জালপরা বাসন্তী—এটি সম্ভবত বাংলাদেশের আলোকচিত্রকলার ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত ছবি। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময়ে কুড়িগ্রাম থেকে ছবিটি তুলেছিলেন সেসময়ের দৈনিক ইত্তেফাকের ফটোসাংবাদিক আফতাব আহমেদ। তবে ছবিটি ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় ছাপা হওয়ার পরপরই এর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সবখানে শুরু হয় ছবিটির পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্কের ঝড়।
আফতাব আহমেদের জন্ম ১৯৩৫ সালে, রংপুরের গঙ্গাচড়ায়। ১৯৬২ সালে ফটোসাংবাদিক হিসেবে ইত্তেফাকে যোগ দেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বহু দুর্লভ ছবি তিনি ধারণ করেছেন। এসব ছবির জন্য তিনি যেমন নন্দিত—তেমনিভাবে দুর্ভিক্ষের সেই ছবিটির জন্য অনেকের কাছেই তিনি নিন্দিত।
’৭৪ সনের দুর্ভিক্ষ কভার করতে কুড়িগ্রামের চিলমারিতে যান ইত্তেফাকের প্রতিবেদক শফিকুল কবির ও ফটোসাংবাদিক আফতাব আহমেদ। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, সেখানকার এক জেলেপাড়াতেই তাদের সঙ্গে দেখা হয় দুর্ভিক্ষ পীড়িত প্রতিবন্ধী বাসন্তীর সঙ্গে। বাসন্তীর গায়ে পোশাকের বদলে জড়ানো ছিল একটি মাছধরার জাল। কাপড়ের অভাবে বাসন্তী নিজের শরীর ওই জাল দিয়েই নাকি ঢেকে রাখতেন। তরুণীর সঙ্গে ছিল দুর্গতি নামের আরেক তরুণী। তাদের ছবিই তোলেন আফতাব আহমেদ। ছবিতে দেখা যায়, তারা কলাগাছের ভেলায় দাঁড়িয়ে কলার থোড় সংগ্রহ করছেন। ছবিটি প্রকাশিত হওয়ার পর দেশে–বিদেশে আলোড়ন তোলে। ইত্তেফাকের পর ছবিটি অন্যান্য পত্রিকায়ও ছাপা হয়। এই ছবির সূত্র ধরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা শুরু হয়।
ছবিটির সত্যতা যাচাই করতে পরবর্তিতে বহু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন হয়েছে। অনেকে মনে করেন, এই ছবিটি ছিল বানানো এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। অভিযোগ ওঠে, ঘটনাটি ছিল পূর্ব-পরিকল্পিত। বাসন্তীকে টাকার লোভ দেখিয়ে কিছু সময়ের জন্য পোশাক খুলে গায়ে জাল জড়িয়ে নিতে বলা হয়েছিল। অনেকে এও মনে করেন যে, এই ছবিটিও বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রেক্ষাপট নির্মাণ করতে সহযোগিতা করেছিল। ঘটনার এক বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। আবার নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের পরপর ৩২ নম্বরের বাড়ির ভেতরে ছবি তোলার অনুমতি পান আফতাব আহমেদই।
আফতাব আহমেদ ২০০৬ সালে বিএনপি–জামায়াত জোট সরকারের আমলে একুশে পদক পান। একই বছর তিনি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ছাত্র শিবির আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে জামায়াতের তৎকালীন আমির এবং একাত্তরের আলবদর বাহিনীর নেতা মতিউর রহমান নিজামীর কাছ থেকে পদক গ্রহণ করেন। সেই ছবি বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়েছে।
২০১৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর আফতাব আহমেদ তার রামপুরার বাসায় খুন হন। তার হাত–পা বেঁধে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। তার বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। পরদিন আফতাবের ছেলে মনোয়ার আহমেদ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে গাড়ি চালক মো. হুমায়ুন কবীর মোল্লাসহ অজ্ঞাত কয়েক জনের বিরুদ্ধে রামপুরা থানায় মামলা করেন। পরে কবীরসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। ২০১৭ সালে তাদের ফাঁসির রায় দেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল।