
প্রথম পর্বঃ কাসুভি’র সৌধ (২)
দ্বিতীয় ভ্রমনের সময় আমি যে বাংলোতে একসময় অবস্থান করতাম তা দেখার ইচ্ছে জাগে। বিয়াল্লিশ বছর আগে আমি ঐ বাংলো প্রাঙ্গণে একটি টিউলিপ গাছ রোপন করেছিলাম। গাছটি রোপনের সময় কেন যেন আমার মনে হয়েছিল, কোন একদিন যে কোন কারণেই হোক আমি আবার কাম্পালায় ফিরে আসবো এবং সেই সময় গাছটির বেড়ে ওঠা দেখলে ভাল লাগবে। কিন্তু ততদিন ম্যাকেরে বিশ্ববিদ্যালয়টি অনেক বদলে গেছে। নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে চিনতে কষ্ট হয়েছিল। মনে হয়েছিল, অন্য সব কিছুর মতো, বিশ্ববিদ্যালয়টিও তার নিজস্বতা হারিয়ে কোলাহলতাড়িত, ধূলায়িত কাম্পালা শহরের একটা অংশ হয়ে গেছে। একটি স্থানীয় পত্রিকায় ছাপা চিঠির বরাতে যখন জানতে পারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা পাঁচিল ভেঙ্গে ফেলার পর তা আর তোলা হয়নি তখন আমার বিশ্ববিদ্যালয়টিকে চিনতে না-পারার কারণ অনুমান করতে আর কষ্ট হয়নি। পরে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রভাষক আমাকে জানান, বিশ্ববিদ্যালয়টি অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে সময় পার করলেও (ইদি আমিনের সময় ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভাইস চ্যান্সেরলকে খুন করার পাশাপাশি অনেক শিক্ষককে কারাবরণ এবং শারিরীক ভাবে নিগৃহিত হতে হয়) কিছু দলিলাদি আগের মতই আছে। সেই সব অবিকৃত দলিলাদির সূত্রে আমি আবিষ্কার করি ১৯৬৬ সালে আমি ‘কাসুভি ভিউ’ নামের ছোট্ট একটি রাস্তার ‘আশি নম্বর’ বাড়িটিতে অবস্থান করতাম।
রাস্তার নামটি আমার মাথায় একটা ঘন্টা বাজালেও বাড়ির নাম্বারটির বিষয়ে আমি নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। আমাকে সেই বাংলো প্রাঙ্গণে নিয়ে যাওয়া হলে, আমার মনে হয়েছিল, এই ক্ষয়িষ্ণু এবং জীর্ণ বাংলোতে আমি কখনই ছিলাম না। বাড়ির আঙ্গিনায় গাছ রোপনের যে স্মৃতি আমি বর্ণনা করেছিলাম সেই স্মৃতি হয়ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করেছিল। কারণ আমাকে নিয়ে যাওয়া বাংলোটির আঙ্গিনায় সদ্যই একটি গাছ কাটা হয়েছে এবং গাছের গুঁড়িটি তখনও সরিয়ে নেয়া হয়নি। আমি বা আমার দলের কারও টিউলিপ গাছের গুঁড়ি বিষয়ক কোন ধারনা না থাকায় সেই কাটা গাছের সূত্র ধরে পুরনো বাংলোটি সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। বরং আমার মনে হয়েছে, আমাকে দেখানো বর্তমান বাংলোটির অবস্থান আমার তৎকালীন বাংলোর অবস্থানের চেয়ে আলাদা। সেই বাংলো এবং তৎসংলগ্ন বাগানের সাথে অবারিত বা উন্মুক্ততার একটা অনুভূতিও আমার মধ্যে জমে আছে। কিন্তু আমাকে দেখানো বর্তমান বাড়িটি অনেক অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং অবরূদ্ধ বলে মনে হয়েছিল। তাছাড়া বাড়িটির অদূরেই ছিল আবর্জনার ঢিবি।
আমার মনে হয়েছিল, এই ক্ষয়িষ্ণু এবং জীর্ণ বাংলোতে আমি কখনই ছিলাম না। বাড়ির আঙ্গিনায় গাছ রোপনের যে স্মৃতি আমি বর্ণনা করেছিলাম সেই স্মৃতি হয়ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করেছিল। কারণ আমাকে নিয়ে যাওয়া বাংলোটির আঙ্গিনায় সদ্যই একটি গাছ কাটা হয়েছে এবং গাছের গুঁড়িটি তখনও সরিয়ে নেয়া হয়নি। আমি বা আমার দলের কারও টিউলিপ গাছের গুঁড়ি বিষয়ক কোন ধারনা না থাকায় সেই কাটা গাছের সূত্র ধরে পুরনো বাংলোটি সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। বরং আমার মনে হয়েছে, আমাকে দেখানো বর্তমান বাংলোটির অবস্থান আমার তৎকালীন বাংলোর অবস্থানের চেয়ে আলাদা
ম্যাকেরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আবর্জনা ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিশেষ সমস্যায় আছে বলে মনে হলো। ঐ আবর্জনার ঢিবি বলে দিচ্ছিলি— এখানে বর্জ্য নিয়মিত অপসারন করা হয় না। কোনরকম ভয়-ভীতি বা বাঁধা ছাড়াই ক্যাম্পাসের যত্রতত্র হাড়গিলা পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে এবং সময় সময় লম্বা ঠোঁট দিয়ে ঐ ময়লার ঢিবিতে থাকা নানারকম বর্জ্যদ্রব্য ঠোকর দিয়ে খাদ্যের সন্ধান করে যাচ্ছে। পাখিগুলোর ভাঁজ করে রাখা লম্বা ডানা, দীর্ঘ-হলুদ-পাতলা পদযুগল আর নির্ভয় উপস্থিতি এমন একটা ধারনা দেয় যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশে তাদের অবস্থানটি সর্বজনের কাছে গ্রহনযোগ্য। স্বাভাবিক অবস্থায় দেখতে আকর্ষণীয় হলেও পাখিগুলোর সেই উপস্থিতি কেবলমাত্র মেথরের সাথেই তুলনীয়। ময়লার ঢিবি থেকে দীর্ঘদিন খাবার সংগ্রহের কারণে তাদের মুখমন্ডলের স্বাভাবিক রং নষ্ট হয়ে গেছে। পাখিগুলোকে একই সাথে কুৎসিত এবং অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত বলে মনে হয়েছিল। স্বাভাবিক সৌন্দর্য্য হারিয়ে যে বিকৃতি নিয়ে তারা জীবন-যাপন করছে তাতে প্রকৃতির কোন দায় ছিল না। সবই ছিল মানুষ্যসৃষ্ট। ঐ বদলে যাওয়া পরিবেশে পাখিদের দেখে যতটা খারাপ অনুভূতি হয়েছিল তেমনি খারাপ অনুভূতি হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের দেখেও। শ্রেণীকক্ষের বাইরের মত ভেতরটাও আগের মত নেই। তাদের ক্লাসরুমগুলো ছিল ভীড়াক্রান্ত, আবাসিক ভবনের মাঝপথ দিয়ে টেনে নেয়া হয়েছিল লন্ড্রীতে ব্যবহারের জন্য পানির লাইন। ভেতরে-বাইরে কোথাও পরিস্থিতি তাদের অনুকূল ছিল না। একশ চল্লিশ বছর আগে অভিযাত্রী স্পেক যে দেশের স্যানিটেশন ব্যবস্থার প্রশংসা করেছিল সেই দেশের বর্তমান স্যানিটেশন ব্যবস্থার করুন হাল মেনে নেয়া যাচ্ছিল না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা দেখে মনে হয়েছে, সবকিছু যেন বিশ্ববিদ্যালয় এবং জ্ঞানচর্চার বিরূদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ছাত্র সংখ্যা বেড়েছে কিন্তু সেই সাথে অবকাঠামোর পরিবর্তন ঘটেনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের। ১৯৬৬ সালে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে চার হাজার ছাত্র ছিল বর্তমানে সেখানে পড়াশোনা করছে ত্রিশ হাজার। মূল সড়ক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে প্রবেশমুখে আমি এক সময় ব্যারিকেড দেখেছিলাম সেই রাস্তাটি এখন কোন শপিং মলের সামনের সদা ব্যস্ত রাস্তা বলে মনে হয়েছে। রুগ্ন কাম্পালা শহর বিস্তৃত হতে হতে ততদিনে বিশ্ববিদ্যালয়কেও গ্রাস করে নিয়েছে।
আমার কাম্পালা শহরে অবস্থানের সময়ই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের দ্বারা দুটি খুনের ঘটনা ঘটে। একটি খুনের ঘটনায় পাকিস্তানী বিক্রয়কর্মীকে গাড়ি পরীক্ষা করার কথা বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ভেতরে নিয়ে আসে ভূয়া ক্রেতারা। ক্যাম্পাসের ভেতরের পরিবেশকে তাদের কাছে এতটা সুবিধাজনক মনে হয়েছিল যে, সেখানে প্রবেশের পর চালকের গলায় ছুরি চালিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে। দ্বিতীয় ঘটনায় একজন নিরাপত্তা রক্ষী, যার দায়িত্ব ছিল নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সে খুব ভোরে বোডা-বোডা যাত্রীর মালামাল ছিনতাই করতে গিয়ে খুন হয়েছিল।
কাসুভি ভিউ নামের যে স্থানটিতে আমি থাকতাম সেখান থেকে কোন এক সময় হয়তো দূরের পাহাড়ে অবস্থিত মাতেসা-১ এর সৌধটি দেখা যেত। শহরটি বর্তমানে এত ঘনবসতিপূর্ণ হয়ে উঠেছে যে এখান থেকে তা আর দেখা সম্ভব না। এমনকি ১৯৬৬ সালেও আমি ’কাসুভি ভিউ’র বাংলোতে বসে সৌধটি দেখতে পেরেছি বলে মনে পড়ে না। সেই সময় নিজের পড়াশোনা আর স্থানীয় বিভিন্ন কার্যক্রমে সম্পৃক্ততার কারণে অনেক কিছুই আমার নজর এড়িয়ে গিয়েছিল। প্রথমবার কাম্পালা অবস্থানের সময় আমি স্যার ফ্রেডরিক মাতেসার (যিনি মাতেসা ২ নামে পরিচিত) কাছে পরিচয়পত্রের জন্য আবেদন করি, যদিও আমার পরিচয়পত্র পাবার আবেদন পাঠাতে মার্চ মাস লেগে গিয়েছিল তারপরও আমি সেই আবেদনের জবাব পেয়েছিলাম। এবং রাজনৈতিক ভাবে চরম প্রতিকূল একটা সময়ে সেই জবাব পেয়ে আমি কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলাম। কারণ ততদিনে উগান্ডার অবস্থা বেশ জটিল হয়ে উঠেছে।
নতুন প্রধানমন্ত্রী ওবেতে, জনগনকে প্রায় বিস্মিত করে তৎকালীন কাবাকা’র প্রাসাদের উদ্দেশ্যে সেনা প্রেরণ করেছে। যে কাবাকা উগান্ডার মানুষের কাছে একজন আফ্রিকান নৃপতি-ই ছিলেন না, ছিলেন জনগণের আত্মার প্রতিমূর্তি। এমন একজন মানুষের বিরূদ্ধে সেনা অভিযান পরিচালনাকে অসম্মানজনক হিসেবে মনে করা হয়েছিল। যদিও সেই রাজা পালিয়ে যেতে সক্ষম হন কিন্তু ইংল্যান্ডে অনেকটা এতিমের মত জীবন যাপন করে ১৯৬৯ সালে মাত্র পয়তাল্লিশ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তার সেই দূভার্গ্যজনক তরুণ বয়সের মৃত্যু উগান্ডার অনেক মানুষকে এখনও পীড়িত করে ( যদিও কাবাকা গোত্রের পূর্ব রাজাদের মৃত্যুও অল্প বয়সেই ঘটেছিল। যেমন কাবাকা সুন্নাহ চল্লিশ বছর বয়সে এবং মাতেসা-১ আটচল্লিশ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন)। সেই পরিস্থিতিতে উগান্ডায় আমার অবস্থান দীর্ঘ করা সম্ভব হয়নি। আমি অনেকটা তাড়াহুড়োর মধ্যে আমার প্রথম উগান্ডা ভ্রমণ শেষ করি।
তবে মনে পড়ে, ১৯৬৬ সালে উত্তর আফ্রিকা ভ্রমণের শেষ সময়ে আমি একবার মাতেসা’র সৌধ দেখতে গিয়েছিলাম।
সেই স্মৃতি অস্পষ্ট হয়ে গেলেও আমার মনে আছে, সৌধে কাবাকা বংশের দু’জন রাজা সমাহিত ছিল। সেনা উপস্থিতি এবং পর্যটকদের সৌধের ভেতরে প্রবেশে বাঁধা দেয়ার কারণে আমার সেই ভ্রমণ আনন্দদায়ক ছিল না। প্রথমবার উপস্থিতির স্মৃতি থেকে আমি বলতে পারি, কাসুভি’র সেই সৌধের ঘাসের অবকাঠামোটি ছিল গোলাকৃতির এবং আমার দেখা সবচেয়ে উঁচু মোচাকৃতির নিখুঁতভাবে ছাটা ঘাসের ছাদ দ্বারা আচ্ছাদিত। বাইরে দাঁড়িয়ে দেখা সেই সৌধটি আমাকে একটি রূপকথার আফ্রিকার অনুভূতি দিয়েছিল।
দ্বিতীয় সফরে পরিপূর্নভাবে কাসুভি’র সৌধ দেখার সুযোগ ঘটে। ইতোমধ্যে কাসুভি’র সৌধ ইউনেস্কো কর্তৃক ’ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইট’ হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। সেই পবিত্রস্থানের বাইরে ছোট একটা অফিসও স্থাপন করা হয়েছে। সৌধ দেখার জন্য আমরা একজন গাইডকে সাথে নিয়েছিলাম না-বলে একজন গাইড আমাদের তুলে নিয়েছিল বলাই উত্তম। সৌধের প্রবেশ মুখে ঘাসের তৈরি একটি প্রবেশগৃহ অবস্থিত। অন্ধকার সেই প্রবেশগৃহ দুই সারি কাঠের স্তম্ভ দিয়ে খাড়া করা। জেনে বিস্মিত হয়েছিলাম, ঐ দুই সারি কাঠের স্তম্ভ প্রবেশগৃহের