
লেখাটা শুরু করার আগে এর শিরোনামের একটু ব্যাখ্যা দেয়া দরকার। আমি তাই দিয়ে লেখাটা শুরু করবো। আলোচনা-সমালোচনা হতে পারে লিখিত ও মৌখিক ভাষার এই দুই মাধ্যমেই। আলোচনা-সমালোচনা না লিখে শিরোনামে প্রবন্ধ শব্দটাও ব্যবহার করা যেত। কিন্তু প্রবন্ধ মূলত লিখিত আলোচনা-সমালোচনাকে প্রকাশ করে। এছাড়া আজকাল ফেসবুক ও সোশাল মিডিয়ার কারণে আমরা কিছুটা ভিন্ন ধরণের লিখিত প্রবন্ধের সাথে পরিচিত হয়েছি যাকে প্রথাগত প্রবন্ধের সাথে মিলানো যায় না। প্রবন্ধ শব্দটা আড্ডাকেও ধারণ করে না যে আড্ডার মাধ্যমে আমরা প্রতিদিন নানা ধরণের আলোচনা-সমালোচনা করে যাচ্ছি। এছাড়া আলোচনা-সমালোচনা হতে পারে অডিও-ভিডিও মাধ্যমেও, যা আমরা দেখছি প্রতিদিন। তাই আলোচনা-সমালোচনা বলতে আমি বুঝাতে চাচ্ছি আমরা মৌখিক ও লিখিত নানা মাধ্যমে যে মতামত-পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করি সেগুলোকে, প্রবন্ধ সাহিত্য যার ক্ষুদ্র একটা অংশ। এই লেখাটার প্রস্তুতির সময় আমি এরকম কিছু কিছু বিষয় নিয়ে দুই একটা ছোট লেখা দেখেছি। দুই একজনের সাথে মাঝে মাঝে কথাও হয়েছে যার সামান্য কিছুটা প্রভাব এই লেখাতে আছে।
এই প্রবন্ধের বিষয় জ্ঞান ভিত্তিক আলোচনা-সমালোচনা। জ্ঞান ভিত্তিক আলোচনাতে আছে শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, গণিত, দর্শন, সমাজ, অর্থনীতি ইত্যাদি নিয়ে আমরা যে মতামতগুলো দিয়ে থাকি সেগুলো। এই প্রবন্ধের মূল কথা হলো বাংলাদেশে জ্ঞানভিত্তিক আলোচনার দুর্দশা ও কীভাবে তা থেকে উত্তরণ ঘটানো যাবে। আমি আরো বলতে চাচ্ছি যে, বাংলা ভাষায় উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলোর চর্চা আগাচ্ছে না আলোচনা-সমালোচনার দুর্বলতার কারণে। এই দুর্বলতাকে না কাটিয়ে এগুলোর চর্চা কিছুটা অর্থহীন, মানে সময়ের অপচয়ের মতো। আমি যেহেতু অর্থনীতি ও সাহিত্য নিয়ে কাজ করছি তাই উদাহরণগুলো সেখান থেকেই দেবো।
বাংলাদেশে জ্ঞান চর্চার বড় বাধা হলো নতুন কাজের যথাযথ মর্যাদার অভাব। দেখা যায় যে নতুন ভালো কাজ যারা করেন তাদের প্রতিষ্ঠা পেতে পেতে অহেতুক সময় লেগে যায়। পঁচিশ বছর বয়সে তারা যে কাজ করেন তার জন্য প্রতিষ্ঠা পান ষাট বছর বয়সে এসে। আবার যখন তারা প্রতিষ্ঠা পেয়ে যান জীবনের এক পর্যায়ে এসে তখন তারা নতুন কি হচ্ছে না হচ্ছে তাকে গুরুত্ব দেন না। এই বিষয়টা অনেকখানি এক দুষ্ট চক্রের মতো। এর একটি কারণ মনে হয় সমকাল ও ভবিষ্যতের দিকে যথাযথ নজরের অভাব। বিশেষ করে নতুন পুরাতন সব লেখকের মধ্যে দেখা যায় বর্তমান ও ভবিষ্যৎমুখিতার পরিবর্তে আছে অতীত মুখিতা। নতুন ভালো কাজ যা হচ্ছে তা তাই উপেক্ষিত থেকে যায়। যেমন বাংলাদেশের পত্র পত্রিকাগুলো প্রতি সপ্তাহে সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশ করে। এই পত্রিকাগুলো নতুন লেখা প্রকাশ করে কিন্তু প্রবন্ধের ক্ষেত্রে দেখা যায় সেগুলোর লক্ষ্য থাকে পুরানোদের প্রতিষ্ঠিত করার বা আলোচনা করার চেষ্টা। এর বিরাট অংশ জুড়ে থাকে পুরানোদের জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী উদযাপন। জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী উদযাপনের দরকার আছে কিন্তু এটাই এখন প্রথা দাঁড়িয়েছে ব্যতিক্রম না হয়ে।
