ভি এস নাইপল
১৯৩২ সালে ত্রিনিদাদে জন্ম নেয়া ভি এস নাইপল সাহিত্যে তার অবদানের জন্য নোবেল পুরষ্কার পান ২০০১ সালে। ফিকশন এবং নন-ফিকশন দুই বিষয়ে লেখকের সমান আগ্রহ। চৌদ্দাটি ফিকশনের পাশাপাশি তার নন-ফিকশন বইয়ের সংখ্যা পনেরটি। ভিএস নাইপল বিয়াল্লিশ বছরের ব্যবধানে দু’বার আফ্রিকা মহাদেশ ভ্রমণ করেন। তার দুটি ভ্রমনের মধ্যে তিনি যেমন আফ্রিকার সমাজ ব্যবস্থার তুলনা করেছের তেমনি আফ্রিকার ইতিহাস এবং এর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেছেন গভীর মনোযোগের সাথে। বাংলাদেশের ইতিহাস বা নৃবিজ্ঞান চর্চায় ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্য যতটা গুরুত্বপূর্ণস্থান দখল করে আছে আফ্রিকা ততটা স্থান করে নিতে পারেনি। আফ্রিকার সাথে আমাদের ভৌগলিক দূরত্বের চেয়ে মানসিক দূরত্বটাই যেন বেশি। ভি এস নাইপলের এই ভ্রমন অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা বইটি আফ্রিকা মহদেশের অতীত এবং বর্তমানের মধ্যে একটি সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হবে।
বই নিয়ে ভি. এস নাইপলের কথা
ভ্রমণ বিষয়ক পুস্তক রচনায় আমি একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে নিবিষ্ট থাকার চেষ্টা করি। সে কারণে ‘দ্যা মাস্ক অফ আফ্রিকা’ বইয়ে আমার বিষয় নির্ধারন করেছি ‘আফ্রিকান বিশ্বাস’। আমার এই ভ্রমণ শুরু হয়েছিল মহাদেশটির কেন্দ্রে অবস্থিত উগান্ডা থেকে পরবর্তী সময় তা ঘানা, নাইজেরিয়া, আইভরি কোস্ট, গ্যাবন হয়ে আফ্রিকা মহদেশের তলানীতে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে শেষ হয়। যেহেতু আমার বিষয়বস্তু ছিল ‘আফ্রিকান বিশ্বাস’ সেহেতু রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক জীবনে আমি প্রবেশ করতে চাইনি কিন্তু মহাদেশের শেষপ্রান্তে এসে রাজনৈতিক বাস্তবতা এতটাই গুরুত্বপুর্ণ হয়ে উঠলো যে আমি সেদিকে নজর না-দিয়ে পারিনি। আমি অনুধাবন করি, বহির্বিশ্বের প্রভাবে পুরনো আফ্রিকার বিশ্বাসগুলোর ভেঙ্গে পড়ার সম্ভাবনাটিকে যাচাই করে দেখাও আমার অনুসন্ধানের একটি নীরব অংশ ছিল। দক্ষিণে যাওয়া পর্যন্ত আমি মূল বিষয়বস্তুতে আটকে থাকলেও পরে আবিষ্কার করি সেখানে এমন এক অবস্থা বিরাজ করছে যে, দুটি ভিন্ন ধারার চিন্তা এবং বিশ্বাস দুই পক্ষকে অনেক বেশি দূরে সরিয়ে নিয়েছে। জোহান্সবার্গের অট্টালিকা আকাশ ছুঁয়েছে কিন্তু তার পৃথিবীর অংশে শান্তি নেই। যাদু বিশ্বাসের পুরাতন পৃথিবী এখানে যতটা ভঙ্গুর অনুভূত, এর চিরায়ত বৈশিষ্ট্য ততটা হারিয়ে গেছে বলে মনে হয় না। আপনার মনে হবে, কোন বিপর্যয়ের মধ্যেও তার বেঁচে থাকার একটা অন্তর্নিহিত শক্তি বিদ্যমান। আমার বিশ্বাস ছিল, আফ্রিকার বিশালত্বের কারনে তার যাদু বিশ্বাসের স্থানিক ভিন্নতা নজরে পড়বে। কিন্তু আমার ধারনার সাথে বাস্তবতা ছিল বৈপরিত্যপূর্ণ। দৈবজ্ঞরা সর্বত্র একইরকম, তারা সর্বদাই ’হাড় ছুঁড়ে’ ভবিষ্যৎ জানতে আগ্রহী এবং পশু, ক্ষেত্র বিশেষে নার-নারীর শারীরিক অঙ্গ উৎসর্গের মধ্যেই ’শক্তি’র ধারনা এখনও স্থবির এবং বন্দী হয়ে আছে। এইসব উপলব্ধি আমাকে বিশ্বাসের উৎস খুঁজতে ধাবিত করেছে। সেই উৎসানুসন্ধানই আমার এই বইয়ের উদ্দেশ্য।
প্রথম পর্ব
কাসুভি’র সৌধ
১৯৬৬ সালে আমাকে পূর্ব আফ্রিকাতে প্রায় আট-নয় মাস কাটাতে হয়েছে। এই সময়ে আমি তানজানিয়াতে অবস্থান করেছিলাম এক মাস, ছয় সপ্তাহের মত সময় পার করেছিলাম কেনিয়ার উঁচুভূমিতে আর বাকি সময় উগান্ডাতে। উগান্ডা ভ্রমনের অভিজ্ঞতা আমার মনে এতটা গেঁথে গিয়েছিল যে, কয়েক বছর পর আমার একটি উপন্যাসে আমি সেই অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করেছিলাম। প্রথম ভ্রমনের বিয়াল্লিশ বছর পর আমার আবার উগান্ডা যাবার সুযোগ ঘটে। আমি এই দ্বিতীয় ভ্রমনের সময় আফ্রিকার মানুষের বিশ্বাসের প্রকৃতি বা ধরন নিয়ে কিছু লেখার ইচ্ছা পোষণ করি। পূর্ব ভ্রমনের অভিজ্ঞতা আছে এমন একটি অঞ্চলের চেনা বা আধ-চেনা মানুষদের আমার লেখার বিষয় হিসেবে বিবেচনা করতে আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছি। কিন্তু আমি দ্বিতীয় ভ্রমনে যে আফ্রিকাকে পেলাম তাকে মনে হলো আমার কাছ থেকে পালিয়ে থাকতে চাওয়া এক জনপদ।
১৯৬৬ সালে আমার আফ্রিকা গমনের কারণ ছিল উগান্ডার রাজধানী কাম্পালাতে অবস্থিত ম্যাকারেরে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাইটার ইন রেসিডেন্স হিসেবে কাজ করার জন্য। সেই সময় আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পসের ভেতরেই একটি প্রশস্থ আঙ্গিনার ছোট্ট ধূসর বাংলোতে থাকতে দেয়া হয়েছিল। বাড়িটির সদর দরজা থেকে পীচ ঢালা রাস্তা বের হয়ে গিয়েছিল ক্যাম্পসের বাইরে। সে রাস্তার প্রবেশমুখে একজন পাহারাদার সবসময় নিয়োজিত থাকত। আমাকে আমেরিকান ফাউন্ডেশন যে পরিমান পারিতোষিক দিত তা আমার নিজের সুবিধার্থে একজন ড্রাইভার এবং বাবুর্চি নিয়োজিত করার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। আর সেই সময় আমার কোন সুনির্দিষ্ট দায়িত্বও ছিল না। ফলে আমি অনেকটা নিভৃতে অখন্ড অবসর কাটাতাম। অধিকাংশ সময় আমি সঙ্গে নিয়ে যাওয়া বই পাঠে নিমগ্ন থাকতাম। এখন মনে হয়, সেই সময় আমার হয়তো আফ্রিকা এবং ম্যাকেরেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের দিকে আরও নজর দেয়াটা যথাযথ কাজ হতো কিন্তু আমি সেই কাজটি করিনি। কখনও কখনও পড়তে পড়তে কিংবা একই ক্যাম্পসে সারাদিন অবস্থানের কারণে অবসাদগ্রস্থ হলে আমি গাড়ি চালিয়ে পনের মাইল দূরের এংটেব্বীতে চলে যেতাম। যেখানে রয়েছে বিমানবন্দর এবং আফ্রিকার সবচেয়ে বড় হ্রদ ভিক্টোরিয়ার একটি প্রান্ত এসে এংটেব্বীকে স্পর্শ করেছে। শুধু বিমানবন্দর আর হ্রদ আমাকে সেখানে টেনে নিয়ে যেত না, সেই এংটেব্বী’তে ছিল একটা উদ্ভিদ-উদ্যান। গাছা-গাছালিতে পূর্ণ সেই উদ্যানে হাঁটতে আমার ভাল লাগত। হ্রদ আর উদ্যান এতটা নিবিঢ় ছিল যে প্রায়ই সেই হ্রদের উপচে পড়া পানিতে উদ্যানের কিছু অংশ ডুবে যেত।
