছ, সবুজ বন, ছাদে লাল টালি দেয়া বাসাগুলো এক নাগাড়ে তাকিয়ে দেখেছে। ওটা মদিনপুর হতে যাবে কেন? ওটা তো পুরবাহা গ্রাম, গতকাল তো ইন্দু ওখানে বিস্কুট বিক্রি করে এসেছে।
জুম্মাপুরের শরণার্থীরা সারা রাত আর ঘুমাতে পারল না। এটা কি দেখিয়ে দিল দিদি ঠাকুর? রাতের অন্ধকারেও একই দৃশ্য। অবিকল মদিনপুর হাটের আলো, ওই রকম ঝলমল করা আলো।
সারা রাত যখন পর্যন্ত তাঁরা জেগে থাকল, জুম্মাপুরেই বসবাস করল। ওখানকার স্মৃতি, ওখানের কথা। কেউ রাতের খাবার খেল, কেউ এমনিই শুয়ে থাকল।
রাতের শেষ অংশে তাদের ঘুম এল তার সঙ্গে স্বপ্ন– সবাই দেখল একই স্বপ্ন। সকালে তাঁরা একে অন্যের স্বপনের কথা শুনল আর লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে চুপ হয়ে গেল। রাখাল জানাল সে আজ ক্ষেতে যেতে পারবে না, সারা রাত তার চাচি স্বপনে ডেকেছে, ও রে রাখাল তুই কোথায় গেলি রে।
জুম্মাপুর থেকে আগত ত্রিশটি পুরুষ মহিলাদের মধ্যে বিশজন ওই দিন কোন কাজ করেনি। কিন্তু ফেরী ওয়ালা ছেলেরা নিজের সময় মত কাজে বের হয়ে গেল। একে অন্যকে ডাক দিল, গোসল করল আর নিজেদের থলি, টুকরি, বাক্স নিয়ে সকলে বের হয়ে গেল। চল রে সাড়ে আটটা বেজে গেছে। যদি ট্রেন না ধরতে পারি, আজকে বাস কিন্তু বন্ধ।
ফেরী করা দলের নেতা হচ্ছে বিষ্ণু। ট্রেনের টিকিট চেকারকে নিজে এবং নিজে বন্ধুদের দুঃখ দুর্দশার গল্প শুনিয়ে, ট্রেনে ফেরী করার মৌখিক অনুমতি নেয়া, বাসের চালক আর কন্ডাক্টারকে খুশী রাখা, আর নিজের দলের টাকা পয়সা আর খরচের হিসাব রাখা সব বিষ্ণুর দায়ীত্ব। মহাজনরাও তার জামিন চায়।
কলোনি থেকে বের হয়ে তার মনে পড়ল যে দিদি ঠাকুর তাকে যেতে বলেছিল, কোথাও কোন চিঠি পাঠানোর প্রয়োজন।
অফিসে পবিত্রা জড় হওয়া লোকদের বুঝাচ্ছে, কাজে না যাবার কি কারণ? অর্থ কি? দেখ নিজের দেশের স্মৃতি, নিজের জন্মভূমিকে স্মরণ করে করে আমাদের হৃদয় অবশ হয়ে গেছে। কারো কোন কাজে মন বসে না। আমরা কোন জিনিষকে ভালবাসি না, এখানকার মাটি, এখানকার মানুষ, এমন কি এখানকার জন্তু আর পাখি আমাদের ভাল লাগে না। কোন জিনিষের উপর আমরা বিশ্বাস করতে পারছি না। তাই ভগবান চিন্তা করল চল এদেরকে আমার লিলা দেখাই যেন এরা এই মাটিকে ভালবাসতে পারে, এখানকার লোকদের সাথে প্রীতি স্থাপন করতে পারে। তাই দেখিয়ে দিল যে দেখ নবী নগর আর জুম্মাপুর একই… কোন তফাৎ নেই।
বিষ্ণু ওখানে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। পবিত্রা তাকে বলল, না বিষ্ণু তুমি যাও, আমার কাজ হয়ে গেছে।
সবাই চলে যাবার পর পবিত্রা তার কাজের হিসাব নিকাশ করতে লাগলো, চারটি টেবিল ক্লথ, দুটি চাদর, দুই ডজন গ্লাস কভার, পাঁচটা ব্যাগ। মাত্র এটাই দুই মাসের উৎপাদন?
পবিত্রা কলোনী মেম্বার, জেলা কমিটির সাথে তার সম্পর্ক। মাসে একবার তাকে সদরে যেতে হয়। আগামী পরশু একটি বাধ্যতামূলক মিটিঙে যেতে হবে। তার ইচ্ছে ছিল যে বিষ্ণুর হাতে একটা চিঠি পাঠিয়ে…
কালাচাঁদের মা আবার কোথা থেকে আসছে?
—কি হলো কালা’র মা?
কিছু না, একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে এসেছি।
সে পেতে রাখা পাটির উপর বসে পড়ল। পবিত্রা জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যপার?
একদিকে যুগেশের মেয়ে বসে দিদি ঠাকুরের শিখানো গান তুলছে, দেশে দেশে মোর ঘর আছে।