স্থাপত্যেরই অংশ। প্রবেশগৃহ অতিক্রম করলে হাতের বামে নজরে পড়বে ঢাক বা ড্রাম ভর্তি কুঁড়েঘর। ঐ ড্রাম বা ঢাকগুলোকে পবিত্র হিসেবে গন্য করা হয়। প্রত্যেকটি ঢাকের একটি করে নিজস্ব শব্দ আছে এবং এক এক অনুষ্ঠানে এক একরকম ঢাক বাজানো হয়। কিন্তু আমাদের গাইড নিজেকে বাদক বংশের সন্তান হিসেবে দাবী করলেও কোন ঢাক বাজিয়ে দেখানোর আগ্রহ প্রকাশ করেনি। সে দাবী করেছিল, যেহেতু কাবাকাদের সেবা করার কাজে তার পূর্বপুরুষরা নিয়োজিত ছিল এবং কাবাকা নারীদের সংস্পর্শে তারা অবস্থান করতো সেহেতু তাদের পূর্বপুরুষদের নপুংশক করে রাখা হতো। এই সব তথ্যাদির সাথে বাস্তবতার কতটা মিল আছে তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। কারণ, আমাদের গাইড ঢাক-বাদকদের বংশধর হলেও নিজে নপুংসক ছিল না। সম্ভবত আমাদের শিহরিত করে তুলতে গাইড এধরনের গল্প জুড়ে দিচ্ছিল।
প্রবেশগৃহ অতিক্রম করার পর শুরু হয় একটি বাঁধানো রাস্তা। বাঁধানো রাস্তার চারপাশ উন্মুক্ত এবং অবারিত। তবে ছোট ছোট কিছু কুঁড়ে-ঘর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায়। পরিচারক এবং নানারকম যজ্ঞ চালানোর কাজে যারা নিয়োজিত তারা ঐ ছোট-ছোট কুঁড়ে-ঘরে বাস করে। বাঁধানো রাস্তার দুই পাশের উন্মুক্ত মাঠে কোন ঘাস ছিল না। অনাবৃত-উন্মুক্ত উঠান দেখে মনে প্রশ্ন জেগেছিল, সেখানে ঘাস থাকলে সমস্যা কি ছিল? কিন্তু গাইড জানাল, ঘাসে আবৃত থাকলে সাপেরা নজর এড়িয়ে যায়। তাই সারা উঠান অনাবৃত করে রাখা হয়েছে।
প্রবেশগৃহ থেকে বাঁধানো রাস্তা উন্মুক্ত উঠানের মধ্য দিয়ে সরাসরি সৌধে প্রবেশ করেছে। সৌধে প্রবেশ করলে আচমকা বিষন্নতা গ্রাস করে। সৌধের দুর্গের মেঝে এতটা অসমান কেন তা আপনার মনে একটা প্রশ্নের উদ্রেক করবে। সেই প্রশ্নের সমাধান বের করার আগেই চোখে ভেসে উঠবে সেই অসমান মেঝেতে বিছানো পামট্রি’র বাকল থেকে তৈরি অনেকগুলো লাল রংয়ের মাদুর। ঐ লাল রংটাই পুরো সৌধের একমাত্র রং। অনেকগুলো মাদুরের একটিতে বসে থাকা সূতির নীল কাপড়ে জড়ানো একজন বৃদ্ধা সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেই নারীর অস্থির হাত, উদভ্রান্ত এবং উদাসী চাহনী দেখে বুঝা যায় তিনি বর্তমানে এই সৌধের প্রহরী। সৌধের মধ্যকার ঐ লাল মাদুরে বসা একটা বিশেষ সম্মানের বিষয়। যা কেবলমাত্র কাবাকা রাজাদের স্ত্রীরাই ভোগ করে থাকেন। তারা বিশ্বাস করে, কাবাকা’দের আত্মা যে কোন সময় জেগে উঠতে পারে এবং জেগে ওঠা কাবাকা’দের কেউ কোন কিছু চাইতে পারেন। তাদের সেই সম্ভাব্য চাহিদা পূরণের জন্যই তাদের স্ত্রী’রা সেই সৌধের ভেতর অবস্থান করেন। এক একজন স্ত্রী একটানা এক মাস না-ঘুমিয়ে রাজার সম্ভাব্য জাগরনের অপেক্ষা করেন। এক মাস অতিক্রান্ত হলে সেই বৃদ্ধা তার মতই বিশেষ সম্মানের আসনে আসীন অন্য কোন নারীর কাছে অপেক্ষার দায়িত্বভার অর্পন করে তারপর প্রস্থান করেন।