উগান্ডার প্রায় প্রতিটি পাহাড়ের চূড়ায় মসজিদ বা চার্চ দেখা যায়, আছে পুরোহিতদের যাজকীয় দালান। খ্রীস্টানদের প্রায় সব সম্প্রদায় সেখানে অবস্থান গ্রহন করেছে। ঘনবসতিপূর্ণ (তুলনামূলক দরিদ্র এলাকার) খ্রীষ্টানরাও কম খরচে বিভিন্ন ধর্মীয় অবকাঠামো এমন ভাবে তৈরি করেছে যে আপনার মনে হতেই পারে এগুলো নব-জন্মপ্রাপ্ত খ্রিষ্টীয় অবকাঠামো। তারা এই সব তৈরি করেই ক্ষান্ত হয় না। প্রতিটির আবার কল্পনাপ্রসূত নাম দিয়ে তাদের গায়ে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়। তাদের উৎসাহ দেখলে কে বুঝবে এখানে ধর্মের বিস্তার ঘটেছিল সর্ব শ্রেণীতে বিদ্যমান ভোক্তার পণ্য হিসেবে।
কাম্পালা থেকে এংটেব্বী যাবার রাস্তাটি ১৯৬৬ সালেও অনেক গ্রামীন আর প্রশান্তময় ছিল। এবারে এসে দেখলাম সেই অকৃত্রিমতা আর নেই। এক সময় এংটেব্বী ছিল দূরবর্তী এবং বিচ্ছিন্ন কতগুলো গ্রামের জনপদ, বর্ষায় যার আকাশ ভরা মেঘের নীচে ভেজা সবুজ মাঠ নজরে পড়ত। এখন বিমান মাটিতে নামার সময় বোঝা যায় কিভাবে ছোট উপনিবেশের ঝোঁপ-ঝাড়ের জনপদ থেকে এংটেব্বী একটা মূল্যবান কংক্রিটের ভূমিতে রূপান্তরিত হয়েছে। জ্বলজ্বল করতে থাকা ঢেউ খেলানো লোহার নতুন ছাদের বাড়িগুলো আপনাকে একটা অদ্ভুত ধারনা দিবে। আপনি আবিষ্কার করবেন, গত চল্লিশ বছর ধরে লাগাতার স্বৈরশাসন এবং তার প্রেক্ষিতে সংঘটিত ধারাবাহিক ছোট-বড় অনেকগুলো কারণে আফ্রিকা মহাদেশ যে কঠিনতম সময় কাটিয়েছে তার পরও অর্থের সমাগম থেমে থাকেনি।
রাজধানী অভিমুখী যাত্রায় এখন আর গ্রামীন পরিবেশের ছোঁয়া পাওয়া যায় না। ঔপনিবেশিক এংটেব্বী’র পুরনো প্রশাসনিক দালান ও আবাসিক এলাকা (যা কোনক্রমে এখনও বেঁচে আছে) অতিক্রম করার পর আপনি আবিষ্কার করবেন আধা-নগরায়নের একটা ভিন্নরূপ। অনেক সময় যুক্তিহীন ভাবে গড়ে ওঠা এইসব দালানকে আপনার ধ্বংসের প্রতীক্ষায় অপেক্ষারত মনে হলেও প্রায়শই আপনি এইসব দালানে থাকা দোকান, গ্যারেজ কিংবা আবাসিক ঘরগুলোর ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে মুখ বের করে রাখা মোবাইলফোনের রঙ-চঙা বিজ্ঞাপন দেখে বিস্মিতও হবেন। কাম্পালা যাবার পুরো পথটাই এমন যে ঐসব ঘিঞ্জি ঘর-বাড়ির জন্য শহর বা শহরের অদূরে বিদ্যমান সবুজ পাহাড়ের সারি, যা কাম্পলাকে সৌন্দর্য্যের জন্য এক সময় বিখ্যাত করেছিল তা খুঁজে পাবেন না। সব পাহাড়ই এখন দালানের নীচে চাপা পড়ে গেছে, এমনকি দুই পাহাড়ের মাঝের ফাঁকা জায়গা, উপত্যকা