কালাচাঁদের মায়ের আচরণ দেখে সে আঁচ করতে পারছে যে এই বুড়ি আজ নিশ্চয় কোন গম্ভীর কথা বলতে এসেছে। সে আগে ঠাকুর বাড়ীতে চাকরি করত। পবিত্রা’র ঘরের অনেক কথাই তার জানা। সে এটাও জানে যে জুম্মাপুরে দাঙ্গার কারণ ধর্ম বা জাত নয়। এলাকার সবাই ঠাকুর পিতাকে আশ্বাস দিয়ে ছিল যে এখানে কিছুই হবে না। কালা’র মা তাকে বিথিয়া ক্যাম্পে চুপি চুপি জানিয়েছিল যে, মিছিলে সবার আগে ছিল কাশেম আর তার হাতে বল্লমের উপর বিনোদের কাটা মাথা ছিল, বিনোদ মুখারজি। লক্ষিপুরের রায় সাহেব বিকাশ মুখারজির ছেলে। সে ঠাকুর পিতা’র জন্য একটি গোপন বার্তা বহন করছিল। অথবা যে তার মন জয় করে বসে ছিল তাকে দেখার জন্য আসছিল। মদিনপুর হাটে কাশেমের সাথে তার দেখা এবং সে তাকে ভুলিয়ে নিজের বাসায় নিয়ে যায়।
কালাচাঁদ’এর মা বলল, দিদি ঠাকুর একটি কথা জিজ্ঞাসা করি? কিছু মনে করো না। তুমি শিক্ষিতা পন্ডিত মানুষ যদি কোন ভুল কথা জিজ্ঞাসা করি ক্ষমা করে দিও। সব কিছুই তো পেলাম। নিজের দেশের মত খাদ্যশস্য, মাছ, চাল, তরি তরকারিল সব কিছু জুম্মাপুরে যেমন পাওয়া যেত এখানেও পাওয়া যায়। পানি ও বাতাসও এক কিন্তু মনের মানুষের মত এখানে কেউ নেই? আমাকে ক্ষমা কর দিদি ঠাকুর, তুমি একদিন বলেছিলে এখানেও শত শত কাশেম আছে।
পবিত্রা বুঝে নিয়েছে কালাচাঁদের মা কি বলতে চাচ্ছে। পবিত্রা’র মনে হল যে সে তার আহত আত্মাকে স্পর্শ করেছে।
নবী নগরের আকাশে এক ঝাঁক কাক বিকট শব্দ করে উড়ে বেড়াচ্ছে।
পবিত্রা নিজেকে সংযত কিরে বলল, কালা’র মা, আশ্চর্যের কথা! মনের মানুষের মতো মানুষ এখানেও আছে। নিজের মনের কথা সে চোখে লিখে নিয়ে আসে আর চোখে চোখেই উত্তর নিয়ে যায়।
কালা’র মা বলল, দেখতে সে একদম অবিকল বিনোদ বাবুর মত, তাই না? সেই তো সেই না, খবরের কাগজের বাবু?
পবিত্রা হেসে দিল। কালাচাঁদের মা বলল, আমি ঠিকই আন্দাজ করেছি। কিন্তু সেও কি বিনোদ বাবুর মতো কিছু বলে নাই? ঠাকুর দিদি এইসব ভগবানের লিলা, কিন্তু কথা শুধু চোখে রাখলে তো।
কালা’র মা সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, শুনবে? সে বিনোদের মত হাসে, ওর মত কথা বলে, ওর মত তোতলায়, সে মিষ্টিও প্রাণহারা পছন্দ করে।
দিদি ঠাকুর আমি তোমার পায়ে ধরি, আমার মনে হয় ভগবান ওকে আবার তোমার কাছে পাঠিয়েছে যেন তুমি তোমার মনের লুকানো কথা বলতে পারো।
—মনের কথা তো সে বলেছে।
তুমি কি উত্তর দিলে দিদি ঠাকুর?
—তুমি কি পাগল কালা’র মা? তুমি কি চাও? হারানো ধন পেয়ে আমি আবার হারাই? আমি শুধু পবিত্রা নই, আমি আগুন, আমি তরবারি, আমি বল্লম। আমি বিষ। আমি নাগিনী। ও আমাকে পেয়ে, আমার মনটা পেয়ে কত দিন বেঁচে থাকতে পারবে? আর তোমাদের ছেড়ে আমি যদি চলে যাই তখন আমি কত দিন বাঁচব। তোমরা আমাকে ধাক্কা দিয়ে তোমাদের কাছ থেকে দূরে ঠেলে দিও না। তুমি কালা’র মা, তুমি আমার মা! তোমার ভগবানের দোহাই লাগে আর কোন দিন এমন কথা বলবে না। আর সে যেন কোন দিন এই সব কথা জানতে না পারে। ওকে বেঁচে থাকতে দাও তা না হলে তোমাদের দিদি ঠাকুর…
পবিত্রা অঝোরে কাঁদতে লাগল।
কালাচাঁদের মা তার অশ্রু মুছতে মুছতে নিজেই কান্নায় ভেঙে পড়ল।
—না মা আমি তোমাকে নিজের কলিজার ভিতরে রাখব। আমার মাকে চোখে বসিয়ে রাখবো। তুমি যে আমার প্রাণ।