কাবাকা’রা কখনও মরে না। তারা বনে নিখোঁজ হয়ে যায়। সেই বনটি আবার দূরে নয়। সৌধের ভেতরেই অবস্থিত। সৌধের ভেতরেই ছাদ থেকে মাটি পর্যন্ত লম্বা বাদামী রঙের বাকলের তৈরি কাপড়ের পর্দা দ্বারা সেই বন আবৃত। হঠাৎ দেখলে মনে হবে কোন মঞ্চে আগুনের পর্দা ঝোলানো হয়েছে। পৌরাণিক গল্পের সেই বনের পর্দা যেমন স্থানীয়ভাবে তৈরি তেমনি ঐ সৌধের ভেতরে আর যা কিছু আছে সবই স্থানীয়ভাবে সংগৃহিত; কোন কিছুই বাইরে থেকে সংগৃহিত হওয়া সম্ভব নয়
কাবাকা’রা কখনও মরে না। তারা বনে নিখোঁজ হয়ে যায়। সেই বনটি আবার দূরে নয়। সৌধের ভেতরেই অবস্থিত। সৌধের ভেতরেই ছাদ থেকে মাটি পর্যন্ত লম্বা বাদামী রঙের বাকলের তৈরি কাপড়ের পর্দা দ্বারা সেই বন আবৃত। হঠাৎ দেখলে মনে হবে কোন মঞ্চে আগুনের পর্দা ঝোলানো হয়েছে। পৌরাণিক গল্পের সেই বনের পর্দা যেমন স্থানীয়ভাবে তৈরি তেমনি ঐ সৌধের ভেতরে আর যা কিছু আছে সবই স্থানীয়ভাবে সংগৃহিত; কোন কিছুই বাইরে থেকে সংগৃহিত হওয়া সম্ভব নয়। গম্বুজটিকে যে কাঠের স্তম্ভ দিয়ে ধরে রাখা হয়েছে তার ডালাপালাগুলো মূল গাছে যেমন ছিল তেমন অকৃত্রিমভাবেই রেখে দেয়া হয়েছে। এমনকি গম্বুজ ধরে রাখতে যে বাইশটি কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে তা বেঁধে রাখার জন্য স্থানীয়ভাবে সংগৃহিত নলখাগড়া ব্যবহার করা হয়েছে। এই বাইশটি স্তম্ভ বুগান্ডা(উগান্ডার প্রাচীন উপজাতী যারা দীর্ঘদিন শাসকের ভূমিকায় ছিল) রাজাদের বাইশটি বংশধারার চিহ্ন হিসেবে পরিগনিত হয়।
কাবাকাদের শেষকৃত্য সহজ কোন কাজ ছিল না। শেষকৃত্যে যে সব আচার পালন করা হয় তা দূর অতীত থেকে বংশানুক্রমে চলে এসেছে। মৃত রাজার দেহ খুব হাল্কা আগুনে প্রায় তিনমাস ধরে শুকানো হয়। তারপর শরীর থেকে চোয়ালের হাড়, নাভিমূল বা নাড়ি, যৌনাঙ্গ, অন্ডকোষ পৃথক করে পশুর চামড়ায় নির্মিত একটি থলেতে নেয়া হয়। তারপর সেই বিশেষ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্বলিত থলেটি এই সৌধে সমাহিত করা হয়। শরীরের অন্যান্য অংশ যা পুরুষের জন্য অপ্রয়োজনীয় বলে ধরে নেয়া হয়— তা অন্য কোথাও সরিয়ে নেয়া হয়। আমার কাছে তাদের প্রথার এই অংশটিকে বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন বলে মনে হয়েছে। শরীরের বাকি অংশ কেন অপ্রয়োজনীয় কিংবা কোথায় সমাহিত করা হয় সে বিষয়ে প্রশ্ন করেও আমি সরাসরি কোন উত্তর পাইনি।