সবই পুরনো ঢেউ খেলানো লোহার আবরন কিংবা গরীব মানুষের আবাসনে পাহাড়গুলো ধরাশায়ী হয়ে পড়লেও সেখানে টাকা এবং মোটর গাড়ি আসা বন্ধ করা যায়নি। যারা অস্বচ্ছল তারা পরিবহনের জন্য ব্যবহার করেন বোডা-বোডাস, যেখানে বাইসাইকেল বা মোটর সাইকেলে চালকের পেছনে একধরনের গদি সাঁটা থাকে যাতে আরোহন করে অল্প খরচে কাম্পালার স্থবির হয়ে থাকা যান চলাচলের পথটি সহজে অতিক্রম করা যায়। এইসব রাস্তা যান চলাচলের পক্ষে যথেষ্ট সহায়ক নয়, এমনকি এই বর্ষা মৌসুমেও রাস্তাগুলো যথেষ্ট ধূলোমলিন, পীচের আবরন ছেড়ে ভেসে ওঠা উগান্ডার উর্বর মাটিতেও পা টেনে চলতে হয়। আমার পক্ষে এই নবরূপের প্রাথমিক পর্যায়ের কাম্পলাকে মেনে নেয়া কঠিন ছিল, কেবলই মনে হচ্ছিল বড় কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয় মাত্রই সমাপ্ত হয়েছে।
পরবর্তী সময় আমি জনসংখ্যা বিষয়ক কিছু তথ্য সংগ্রহ করার মধ্য দিয়ে এই করুন পরিস্থিতির পেছনের গল্পটি জানতে পারি। ১৯৬৬ সালে উগান্ডার জনসংখ্যা ছিল মাত্র পাঁচ মিলিয়ন। কিন্তু এখন জনসংখ্যা প্রায় ত্রিশ থেকে চৌত্রিশ মিলিয়ন। যদিও এই সময়ে ইদি আমিনের কুখ্যাত শাসনের কারণে ১৯৭১ থেকে ১৯৭৯ সালের মধ্যকার সময়ে প্রায় এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে বলে একটি ধারনা প্রচলিত আছে, এবং তৎপরবর্তী সময় ১৯৮১ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত উগান্ডা শাসন করেছে ইদি আমিনের মতই আরেক স্বৈরশাসক মিল্টন ওতেবো ( যিনি চুলে সিঁথি করার চেয়ে চুলকে খাড়া রাখতে পছণ্দ করতেন এবং এই চুল আঁচড়ানোর কৌশল উগান্ডায় ‘ইংলিশ স্টাইল’ নামে পরিচিত) উগান্ডা শাসন করেছে এবং উগান্ডা ধারাবাহিকভাবে অনেকগুলে ছোট যুদ্ধ চলমান থাকার পাশাপাশি (উত্তরের দেড় লক্ষ মিলিয়ন মানুষ এই সময়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছে বলে ধারনা করা হয়) এইডস রোগও মহামারি আকারে বিস্তারে লাভ করেছিল, তারপরও জনসংখ্যা ভয়ংকর ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও প্রকৃতি তার আপন নিয়মে উগান্ডার মানুষের কষ্ট লাঘবের সব চেষ্টা করে গেছে কিন্তু তাদেরকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারেনি।
উগান্ডার প্রায় প্রতিটি পাহাড়ের চূড়ায় মসজিদ বা চার্চ দেখা যায়, আছে পুরোহিতদের যাজকীয় দালান। খ্রীস্টানদের প্রায় সব সম্প্রদায় সেখানে অবস্থান গ্রহন করেছে। ঘনবসতিপূর্ণ (তুলনামূলক দরিদ্র এলাকার) খ্রীষ্টানরাও কম খরচে বিভিন্ন ধর্মীয় অবকাঠামো এমন ভাবে তৈরি করেছে যে আপনার মনে হতেই পারে এগুলো নব-জন্মপ্রাপ্ত খ্রিষ্টীয় অবকাঠামো। তারা এই সব তৈরি করেই ক্ষান্ত হয় না। প্রতিটির আবার কল্পনাপ্রসূত নাম দিয়ে তাদের গায়ে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়। তাদের