Author Picture

একজন বিধবার স্মৃতিকথা

মোহম্মাদ জামিল আক্তার

উর্দু থেকে ভাষান্তর– হাইকেল হাশমী

এটা জুলেখার গল্প, যার বয়স প্রায় ৩৫ বছর। সে একজন বিধবা। প্রায় এক বছর আগে তার স্বামী যে একজন মোটর মেকানিক ছিল, শহর থেকে কিছু সামগ্রী আনতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা গেল।
জুলেখা ম্যাট্রিক পর্যন্ত লেখা-পড়া করেছে কিন্তু এই যুগে ম্যাট্রিক পাস করে কোন চাকুরী পাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। তার ভাগ্য ভাল যে তার মা তাকে সেলাই আর বুননের কাজ শিখিয়েছিল তার জন্য সে আজ তার ৮ বছরের ছেলে রুস্তমকে নিয়ে কোন রকম দিন যাপন করতে পারছে।
এই দুনিয়াতে তার আপন বলে কেউ ছিল না যার সাথে সে তার দুঃখ আর অভাবের কথা ভাগ করতে পারতো, তাই সে বাজার থেকে একটি ডাইরি কিনে নিয়ে এসেছে আর যখন রুস্তম রাত্রে ঘুমিয়ে পড়ে তখন সে তার ডাইরি লেখে, তাতে তার মন হালকা হয়ে যায়।

জুলেখার ডাইরি
আমি জানি না কি ভাবে ডাইরি লিখতে হয়। যখন রশীদ ছিল তখন তো ডাইরি লেখার কোন প্রয়োজনই ছিল না। আহ, আমার প্রিয় রশীদ, তুমি তো সারা জীবন আমার সাথে থাকার প্রতিজ্ঞা করেছিলে। আজ দেখো আমি আর তোমার কলিজার টুকরা রুস্তম এই দুনিয়াতে একলা রয়ে গেছি।
একজন পুরুষ ছাড়া একজন মেয়ে কতো একলা হয়ে যায় আমি এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। মকবুল দোকানদার, আমাকে কেমন খারাপ দৃষ্টিতে দেখে, যদিও ওই বুড়ার নিজের নাতি-নাত্নি আছে। আমি বুঝি না কিছু কিছু পুরুষের লালসা কেন কোন দিন শেষ হয় না। আমার ইচ্ছে হয় ওর দোকান থেকে কিছুই কিনবো না। কিন্তু কি করবো ও ছাড়া বাকিতে আমাকে কে জিনিষ দেবে?

অনেক সময় সপ্তাহে ৩-৪ জোড়া কাপড় সেলাই’এর জন্য পেয়ে যাই কিন্ত কোন কোন সপ্তাহে একদম আসেই না। বিয়ে-শাদির মরশুম আসছে, আশা করি বেশি কাপড় পেয়ে যাবো। তাতে বেশী আয়ও হবে। বাড়িওয়ালার তিন মাসের ভাড়া বাকি আছে, ওই টাকা দিয়ে তার ভাড়া শোধ করে দেবো। শুধু দোয়া করি বিয়ের মরশুমের আগে বৃষ্টি যেন শুরু না হয়ে যায় তা হলে বাসার ছাদ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করবে এবং সব টাকা ছাদের মেরামতে শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু বৃষ্টিও কতো দিন থেমে থাকবে? বাড়ির মালিক এইসব কাজ নিজে তো করে দেবে না আর এটা আমার জন্য অতিরিক্ত বোঝা।

আর কি লিখব? রুস্তম ঘুমাচ্ছে। আমার ইচ্ছে করে তাড়াতাড়ি বড় হয়ে একটি বিরাট অফিসার হয়ে যাক। রশীদ তুমি যখন ছিলে তখন আমার মনে হতো সময় অতিদ্রুত কেটে যাচ্ছে কিন্তু এখন তুমি যাওয়ার মাত্র একবছরই হয়েছে কিন্তু আমার মনে হচ্ছে একটি শতাব্দী কেটে গেছে। রুস্তম যে খুব দ্রুত বড় হচ্ছিল মনে হচ্ছে তার বৃদ্ধিও থেমে গেছে। আমার মনে হচ্ছে সে এক ইঞ্চিও বাড়ে নাই। তার স্কুলের ড্রেস আর জুতা পুরান হয়ে গেছে। আমি প্রত্যেক সেলাইয়ের কাজ থেকে ওসবের জন্য কিছু কিছু করে টাকা জমাচ্ছি। আমি শুধু চাই যে সে রোজ সকালে আমাকে যেন প্রশ্ন না করে যে আজ অনেক বেশি কাপড় সেলাইর জন্য আসবে তো? এই প্রশ্নে আমি তাকে কি উত্তর দিবো!