বাংলাদেশে জ্ঞান চর্চার বড় বাধা হলো নতুন কাজের যথাযথ মর্যাদার অভাব। দেখা যায় যে নতুন ভালো কাজ যারা করেন তাদের প্রতিষ্ঠা পেতে পেতে অহেতুক সময় লেগে যায়। পঁচিশ বছর বয়সে তারা যে কাজ করেন তার জন্য প্রতিষ্ঠা পান ষাট বছর বয়সে এসে। আবার যখন তারা প্রতিষ্ঠা পেয়ে যান জীবনের এক পর্যায়ে এসে তখন তারা নতুন কি হচ্ছে না হচ্ছে তাকে গুরুত্ব দেন না। এই বিষয়টা অনেকখানি এক দুষ্ট চক্রের মতো।
আরেকটি সমস্যা যা আমার নজরে এসেছে তা হল পরিচিত না হলে কেউ কারো লেখা পড়তে চায় না বা পড়ে মতামত দিতে চায় না। এ কারণেও ভালো কাজের যে গতিতে প্রচার প্রসার হওয়ার কথা তা হয় না। একটু বয়োজ্যেষ্ঠদের মধ্যে এই প্রবণতা প্রকট। আমার নিজের কাজের উদাহরণ দিচ্ছি। বিটকয়েন নিয়ে আমি একটা লেখা লিখেছিলাম যা বাংলাদেশ ২০১৭-১৮ সালের দিকে যখন বিটকয়েন, ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে অনেকেই জানতে বুঝতে চাচ্ছিলেন। সেই সময়ে প্রচুর লোক (অনুমান করি লাখ খানেক) আমার লেখাটা পড়েছেন। অনেকে জানিয়েছেন ও তাদের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তাও আছে। অথচ আমার ফেসবুকের সিনিয়র বা সমসাময়িক অর্থনীতিবিদ বন্ধুদের কাছে থেকে, কিছু ব্যতিক্রম বাদে ভালো মন্দ কোন সাড়া পাইনি। একই অবস্থা দেখেছি প্রিজনার্স ডাইলেমা নিয়ে একটা লেখাতেও। দেখা যাচ্ছে যারা শুধু মাত্র আমার চেয়ে বয়সে ছোট তারাই আমার লেখাগুলো পড়ার কথা প্রকাশ করছেন ও মতামত জানাচ্ছেন। সিনিয়র বা সমসাময়িকরা কেন জানাচ্ছেন না? সমসাময়িকদের মধ্যে কিছুটা প্রতিযোগিতা থাকে তবে ৪০-৫০ বছরে পৌঁছে গিয়ে তা সীমিত হয়ে পড়ে। একই সমস্যা কিছুটা হয়তো থাকে বয়োজ্যেষ্ঠদের মধ্যেও। কিন্তু তারা কেউই বুঝছেন না যে ৪০-৫০ বছরের পৌঁছানোর পরে জ্ঞানের জগতে কার দৌড় কতো তা নির্ধারিত হয়ে গেছে। তাদের নিজেদেরকেই বুঝে নিতে হবে যে তাদের কেউই আর অমর্ত্য সেন হতে পারবেন না এমন কি হালের অভিজিত ব্যানার্জিও। তাই জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করার পাশাপাশি তাদের নিজেদেরকে কর্মী হিসাবে মনে করা উচিত যাদের নিজের সৃষ্টিকর্ম এখন আর বেশী গুরুত্বপূর্ণ নয়। কাজ করে যাওয়াই তাদের জন্য মুখ্য এবং সেই কাজের মধ্যে আছে অন্যের কাজের পাঠ ও প্রচার-প্রসারের কাজ।
কিন্তু এই বোধটা বাংলাদেশে যারা এই ধরণের কাজ করছেন তাদের মধ্যে দেখতে পাই না। আত্মপ্রচারণায় ব্যস্ত থাকার প্রবণতা আছে অনেকেরই। মানুষের মধ্যে তা থাকবেই কিন্তু কিছুটা সময় কি আমরা বের করতে পারি না নতুন কি হচ্ছে পড়ে দেখতে ও ভালো কিছু হলে তার প্রচার করতে? এই দায়িত্ব অগ্রগণ্য ভূমিকা নিতে হবে বয়োজ্যেষ্ঠদেরকেই, কারণ তারা সমাজে নানা ভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছেন। নতুন কাজের প্রচারণাতে তারা শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারবেন।