উৎসাহ দেখলে কে বুঝবে এখানে ধর্মের বিস্তার ঘটেছিল সর্ব শ্রেণীতে বিদ্যমান ভোক্তার পণ্য হিসেবে। সেই সময় খ্রিষ্ট্রান সম্প্রদায়ের মত মুসলমানরাও নানা মতে বিভক্ত ছিল। শিয়া, সুন্নী, ইসমাইলি ইত্যাদি মতাদর্শে বিভক্ত হয়ে মসজিদ নির্শাণের প্রতিযোগিতায় তারা লিপ্ত ছিল। অনেকের মতে ইসমাইলি সম্প্রদায় উত্তরাধিকার সূত্রে পূর্ব আফ্রিকার সবচেয়ে শক্তিশালী সম্প্রদায়। শুধু আরব অঞ্চলের ইসলামী সম্প্রদায় নয়। উনবিংশ শতাব্দীর ভারতে জন্ম নেয়া মুসলমানরা নবীর সম্মানে সেখানে আহমেদিয়া সম্প্রদায়ের একটি মসজিদ এবং একটি বিদ্যালয়ও চালু করেছিল। যদিও সেই নবী মুসলমানদের নিকট গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি। আমার অবস্থানকালের কিছুদিনের মধ্যে উগান্ডার ভাতৃ-রাষ্ট্র লিবিয়ার নেতা গাদ্দাফির সফর করার কথা ছিল। তার সফরের উদ্দেশ্য ছিল পুরনো কাম্পালার একটি বিখ্যাত পাহাড়ের পাদদেশে একটি বড় মসজিদ উদ্বোধন। চার্চ এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মসজিদ মন্দিরের পাশাপাশি শহরের বাণিজ্যিক অংশে যেখানে ভারতীয় লোকজন ব্যবসা করে থাকে সেখানে নতুন দুটি পাথরে তৈরি মন্দিরের উপস্থিতিও নজরে পড়ে। ইদি আমিনের শাসনকালে ভারতীয়দের তাড়িয়ে দেয়ার পর আবার তাদের ফিরিয়ে আনা হয়েছিল, তবে তাদের অনিশ্চয়তার মধ্যে ফিরে আসাটা তাৎপর্যময় করে তুলতে মন্দিরের শিরে লাল পতাকা তোলা হয়েছিল, যাতে প্রমানিত হয় যে ভারতীয়রা স্বাভাবিক জীবন-যাপন করছে।
১৮৪০ সাল পর্যন্ত উগান্ডা ছিল পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন এবং নিজের মত একা এক জনপদ। প্রথম ভিনদেশি হিসেবে পূর্ব থেকে এলো আরব বণিকরা। তাদের প্রয়োজন ছিল ক্রীতদাস এবং হাতির দাঁত। বিনিময়ে তারা উগান্ডার মানুষদের হাতে তুলে দিয়েছিল সস্তা আগ্নেয়াস্ত্র এবং খেলনাসামগ্রী। সেই সময় উগান্ডার শাসক কাবাকা সুন্নাহ, যিনি তার নিষ্ঠুরতার জন্য পরিচিত ছিলেন, তিনি আরবদের স্বাগত জানান। আরব বণিকদের আনা খেলনা ছিল তার খুব পছন্দের। বিশেষত তাকে মুগ্ধ করেছিল আরব বণিকদের আনা আয়না। কারণ ঐ আয়নার সূত্রে তিনি জীবনে প্রথমবারের মত নিজের মুখ দেখতে পান এবং তার সেই আয়নার সূত্রে শুরু হওয়া আরবপ্রীতি আর শেষ হয়নি। নীল নদের উৎস খুঁজতে থাকা জন হ্যানিং স্পেকের সাথে আরবদের আগমনের বিশ বছর পরে (১৮৬১-৮১ সালের দিকে) পরিচয় ঘটে সুন্নাহর পুত্র এবং উত্তরাধিকারি মুতোসা’র। মুতোসা তখন পঁচিশ বছরের যুবক। বাবার মত নিষ্ঠুর হলেও তার ছিল বহির্মুখী দৃষ্টিভঙ্গি, প্রজ্ঞা এবং মেধা। তিনি স্পেকের কাছ থেকে পাওয়া আগ্নেয়াস্ত্র পছন্দ করেছিল, আরও পছন্দ করেছিল কম্পাস এবং স্পেকের ব্যবহার করা নানাবিধ যন্ত্র। স্পেকের মতে কয়েকশ বছরের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সেই সময়ের উগান্ডার জনগণের সামাজিক সংগঠন ছিল বেশ শক্তিশালী, তাদের ছিল সুশৃংখল সেনাবাহিনী, বিচার কাঠামো বেশ প্রথাবদ্ধ এবং বিস্তৃত আকারে সংগঠিত ছিল। স্পেকে আরও দেখেছিল তৎকালীন উগান্ডার রাস্তাগুলো ছিল রোমানদের মতই সোজা, স্যানিটেশন ব্যবস্থা ছিল উন্নত, এমনকি ভিক্টোরিয়া হ্রদে নৌ-সেনাপতিসহ তাদের যুদ্ধপোযোগী তরনী সাজানো ছিল নীল নদ ধরে বুসাগা আক্রমনের জন্য। তারা লোহার ব্যবহার জানত, তারা জানত কি করে লোহা দিয়ে বল্লম বা তলোয়ার তৈরি করা যায়, এমনকি গাছের বাকল থেকে কাপড় তৈরি এবং ঘাস দিয়ে তৈরি বাড়ির ছাদগুলো এত সূক্ষভাবে ছাটা ছিল যা কেবল লন্ডনের কোন দক্ষ কারিগরের কাজের সাথেই তুলনীয়। স্পেকের কাছ থেকে মাতোসা এই সব তুলনামূলক তথ্যাদি জানার পর এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, তার এবং স্পেকে’র মধ্যে মূল বিভাজনটি মূলত দার্শনিক এবং ধর্মীয়। মাতোসা আরবদের আগমনের বিশ বছর পর তাদের মিথ্যাবাদি বলে অভিহিত করে এবং স্পেকে’র ভিক্টোরিয়ান খ্রীষ্টান ধর্মের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। স্পেকের সংস্পর্শে আসার তের বছর পর যখন মাতোসে’র সাথে আরেক পর্যটক এইচ এম স্ট্যানলির পরিচয় ঘটে তখন তিনি উগান্ডায় খ্রিষ্টান ধর্মপ্রচারকদের নিয়ে আসার জন্য সাহায্য প্রার্থনা করেন।
একশ ত্রিশ বছর আগের সেই সিদ্ধান্তের ফলাফল আজকের কাম্পালায় প্রত্যক্ষ করা যায়। বিদেশি ধর্মগুলো সংক্রমিত করেছে উগান্ডার মানুষদের। পাহাড়ের চূড়ায় প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে জন্ম নেয়া যাজকীয় দালানগুলো সেই সংক্রমণ থেকে উগান্ডার মানুষকে মুক্তি দিতে ব্যর্থ হয়েছে, কোন কিছুরই কোন সমাধান দিতে-তো পারেনি বরং সবাইকে সন্ত্রস্ত করেছে, ভুল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে উৎসাহ যুগিয়েছে, আর মানুষকে সংকীর্ন করে তুলেছে।
একশ ত্রিশ বছর আগের সেই সিদ্ধান্তের ফলাফল আজকের কাম্পালায় প্রত্যক্ষ করা যায়। বিদেশি ধর্মগুলো সংক্রমিত করেছে উগান্ডার মানুষদের। পাহাড়ের চূড়ায় প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে জন্ম নেয়া যাজকীয় দালানগুলো সেই সংক্রমণ থেকে উগান্ডার মানুষকে মুক্তি দিতে ব্যর্থ হয়েছে, কোন কিছুরই কোন সমাধান দিতে-তো পারেনি বরং সবাইকে সন্ত্রস্ত করেছে, ভুল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে উৎসাহ যুগিয়েছে, আর মানুষকে সংকীর্ন করে তুলেছে। বিদেশী ধর্মকে আমন্ত্রণ জানানো মাতোসে যদি ফিরে আসতো তবে তিনি বর্তমান উগান্ডার অবস্থা দেখে নিজেকে দায়ী ভাবতেই পারতেন। বিদেশি ধর্মগুলো আফ্রিকার মানুষের প্রচলিত বিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত করে কিভাবে তা ধ্বংস করে দিতে সমর্থ্য হলো?