ডাইরি যদি লিখতে থাকি তা হলে সকাল হয়ে যাবে, ঘুম এখন আমার চোখ থেকে অভিমান করেছে। ঘুম যদি আসেও, প্রত্যেকটি শব্দে উঠে বসে থাকি। একটি নারীর দুঃখ কে বুঝবে যাকে রাত দিন একটি ভয় আঁকড়ে রাখে। এই দুঃখের তো কোন শেষ নেই কতই বা ডাইরিতে লেখা যায়?

বিধবার ছেলে
রুস্তম রোজ স্কুলে যায় কিন্তু জুতা আর স্কুলড্রেস পুরান হয়ে গেছে। তার মা তাকে বলেছে যখন অনেকগুলো কাপড় সেলাইর জন্য আসবে তখন তাকে নতুন জুতা আর ইউনিফর্ম অবশ্যই কিনে দেবে। সে রোজ সকালে স্কুল যাবার আগে তার মাকে জিজ্ঞাসা করে, “মা, আজ অনেক কাপড় সেলাইর জন্য আসবে?”
“হ্যাঁ আমার সোনা আজ অনেক কাপড় সেলাইর জন্য আসবে”, তার মা তাকে উত্তরে বলে।
ফিরে এসে সে জিজ্ঞাসা করে, “মা আজ কতো কাপড় সেলাইর জন্য এসেছে”।
“অনেকগুলো এসেছিল কিন্তু ওগুলোর রঙ মোটেও ভাল ছিল না তাই আমি সব ফিরিয়ে দেয়েছি আর বলেছি ভাল ভাল রঙের কাপড় আনো তা হলে সেলাই করবো। খারাপ রঙের কাপড় তো আর সেলাই করে দেয়া যায় না?”
সে চিন্তা করতো জানি না কবে যে ভাল ভাল রঙের কাপড় সেলাইর জন্য আসবে?
তার বাসার গলির মাথায় যে মকবুল চাচা আছেন তিনি অনেক ভাল লোক, তাকে বিনা পয়সায় চকলেট দেয়। সে ভাবে যে এমন ভাল লোক খুব কমই হয়।

মকবুল দোকানদার
মকবুল মুদিদোকানের মালিক। তার তিনটি ছেলে বিয়ে করে অন্য শহরে চলে গেছে। তাকে সারাক্ষণ একটি কথা ভাবিয়ে তোলে, সে কি এই দিন দেখার জন্য তার ছেলেদের পড়া-লেখা শিখিয়েছিল যেন তারা বিয়ের পর তাকে ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যাবে?
গতকাল তার বড় ছেলে সাজ্জাদে ফোন করেছিল, “আব্বা আপনাকে অনেক অনেক অভিনন্দন আপনি দাদা হয়ে গেছেন। নাতিকে দেখতে কবে আসবেন?”
“অনেক শীঘ্রই আসবো”, সে খুব রুক্ষ ভাবে বলেছিল।

কিন্তু সত্যি কথা সে সাজ্জাদকে বলতে চেয়ে ছিল, আমি কেন আসবো? নিজে তুমি তো এক বছর পরে আসো আর আমাকে ডাকতে থাকো। কেউ বলে আমার শহরে কবে আসবে, একজন বলে আমার এখানে কবে আসবে, আর একজন বলে আমার এখানে কবে চক্কর লাগিয়ে যাবে। এই বছর আমি কোথাও যাচ্ছি না। আমার কিসের কমতি? আমার কাছে অনেক টাকা পয়সা আছে, আমি আবার আমার ঘর সংসার করবো। কিন্তু সে এমন কোন কথাই বলেনি, আর ফোন কেটে দিয়ে জুলেখার ভাবনায় ডুবে গেল। তার প্রচণ্ড ইচ্ছা যেন জুলেখা তার সাথে বিয়ে করার জন্য রাজী হয়ে যায়।

বিধবার ডাইরি
আজ তো মকবুল দোকানদার সব সীমা পার করে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো যে আমার ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে কি পরিকল্পনা?
বুড়া ব্যাটা তোর কি? আমার কি পরিকল্পনা তোকে বলতে যাবো কেন? আমি যদি তার থেকে দশ হাজার টাকার জিনিসপত্র বাকিতে না কিনতাম তবে তার মুখ ভেঙ্গে দিতাম। কিন্তু কি করা এই সপ্তাহে মাত্র দুটি কাপড় এসেছে সেলাইর জন্য। বিয়ের “সিজেন” আসছে, টাকা জমা হলেই সব চেয়ে আগে এই মকবুলের ধার শোধ করবো।