বাংলা ভাষা অর্থনীতি-বিজ্ঞানে তেমন অগ্রসর না হলেও অনেক অগ্রসর শিল্প, সাহিত্য, কবিতাতে কিন্তু সেখানেও একই সমস্যা প্রকট। পরিচিত না হলে কেউ কারো লেখা পড়তে চান না বা পড়ে মতামত দিতে চান না। তবে এখানেও ব্যতিক্রম আছে ও কেউ কেউ নিজেদেরকে কর্মীর ভূমিকাতেও দেখেন। তবে তা ব্যতিক্রমই। কেন যে বাংলাদেশের সিনিয়র লেখকরা জুনিয়ারদের কাজ বা সমকালকে নিয়ে সময় থাকা সত্ত্বেও কিছু লেখেন না বোঝা মুশকিল? তাদের আলোচনা-সমালোচনার বিষয় এখনও রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ অথবা কালে ভাদ্রে বিশ্বসাহিত্য। পুরানো প্রতিষ্ঠিতদের নিয়ে আলোচনা নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করে না, করলেও যে পরিমাণে কম তা অনেকেই বোঝেন না। তাই সময় সাপেক্ষে সমকাল ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। পুরানো প্রতিষ্ঠিত লেখককে ভালো বলার মধ্যে আলোচকের গর্বের কিছু নেই বরং নতুনকে চিহ্নিত করাটাই কঠিন কাজ। কিছুটা উন্নাসিকতাও কাজ করে এখানে। কিন্তু আগে যা লিখেছি তা এখানেও প্রযোজ্য। তরুণরা নিজেকে জীবনানন্দ মনে করে লেখা শুরু করেন তা সত্য কিন্তু ৪০-৫০ এর মধ্যেই কার দৌড় কতটুকু তা বুঝে ফেলার কথা। তাই একটা পর্যায়ে এসে নিজের সৃষ্টিশীলতার চেয়ে কর্মীর ভূমিকাই বেশী গুরুত্বপূর্ণ। তাই যথাসম্ভব নতুন ভালো কাজের প্রচার ও প্রসারে নিয়োজিত হওয়ার চেষ্টা করা প্রয়োজন।
বাঙ্গালি মাত্রই আড্ডা প্রিয়। কিন্তু এই আড্ডাতে যা বলা হয় তাকে লিখিত রূপ দেবার চেষ্টা করা প্রয়োজন। দুঃখজনক ভাবে তা করার আগ্রহ বেশী লোকের আছে বলে মনে হয় না। যারা করছেন না তারা আড্ডার সময় শুধু আড্ডার আনন্দ পাচ্ছেন কিন্তু আলোচনাটার অপচয় হচ্ছে। তবে সমকালের অনেকেই সাহিত্য আলোচনাকে লিখিত বা স্থায়ী রূপ দেবার চেষ্টা করছেন। আমার দেখায় বেশ কয়েকজন আছেন যারা পরষ্পরের কাজ নিয়ে সোশাল মিডিয়াতে লেখালিখি করে থাকেন। এই আলোচনাগুলো তেমন বিশ্বাসযোগ্যতা পায় না গোষ্ঠীবদ্ধতার কারণে। যেমন বইমেলা উপলক্ষে বেশ কিছু বইয়ের রিভিউ দেখেছি। বাংলাদেশে এই রিভিউগুলো পরিচিত বন্ধু বান্ধবরা করে বলে কেউ তেমন গুরুত্ব দেয় না। তাই পত্র পত্রিকাতে নিরপেক্ষ রিভিউয়ের ব্যবস্থা থাকলে ভালো হবে। যারা রিভিউ বা বই আলোচনা করেন তারা লেখকের পরিচিত বা অপরিচিত হতে পারেন। কিন্তু রিভিউয়ের সময় নিরপেক্ষতা বজায় রাখা উচিত বা রিভিউ এমন ভাবে লেখা উচিত যে তা বিশ্বাসযোগ্য হয়। বিশেষ করে যারা বয়োজ্যেষ্ঠ আছেন তাদের নতুন বইয়ের রিভিউ-আলোচনা করার অভ্যাস গড়ে তোলা দরকার। এর উদাহরণে আছেন আমাদের প্রিয় রবীন্দ্র-জীবনানন্দ। তিরিশ দশকের দিকে