 

( প্রেমহীন প্রেম কাহিনির উপক্রমণিকা
মূল : ফণিশ্বারনাথ রেনু
অনুবাদ : হাইকেল হাশমী

ফনিশ্বারনাথ রেনু (জন্ম : মার্চ ১৯২১, মৃত্যু : এপ্রিল ১৯৭৭)। হিন্দি ভাষার একজন প্রভাবশালী লেখক ছিলেন। তাকে প্রেমচন্দরের পর হিন্দি ভাষার সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার উপন্যাস “মেয়লী আঁচাল” প্রেমচন্দের উপন্যাস “গাউ দান”এর পর সব চেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস মনে করা হয়। তার গল্প “মারে গায়ে গুলফাম” এর উপর ভিত্তি করে চলচিত্র “তিসিরি কাসাম” নির্মিত হয়েছে। তাকে পদ্মশ্রী উপাধি দিয়ে ভূষিত করা হয়েছিল যেটা তিনি “ইমেরজেন্সি” বিরোধিতা করে ফেরত দিয়েছিলেন।)

আরো পড়তে পারেন

মহামায়া (পর্ব-২)

পড়ুন—  মহামায়া (পর্ব-১) ৩. কাঁচা রাস্তায় উঠতে উঠতে কাপড় ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে গেছে। পায়ের সাথে কাপড় জড়িয়ে যাচ্ছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। সবার আগে মনিশঙ্কর হাঁটছে। তার হাতে মাথায় খাবারের টিন। একটা কাপড়ের ট্রাঙ্ক। সকলের হাতেই কাপড়ের পুটুলি। এতটুকু আসতেই হাপিয়ে উঠেছে। আরো অনেকটা দূর যেতে হবে হেঁটে। তারপর নৌকায় সীমানার কাছাকাছি কোনো একটা জায়গায়।….

মহামায়া (পর্ব-১)

১. সূর্য উঠতে এখনো অনেকটা দেরি। আকাশে কোনো তারা নেই। পুরোটা আকাশ মেঘে ঢাকা। রাতের অন্ধকারটা আজকে আরও বেশি চোখে লাগছে। বাতাস হচ্ছে। মাঝে মাঝে মেঘের আলোতে দেবীপুর গ্রামটা দেখা যাচ্ছে। মুহুর্তের জন্য অন্ধকার সরে আলোয় ভেসে যাচ্ছে। রাধাশঙ্করের ভিটাবাড়ি, ধান ক্ষেত, বাঁশঝাড় হাইস্কুল আলোয় ভেসে যাচ্ছে মুহূর্তের জন্য। মহামায়া আর মনিশঙ্করের ঘরে হারিকেন জ্বলছে।….

স্বর্ণবোয়াল

মোবারক তার কন্যার পাতে তরকারি তুলে দেয় আর বলে, আইজ কয় পদের মাছ খাইতেছ সেইটা খাবা আর বলবা মা! দেখি তুমি কেমুন মাছ চিনো! ময়না তার গোলগাল তামাটে মুখে একটা মধুর হাসি ফুটিয়ে উল্লসিত হয়ে ওঠে এই প্রতিযোগিতায় নামার জন্য। যদিও পুরষ্কার ফুরষ্কারের কোন তোয়াক্কা নাই। খাবার সময় বাপবেটির এইসব ফুড়ুৎ-ফাড়ুৎ খেলা আজকাল নিয়মিত কারবার।….

error: Content is protected !!