এই বিদেশী ধর্মগুলোর একটি জটিল তত্ত্ব বিদ্যমান ছিল বলে আমি মনে করেছিলাম। সুতরাং আমি খুব সহজে এইসব ধর্মের প্রভাব এবং বিস্তারের কারণ উদঘাটন করার আশা করিনি। আমি মাতোসা’র সরাসরি বংশধর প্রিন্স কাসিম (যিনি ইসলামিক অংশের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং একজন বংশধরে ইসলাম ধর্মে অবস্থান প্রমান করে মাতেসা’র উত্তরাধিকারীরাও ধর্মীয় ভাবে বিভক্ত ছিল) এর কাছে জানতে চেয়েছিলাম। তার মতে, আফ্রিকা মহাদেশে ইসলাম এবং খ্রিষ্টান ধর্ম জনপ্রিয়তা পেয়েছিল খুব সহজ কারণে। উভয় ধর্মই আফ্রিকার মানুষদের মৃত্যু পরবর্তী জীবনের সন্ধান দিয়েছিল। বিদেশি ধর্মগুলো আসার পূর্বে আফ্রিকায় প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসগুলো ছিল অনেক ধোঁয়াশাপূর্ণ, আত্মানির্ভর এবং পূর্বপুরুষের সাথে মিলনের সম্ভাবনাপূর্ণতাতে সীমাবদ্ধ। কিন্তু ইসলাম এবং খ্রিষ্টান ধর্ম তাদের সামনে প্রথমবারের মত মৃত্যু পরবর্তী অন্য আরেকটি জীবনের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়।
[ অনুবাদকের কথাঃ ভি এস নাইপলের এই পুস্তকটি কোন এক বিমানবন্দরের বুক স্টোর থেকে সংগ্রহ করা। অনেক দিন ধরে খুব ধীরে ধীরে আমি পাঠ করে যাচ্ছি। পাঠ করার সময় মনে হলো এই পাঠ-অভিজ্ঞতা শেয়ার করা মন্দ হবে না। একটা দায়িত্ববোধের মধ্যে নিজেকে আটকে রাখলে বই পড়ার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সহজ হয়। সেই ভাবনা থেকে ভাবানুবাদ শুরু করি। এই বইয়ে রয়েছে ‘আফ্রিকান বিশ্বাস’কে কেন্দ্র করে ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন ভ্রমন-বিষয়ক প্রবন্ধ। প্রতিটি প্রবন্ধ আবার অনেকগুলো অধ্যায়ে বিভক্ত। পাঠকের এবং নিজের সুবিধার্থে লাইন বাই লাইন অনুবাদ না করে, মূল তথ্য অবিকৃত রেখে বইটির বিষয়বস্তুর একটি ভাবানুবাদের চেষ্টা করা হয়েছে। তিনশত পঁচিশ পৃষ্ঠার ‘দ্যা মাস্ক অব আফ্রিকা’র ঠিক কত পর্ব পর্যন্ত ভাবানুবাদ চালিয়ে যেতে পারব জানি না। তবে করোনা’র ছুটির এই সময়টাকে নিজের এবং পাঠকদের নিকট তাৎপর্যময় করে তোলাই এই লেখার মূল উদ্দেশ্য। মতামত জানাতে পারেন : onemasud@gmail.com ]