রবীন্দ্রনাথের বয়স সত্তরের উপরে। তিনি তখন নোবেল বিজয়ী বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত সাহিত্যিকের একজন। অথচ তিনি নতুনদের লেখা পড়ে মতামত দিতেন। জীবনানন্দ দাশের কবিতা, যার বয়স তখন চল্লিশও হয়নি পড়ে চিঠিতে লিখেছিলেন ‘চিত্ররূপময়’। আরো আগে আরেকটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন ভাষা নিয়ে জীবনানন্দ দাশ জবরদস্তি করছেন। রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়ে তার গুরুত্ব বুঝতে পারুন আর নাই পারুন লিখিত মতামত প্রকাশ করেছিলেন। তুলনায় এখনকার প্রতিষ্ঠিতদের কথা ভাবুন?
মোট কথা হলো সমকাল ও ভবিষ্যতকে ধারণ করা হওয়া উচিত আলোচনা-সমালোচনার অন্যতম লক্ষ্য। অতীতকে জানার ও নতুন ভাবে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন আছে, এবং তা ঘটবেই। জানা দরকার বিশ্বে বড় বড় কি কাজ হচ্ছে তাকে। কিন্তু আপনি আমি কাজ করছি বর্তমান বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষা নিয়ে। সেখানে কি কাজ হচ্ছে তার দিকে নজর না দেয়া হল রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ব্যাপারটা ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া’র মতো।
তাই পত্রিকার রিভিউয়ের ক্ষেত্রে আমি মনে করি এই কাজটার দায়িত্ব যারা প্রতিষ্ঠিত তাদেরকেই নিতে হবে। সবাই তা সবসময় করতে পারবেন না কিন্তু সময় সাপেক্ষে বছরে একটা দুইটা রিভিউ করে দেখতে পারেন।
তবে বিভিন্ন মাধ্যমে মাঝে মাঝে যে আলোচনাগুলো দেখি তা আমাকে কিছুটা হতাশ করে। রিভিউগুলো শুধু কবি এই বলেছেন ওই বলেছেন টাইপের হয়। আলোচকের কোন নিজস্ব মতামত পর্যবেক্ষণ থাকে না। দেখা যায় যে শুধু বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়, প্রকাশ কৌশলের দক্ষতা/টেকনিক নিয়ে আলোকপাত করা হয় না। তুলনা করা হয় না পূর্ববর্তীদের কাজের সাথে। ফলে লেখাগুলোকে অসম্পূর্ণ ও অনাকর্ষনীয় লাগে। যদিও কিছু ব্যতিক্রম আছে। কয়েকদিন আগেই আমার কয়েকটি চমৎকার রিভিউ পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে।
অনুবাদ যে কোন ভাষার জন্যই জরুরী তবে তাকে ঠিক মৌলিক নতুন কাজ বলা যাবে না। জ্ঞান বিজ্ঞানের নানা শাখা সম্পর্কে যাদের ধারনা আছে তাদের অনেককেই দেখি অনুবাদ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে। অনুবাদের প্রয়োজন আছে, কিন্তু নিজেদের নতুন কাজের দিকে নজর না দেয়ার কারণে এই অনুবাদকর্মীদের কাজ আমার কাছে কিছুটা ব্যর্থ মনে হয়। অনুবাদের উদ্দেশ্য বিশ্বকে জানা ও সেই জ্ঞান ধারণ করে নতুন কাজ করা। যে ভাষায় অনুবাদ করা হচ্ছে যে ভাষায় নতুন কাজ কেমন হচ্ছে তার দিকেও নজর রাখা প্রয়োজন। এছাড়া অনুবাদ যারা করেন তাদের প্রচুর লেখা পড়ার করেই তা করতে হয়। অনুবাদ করতে পারবেন এমন লেখা-পড়া জানা লোকের সংখ্যা বেশী নেই। এই সীমিত সম্পদ কীভাবে ব্যবহার হচ্ছে তাও দেখা দরকার। যেহেতু মানুষের জীবনের সময় সীমিত, তাই অনুবাদকর্মীরা বিশ্বেকে জানতে গিয়ে নিজের আশেপাশে কি হচ্ছে না হচ্ছে তা জানার সময় কম পান। তারা অনুবাদের পাশাপাশি কিছুটা সময় নিজের ভাষায় যে নতুন কাজগুলো হচ্ছে তা পাঠ পূর্বক আলোচনা করলে নতুন কাজের প্রচার ও প্রসার গতিশীল হবে।