বিধবার ছেলে
রুস্তমের মা তৃতীয়বার তার জুতা মেরামত করিয়েছে। এবার মুচি জুতার তলা বদলিয়ে দিয়েছে। একটি জুতার তলায় মোটা চামড়া লাগিয়েছে আর একটাতে পাতলা চামড়া, এই কারণে তার মনে হচ্ছে যেন তার একটা পা লম্বা আর একটা খাট।
জানি না কবে যে ভাল রঙের কাপড় সেলাইর জন্য আসবে?

মকবুল দোকানদার
সে একদিন এক মহিলা ঘটকের সাথে কথা বলল। তাকে বলল যেন তার বিয়ের প্রস্তাব জুলাখার কাছে নিয়ে যায়। সে রাজী হলে তার সব ধার-দেনা মাফ করে দেবে আর তার থেকে বাড়ীর মালিক যা ভাড়া পায় ওটাও শোধ করে দেবে। সে আশা করছে যে জুলেখার মনটা গলে যাবে। সে তো তারে যে ভাবে দেখে যেন মনে হয় এখনই একটি পাথর তুলে তার মাথা ফাটিয়ে দেবে।

বিধবার ডাইরি
ওটাই হলো যা ভয় পাচ্ছিলাম। মকবুল দোকানদার তার আসল চেহারা দেখিয়ে দিল। আজ ঘটক খালা এসেছিল মকবুলের সম্পর্ক নিয়ে। আমার ইচ্ছে হলো তার মুখটা ভেঙ্গে দিই। তার কি একটুও লজ্জা নেই যে একটি বুড়া লোকের জন্য সম্পর্কের কথা বলতে এসেছে। কিন্তু পরে চিন্তা করলাম যতক্ষণ বিয়ের “সিজেন” আসছে না, বেশী কাপড় সেলাইর জন্য আসবে না, কাজ না করলে খাবো কি। আমি না হয় কিছু না খেয়ে ঘুমিয়ে যাবো কিন্তু বেচারা রুস্তমের কি দোষ। এইসব চিন্তা করে তাকে বলে দিয়েছি একটু চিন্তা করার জন্য সময় লাগবে।

বিধবার ছেলে
রুস্তম অনেক খুশী, তার ভাল মকবুল চাচা তার পুরান জুতা আর ইউনিফর্ম দেখে তাকে বাজারে নিয়ে গিয়ে নতুন জুতা আর ইউনিফর্ম কিনে দিয়েছে। এখন সে অপেক্ষায় আছে কখন যে সকাল হবে আর সে এই নতুন ড্রেস আর জুতা পরে স্কুলে যাবে।

মকবুল দোকানদার
জুলেখা চিন্তা করার জন্য কিছু দিন সময় চেয়ে নিয়েছে আর এদিকে মকবুলের একটা মুহূর্তও কাটানো দুষ্কর। সে জুলেখার ছেলেকে নতুন জুতা আর ইউনিফর্ম কিনে দিয়েছে, উদ্দেশ্য একটাই এটা দিয়ে যদি জুলেখার মনে একটু স্থান পাওয়া যায়। তার চিন্তা জুলেখার সাথে বিয়ের পর সে এই ছেলেকে বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দিবে।

বিধবার ডাইরি
আজ যখন রুস্তম বাসায় ফিরল তখন তার হাতে ইউনিফর্ম আর জুতার প্যাকেট ছিল। সব তাকে মকবুল দোকানদার কিনে দিয়েছে। আমার ইচ্ছে করলো আমি এই সব জিনিস নিয়ে মকবুলের মুখে ফেলে দিয়ে আসি, সে আমাকে কি মনে করছে, ভিক্ষুক? এখনও আমার দুটি হাত রয়েছে, আমি সেলাই, বুনন করে খেতে পারি। কিন্তু পর মুহূর্তেই রুস্তমের হাসি মাখা মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠলো। সে এই জিনিসগুলো পেয়ে অনেক খুশি। অনেক দিন পর আমি তাকে এতো খুশি দেখলাম। আমি রোজ ওর সাথে মিথ্যা কথা বলে বলে ক্লান্ত হয়ে গেছি।
জানি না কখন যে বিয়ের মরশুম আসবে?

