
একজন আলোকচিত্রী তার পুরো জীবনে লাখ লাখ ছবি তোলেন। অনেকে সেই লাখ লাখ ছবি থেকে নিজের দশটি সেরা ছবি বের করতেও বিপাকে পড়েন। আবার কেউ কেউ এমনও আছেন—যিনি পুরো পৃথিবীজুড়ে বিখ্যাত হয়েছেন কেবল একটি ছবি দিয়ে।
যেমন কেনেথ জারেক। তার জন্ম ১৯৬৩ সালে। তিনি একাধারে একজন মার্কিন ফটোসাংবাদিক, লেখক ও সম্পাদক। রণক্ষেত্রের সংবাদ সংগ্রহের জন্য জারেকের সুনাম রয়েছে। তিনি বিশ্বের প্রায় আশিটিরও বেশি দেশে ‘লাইফ’ ও ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক’ ম্যাগাজিনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের হয়ে কাজ করেছেন। ‘কন্টাক্ট প্রেস ইমেজেস’-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
পেশাগত কারণে উপসাগরীয় যুদ্ধ কভার করতে গিয়েছিলেন তিনি। ১৯৯০ সালের আগস্ট সাদ্দাম হুসাইন কুয়েত দখল করে বসলেন। বন্ধুরাষ্ট্রকে বাঁচাতে এগিয়ে এলো যুক্তরাষ্ট্র। কুয়েতকে মুক্ত করতে মার্কিন বাহিনীর নেতৃত্বে যৌথবাহিনী হাতে নিল ‘অপারেশন ডেজার্ট স্ট্রম’। যুদ্ধ চলল ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। অবশেষে ইরাকের আগ্রাসন থেকে মুক্ত হয় কুয়েত। যুদ্ধজয়ের প্রাক্কালে জারেকও মার্কিন বাহিনীর সঙ্গে রণক্ষেত্রে ছিলেন। তিনি একটি ছবি তোলেন, যা পরবর্তিতে বিশ্ব-বিবেককে নাড়া দিতে সক্ষম হয়।

১৯৯১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি দেখলেন একটি গাড়ির সঙ্গে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া এক ইরাকি সেনা সদস্যের মরদেহ। জ্বলন্ত অবস্থায় সে গাড়ি থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছিলেন হয়তো, ঠিক সে অবস্থাতেই তার মৃত্যু হয়। মৃত্যু-যন্ত্রণার চিহ্নগুলো তার মুখে রয়ে গেছে। যেন ভাস্কর্য! কিন্তু জারেক যেহেতু মার্কিন সেনাদের গাড়িতে ছিলেন—তাই তার জন্য এই দৃশ্যের ছবি তোলা সহজ ছিল না। আবার ছবি তোলার পর তা ছাপানো নিয়েও তাকে বিপাকে পড়তে হয়।
মার্কিন সেনাদের সঙ্গে একটি গাড়িতে ছিলেন জারেক। কুয়েত সিটি থেকে প্রায় ৭০-৮০ কিলোমিটার দূরে—ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলের কোনো একটি এলাকায় তিনি সেই মরদেহটি দেখতে পান। তিনি যখন ছবি তুলতে যাবেন তখন তার সঙ্গে থাকা সেনাবাহিনীর পাবলিক অ্যাফেয়ার্স অফিসার জানতে চাইলেন, এই ছবি তুলতে হবে কেন? জারেক উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এই ছবি না তুললে আমার মায়ের মতো অনেকে মনে করে বসে থাকবনে—যুদ্ধ বুঝি সিনেমার মতোই হয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘এই ছবি আমাকে তুলতে হবে, কারণ আমি এজন্যই এখানে এসেছি।’ এরপর আর সেই অফিসার তাকে বাধা দেননি। জারেক ছবি তুললেন।
ছবি তো তোলা হলো, এখন তা প্রকাশ হওয়া জরুরি। জারেক ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের হয়ে রণক্ষেত্রে গিয়েছিলেন। কিন্তু ছবিটিকে ভীতিকর আখ্যা দিয়ে তারা তা ছাপল না। পরে ‘অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস’ (এপি) ও ‘রয়টার্স’ও ছবিটি অবমুক্ত করতে অস্বীকৃতি জানায়। একই সিদ্ধান্ত নেয় ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’সহ অন্যান্য মার্কিন গণমাধ্যম।
এমন এক সময়ে জারেকের পাশে দাঁড়ায় যুক্তরাজ্যের ‘দ্য অবজারভার’ ও ফ্রান্সের ‘লিবারেশন’। অবশেষে ছাপা হলো এক হতভাগ্য ইরাকি সেনার মরদেহের ‘বীভৎস’ ছবিটি। অবজারভার ছবির শিরোনাম দিল, ‘যুদ্ধের আসল চেহারা’। ছাপা হতেই বিশ্বজুড়ে আলোচনার ঝড় তুললো সেই ছবি। তার বেশ কয়েক মাস পর ছবিটি ছাপল ‘আমেরিকান ফটো’ ম্যাগাজিন। ১৯৯২ সালে ছবিটির জন্য জারেক ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো’ পুরস্কার অর্জন করেন।