সৌধের ভেতরে যে বাকলের তৈরি পর্দার কথা বলেছিলাম তার পেছনে একটা ধাতু নির্মিত র্যাকে কতগুলো ভয়ংকর দর্শন বল্লম রাখা থাকে। সেই সব লোহা, পিতল কিংবা ব্রোঞ্জের তৈরি রাজকীয় বল্লমগুলোতে নিশ্চিতভাবেই হত্যা আর লুন্ঠনের গল্প জমা হয়ে আছে। হয়তো আরবরা নিতান্তই উপহার হিসেবে কিংবা হয়তো কোন কিছুর বিনিময়ে তা একদিন রাজার হাতে তুলে দিয়েছিল। পুরো সৌধে সম্ভবত এই বল্লমগুলোই একমাত্র বিদেশি জিনিস। সৌধের দেয়ালে মাতেসা’র বিস্মিত চোখের একটি প্রতিকৃতি ঝুলানো থাকে যা পুরো কাম্পালায় হরহামেশায়ই নজরে পড়ে। যদিও অভিযাত্রী স্ট্যানলি’র ‘থ্রু দ্যা ডার্ক কন্টিনেন্ট’ বইয়ের সূত্রে আরও রাজকীয় এবং কৌতুহল উদ্দীপক ছবি সংগ্রহ করা সম্ভব, তারপরও কেন যেন সর্বত্র এই ছবিটিই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সৌধে ব্যবহার করা মাতেসা’র প্রতিকৃতিতে কারও স্বাক্ষর নেই এবং জিজ্ঞেস করেও জানতে পারিনি এই প্রতিকৃতি কোন সময়ের। যদি ১৮৬১-৬২ সালের দিকে আঁকা হয়ে থাকে তবে তা অভিযাত্রী স্পেক বা গ্রান্টের আঁকা হতে পারতো কারণ তারা দু’জনেই গুণী চিত্রকর হিসেবে পরিচিত ছিলেন। হতে পারে মাতেসা এই প্রতিকৃতি (সম্ভবত ছবিটি পরে এখানে আনা হয়েছে) এবং বল্লমের মাধ্যমে স্মরণীয় হয়ে থাকতে চেয়েছিলেন।
বোগান্ডা সম্প্রদায়ের একশ বায়ান্নটি মঠের মধ্যে এই সৌধটি একটি। একটা মঠ বা মন্দির শুধু ব্যক্তিগত উপাসনার জন্য গুরুত্বপূর্ন না, এখানে মানুষ নানারকম মনোবাঞ্চনা পূরণের জন্যও সমবেত হয়। মাতেসা’র বল্লম আর ছবির সামনে তিনটি ঝুড়ি রাখা আছে। আপনি আপনার নিয়ামত লাভের উদ্দেশ্য অনুযায়ী যে কোন একটা নির্দিষ্ট ঝুড়িতে অর্থ ফেলবেন। তারপর কোন এক অদেখা দৈবজ্ঞর সাথে পরামর্শ করার সুযোগলাভ করবেন। যদিও আমি তেমন কোন দৈবজ্ঞর উপস্থিতি দেখতে পাইনি।

আমি যখন বিস্ময় নিয়ে সৌধের ভেতরে মাতেসার প্রদর্শনীয় বস্তুগুলো, ছাদের নির্মানশৈলী নিয়ে ভাবতে ভাবতে ১৮৮৪ সালে চলে যাচ্ছিলাম তখন খেয়াল করি একটি সাদা-কালো বিড়ালের বাচ্চা সেই সৌধের রক্ষক হিসেবে অবস্থান করা বৃদ্ধ নারীর সামনে এসে শুয়ে পড়েছে। আমি ভেবেছিলাম শিশু বিড়ালটি হয়তো ঐ নারীর পোষা। এই অঞ্চলে যেহেতু বিড়ালকে খারাপ-আত্ম বা মন্দ সময়ের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয় সেহেতু আমি বেশ অনন্দিত হয়েছিলাম বিড়ালটিকে ঐ বৃদ্ধার সামনে শুয়ে পড়তে দেখে। কিন্তু পরক্ষণেই একটি বালক কোথা থেকে এসে যেন বেড়ালটিকে লাথি দিয়ে সরিয়ে দিল। ফলে বিড়ালটি