মকবুল দোকানদার
আজ জুলেখার বাড়ির মালিক তার বাসা খালি করাতে এসেছিল। ভাগ্যিস তখন মকবুল উপস্থিত ছিল। সে সঙ্গে সঙ্গে বাড়িওয়ালাকে তিন মাসের বকেয়া ভাড়া শোধ করে দিল আর ব্যপারটা মিটমাট হয়ে গেল। বোধ হয় এইটাই কারণ ছিল যে সন্ধ্যার সময় ঘটক মহিলা এসে বলল, মুখ মিষ্টি করাও, জুলেখা হ্যাঁ করে দিয়েছে।

বিধবার ডাইরি 
আমি কি করতাম?
বাড়ির মালিক বাসার সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছিল। আমি রুস্তমকে নিয়ে কোথায় যেতাম? একটি একা মেয়েলোকের সারা দুনিয়া শত্রু হয়ে যায়। আমি মকবুলকে একদমই পছন্দ করি না কিন্তু সে যদি আজ বাড়ি ভাড়ার টাকা না দিতো তা হলে আমাদের এই বাসাটা ছেড়ে দিতে হতো। তার উপর সে কয়েক মাস ধরে আমাকে বাকিতে খাওয়াদাওয়ার সামগ্রী দিচ্ছিল।

আমার প্রিয় রশীদ, আমার করার কিছুই ছিল না। বিয়ের মরশুম আসতে এখনও কয়েক মাস রয়েছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে একটি কাপড়ও সেলাইর জন্য আসে নাই। বর্ষা চলে এসেছে, কাল রাতে এতো বৃষ্টি হলো যে ছাদের তিন কোণা থেকে পানি পড়তে শুরু করলো। আমি আর রুস্তম চতুর্থ কোণায় বসে সারা রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলাম। মকবুল দোকানদার যদি না থাকতো তা হলে গত রাতে আমাদের এই চতুর্থ কোণাও থাকতো না। আজ সন্ধ্যা সময় যখন ঘটক মহিলা এলো তখন আমি বিয়েতে হ্যাঁ বলে দিয়েছি। রুস্তমকেও অনেক বুঝিয়েছি এবং তাকে বলেছি আমি তার মকবুল চাচার সাথে বিয়ে করতে যাচ্ছি।
আহ, জীবন যে কেমন কেমন সময় দেখায়, মানুষকে কি কি করতে হয়, যদিও মকবুল দোকানদারকে এখনও আমার কাছে ভাল লাগে না কিন্তু এই পেটের আগুন…।

আরো পড়তে পারেন

শেষ বিকেলের অতিথি

আজ চন্দ্রার কথা মনে পড়তেই ছল ছল চোখে অশ্রুবিন্দু ঝড়ছে। তার অভিমানের শেষ আকুতি মনের মধ্যে বারবার ধাক্কা দেয়। তার প্রস্থান শেষ পর্যন্ত এতো কঠিন হবে বুঝতে পারিনি। আগেও চন্দ্রার সাথে হয়েছে অভিমানের খুনসুটি। নিজেকে মেঘের আড়ালে ঢাকতে চেয়েছে, কিন্তু সে মানাভিমান ক্ষণিকেই ইতি ঘটে গেছে। জোছনা হয়ে সে ধরা দিয়েছে। খুব ছোট্ট বিষয় নিয়ে….

স্মৃতি এখন কী করবে

জেলখানা থেকে বেরিয়ে স্মৃতি বাসে চড়ে বসে। সঙ্গে ওর মেয়ে ফাতেমা। বেশিক্ষণ কথা বলতে পারেনি হায়দারের সঙ্গে। শুধুই চোখ বেয়ে পানি পড়েছে। ফাতেমাও ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে। আর হয়তো দেখা হবে না বাবার সঙ্গে। হায়দারের চোখও ভেজা ছিল। আজই হয়তো ওদের শেষ দেখা। হায়দার বারবার স্মৃতির হাত ধরে অনুরোধ করেছে ওকে ক্ষমা করে দিতে।….

ইন্টারভিউ

কত দিন পর দেখা হলো রূপার সঙ্গে। তা মনে করতে পারছি না। চোখে চোখ পড়তেই কিছুটা থমকে গেলাম। চিন চিন করে উঠল বুকের ভেতর। ভেতর-বাইর শুরু হলো জ্বলন-পোড়ন। কথা বলব কি-না তা বুঝে ওঠার আগেই সে এলো এগিয়ে। আমাকে বলল, সায়েম তুমি এখানে? আমার ইন্টারভিউ আজ। তোমারও কি তাই? হ্যাঁ। আমারও তাই। কেমন আছ তুমি?….

error: Content is protected !!