উপরের আলোচনাগুলোতে আমি শুধু অর্থনীতি ও সাহিত্য নিয়ে কথা বলেছি যে বিষয়ে আমার নিজের কাজের অভিজ্ঞতা আছে। অন্যান্য বিষয়গুলোর ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য অনুমান করি। বাংলা ভাষার কাজের আলোচনা-সমালোচনা ও তাকে স্বীকৃতি দেবার প্রচলন না থাকায় বাংলাতে জ্ঞান বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর চর্চাতে আগ্রহ দেখা যায় না। ইংরেজিতে লিখলে দেখা যায় অনেক বেশী পাঠক থাকে। তা নিয়ে বিশ্ব পর্যায়ে আলোচনা হয়। ভালো কাজ হলে তার স্বীকৃতি মিলে। বাংলাতে পাঠক যেমন থাকে না, তেমন শুধুমাত্র বাংলাদেশের মধ্যেও ভালো করে পড়ে আলোচনা করবে এমন লোক পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। আগের মতামত এখানেও প্রযোজ্য– তা হল এই আলোচনা-স্বীকৃতির মূল দায়িত্ব বয়োজ্যেষ্ঠ প্রতিষ্ঠিতদেরকেই নিতে হবে। তবে তা করা দরকার সব বয়সের পাঠকেরই।
বাংলাতে আলোচনার আরেকটি দুর্বলতা যথাযথ রেফারেন্স না দেয়া। লক্ষ করবেন যে আমি লেখার শুরুতেই জানিয়ে দিয়েছি যে আমি অন্য কারো কারো এরকম লেখা দেখেছি, মানে আমি জানিয়ে দিচ্ছি যে অন্যদের কাছ থেকে আমি কিছু ধারনা নিয়েছি। যেহেতু তার প্রভাব বেশী নয় তাই নাম উল্লেখ করিনি, যদিও প্রয়োজন হলে তাও করতাম। অন্যের কাজ থেকে ধার না করলে আলোচনা-সমালোচনা সম্ভব নয় কিন্তু বাংলা ভাষায় আলোচকদের কেউ তা কেন জানি স্বীকার করতে চান না। রেফারেন্স দিতে হলে তারা পুরানো প্রতিষ্ঠিতদের নাম ছাড়া কারো নাম উল্লেখ করতে চান না। অথচ চিন্তায় সবচেয়ে বেশী থাকে সমসাময়িকের প্রভাব।
মোট কথা হলো সমকাল ও ভবিষ্যতকে ধারণ করা হওয়া উচিত আলোচনা-সমালোচনার অন্যতম লক্ষ্য। অতীতকে জানার ও নতুন ভাবে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন আছে, এবং তা ঘটবেই। জানা দরকার বিশ্বে বড় বড় কি কাজ হচ্ছে তাকে। কিন্তু আপনি আমি কাজ করছি বর্তমান বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষা নিয়ে। সেখানে কি কাজ হচ্ছে তার দিকে নজর না দেয়া হল রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ব্যাপারটা ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া’র মতো। আপনি দূরে পর্বত মালা সিন্ধু দেখেছেন, কিন্তু যেখানে আপনি প্রতিদিন থাকেন, তার পাশে যে অপার সৌন্দর্য থাকে তা নজরে পড়ে না। বাংলাভাষাতে বিরাজমান এমন অন্ধত্ব দূরভীত হোক এই প্রত্যাশা নিয়ে আপাতত সমাপ্তি টানছি।
লেখকঃ যুক্তরাজ্যে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ের শিক্ষক। অর্থনীতি, গণিত, শিল্প-সাহিত্য, দর্শন বিষয়ের লেখক।