স্থান পরিবর্তন করে অন্য একটি স্থানে আবার শুয়ে পড়লো কিন্তু আবার সেই বালকটি তাকে উত্যক্ত করে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করলো। আমি এই আচরনের প্রতিবাদ করলে আমাদের গাইড আমাকে থামিয়ে বলেছিল, আমি ভুল বুঝছি। বেড়ালের সাথে বালকের সম্পর্কটি মূলত বন্ধুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমার কাছে তার বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি।
কিছুদিন পর আমি উগান্ডার একটি টেলিভিশন চ্যানেলে একটি বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান দেখছিলাম। সেই অনুষ্ঠানের একটা অংশ ছিল কাসুভির সৌধ বিষয়ক। অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকা খুব সহজ এবং স্বাচ্ছন্দ্যময় ভঙ্গিতে জানাচ্ছিল যে, ঐ সৌধ নির্মাণের সময় নয় জন মানুষকে উৎসর্গ করা হয়েছিল। এই তথ্যটি আমাদের গাইড আমাদের জানায়নি। তথ্যটি জানার পর আমি যা দেখে এসেছিলাম সেই মজাদার স্মৃতির উপর যেন কেউ কালি লেপ্টে দিল। আমি চিন্তাও করতে পারিনি এমন একটা আধ্যাত্মিক পরিবেশের সাথে পরিচিত হবার পর এমন একটা নির্মম উৎসর্গের গল্প শুনতে হবে। ফলে পুরণো যাদু বিশ্বাসের জগৎ আমার কাছে পুনরিজ্জীবিত হয়ে উঠলো।
পরে মাতেসা’র মুসলমান উত্তরসূরি যুবরাজ কাসিমের কাছ থেকে জানতে পারি, আদিকালে যে কোন স্থাপনার স্তম্ভ বা সৌধের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপনের সময় মানুষকে উৎসর্গ করা খুব সাধারন একটি ঘটনা। তার এই কথা শুনে আমার মনের পর্দায় ভেসে উঠেছিল, কাসুভি’র সৌধের মাদুর বিছানো বিস্ময়কর অসমান মেঝের ছবি।
[অনুবাদকের কথাঃ ভি এস নাইপলের এই পুস্তকটি কোন এক বিমানবন্দরের বুক স্টোর থেকে সংগ্রহ করা। অনেক দিন ধরে খুব ধীরে ধীরে আমি পাঠ করে যাচ্ছি। পাঠ করার সময় মনে হলো এই পাঠ-অভিজ্ঞতা শেয়ার করা মন্দ হবে না। একটা দায়িত্ববোধের মধ্যে নিজেকে আটকে রাখলে বই পড়ার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সহজ হয়। সেই ভাবনা থেকে অনুবাদ শুরু করি। এই বইয়ে রয়েছে ‘আফ্রিকান বিশ্বাস’কে কেন্দ্র করে ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন ভ্রমন-বিষয়ক প্রবন্ধ। প্রতিটি প্রবন্ধ আবার অনেকগুলো অধ্যায়ে বিভক্ত। পাঠকের এবং নিজের সুবিধার্থে লাইন বাই লাইন অনুবাদ না করে, মূল তথ্য অবিকৃত রেখে বইটির বিষয়বস্তুর একটি ভাবানুবাদের চেষ্টা করা হয়েছে। তিনশত পঁচিশ পৃষ্ঠার ‘দ্যা মাস্ক অব আফ্রিকা’র ঠিক কত পর্ব পর্যন্ত চালিয়ে যেতে পারব জানি না। মতামত জানাতে পারেন : onemasud@gmail.com]